#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সন্ধ্যারাগের অক্লান্ত মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে বিভাবরী। জমাট অসিত অম্বুবাহীতে প্রচ্ছন্ন অন্তহীন নক্ষত্রলোক। মেদিনীর বুক জুড়ে বইছে মন্থর অনুরণনে শীতল নভঃশ্বাস।
ক্রমশ জ্বলে উঠছে নিয়নের বাতি। বিভাসিত মেদিনী উল্লাসিত! নক্ষত্রলোকে উদ্ভাসিত চন্দ্রমা কী নিদারুন চন্দ্রকিরণে জড়িয়েছে তাকে।
প্রাবিশের মা- বাবা তার বোনের বাসায় গেছে। চলে আসবেন মধ্য প্রহরের পূর্বেই। এমনটাই কথা ছিল।
কুসুম তার মামা-মামীকে বান্ধবীর বাসায় থাকবে বলেছে। তাই তারা কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তৃণা আসেনি। সে ব্যস্ত তার প্রথম সাময়িক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে। সীমান্ত অনেকটা সুস্থ থাকায় তার ভাই তাকে এখানে আসার জন্য সম্মতি দেয়। আরাজকে সাথে করে নিয়ে এসেছে আয়েন্দ্রি। আলফাজ সাহেব কিছুতেই আয়েন্দ্রিকে আসতে দেবে না। আরাজ বাবাকে আশ্বস্ত করল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বোনকে নিয়ে সে ফিরে আসবে। প্রাবিশদের বাড়ি আয়েন্দ্রিদের দুই বাড়ির পরেই। চেনাশোনা বহু দিনের। ভরসা আছে আলফাজ সাহেবের। কেক কাটা শেষে আরাজকে দিয়ে আসা হয় এক পিস। সে বসার ঘরে বসে আছে। বাকিরা প্রাবিশের বেডরুমে। হৈ-হুল্লোড় শ্রুতিগোচর হচ্ছে আরাজের। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে সে। নির্দিষ্ট সময় হতেই বোনকে নিয়ে ছুটতে হবে বাসায়।
সীমান্ত ঠোঁটভরা হাসল। কৌতুকপ্রদ গলায় বলল—
“বুঝলাম না কিছুই। একমাস একটু অসুস্থ আছিলাম আর তোরা দুইটা একটার প্রেম সাগরে আরেকটা ভাসা শুরু করছোস!”
আয়েন্দ্রি চোখ পিটপিট করে। সীমান্তের সাথে তাল মেলায় কুসুম। এক ধাপ এগিয়ে বলল—
“সেইটা আবার কইতে! শুধু কী ভাসা! ডুইবা যাইতাছে। কেউ একটা ভেলা ভাসা!”
হা হা করে হেসে ওঠে সবাই। প্রাবিশ চ্যাটিং এ ব্যস্ত জাহ্নবীর সাথে। মেয়েটা দূরে থাকে বলে আসতে পারল না। ক্ষুণ্ণ মনে চলে বিরহ প্রেমের আলাপন। ছোঁ মেরে মোবাইলটা কেড়ে নেয় সীমান্ত। তড়িৎ গলায় বলল—
” অপমান করতাছোস কেন? আমগোরে ডাইকা আইনা বৌদির লগে ফুসুর ফাসুর করতাছোস কেন?”
“আরে মোবাইলটা দে।”
প্রাবিশের শান্ত গলায় সীমান্তের মস্তিষ্কের একটা নিউরণও নড়লো না। প্রাবিশ পরাস্থ। বিয়ারের ক্যান খুলে ঢগঢগ করে গিলতে থাকে সীমান্ত। কুসুম আর আয়েন্দ্রির জন্য সফট ড্রিংকস। কিন্তু জেদ ধরলো আয়েন্দ্রি। সে বিয়ার খাবে। বিয়ারে হালকা অ্যালকোহল থাকে। নিষ্প্রাণ আপত্তি করে বলল—
“দরকার নেই। তুই টলারেট করতে পারবি না।”
আয়েন্দ্রি জোর গলায় বলল—
“পারব।”
নিষ্প্রাণ জোর গলায় বলল—
“দরকার নেই ধ্রুবতারা। স্যার জানতে পারলে রাগ করবে।”
আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের হাত ধরে আদুরে গলায় বলল—
“একটু খাবো, বিশ্বাস কর্। একটু!”
সীমান্ত উসখুস চোখে চেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।
“কী সমস্যা তোর? তুই ভ্যাদা মাছের মতো ওরে মানা করতাছোস ক্যান নিষ্প্রাইন্না? আন্দির মুখ দিয়া আন্দি খাইবো তাতে তোর কী?”
নিষ্প্রাণ ক্ষুণ্ণ গলায় বলল—
“বুঝতে কেন পারছিস না, প্রথম দফায় ও টলারেট করতে পারবে না। বাইরে আরাজ বসে আছে।”
“চুপ কর্ তুই। আন্দি তুই গিল। কিছু হইলে আমি আছি।”
আয়েন্দ্রি সময় ব্যয় করে না। পুরো একটা বিয়ার নাক বন্ধ করে গিলে নেয়। বিশ্রি গন্ধে নাক ছিটকে ওঠে আয়েন্দ্রির। তবুও আজ সে খাবে।
একা বসে থাকাতে ঘুম জড়িয়ে আসে আরাজের। ছোটো ছোটো হামি তুলতে থাকে। কাউচে শরীরটা এলিয়ে দিতেই ঘুমপরীরা উড়াউড়ি শুরু করে তার চোখের পাতায়।
আয়েন্দ্রি নিয়ন্ত্রণ হারায়। পেটভরে খাওয়ার ফলে সবার গা ছেড়ে দেয়। প্রাবিশ তার বিছানায় আধশোয়া বসে জাহ্নবীর সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। ল্যাপটপে রেসলিং দেখছিল সীমান্ত। দেখতে দেখতে চোখের পল্লব মিলিয়ে যায়। কুসুম গিয়ে শুয়েছে প্রাবিশের মা-বাবার ঘরে। নিষ্প্রাণের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আয়েন্দ্রি। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে তার। নিষ্প্রাণের দিকে বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে তার দিকে এগোতে থাকে। নিষ্প্রাণ অপ্রস্তুত হয়। আয়েন্দ্রি নিজের মাঝে নেই। একটু একটু করে নিষ্প্রাণের বুকে নিজের ভর ছাড়তে শুরু করে আয়েন্দ্রি। বেখেয়ালি গলায় বলল—
“প্রাণ, আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি একটু ঘুমাই।”
নিষ্প্রাণ কঠোর গলায় বলল—
” এই জন্য তোকে বাড়ন করেছি আমি। শুনিসনি আমার কথা। চল্। ওঠ এখান থেকে।”
“না। আমি এখানেই ঘুমাব।”
“পাগলামি করিস না।”
কেমন অদ্ভুত আঁখুটে গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—
“আমি তোর বুকে ঘুমাব।”
নিষ্প্রাণের বুকের দিকে খাঁমচে ধরে আয়েন্দ্রি। ডিভানে বসা নিষ্প্রাণ পেছন দিকে হেলে পড়ে। পুরোদস্তুর নিজের ভর নিষ্প্রাণের উপর ছেড়ে দেয় আয়েন্দ্রি। লম্বা শ্বাস টেনে নেয় নিষ্প্রাণ। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে!
আয়েন্দ্রির দেহযষ্টির মিষ্টি ঘ্রাণ উন্মাদ করে দিচ্ছে তাকে। নিষ্প্রাণ মৃদু গলায় ডেকে উঠে—
“ধ্রুবতারা! ধ্রুবতারা!”
নড়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। ঘুমো ঘুমো গলায় বলল—
“আমি ঘুমাব।”
নিষ্প্রাণকে আরও আড়ষ্ট করে নেয় আয়েন্দ্রি। বিপাকে পড়ে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছুঁয়ে আছে নিষ্প্রাণকে। নিষ্প্রাণ অসাড়, অপ্রমত্ত। অপ্রগলভ্ দৃষ্টিতে বারবার দেখছে আয়েন্দ্রির ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখ। অভাবিতরূপে কিছু একটা হলো নিষ্প্রাণের। দুই বাহুর জোরালো বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল আয়েন্দ্রিকে। মৃদু কম্পন হলো আয়েন্দ্রির শরীরে। নিষ্প্রাণের উষ্ণতায় আরাম বোধ হলো তার। নিষ্প্রাণ চোখ বুজে নেয়। অকপটে বলতে থাকে—
“জানিস ধ্রুবতারা, ছোটোবেলা থেকেই আমি একা। বাড়ির একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন কখনো বাড়ির বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমার। তারা ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। আমার বোনেরা আমাকে ভালো চোখে দেখত না। হিংসে হতো ওদের। কিন্তু আমি বুঝতাম না। কী করে বুঝব? মাত্র তো দশ বছরের ছিলাম আমি। তারা। উঁহু, নয়নতারা। বড়ো নাম তো। তাই ডাকতে পারতাম না। তারা বলে ডাকতাম। আমাকে আগলে রাখত। আমার চেয়ে সাত বছরের বড়ো ছিল। বলতে পারিস আমাকে মানুষ করতে ওর অবদান আছে। সত্যের দ্বার তো ওই খুলেছিল আমার সামনে। আমাকে খাইয়ে দিত, খেলত, আমাকে ভালোও বাসতো। কিন্তু এই আমিই ওকে নিজ হাতে মেরে ফেললাম!
আমার জীবনে প্রথম খুন করেছি আমি সেদিন। ওকে মারতে সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। কিন্তু এরপর আর কাউকে মারতে দ্বিতীয়বার ভাবিনি আমি। তোকে মারতেও ভাববো না। আমার থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করিস না ধ্রুবতারা। তা কারো জন্য ভালো হবে না। না তোর জন্য, না তোর পরিবারের জন্য।”
আচমকা তন্দ্রালুভাব কেটে যায় নিষ্প্রাণের। আঁখি জোড়া অমিলীত করে চাইতেই দেখল দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আরাজ। ইতস্তত বোধ করে নিষ্প্রাণ। তার বুকের উপর গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে। অপরাধি মুখ করে বলল—
“সরি। আসলে ও ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর বিরক্ত করিনি। আই এম এক্সট্রেমলি সরি।”
আরাজ স্বাভাবিক চোখে চেয়ে রইল। ব্যস্ত হয়ে ওঠে বসে নিষ্প্রাণ। তার বুকের পাঁজরের সাথে লেপ্টে আছে আয়েন্দ্রি। আয়েন্দ্রির ঘুমন্ত শরীরের ভার যেন দ্বিগুন! সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে নিষ্প্রাণকে। আরাজ দাঁড়িয়ে রইল। কোনো প্রতিক্রিয়া করল না সে। ছেলেটা তার বোনকে কতটা আগলে রাখতে পারে তা পরখ করছে সে!
নিষ্প্রাণ ইতিবিতি করে আয়েন্দ্রিকে সোজা করে। তার মাথাটা কাঁধের দিকে হেলিয়ে দেয়। আয়েন্দ্রি গোঙানির মতো বলে উঠে—
“প্রাণ, বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। তুই বিয়ে করবি না আমাকে?”
আরাজ শুনতে পেল সেই কথা। লজ্জা পেল সে। অপ্রকট চাহনিতে বলল—
“আব্বু, ফোন করেছে। বলেছে আপুকে নিয়ে যেতে। বকা দিয়েছে আমাকে। কী হলো জানি না! ঘুম এসে গেল আমার!”
আয়েন্দ্রির ঘাড়টা সরতে গেলেই তা হাতে নিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। ঘুমের ঘোরেও নিষ্প্রাণকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে আয়েন্দ্রি। সব ওই বিয়ারের জন্য! আয়েন্দ্রি টাল সামলাতে পারছে না। ছেড়ে দিয়েছে শরীর!
নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় বলল—
“ও ঘুমাচ্ছে। স্যারকে বলো সকালে যাবে। আমি ওকে প্রাবিশের বোনের ঘরে শুইয়ে দিচ্ছি। তুমি না হয় দরজা লক করে চাবিটা নিজের কাছেই রেখো।”
আরাজ পুলকিত হয়। সে হৃষ্ট গলায় বলল—
“হুম।”
আয়েন্দ্রিকে ক্রোড়ে তুলে নেয় নিষ্প্রাণ। রাতের মধ্য প্রহর। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে সবাই। প্রাবিশের বোনের বিয়ের হয়ে গেছে। তাই তার কক্ষটা খালি। আয়েন্দ্রিকে সেখানে শুইয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। সবুজ রঙের বাতিতে নিষ্প্রাণের কম্পিত পল্লব থমকে যায়। আয়েন্দ্রির অধরের সেই লাল তিন তাকে আহ্বান জানাচ্ছে। নিজের পৌরষসত্ত্বাকে থমকে দেয় নিষ্প্রাণ। তার ধ্রুবতারাকে সে কলঙ্কিত করবে না। তাহলে তার আর সেই মানুষগুলোর মধ্যে পার্থক্য কই যারা তার তারাকে কেড়ে নিয়েছে!
আরাজ মিথ্যে বলে তার বাবাকে। প্রাবিশের বাবা-মা সংগত কারণে আসতে পারেনি। কিন্তু আরাজ বলেছে তারা ফিরে এসেছে। আয়েন্দ্রি প্রাবিশের মায়ের সাথেই আছে। তবুও মনে খচখচ করছে আলফাজ সাহেবের।
দরজা লক করে বসার রুমে আসে নিষ্প্রাণ। কাউচে বসে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। আরাজ তার বিপরীত কাউচে বসে আছে। নম্র গলায় প্রশ্ন করে সে—
“আপুকে বিয়ে করতে চাও তুমি?”
মাথা ঝাঁকায় নিষ্প্রাণ। আরাজ তার কিশোর গলায় ফের বলল—
“আব্বু তোমাকে মেনে নিতে চাইছে না কেন? তোমার কেউ নেই বলে?”
নিষ্প্রাণ গম্ভীর গলায় বলল—
“হয়তো। এখানে স্যার ভুল কিছু করেনি। তার জায়গায় সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“কী করবে তাহলে তুমি?”
“বুঝাব তাকে। এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই আমার।”
“যদি আব্বু রাজি না হয়?”
চোখের পাতা পূর্ণ প্রকাশ করে নিষ্প্রাণ। নিষ্পলক চেয়ে থাকার হেতু ছলছল করে ওঠে চোখ। চোয়াল দৃঢ় করে, কপালে তোলে ভাঁজ। ভয় পেয়ে যায় আরাজ। পলক ফেলে নিষ্প্রাণ। স্বাভাবিক করে অভিব্যক্তি। কিন্তু উত্তর দিলো না। কাউচে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল—
“ঘুমাও আরাজ। অনেক রাত হয়েছে। ”
আরাজ নিষ্প্রাণের কথামতো কাজ করল। শুয়ে পড়ে কাউচে। কুশনটা বুকে জড়িয়ে ধরে মুদিত করে চোখ। নিষ্প্রাণ চেয়ে আছে সিলিং এ। আজ আর তারার সাথে তার কথা হবে না। মেয়েটা নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষা করছে!
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিছানায় ওঠে বসে আয়েন্দ্রি। নিভুনিভু চোখ দুটো মেলে ধরতেই সামনে দেখতে পায় নিষ্প্রাণকে। শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ঘুম জড়ানো চোখে হাসে। অলস ভঙ্গিতে বলল—
“তুই ঘুমাসনি?
নিষ্প্রাণ ছোট্ট করে হাসে। সরস গলায় বলল—
“হাত, মুখ ধুয়ে নে। বাসায় যেতে হবে। আরাজ বসে আছে বাইরে।”
আয়েন্দ্রি প্রশস্ত পল্লব নাচিয়ে বলল—
“আরাজ যায়নি? বাকিরা কোথায়?”
“বাকিরা বাইরেই আছে। ওঠ।”
বিস্ময়কর কাজ করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের অধরের সম্মুখে নিয়ে আসে নিজেকে। ওষ্ঠাধর ছোঁয়ার আগেই নিষ্প্রাণের চশমা নাকে লেগে যায় আয়েন্দ্রির। বিব্রত হয় সে। আলতো হাতে নিষ্প্রাণের চশমাটা খুলে হাতে নিয়ে নেয়। উলটে পালটে দেখতে থাকে। টিমটিমে গলায় বলল—
“এইটা ছাড়া তুই দেখতে পাস?”
নিষ্প্রাণ অতরল হাসে। নিস্পৃহ গলায় বলল—
“পারব না কেন! মাইনাস পয়েন্ট সেভেন ফাইভ মাত্র। এই যে তোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”
“তাহলে আর পরবি না।”
নিষ্প্রাণ সংকীর্ণ গলায় বলল—
“কেন?”
“রোমান্সে নো বাঁধা।”
হৃষ্ট হাসে নিষ্প্রাণ। সপ্রতিভ গলায় বলল—
“বিয়ের পর লেন্স পরে নেবো। চল এখন। সবাই বসে আছে।”
আয়েন্দ্রি ফট করে নিষ্প্রাণের শার্টের কলার চেপে ধরে। কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে। নিষ্প্রাণ কৃশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আয়েন্দ্রি আচ্ছন্ন গলায় বলল—
“বাবাকে রাজি করাতে পারবি তো তুই?”
দম বন্ধ হয়ে আসছে নিষ্প্রাণের। বেলি ফুলের তীব্র সৌরভ হুরহুর করে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে সাড়া জাগাচ্ছে। মেয়েটা এত কাছে কেন আসে!
নিষ্প্রাণ নিবারিত গলায় বলল—
“আমি চেষ্টা করব।”
চকিতে ভাবনাতীত কাজ করে বসে আয়েন্দ্রি। তার কুসুমকোমল ওষ্ঠাধরে আঁকড়ে ধরে নিষ্প্রাণের সরু অধর। হতচকিত নিষ্প্রাণ!
,
,
,
ঝুমঝুম করে চোখের পানি পড়ছে আয়েন্দ্রির।আগামীকাল তাকে দেখতে আসার কথা থাকলেও পাত্রপক্ষ আজ-ই চলে এসেছে। তারা বসার ঘরে বসে আছেন।
আয়েন্দ্রিকে তৈরি হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছেন তার মা। ঝুমা মেয়ের এহেন কাজে দুঃখী। কী করবেন তিনি? তার কিছুই করার নেই। অত্যন্ত নরম গলায় মেয়েকে বললেন—
“দেখ আয়ু, এখন ঝামেলা করিস না। ওরা যখন এসেছে দেখে চলে যাক। তারপর না হয় আমিই তোর বাবার সাথে কথা বলব।”
আয়েন্দ্রি রাগান্বিত গলায় বলল—
“কী বলবে তুমি? কী বলবে? এতদিন কেন কিছু বললে না? করব না আমি বিয়ে। চলে যেতে বলো ওদের।”
ঝুমা মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন। কপালে আদুরে চুমু খেয়ে বললেন—
“রাগ করে না মা! ওরা চলে যাক আমি সত্যিই তোর বাবার সাথে কথা বলব।”
কান্না আটকে নেয় আয়েন্দ্রি। মায়ের কথায় আশ্বস্ত হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের দেওয়া গাঢ় নীল রঙের সুতি শাড়িটা পরে নিজেকে গোছগাছ করে নেয়।
ছেলে তার মামা, মামীকে সাথে নিয়ে এসেছে। আয়েন্দ্রিকে তাদের সামনে এনে বসাল ঝুমা। মেয়েকে তাদের দেখার কিছু নেই। তথাকথিত নিয়ম মানতে তারা এসেছেন। তাদের আসল উদ্দেশ্য বিয়ের তারিখ ঠিক করা। আয়েন্দ্রি চোখে তুলে তাকাল না। ঘর্মাক্ত দুই হাত একে অপরের সাথে ঘষে চলছে। জল ছাপিয়ে আসায় চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আছে। আরাজ এক পাশে বসে আছে। রান্না ঘরের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে আরিশা। দরজায় করাঘাত পড়ে। হুলস্থুল হয়ে ছুটে যায় আরিশা। দরজা খুলতেই আশ্চর্যচকিত সে! নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু স্বাভাবিক সে। আরিশাকে দেখে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল—
“কেমন আছো?”
আরিশা বৃহৎ ঢোক গিলে মিইয়ে গলায় বলল—
“ভালো।”
ঘরে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। সবাইকে দেখল সে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াহীন! আলফাজ সাহেব ক্ষোভিত দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি বুঝতে পারলেন এসব তার মেয়ে করেছে!
নিজের রাগকে সংবরণ করলেন তিনি। আয়েন্দ্রি ছলছল চোখে একবার তাকাল। নিষ্প্রাণের অধরে নির্মল হাসি। সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল—
“আসসালামু আলাইকুম।”
নিষ্প্রাণের এই মোলায়েম স্বরেও অন্ত:করণে তান্ডব শুরু হলো রাশেদের। ঘামতে শুরু করল সে। নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছেন তিনি!
রাশেদ কোনোভাবেই বুঝতে পারলেন না নিষ্প্রাণ এখানে কী করে চলে এলো! নিষ্প্রাণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকার জন্যই হুট করেই তারা আজ চলে এসেছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে এসেছে রাশেদের। টেবিলের উপর রাখা পানিভর্তি গ্লাস নিয়েই ঢগঢগ করে গিলে ফেলে। অতি দ্রুততার সাথে কাজটি করায় রাশেদের মুখের দু’পাশ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চমকিত হলেন আলফাজ সাহেব। ভ্রু কুঞ্চন করে চেয়ে রইলেন। নিষ্প্রাণ অধরের কোন কিঞ্চিৎ চওড়া করল। আয়েন্দ্রি দুই হাত কচলাতে থাকে। ইচ্ছে করছে এখনই দৌঁড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে নিষ্প্রাণের বুকে!
নিষ্প্রাণ আরিশার সাথে ভেতর ঘরে গেল। আরিশা কাচুমাচু করে বলল—
“আপুর কোনো দোষ নেই। তারাই হঠাৎ করে চলে এলো!”
নিষ্প্রাণ নৈঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। স্নেহার্দ্র গলায় বলল—
“আমি এমনিতেই এসেছি। আপুকে বলো আমি প্রাবিশদের বাসায় আছি। সুযোগ পেলে আসতে। চলি।”
নিষ্প্রাণ দাঁড়াল না। যা সে জানতে এসেছে জানা হয়ে গেছে। নিষ্প্রাণ যখন বের হচ্ছে তাকে দেখে আরেক দফা চমকাল রাশেদ। হাতে থাকা ভাঁজ করা রুমালটা মুখে উপর চাপতে লাগল। নিষ্প্রাণ বাঁকা হাসে।
,
,
,
আয়েন্দ্রির বাবা জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছেন। সময় ব্যয় করল না আয়েন্দ্রি। আরিশাকে নিয়ে প্রাবিশদের বাসায় চলে আসে। দরজা খুলেও নিষ্প্রাণ। হুড়মুড়িয়ে তার বুকের উপর পড়ে আয়েন্দ্রি। সীমান্ত সেখানেই ছিল। বিরক্তি নিয়ে বলল—
“দরজার সামনেই এমন জড়াজড়ি করতাছোস কেন? যা, ঘরে যা।”
নিষ্প্রাণ আলতো করে আয়েন্দ্রির হাত ধরে তাকে প্রাবিশের বোনের কক্ষে নিয়ে আসে। বিছানায় দুইজন পাশাপাশি বসে আছে। আয়েন্দ্রি নীরব, নিস্তব্ধ, নির্লিপ্ত।
বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিল নিষ্প্রাণ। স্বাভাবিক গলায় বলল—
“শাড়িতে সত্যিই তোকে প্রাণহারিনী মনে হয়!”
থমকে থাকা আয়েন্দ্রির উপর যেন কোনো অপার্থিব আত্মা ভর করল! উপর্যুপরি কিল, ঘুষি বসাতে লাগল নিষ্প্রাণের বুকে। কিছুক্ষণ তা নীরবে সহ্য করলেও পরক্ষণেই আয়েন্দ্রিকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে নিষ্প্রাণ। তার মাথাটা চেপে ধরে। আয়েন্দ্রি দুই হাতে আঁকড়ে ধরে নিষ্প্রাণকে। ঝুমঝুমিয়ে কাঁদছে সে। নিষ্প্রাণের অন্তঃরিন্দ্রিয়তে তখন অসহায়ত্ব দুলে চলে। চেষ্টা করেও এই মেয়েটাকে সে মারতে পারছে না। তাকে কষ্টে দেওয়ার অধিকার কারো নেই। এই মেয়েটারও নেই। তবুও সে কষ্ট পাচ্ছে। এই মেয়েটাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। পৈচাশিক হাসে নিষ্প্রাণ। এর থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়। “মৃত্যু!”
চলবে,,,
( বি.দ্র:
সারপ্রাইজ😏😏😏)
চলবে,,,