#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩২)
রাত নয়টা। ভ্রমর চেয়ার টেনে বসে এক পলক বাবার দিকে তাকাল৷ মুহূর্তেই পরিতৃপ্তে ভরে উঠল মন,প্রাণ। এক অদ্ভুত প্রশান্তিময় হাওয়া ছুটে চলল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সে বাবার পাশে বসে আছে,বাবার সাথে খাচ্ছে এই ব্যাপারগুলো যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখ দুটোর বিস্ময় এক মুহূর্তের জন্যও সরছে না। যত বার বাবার দিকে তাকাচ্ছে ততবার বিস্ময়ে ডুবে যাচ্ছে। সে বিস্ময় ভর্তি চোখ দুটো মায়ের দিকে ঘুরাল। আঁচল খামচে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আম্মু,আমি কি সত্যি বাজানের পাশে বসে খাচ্ছি?”
মেয়ের এমন প্রশ্নে মৃদু হাসলেন শরীফা খন্দকার। সহাস্যে তাকালেন স্বামীর দিকে। সেদিন বাবা-মেয়ের মিলন পর্বের পর বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি মীর খন্দকার। ফিরে যাওয়ার সময় মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন শীঘ্রই আসবেন। কথা রেখেছেন। সপ্তম দিনের সন্ধেবেলা হঠাৎ হাজির হয়েছেন। তিনজন একসাথে এই প্রথম খেতে বসেছে। শরীফা খন্দকার মৃদু মাথা নেড়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
“হ্যাঁ।”
ভ্রমরের বিস্ময় এবার দ্বিগুনে পৌঁছুল। ঘন কালো মনিদুটো আরও চকচকে। চাপা উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। এত খুশি! এত আনন্দ! সয়তে পারবে তো ভ্রমর? তার মনে হলো খুশিতে সে মরেই যাবে। ঠোঁটে লেগে থাকবে এক মধুর হৃদ্য পুষ্ট তৃপ্ত হাসি।
“মা-মেয়ের মধ্যে কী নিয়ে ফিসফিস চলছে?”
ভ্রমর চমকাল। সামান্য ভয় পেল। কিছু বলার জন্য ঠোঁটদুটো কেঁপে থমকে গেল আড়ষ্টতায়। মীর খন্দকার বুঝি মেয়ের মনের অবস্থা বুঝলেন। ভ্রমরের দিকে ঝুকে এসে কোমল স্বরে সুধালেন,
“বাবা কি তোমাকে খায়িয়ে দিবে?”
ভ্রমরের ভয় কেটে গেল। চোখের তারায় ভর করল প্রবল মুগ্ধতা। আনন্দের জোয়ার শুরু হয় অন্তরে। যে আবদারটা ভাবতেও তার ভয় হচ্ছিল তা এত সহজে পূরণ হয়ে যাবে এ যে ভ্রমরের ভাবনাতীত!
মেয়ের দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা করলেন না মীর খন্দকার। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে ভাত মাখতে শুরু করলেন। আঙুলের ডগায় এক দলা ভাত মেপে মেয়ের মুখে ধরলেন। ভ্রমর খেল। তৃপ্তি ভরে সময় নিয়ে দাঁতের ফাঁকে ভাত পিষল যতনে। ভাতের দানা গলায় পড়তে স্বর্গীয় স্বাদ অনুভব হলো। ভাত বুঝি এত ভালো খেতে হয়?
এক,দুই,তিন শেষ করে চার নাম্বার লোকমা মুখে তুলতে হঠাৎ খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মনোযোগ চলে গেল অন্য কোথাও। একটা মিহি সুর কর্ণগহ্বর দিয়ে ঢুকে হৃদয়ে বাড়ি মারছে। ভ্রমরের টনক নড়ে। আপন মনে প্রশ্ন রাখে,’হৃদ্য ভাইয়া কি আমাকে ডাকছে?’ মনের ঝুড়িতে প্রশ্ন পড়তে তার খেয়াল হয় কয়েক দিন হৃদ্যের সাথে দেখা হলেও ঠিকঠাক মতো কথা হচ্ছে না। মানুষটার চেহারার সেই প্রাণবন্ত ভাবটা নেই। কেমন যেন দিশাহারা ভাব। চিন্তায় ডুবে থাকে সারাক্ষণ।
ভ্রমর চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলে মীর খন্দকার বাধা দিলেন,
“খাবার ছেড়ে কোথায় যাচ্ছো?”
হৃদ্যের নামটা ঠোঁটে এসে আটকে গেল। চোখ নামিয়ে মাথা ঝুকিয়ে বলল,
“রুমে।”
“কেন?”
ভ্রমর উত্তর দিতে পারল না। মিথ্যে অযুহাত বানানোর সাহসও পেল না। মীর খন্দকারের ঠোঁটে আগের হাসিটা নেই। মুখজুড়ে কেমন এক কাঠিন্যতার ছাপ। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আগে খাওয়া শেষ করো। খাবার রেখে উঠতে হয় না।”
ভয়ঙ্কর রকম অস্থিরতা নিয়ে খাবার শেষ করল ভ্রমর। কিন্তু সাথে সাথে উঠার সাহস পেল না। কিছুক্ষণ বসে থাকল মা-বাবার মধ্যিখানে।
_________________
বারান্দায় দৌড়ে এসে হতাশ হলো ভ্রমর। হৃদ্য নেই। সে কিছুক্ষণ চাপা স্বরে ডাকল। কাজ হলো না। শেষে বাধ্য হয়ে একটা পাথর নিক্ষেপ করল হৃদ্যের রুমের জানালায়। কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দটা শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর হৃদ্যের মুখটা দেখতে পেল ভ্রমর। রেলিংয়ের সাথে ঘেষে এসে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় ছিলে? কখন থেকে ডাকছি।”
হৃদ্য চুপ। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে ভ্রমরের দিকে। রাগ রাগ একটা ভাব ধরতে গিয়েও পারছে না। ব্যর্থ হয়ে বলল,
“আমিও তো ডেকেছিলাম।”
সঙ্গে সঙ্গে আসতে না পারার কারণ উল্লেখ করতে চাইল ভ্রমর। তার আগেই হৃদ্য বলল,
“একটু আমার কাছে আসবি?”
কথাটা এত নরম স্বরে বলল যে ভ্রমর বুঝতেই পারল না। প্রশ্ন করে বসল,
“কী বললে?”
হৃদ্য সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলো পাল্টে বলল,
“আমাদের বাসায় আয়।”
“এখন?”
ভ্রমরের কণ্ঠে সংশয়,দ্বিধা। হৃদ্য অবাক হলো। রাগটা নড়েচড়ে উঠল। তবে প্রকাশ করল না।
“হ্যাঁ। এখন আসলে সমস্যা?”
“কেন? কিছু দরকার?”
এ পর্যায়ে হৃদ্য রেলিংয়ের কাছে চলে আসল। খেঁকিয়ে উঠে বলল,
“এত প্রশ্ন করছিস কেন? আসতে বলছি,আসবি।”
ভ্রমর নিভে গেল। দুর্বল স্বরে বলল,
“আচ্ছা।”
ভ্রমর বারান্দা ছেড়ে চলে যেতে হৃদ্য বেতের চেয়ারটায় বসে পড়ল। হাত চলে গেল কপালে। চোখ দুটো বন্ধ করে জড়িয়ে পড়ল গভীর চিন্তায়। এত অস্বস্থি হচ্ছে কেন তার? কী নিয়ে এত দুশ্চিন্তা হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে? হৃদ্যের চিন্তায় বিঘ্ন ঘটাল ভ্রমরের কণ্ঠ স্বর,
“এখনই আসতে হবে? কাল সকালে আসলে হবে না?”
হৃদ্য চেয়ারে বসেই চকিত দৃষ্টি রাখল ভ্রমরের উপর। এই এতক্ষণ পড়ে এসে এই কথা? হৃদ্যের ইচ্ছে হলো কঠিন করে দুটো বকা দিয়ে দিতে। সে রকম চিন্তা-ভাবনা নিয়েই রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বকাগুলো আর আসল না। মেয়েটার কোমল মুখের দুঃখী ভাবটাই বলে দিচ্ছে না আসতে পারায় কতটা কষ্ট পাচ্ছে।
“কে মানা করল?”
হৃদ্যের আতকা প্রশ্নে ভ্রমর ছিটকে ওঠে। চোখে ভেসে উঠে বাবার মুখটা। হৃদ্য ঠোঁট টেনে হাসল। একপেশে হাসি! ভ্রমরের উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোন আনতে নিজের রুমে চলে গেল। রিং বাজল ভ্রমরের মোবাইলে। স্ক্রিনে ‘মি.প্রতিবেশি’ নামটা ভেসে উঠতে ভারি অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
“আমি তো তোমার সামনেই তাহলে কল করছ কেন?”
জবাবে হৃদ্য মৃদু হাসল। হৃদ্যের ইশারায় কল রিসিভ করে কানে ধরলে হৃদ্য বলল,
“একটা জোরে শ্বাস নে।”
“কেন?”
“আমি বলছি তাই।”
ভ্রমর ফোন কানে হৃদ্যের দিকে তাকাল। বিরক্ত নিয়ে জোরে শ্বাস টেনে ফেলতে হৃদ্য বলল,
“এখন ঠিক আছে।”
“কী ঠিক আছে?”
হৃদ্য জবাব দিল না। দূর থেকে ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল গভীরভাবে। আপনমনে বিড়বিড় করল,’এখন মনে হচ্ছে তুই আমার কাছে আছিস। পাশে বসে নিশ্বাস ছাড়ছিস। মনটা একটু শান্তি পেল বোধ হয়।’
ভ্রমর কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
“কী হলো বলো না কী ঠিক আছে?”
হৃদ্য প্রসঙ্গ পাল্টে জরুরী গলায় বলল,
“তোকে কিছু কথা বলার আছে।”
ভ্রমরের ত্বরিত জবাব,
“বলো।”
“তার আগে বল,তুই সব থেকে বেশি কাকে ভালোবাসিস?”
“কাকে আবার? আম্মুকে।”
“আর তোর বাবা? বাবাকে ভালোবাসিস না?”
মুহূর্তেই ভ্রমরের মুখ শীতের কুয়াশার মতো নিষ্প্রভ হয়ে গেল। চোখের চাহনি উদাস। মন চাপা খেল দ্বিধা আর দ্বন্ধে।
“কী হলো বল,বাবাকে ভালোবাসিস না?”
ভ্রমর খানিকটা জোর করেই বলল,
“বাসব না কেন? বাবা তো ভালোবাসার মানুষই। হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছ?”
হৃদ্য হকচকিয়ে যায়। তালগোল পেকে যায় ভেতরটায়। সত্যিই তো এসব কেন জিজ্ঞেস করছে? তার তো অন্য কিছু বলার ছিল। হৃদ্য খানিকটা অনুরোধের সুরে বলল,
“তোকে একটা কথা বললে রাখবি?”
“কী?”
“মায়ের অবাধ্য হবি না। কখনও না।”
ভারী বিরক্ত নিয়ে বলল,
“কী সব বলছ। আমি কি কখনও মায়ের কথার অবাধ্য হয়েছি?”
“হোসনি। হবিও না।”
“তুমি কি এসব বলার জন্যই কল দিয়েছ?”
হৃদ্য বুঝি ভ্রমরের প্রশ্নটা শুনলই না। সে আনমনে বলল,
“মায়ের কাছে কিছু লুকোবি না। বাবা বললেও না।”
“আচ্ছা।”
হৃদ্য আর কিছু বলল না। ভ্রমরও না। নীরবে কানে ফোন রেখে কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত। নীরবতা ভেঙে হৃদ্য বলল,
“ঘুমিয়ে পড়। রাখছি।”
ভ্রমর কান থেকে ফোন রেখে দিতে নিলে হৃদ্য ডেকে উঠল,
“শোন।”
“বলো।”
“ধর তোর চকলেট খুব পছন্দ কিন্তু বাবা বলছেন,চিপস খেতে। তখন কী করবি? চকলেটের জন্য জেদ ধরবি নাকি খুশিমনে চিপস খাবি?”
“চিপস খাব তারপর আম্মুকে বলব চকলেট কিনে দিতে।”
ভ্রমরের উত্তর শুনে হৃদ্য হতভম্ব!
____________
রিধি চেয়ার,টেবিলে পড়ছিল। হঠাৎ পাশ ফিরতে দেখল শ্রাবণ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে একটুও অবাক হলো না। বিচলিত হলো না। সহজ স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ঘুম ভেঙে গেছে?”
শ্রাবণের ঘোর কাটল। বিব্রতে পড়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
“জি।”
“এখন কেমন আছেন?”
“ভালো।”
“কিছু খাবেন?”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে না বুঝাতে রিধি পড়ায় মনোনিবেশ করল। শ্রাবণ ঘড়ির দিকে তাকাতে চমকে গেল। দুটো বাজছে। সেদিকে তাকিয়ে রিধির দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“এত রাতে পড়ছেন? কোনো পরীক্ষা আছে নাকি?”
“না।”
“তাহলে?”
রিধি শ্রাবণের দিকে তাকাল। কী ভেবে বই বন্ধ করে উঠে পড়ল। বাতি নিভিয়ে বলল,
“আলোর জন্য ঘুম ভেঙে গেছে তাই না? সরি। আমার খেয়ালই ছিল না। অভ্যাস থেকে হয়ে গেছে।”
রিধির অপরাধ প্রকাশে শ্রাবণের কুণ্ঠা বোধ হলো। শশব্যস্ত হয়ে বলতে চাইল,’আলোতে আমার একটুও সমস্যা হয়নি বরঞ্চ উপকার হয়েছে। অন্ধকার থাকলে কি আপনাকে এত কাছ থেকে দেখতে পারতাম?’ এর মধ্যেই মনে পড়ল সে রিধির বিছানায় শুয়ে আছে। এখন মেয়েটি কোথায় শুবে? নিচে শুয়ে পড়বে না তো? শ্রাবণ চট করে শোয়া থেকে উঠে পড়ল। মেঝেতে একপা রাখতে রিধি ধমকে উঠল,
“নিচে নামছেন কেন? নিষেধ করেছি না? কী লাগবে বলুন। আমি এনে দিচ্ছি।”
শ্রাবণ কেঁপে উঠল। পর মুহূর্তে আশ্চর্য হলো এই ভেবে, অন্ধকারেও মেয়েটি তার কর্মকান্ড দেখতে পারছে। কীভাবে?
রিধি কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“কী লাগবে?”
শ্রাবণ টেনে টেনে বলল,
“আপনাকে নিচে শুতে হবে না। আমি..”
“আপনাকে কে বলল আমি নিচে শুব?”
শ্রাবণ অন্ধকারে রিধির দিকে তাকাল। মুখটা দেখা না গেলেও কাছেই একটা ছায়ার উপস্থিতি টের পাচ্ছে। সেদিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তাহলে?”
রিধি উত্তর দিল না। শ্রাবণ অন্ধকারেও টের পেল ছায়াটি নড়ছে। হালকা পদশব্দ তুলে তার আশেপাশেই ঘুরছে। তাকে ভারি অবাক করে রিধি বিছানায় শুয়ে বলল,
“আমার বিছানায়।”
“আর আমি?”
“আপনিও বিছানায়। আমরা এক বিছানায় পাশাপাশি। কিন্তু কাছাকাছি নয়। ঠিক আছে?”
শ্রাবণ স্তব্ধীভূত হয়ে মাথাটা একপাশে কাত করল। রিধি বুঝি অন্ধকারে তাও দেখে ফেলল। বলল,
“নিন এখন শুয়ে পড়ুন।”
শ্রাবণের শরীরে কম্বলটা টেনে দিতে মনে মনে প্রশ্ন করল,’এক কম্বলের নিচে?’ প্রশ্নের উত্তর এলো না। সে বুঝতেও পারল না। শুধু চোখ দুটো বন্ধ করে নিল এই ভেবে,কাছাকাছি না হোক। পাশাপাশি তো!
বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ আবিষ্কার করল তার ঘুম আসছে না। চোখে তন্দ্রা ভাবটুকুও নেই। কেমন যেন সতেজ ভাব। যেমনটা সারাদিন ক্লান্তি শেষে গোসল করার পর অনুভব হয়। এখন সে কী করবে? এভাবে জেগে জেগে রাত কাটাবে? বিরক্ত আর বিতৃষ্ণায় কাহিল হয়ে পড়ল। অন্ধকারে রুমে চোখ বুলাতে মনে হলো ঘুটঘুটে অন্ধকারটা এখন অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। আবছা আবছা অনেক কিছুই বুঝা যাচ্ছে। সে একপাশ থেকে আরেকপাশে ঘুরতে দৃষ্টি আটকে গেল রিধির কোমল মুখে। চাঁদের আলো ঝেঁকে বসেছে মুখটায়। এক রকম নীলচে আভা বের হচ্ছে স্নিগ্ধ মুখ থেকে। বড্ড আদুরে। চট করে ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনা তৈরী করার দারুন ক্ষমতা! কপালের কাছের ছোট চুলগুলো হালকা নড়ে উঠতে শ্রাবণের ঘোর কাটল। ফ্যান তো চলছে না। তাহলে হাওয়া এলো কোথা থেকে? সপ্রশ্নে সামনে তাকাতে দেখল জানালা খোলা। সাথে সাথে অনুভব করল পুরো ঘর ঠান্ডার রাজত্ব। জমে যাওয়া অবস্থা। সে কম্বল সরিয়ে জানালা লাগানোর জন্য উদ্যত হতে মনে পড়ল জানালা লাগালে তো জোসনাও আসবে না। রাত পার করতে হলে এই মেয়েটার মুখ দর্শনে থাকা বড্ড প্রয়োজন!
শ্রাবণ পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। এবার বুঝি খানিকটা রিধির দিকে চেপেও এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধতা ঝরে পড়ার পর শ্রাবণ কম্বলের নিচ থেকে বাম হাতটা বের করল। হাওয়াই নড়েচড়ে বেড়ানো চুলগুলোতে স্পর্শ করল ভয়ে ভয়ে। আলতোভাবে সরিয়ে দিতে রিধি নড়ে উঠল। শ্রাবণের দিকে পাশ ফিরল। একটা হাত শ্রাবণের পেটে রাখতে টের পেল দুজন পাশাপাশি এক এক বিছানায়,এক কম্বলের নিচে।
_______________
“নামো।”
বাবার আদেশে ভ্রমর গাড়ি থেকে নামল। বাইরে তাকিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল,
“আমরা কোথায় আসছি,বাজান? এটা তো আমার কলেজ না।”
মীর খন্দকার মৃদু হাসলেন। ভ্রমরের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমরা একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
“কার সাথে?”
“পরিচয়টা নাহয় তার কাছ থেকেই জেনে নিও।”
মীর খন্দকার ভ্রমরকে নিয়ে একটা দামী রেষ্টুরেন্টে ঢুকলেন। একটা খালি টেবিলে বসিয়ে বললেন,
“তুমি থাকো,আমি আসছি।”
ভ্রমর ভয়ে বাবার অপেক্ষায় বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকল। এর মধ্যে একজন ওয়েটার এসে দু কাপ কফি রেখে গিয়েছে। ভ্রমর ভীষণ অবাক হলো। বলতে চাইল সে কফির অর্ডার দেয়নি। পর মুহূর্তে মনে হলো হয় তো বাবা অর্ডার দিয়ে গেছেন। এখনই চলে আসবেন। সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। সময় যত গড়াচ্ছে অপেক্ষা ততই তেতোতে পরিণত হচ্ছে৷ আবার ক্লাস করতে পারেনি বলে মন খারাপও হচ্ছে। তার থেকে বেশি মন খারাপ হচ্ছে হৃদ্যের সাথে দেখা হবে না দেখে। মন খারাপ যখন পাহাড়ের সমান হলো ঠিক সেই সময় এক অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ,
“তুমি ভ্রমর?”
ভ্রমর চকিত চোখে অপরিচিত মানুষটার দিকে তাকাল। গাঢ় নীল রঙ শার্টের উপর কালো জ্যাকেট ও কালো জিন্স পরা ছেলেটিকে কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু কণ্ঠ? কোথাও কি শুনেছিল?
ছেলেটি বিরতি টেনে আবার জিজ্ঞেস করল,
“তুমি ভ্রমর তো?”
এ পর্যায়ে ভ্রমর কথা বলতে পারল না। মাথা উপর নিচ করতে ছেলেটি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ,
“আমি নীরব।”#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩৩)
এক অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ,
“তুমি ভ্রমর?”
ভ্রমর চকিত চোখে অপরিচিত মানুষটার দিকে তাকাল। গাঢ় নীল রঙ শার্টের উপর কালো জ্যাকেট ও কালো জিন্স পরা ছেলেটিকে কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু কণ্ঠ? কোথাও কি শুনেছিল?
ছেলেটি বিরতি টেনে আবার জিজ্ঞেস করল,
“তুমি ভ্রমর তো?”
এ পর্যায়ে ভ্রমর কথা বলতে পারল না। মাথা উপর নিচ করতে ছেলেটি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সহজ স্বরে বলল,
“আমি নীরব।”
ভ্রমরের ভ্রূ জোড়া কুঁচকে এলো। খানিকটা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল নীরবের মুখ পানে। মুখাবয়ব অপরিচিত লাগলেও নামটা কোথাও শুনেছে। আর কণ্ঠ? সেটাও কি শুনেছে? ভ্রমরের মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। মনে করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে সুধাল,
“আপনার সাথে কি আমার আগেও কথা হয়েছিল?”
নীরব কফি খাচ্ছিল বিধায় সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। সেকেন্ড দুই পর উত্তর দেওয়ার জন্য ভ্রমরের দিকে তাকাল। সেই সময় ভ্রমরের কোলে থাকা ব্যাগটা কেঁপে উঠল। আকস্মিক কাঁপনে ভয়ে ছিটকে ওঠে ভ্রমর। নীরবের দিকে সংকোচ দৃষ্টি রেখে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে। চমকে ওঠে স্ক্রিণে ‘মি.প্রতিবেশি’ নাম দেখে। মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মুখমন্ডলে। কল ধরবে কী ধরবে না দ্বিধায় জড়িয়ে পড়ে খারাপভাবে। এর মধ্যে কল কেটে গেল। ভ্রমর মোবাইল পুনরায় ব্যাগে ভরতে নিলে আবার কল আসে। এবার আর অপেক্ষা নয়,ভাবনা নয়,দ্বিধা নয় ফোন কানে চেপে ধরে বলল,
“হ্যালো?”
“তুই কোথায়?”
ভ্রমর উত্তর দেওয়ার সময় পেল না। হৃদ্য দ্বিতীয় প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“কলেজ আসিসনি কেন?”
ভ্রমর নীরবের দিকে তাকাল। ঘাড়টা একপাশে বাঁকা করে মুখে হাত চেপে ফিসফিসে বলল,
“একটু বাইরে আছি। তোমাকে পরে কল দিচ্ছি।”
মুহূর্তের মধ্যে হৃদ্যের গলার স্বর পাল্টে গেল। উগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“পরে কল দিবি মানে? আর তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? এখন তো আন্টি বাসায় থাকার কথা না। কার থেকে লুকিয়ে কথা বলছিস?”
“কারও সাথে না।”
“ভ্রমর,তুই মিথ্যে বলছিস? আমার সাথে মিথ্যে বলছিস?”
হৃদ্যের কণ্ঠ থেকে ঝরছে বিশ্ব মাপের বিস্ময়! অগ্নি ঝরা রাগ! সে খানিকটা চিৎকার করেই বলল,
“তুই এখনি কলেজে আসবি। এখন মানে এখন। এক মিনিট লেট হলে তোর বাপের মাথা ফাটিয়ে দেব।”
ভ্রমরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। তাদের মধ্যে হঠাৎ বাবার মাথা কী করে চলে আসল বুঝতে পারছে না। তার অবোধ ভঙ্গির মধ্যেই হৃদ্যের হুমকি,
“তোর আসতে হবে না। আমি আসছি। কোথায় আছিস বল।”
ভ্রমরের কিছু বলার আগেই স্পষ্ট শুনতে পেল হৃদ্য কাউকে জিজ্ঞেস করছে,
“টিপু,হাতুড়ি পাব কোথায় রে?”
ভ্রমর বিস্ফারিত নেত্রে কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“হাতুড়ি দিয়ে কী করবে?”
“তা জেনে তোর কী কাজ? তোকে ঠিকানা বলতে বলছি সেটা বল।”
ভ্রমর চট করে কল কেটে দিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে ব্যাগ কাধে নিয়ে শশব্যস্তে বলল,
“বাজান আসলে বলবেন,আমার পেট খারাপ হয়েছে।”
_________________
ভ্রমর রিক্সা থেকে নামার সুযোগ পেল না। তন্মধ্যেই হৃদ্য হামলে পড়ে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় গিয়েছিলি?”
ভ্রমর বিরক্ত চোখে তাকাল। রিক্সা থেকে নেমে কলেজের ভেতরে হাঁটা শুরু করল। হৃদ্য পেছন পেছন ছুটে আসে। প্রশ্ন করে,ভ্রমর উত্তর দেয় না। মুহূর্তকাল এভাবে কাটানোর পর হৃদ্যের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আচমকা ভ্রমরের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কঠিন হুংকার ছাড়ল,
“তখন থেকে একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছি উত্তর দিচ্ছিস না কেন? জলদি বল,ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাপের সাথে কোথায় গেছিলি?”
ভ্রমর চোখ,মুখ কুঁচকে শক্ত স্বরে বলল,
“আশ্চর্য! তখন থেকে দেখছি কথায় কথায় বাবাকে টেনে আনছ। অভদ্র উচ্চারণ করছ। সমস্যা কী? এমনভাবে প্রশ্ন করছ যেন বাবার সাথে বেরিয়ে বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি। বাবার সাথে বেরোনো কি পাপ?”
হৃদ্যের মেজাজ হালকা হলো। খানিকটা নরম স্বরে বলল,
“আচ্ছা আর অভদ্র উচ্চারণ করব না। কোথায় গিয়েছিলি বল।”
ভ্রমরের মেজাজও পড়ে গেল। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারল না। ওভাবে চলে আসা কি ঠিক হয়েছে? আসার সময় তো বাবার সাথে দেখাও হয়নি। প্রথম বার বাবার সাথে কোথাও গিয়েছিল,কারও সাথে দেখা হয়েছিল। কার সাথে দেখা হলো? কেন দেখা হলো?এর কিছুই জানা হলো না। সব কিছু অজানায় রেখে মাঝ পথে চলে আসল। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। অভদ্র আচরন প্রকাশ পেল। বাবা যদি রাগ করে? কথা না বলে? আবার হারিয়ে যায়? মুহূর্তেই ভ্রমরের ভেতরে উথাল-পাতাল শুরু হয়। একটা অজানা আসঙ্কায় বুকে তীব্র কম্পন শুরু হয়। তার বিধ্বস্ত চিন্তা-ভাবনার মধ্যে হৃদ্যের সেই এক প্রশ্নে ভ্রমর রেগে গেল। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,
“বলব না। কিছু বলব না। আমি বাসায় যাব।”
কথাটা বলে ভ্রমর হৃদ্যকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা ধরেছিল। আবার পেছন ঘুরে শাসিয়ে বলল,
“একদম আমার পিছু নিবে না। কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবে না। আমি একা যাব।”
এ পর্যায়ে হৃদ্যও ক্ষেপে গেল।নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,
“আমার ঠ্যাকা পড়ছে তোর পিছু নিতে। সব আমার কপালের দোষ। কপালেরই দোষ। নাহলে এমন বলদ মেয়ের পাল্লায় পড়ি? যত্তসব আজাইরা।”
______________
ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছেড়ে দশটায় পড়তে ভ্রমরের ভেতরের অস্থিরতা তীব্র হলো। রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। মূল দরজার সিটকিনির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে,
“আম্মু,বাজান এখনও আসছে না কেন?”
শরীফা বেগম রাতের খাবার গুছাচ্ছিলেন। হাত থেকে তরকারির বাটিটা রেখে খালি জগ তুলে রান্নাঘরের দিকে এগুতে এগুতে বললেন,
“চলে আসবে।”
ভ্রমর মায়ের পেছন ছুটে আসে। মন খারাপের সুরে বলল,
“সন্ধ্যা থেকে বলছ আসবে। কিন্তু আসছে না তো। একটু কল দেও না।”
শরীফা খন্দকার কল ছেড়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন,
“তুই দিতে পারছিস না?”
“আমার কাছে নাম্বার নেই যে।”
“আমার ফোন থেকে নে।”
ভ্রমর মাকে রেখে রান্নাঘর থেকে বেরোল। হঠাৎ থেমে ঘাড় বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“সত্যি নিব?”
শরীফা খন্দমার চোখের পাতা ফেলে মৃদু ঘাড় নাড়লেন। মায়ের অনুমতি পেয়ে ভ্রমরের সে কী খুশি! সে নাচন ভঙ্গিতে মায়ের ফোনের খোঁজ চালাল। ফোন হাতে নিতে শরীফা খন্দকারের গলা,
“খুকিসোনা,তোমার বাজান চলে এসেছে।”
ভ্রমর আতকে উঠে পেছন তাকায়। ফোন ফেলে দৌড়ে বের হবে তখনই মীর খন্দকার রুমে ঢুকেন। বাবার মুখ দেখে ভ্রমরের জান যায় যায় অবস্থা। মনে পড়ে সকালের ঘটনা। কী খারাপ কাহিনিটাই না ঘটিয়েছে। ঐ লোকটা নিশ্চয় তার সম্পর্কে খারাপ খারাপ কথা বলেছে। সেজন্যই বাবা আর বাসায় আসেনি। এলো এই রাত করে। আচ্ছা,উনি কি বকবেন? মারবেন? নাকি.. ভ্রমর আর ভাবতে পারে না। ভয়ে কলিজা একটুখানি হয়ে আসে। লুকিয়ে পড়তে চায় কোথাও। মাথা ঝুকিয়ে ফেলতে মীর খন্দকার কাছে এগিয়ে আসলেন। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“আমাকে না বলে কোথায় গিয়েছিলে?”
ভ্রমর হালকা কেঁপে উঠল। ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছিল। চোখের কোণে পানি জমতে কেঁদে দিল। ভয়ে ভয়ে বলতে চাইল,’কলেজে গিয়েছিলাম।’ কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই মীর খন্দকার মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। মোলায়েম স্বরে সুধালেন,
“নীরবের সাথে কথা হয়েছিল?”
ভ্রমর মাথা দু’দিকে নাড়তে উনি হাত সরিয়ে নিলেন। স্বাভাবির স্বরে বললেন,
“পরের বার এমন ভুল যেন নাহয়। অবশ্যই কথা বলবে। ঠিক আছে?”
ভ্রমর মাথা তুলল। ছলছল চোখে দ্রুত বলল,
“আচ্ছা,কালকেই বলব। আপনি বললে এখনই বলব। আমি জামা পাল্টে আসব?”
মীর খন্দকার সাথে সাথে কিছু বললেন না। কেমন যেন উদাস ভাব। কিছুক্ষণ পর বললেন,
“এখন না। সময় হলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
“আচ্ছা।”
“এখন চলো খাবে।”
ভ্রমর মাথা নেড়ে বাবার সাথে হাঁটা ধরে। রুম থেকে বের হতে হতে মীর খন্দকার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
“নীরবের কথা মাকে বলেছ?”
ভ্রমরের হঠাৎ কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গি করে বলল,
“যা! আমার একটুও মনে ছিল না। এখনই বলে আসছি।”
ভ্রমর ছুটে চলে যেতে নিলে মীর খন্দকার মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। ধীর কণ্ঠে বললেন,
“তোমাকে বলতে হবে না। সময় হলে আমি বলব।”
__________________
শ্রাবণ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখে রিধি ফোনে কথা বলছে। সে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিল। পর মুহূর্তে আশ্চর্য হলো! কারণ রিধির কানে ফোনটা হৃদ্যের। সে দৌড় কদমে রিধির পেছন এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
“কার সাথে কথা বলছেন?”
রিধি চোখ বাঁকিয়ে শ্রাবণকে দেখল। উত্তর দিল না। ব্যস্ত হয়ে পড়ল ফোনের মানুষটির সাথে। শ্রাবণ কতক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যেতে নিলে রিধি বাম হাতটি চেপে ধরল। ফোন তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
“আপনার বাবা।”
শ্রাবণ সন্দিগ্ধ মনে ফোন কানে ধরে। কিছু একটা বলে কল কেটে দিয়ে বলল,
“কী বলছিলেন?”
রিধি বিছানায় শুয়ে পড়ে বলল,
“এই আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে আমাদের বাসায় কেন পড়ে আছেন।”
শ্রাবণ দূর থেকেই বলল,
“আপনি জানেন না?”
রিধি শ্রাবণের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ফেলল। বালিশে মাথা রেখে বলল,
“না জানতাম না। আংকেল বলল।”
“কী বলেছে?”
রিধি শোয়া থেকে উঠল। কথাটা বলতে গিয়েও বলল না। শুয়ে পড়ে বলল,
“আপনাকে বলব না।”
শ্রাবণ হতাশ হলো। বিছানায় বসে বলল,
“শুয়ে পড়েছেন নাকি? আজ পড়বেন না?”
রিধি মিটিমিটি হাসছিল। হঠাৎ হাসি মুছে গেল। ক্লান্ত স্বরে বলল,
“না।”
“কেন?”
রিধি উত্তর দিল না। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। শ্রাবণ বাতি নিভিয়ে রিধির পাশে শুয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ পর সুধাল,
“ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
উত্তর এলো না। শ্রাবণ আবছা অন্ধকারে পাশ ফিরতে দেখল রিধি তার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ভারি নিশ্বাসের শব্দ আসছে। সে আপনমনে বলল,’আজ বোধ হয় বড্ড ক্লান্ত। চোখ বন্ধ হতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।’ শ্রাবণ খেয়াল করল রিধি কম্বল জড়ায়নি। এমনি কুঁকড়ে শুয়ে আছে। সে সযত্নে কম্বলটা তুলে দিতে রিধি ফুঁপিয়ে উঠল। শ্রাবণ প্রথমে বুঝতে পারল না। আরেকটু কাছ ঘেষে আসতে দেখল রিধি মিহি সুরে কাঁদছে আর কিছু একটা বিড়বিড় করছে। শ্রাবণ অবাক হয়। উদ্বিগ্ন ধরা পড়ে মুখে। সে রিধির গালে হাত রেখে আদুরে স্বরে ডাকল,
“রিধি?”
রিধি নড়ল। একবার বুঝি চোখও মেলল। পর মুহূর্তে কান্নার বেগ বেড়ে গেল। ফুঁপানি থেকে হেঁচকি উঠে গেল। এ পর্যায়ে শ্রাবণ ভয় গেল। আতঙ্কে ফেটে পড়ে রিধির দু’গাল চেপে ধরে বলল,
“কী হলো? এভাবে কাঁদছেন কেন? রিধি? তাকান। আমাকে দেখুন!”
রিধি তাকাল না। অস্ফুটে বলল,
“আমার কষ্ট হচ্ছে। উনাকে আটকান। উনি চলে যাচ্ছে।”
শ্রাবণ জরুরী গলায় বলল,
“কে চলে যাচ্ছে? কেউ যাচ্ছে না। আপনি স্বপ্ন দেখছেন। চোখ মেলুন।”
রিধি বুঝি শ্রাবণের গলা শুনলই না। আগের অবস্থায় বলল,
“আমার কষ্ট হচ্ছে।”
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে? রিধি,বলুন না কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
“বুকে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে!”
রিধি ঘুমন্ত অবস্থায় শব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল। শ্রাবণের হাত খামচে ধরে আবার বলল,
“এত কষ্ট কেন হচ্ছে? আমি কি মারা যাচ্ছি?”
শ্রাবণ আর সহ্য করতে পারল না। রিধিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“না। আপনি মারা যাচ্ছেন না। আপনার কষ্টও হচ্ছে না। কেউ তো কোথাও যাচ্ছে না। তাহলে কষ্ট কেন হবে? সবাই আপনার কাছে আছে। আমিও আছি।”
রিধির কপালে গভীর চুমু খেল শ্রাবণ। এবার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা না করে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। তার চেষ্টা সফল হলো। রিধির কান্না কমল। বিড়বিড়ানিও থামল। কিন্তু তখনও সময়ে সময়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। সে আরেকটু গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে চোখটা বন্ধ করতে হঠাৎ রিধির কথাগুলো মস্তিষ্কে হানা দিল। মুহূর্তেই বেশ কয়েকটি প্রশ্ন জড়ো হলো মন পাড়ায়। প্রথম প্রশ্নটি ছিল,’কার কথা বলছিল রিধি?’ তারপর একে একে অনেক ভাবনা চলে আসে। হঠাৎ আবছা কিছু ভাবনায় আসতে কলিজায় কামড় পরে। অনিচ্ছায় প্রশ্ন চলে আসে,রিধি কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? তার জন্যই কষ্ট পাচ্ছে? কিন্তু এমন কিছু তো রিধির বাবা বলেনি। সেদিন অনেকগুলো কারণ দেখিয়ে ডিভোর্সের কথা বলেছিল। কিন্তু একবারও কি বলেছিল রিধি অন্য কাউকে ভালোবাসে? তার তো এমন কিছু মনে পড়ছে না। বললে নিশ্চয় মনে থাকত। শ্রাবণ ভাবনার মধ্যেই রিধির কোমরটা খামচে ধরে।
চলবে
[আজ একটু বড় লিখেছি। লিখতে ভালোই লাগছিল। এক দিন বিশ্রাম নিয়ে লিখলে ক্লান্তও লাগে না। নীরব পাঠক-পাঠিকারা একটু সাড়া দেন। কেমন লাগছে বলুন। খারাপ লাগলে কারণ বলুন। শোধরিয়ে নিব ইনশাআল্লাহ ]
চলবে
[বড় লিখতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে😒]