#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নৈঃশব্দে নির্ঝরিনী গড়িয়ে পড়ছে আয়েন্দ্রির পদ্মলোচন হতে। থেমে থেমে তার ফোয়ারা স্ফীত হতেই বুক কামড়ে ওঠে আয়েন্দ্রির। প্রভাতের মিষ্টি রোদ এসে থাই গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে নিষ্প্রাণের অরঞ্জিত পিঠে। হেঁচকি তুলে কান্না অবদমন করার পূর্ণ প্রয়াসে ব্যস্ত আয়েন্দ্রি বিছানার চাদর খামচে ধরে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। সমানতালে বুকের উঠানামায় হাঁপিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। উচলে আসা স্রোতে তাকে যে ভেসে যেতেই হবে!
ভোরের আকাশে উঁকি দিয়েছে শান্ত সূর্য । গাঢ় অন্ধকারে আবেশিত বসুন্ধরা শান্ত, নরম সূর্যের আলোয় ক্রমশ প্রলীন করছে তার অমানিশি। পত্রীরা মেতে উঠেছে নতুন দিনে। সূর্যের ম্লাণ আলোয় সূর্যস্নানে ব্যস্ত পত্রপল্লব।
ক্লান্ত কায়াটা বিছানার সাথে লেপ্টে আছে নিষ্প্রাণের। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। তার পাশে রোদনে আচ্ছন্ন আয়েন্দ্রি বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না তার ঘুমের। চট করেই চোখ, মুখ মুছে ফেলে আয়েন্দ্রি। অতি সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে কক্ষের দরজার নব নিঃশব্দে ঘুরিয়ে বাইরে চলে আসে। হন্তিদন্তি করে সিঁড়িতে চঞ্চল পা ফেলে নিচে নেমে আসে। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে অজ্ঞাত পাসকোড টিপে তা এন্ট্রি করায়। দুই বার এন্ট্রি করার পরও ইনকারেক্ট পাসওয়ার্ড লেখা দেকেই ডুকরে ওঠে আয়েন্দ্রি। তৃতীয়বার এন্ট্রি চাপ দেওয়ার আগেই ভরাট পুরুষালী কন্ঠে আয়েন্দ্রির ভয়ে অনুরণিত দেহ ঝাড়া মেরে ওঠে। পেছন ফিরতেই দেখল শান্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে নিষ্প্রাণ।
উলুথলু চুল। তন্দ্রালু চোখ। ক্লান্ত শরীর। অলস অভিব্যক্তিতে আড়ষ্ট নিষ্প্রাণকে দেখে আয়েন্দ্রির প্রাণআত্মা পাখা ঝাপটানো শুরু করে। আয়েন্দ্রির সামনে এসে দাড়ায় নিষ্প্রাণ। বৃহৎ হামি দিয়ে ঘুমো ঘুমো গলায় বলল—
“সকাল, সকাল কী শুরু করেছিস বলতো! একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবি না?”
নিষ্প্রাণ দরজার দিকে তাকাল। মগ্ন দৃষ্টি রেখে বলল—
“আরেকবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলেই তো দরজাটা পুরোপুরি লক হয়ে যেতো। তখন কী হতো বলতো?”
আয়েন্দ্রি এতসময় ধুম ধরে থাকলেও সহসা গুমড়ে ওঠে। তার শাড়ির আঁচল কাধ থেকে ছড়িয়ে লুটিয়ে আছে মেঝেতে। খসখসে চুল এলোমেলো হয়ে আছে মুখমন্ডলে। ঠোঁট দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। নিষ্প্রাণের পাগলামি আর নিরবধি কান্না, দুটোর-ই স্বীকার আয়েন্দ্রির কোমল অধর। ভেজা গলদেশে চিকচিক করছে স্বচ্ছ জল। সিক্ত চোখের পল্লব উঠানামা করছে ধীরগতিতে। যেন বেগ বাড়লেই সব ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রগাঢ় মায়া আর নির্নিমিখ চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির ক্রন্দনরত মুখের পানে নিষ্প্রাণ। ট্রাউজারে দুই হাত পুরে রেখেছে। আয়েন্দ্রি চেয়ে আছে নিচের দিকে। তার অশ্রুসিক্ত পল্লব বেয়ে খসে পড়ছে পানি। হাত দিয়ে পায়ের কাছে শাড়ি খামচে ধরেছে। কান্নার কোনো শব্দ নেই। পলে পলে শুধু নাক টেনে যাচ্ছে আয়েন্দ্রি। আয়েন্দ্রিকে এভাবে দেখে কোথাও সুক্ষ্ম ব্যাথার ইঙ্গিত পাচ্ছে নিষ্প্রাণ!
ধীরেসুস্থে পা ফেলে আয়েন্দ্রির সামনে গিয়ে দাড়ায় সে। পকেট থেকে দুই হাত বের করে। আঁজলায় নিয়ে নেয় আয়েন্দ্রির ভেজা, স্যাঁতসেঁতে মুখটা। চোখের পাতা হতে শুষে নেয় নোনতা জল। কপোলের ভেজা আবরণে নিজের গাল ঘষে তা শুষ্ক করে। কপালে ছোঁয়ায় ঠোঁট। আয়েন্দ্রি নির্বিকার। একরাশ মুগ্ধতা আর অপরিমেয় ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরে আয়েন্দ্রিকে। জমাট গলায় বলল—
“তুই কেন আমাকে মেনে নিতে পারছিস না?
তোর শরীর আমাকে মেনে নিয়েছে ধ্রুবতারা। তোর মন কেন আমাকে মেনে নিতে পারছে না?”
আয়েন্দ্রি ঠোঁট চেপে রাখে। দলিত কান্নার দরুন গলা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। তার হেতু বুক কেঁপে যাচ্ছে আয়েন্দ্রির। নিষ্প্রাণের বক্ষ:স্থলের পাটাতনে তা অনুভূত হচ্ছে। নিষ্প্রাণ জোড়ালো বন্ধনে আড়ষ্ট করল আয়েন্দ্রিকে। স্বীকারোক্তিমূলক কন্ঠে বলল—
“আমি কিন্তু সেদিন রোমানকে মারতে চাইনি। কিন্তু কী হয়ে গেল বলতো! তোকে ওই অবস্থায় দেখে আমার মাথা-ই কাজ করা বন্ধ করে দিলো। আর কিছুই ভাবতে পারলাম না আমি। ”
আয়েন্দ্রি ফুঁসলে ওঠে। নিষ্প্রাণকে জোরালো ধাক্কায় নিজের কাছ থেকে সরিয়ে গর্জন করে বলল—
“তাই বলে তুই ওকে খুন করবি? তাও এভাবে? তুই কী মানুষ? তুই একটা পশু! তুই একটা অসুস্থ জানোয়ার!”
নিষ্প্রাণ ঠোঁট কামড়ে মিষ্টি হাসে। চোখ জোড়া প্রশস্ত করে বলল—
“ওয়েল। যদি তোর তাই মনে হয় তাহলে তাই। তবে আমার ধ্রুবতারার দিকে যে তাকাবে তাকে আমি…।”
আয়েন্দ্রির দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিপাত করল নিষ্প্রাণ। আঁতকে ওঠা চোখে চাইল আয়েন্দ্রি। ভয়ে থিতিয়ে গেল সে। নিষ্প্রাণ খুশ মেজাজে তার অধর বলয় করে সিটি বাজাতে থাকে। আয়েন্দ্রি কান চেপে ধরে। তার মনে হলো কেউ তার মাথার মগজে এসিড ঢেলে দিয়েছে। গলে মিশে যাচ্ছে তা। শরীরে ঢুকিয়েছে হাজার সূঁচ। মৃত্যুসম যন্ত্রণা হচ্ছে তার। যন্ত্রণা!
,
,
,
দুই দিনে অনেকটা সজীব হয়েছে আয়েন্দ্রি। তাদের মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। আয়েন্দ্রি এখন ভয় পায়। সত্যিই নিষ্প্রাণ নামের মানুষটাকে সে ভয় পায়!
নিষ্প্রাণের আপাতত কোনো কাজ নেই। সারাক্ষণ পাখির ছানার মতো আয়েন্দ্রির আশেপাশে তার বিচরণ। আয়েন্দ্রিকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা। তার কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে নিজের অভিলাষ পূরণ করা। হুটহাট চুমু খেয়ে নেওয়া। আয়েন্দ্রি বাঁধা দেয় না। তার শরীর মেনে নিয়েছে এই প্রাণহীন মানুষকে। কিন্তু অন্ত:করণে যেখানে এই পুরুষের জন্য ভালোবাসার ছোট্ট ঘর বানিয়েছিল তা ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেখানে আর কোনো ভালোবাসার ঘর উঠবে না।
কাঁচা হলুদ রঙের শাড়িতে মৃদু সমীরণে দোল খাওয়া সর্ষে ফুল মনে হচ্ছে আয়েন্দ্রিকে। কলাপাতা রঙের ব্লাউজের মাঝে দৃশ্যত তার পিঠ। কাউকে বসে ঐকান্তিক দৃষ্টিতে বুঁদ হয়ে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির অনাবৃত পিঠে, তার সংলগ্ন উদরে। রান্নাঘর থেকে খাবার এনে টেবিলে রাখছে আয়েন্দ্রি। তার খোলা চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিরক্ত করছে তাকে।
নিষ্প্রাণের অপলক দৃষ্টি আয়েন্দ্রির খোলা, অবাধ্য চুলে। তার ধ্রুবতারাকে সে ছাড়া অন্য কেউ বিব্রত করতে পারে না!
বিনা শব্দ করে কাউচ থেকে উঠে আসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির অগোচরেই তার পেছনে এসে দাড়ায়। কাজে ব্যস্ত আয়েন্দ্রি চকিতে ধাক্কা খেয়ে থমকে যায়। সমাচ্ছন্ন চাহনি নিষ্প্রাণের। আলতো করে আয়েন্দ্রির চুলগুলো তার কানের পেছনে গুঁজে দেয় নিষ্প্রাণ। প্রশ্ন করে—
“এত তাড়াহুড়ো করছিস কেন? বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোকে।”
নিষ্প্রাণের কথার পিঠে কোনো কথা বলল না আয়েন্দ্রি। যেন সে কোনো মোমের পুতুল। নিষ্প্রাণ যখন ইচ্ছে নিজের উত্তাপে তাকে গলিয়ে দেবে, আবার ইচ্ছে হলেই যে কোনো আকারে রূপ দিয়ে তৈরি করে নেবে!
চেয়ারটাকে নিজের সামনে এনে আয়েন্দ্রিকে বসায় নিষ্প্রাণ। ছোট ছোট লোকমা মুখে পুরে দিতেই তা গিলে নেয় আয়েন্দ্রি। কুন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করে আয়েন্দ্রি—
“কেন করছিস আমার সাথে এমন? তুই যা চেয়েছিস তা তো তুই পেয়েছিস। এবার আমাকে যেতে দে প্রাণ। আমি তো তোর কোনো ক্ষতি করিনি।”
নিষ্প্রাণ বিস্তৃত করল ওষ্ঠাধর। বিগলিত গলায় বলল—
“কী চেয়েছি আমি তোর কাছে?তোর সাথে বিছানা বিলাস করতে? যদি তাই হতো তাহলে প্রথম দিন-ই আমি তা করতে পারতাম। এর পরেও অনেক সুযোগ ছিল। প্রাবিশের বার্থডের কথা মনে আছে?”
ঝমঝমিয়ে কাঁদতে থাকে আয়েন্দ্রি। তার কান্নার মাঝেই নিষ্প্রাণ ভাতের লোকমা ঠুসে দেয় তার মুখে। গলায় আটকে যায় তা। কেঁশে ওঠে আয়েন্দ্রি। পানির গ্লাস নিতেই তা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির শ্বাস আটকে আসে। চোখের পাল্লা প্রশস্ত করে। জল জমে আসে চোখে। যেন মৃত্যু তাকে হাতছানি দিচ্ছে। ছটফটানি শুরু হয় আয়েন্দ্রির। নিষ্প্রাণ ভাবান্তরহীন। কিছু সময় পর আয়েন্দ্রির মুখের সামনে পানি ধরতেই উদ্ভ্রান্তের তা কেড়ে নিয়ে গিলতে থাকে আয়েন্দ্রি। বক্র হাসে নিষ্প্রাণ। সরব গলায় বলল—
“তোকে ছাড়া আমার এমনটাই লাগে। এখন বুঝলি তো কী চাই আমি তোর কাছে!”
আয়েন্দ্রি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণের সতেজ দুই চোখে।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সন্ধ্যার আবছায়া কাটানোর পূর্বেই ঘিরে ধরল অন্ধকার মায়া। নিস্তব্ধ শহরের কোথাও কোথাও হৈ- হুল্লোড় চললেও নিষ্প্রাণের বাড়ির আশপাশ তার মতোই প্রাণহীণ। এই বাড়ির একটা ধূলিকণারও হয়তো সাহস নেই নিষ্প্রাণের অনুমতি ব্যতিত তার ঘরে প্রবেশ করার।
অগোছালো হয়ে তন্দ্রায় নিমগ্ন আয়ন্দ্রি। মেয়েটা এখন রোজ শাড়ি পড়ে। নিজেকে গুটিয়ে রেখে ঘুমালেও কখনো কখনো তার অস্থিতিশীল অবস্থার একমাত্র কারণ হয় নিষ্প্রাণ।
ঘুমন্ত শরীরে কারো স্পর্শে ত্রস্তে ওঠে বসে আয়েন্দ্রি। বিনা সময় ব্যয়ে বড়ো বড়ো কয়েকটা ঢোক গিলে একটু ধাতস্থ হয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে। চোখের সামনে নিজের বোনকে দেখে চকিত হয় সে। ঝপাৎ করে জড়িয়ে ধরে তাকে আয়েন্দ্রি । আরিশা হতভম্ব হয়ে যায় বোনের এহেন আচরণে! কোমল গলায় প্রশ্ন করে—
“কেমন আছ আপু?”
আয়েন্দ্রি প্রাণবন্ত হেসে বলল—
“তুই এখানে কী করে এলি? কখন এসেছিস তুই? ডুকলি কী করে এই বাড়িতে?”
আয়েন্দ্রির অগোছালো প্রশ্নে বিভ্রান্ত হয় আরিশা। চোখ ছোটো করে তাকিয়ে বোনকে দেখে। গাঢ় শ্বাস ফেলে নরম গলায় বলল—
“নিষ্প্রাণ ভাইয়া নিয়ে এসেছে। আমি একা আসিনি। আম্মু, আব্বু আর ভাইয়াকেও নিয়ে এসেছে।”
আয়েন্দ্রি রুদ্ধশ্বাসে বলল—
“কী?”
বিছানা থেকে পাগলের মতো ওঠে আয়েন্দ্রি। তার শান্ত পা জোড়া অশান্ত হয়ে উঠল। টগবগিয়ে চলতে থাকল তা। বিশাল ড্রয়িংরুমে বসে আছে আয়েন্দ্রির বাবা, মা। তারা শঙ্কিত, চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। নিষ্প্রাণ কেন তাদের এখানে নিয়ে এসেছে তা তারা জানে না। শুধু হুকুম তামিল করেছে। আয়েন্দ্রিকে দেখে কাতর হয়ে উঠেন ঝুমা। কাউচ থেকে উঠে গিয়ে অজস্র চুমু খেলেন মেয়ের চোখে, মুখে। সকাতরে বললেন—
“আয়ু, কেমন আছিস মা আমার?”
আয়েন্দ্রি তার বিপরীতে শুধু অশ্রু ঝরালো। মেঘের ঘনঘটায় শুরু হলো না চাওয়া বর্ষণ। আলফাজ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। প্রবল নয় সুক্ষ্ম ব্যথা হচ্ছে তার পিতাসুলভ চিত্তে। কাউচে বসা আলফাজ সাহেব নিঃশ্চুপ রইলেন। আয়েন্দ্রি কান্না ভেজা হাসল। বাবার পায়ের কাছে গিয়ে বলল—
“কেমন আছ বাবা? কথা বলবে না আমার সাথে?”
মেয়ের ছোট্ট অভিমানি আবদারে পাথরমূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ হলো। ভিজে উঠল আলফাজ সাহেবের নেত্রযুগল। গড়িয়ে পড়ল তা। ক্লান্ত মুখে হাসল আয়েন্দ্রি। পূর্বাকাশে উদিত সূর্যের ন্যায় হেসে সোনারোদের মিষ্টি ঝলকানি দিলো আয়েন্দ্রির চোখে। আরাজ বিব্রত, রাগান্বিত, স্তব্ধ। আয়েন্দ্রির চোখের জলে তার সুপ্ত আক্রোশ ক্রমশ প্রকট হচ্ছে তার চোখে, মুখে।
ডাইনিং এ টুংটাং শব্দে তাকাল আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ টেবিল সাজাচ্ছে। আয়েন্দ্রি শশব্যস্ত হয়ে কাছে এলো নিষ্প্রাণের। নিষ্প্রাণ বিগলিত হাসল। উদ্বেলিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে আয়েন্দ্রি—
“কেন এনেছিস আমার বাবা, মাকে? বল, কেন এনেছিস? ওদেরকেও মেরে ফেলতে চাস?”
নিষ্প্রাণ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। কমলা রঙের প্যাকেট থেকে খাবারের বক্সগুলো বের করে সুসজ্জিত করে রাখল টেবিলের উপর। নিষ্প্রাণের নীরবতায় তেতে ওঠে আয়েন্দ্রি। তার শার্ট খামচে ধরে বলল—
“কথা বলছিস না কেন? কেন এনেছিস আমার বাবা, মাকে?”
নিষ্প্রাণ ঠোঁট কামড়ে ধরে আয়েন্দ্রির পরিবারের উৎসুক মানুষগুলোর দিকে তাকাল। তারা সকলে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে। আলতো করে নিজেকে আয়েন্দ্রির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। স্বাভাবিক গলায় বলল—
“তোর মন ভালো নেই তাই এনেছি তাদের। কেন এমন পাগলামি করছিস তুই? মৃত্যু কী এত সোজা? আমি কেন তোর মা, বাবাকে মারব?
আমি শুধু তাদের মারব যারা তোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইবে। আমার তারার আলো ম্লান করতে চাইবে। খেতে বস। আর একটা কথাও বলবি না।”
ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ টেবিলে খাবার গুছাতে গুছাতে বলল—
“আপনারাও আসুন। আরাজ, আরিশা এসো।”
কলের পুতুলের মতো এগিয়ে এলো সবাই। নিষ্প্রাণের পাশ টেবিলেই বসল আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ সরু গলায় বলল—
” দেখুন মা, আমাদের সবাইর একটা কালো অতীত থাকে। আমারটা না হয় একটু বেশিই কালো। কিন্তু তার আঁচ আমি আমার ধ্রুবতারার গায়ে লাগতে দেবো না।”
নিষ্প্রাণ মুখ তুলে তাকাল। আলফাজ সাহেব কিছু ভেবে চলছেন। নিষ্প্রাণের নিরেট গলায় তার ধ্যান ভাঙল।
“এখন তো আমি আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি। আমি জানি আপনার মেয়ে আমাকে ঘৃণা করে। আপনারাও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু একবার ভাবুন তো, আমাকে ঘৃণা করেও আমৃত্যু ও আমার সাথে থাকতে পারবে কিন্ত নিজেকে ঘৃণা করে ও কতদিন বাঁচতে পারত? সেদিন যদি আমার আসতে আরেকটু দেরি হতো তাহলে কী হতো? আজ ও আমাকে ঘৃণা করছে, কিন্তু সেদিন যদি আমি না আসতাম তাহলে আজ ও নিজেকে ঘৃণা করত। আমাকে দূরে সরাতে পারলেও নিজেকে কী করে সরাতো? ”
আলফাজ সাহেবের মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না। অস্তায়মান সূর্যের ধূসর আকাশের মতো তিনি নির্বিকার চেয়ে রইলেন। কাঁটাচামচ দিয়ে চিকেন কাটলেটের টুকরোটা মুখে দিয়েই নিষ্প্রাণ পূনরায় বলল—
“আমি না হয় ওকে পাগলের মতো ভালোবাসি তাই হয়তো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি। তবুও আমি আছি। কিন্তু সেদিন যদি ধ্রুবতারার সাথে কিছু হয়ে যেতো তাহলে কী আপনারা ওকে বাঁচাতে পারতেন? দুই বছর পরও তো ও আছে। কিন্তু সেদিন যদি ওর গায়ে ওই নরপশু থাবা বসাত তখন!
তখন কী করতেন আপনারা? কী করত আপনাদের মেয়ে? গলায় দড়ি দিতো? বিষ খেয়ে নিতো? না- কি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ত?”
নিষ্প্রাণের মুখ হতে অবলীলায় নিঃসৃত হৃদয়বিদারক কথাগুলো হজম করতে বেগ পেতে হলো সকলের! বিশেষ করে আয়েন্দ্রির। তার ছলছল আঁখি বিদ্ধ হলো নিষ্প্রাণে সরল মুখে।
নিষ্প্রাণ পানির গ্লাসে চুমুক দিলো। তার বুঝতে বাকি নেই, উপস্থিত পাঁচ জোড়া অক্ষি তার দিকে অধীর আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। নিষ্প্রাণ গ্লাস রাখল। মিষ্টি করে হাসল। তার আচরণে সকলের চোখে আরশিতে উড়তে লাগল ডজন খানেক এলোথেলো প্রশ্ন। নিষ্প্রাণ সরব গলায় বলে উঠে—
“রোমানকে হয়তো একটু বেশিই নির্মম মৃত্যু দিয়েছি! কী করতাম বলুন! যাকে ভালোবেসে নিজের করে পাওয়ার আগে তার দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকাতেও আমি দ্বিতীয়বার ভাবতাম ও তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে। অবশ্য ওকে আমি বেশি কষ্ট দেইনি। তবে এক্ষেত্রে ওকে আমি দ্বিতীয় সুযোগ দেইনি। সুযোগ সেই ক্ষেত্রে দেওয়া যায় যেখানে শুধরানোর অবকাশ থাকে।
স্কুলে যখন কোনো বাচ্চা আরেক বাচ্চার বই ছিঁড়ে ফেলে তখন সেই বই টেপ বা আঠা দিয়ে লাগানো যায়। তখন শিক্ষক সেই বাচ্চাকে ওয়ার্নিং দিয়ে সাবধান করেন যেন পরবর্তীতে সে এ ভুল আর না করে। কিন্তু রোমান যা করতে চেয়েছে তা শুধরানোর ক্ষমতা কারো থাকত না। ও যদি আমার ধ্রুবতারা আলো কেড়ে নিতো তাহলে সে আলো পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়ে ওকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারতাম না। ”
নিষ্প্রাণ থামল। দ্যুতিহীন চোখে চাইল আয়েন্দ্রির দিকে। টলটলে গলায় বলল—
” আমাকে মেনে নিতে তোর যতটা কষ্ট হচ্ছে সেই জায়গায় রোমানকে মেনে নিতে এর চেয়ে হাজার গুন বেশি কষ্ট হতো। বাকিটা তোর ইচ্ছে।”
নিস্তব্ধ পরিবেশ আরও নিস্তব্ধ হলো। নিষ্প্রাণের বলা প্রতিটা শব্দ আয়েন্দ্রিকে শুরু থেকে ভাবতে বাধ্য করল। আলফাজ সাহেব নীরব রইলেন। উগরানো কথাগুলো পূনরায় গিলে নিতে বাধ্য হলেন তিনি।
,
,
,
সফেদ রঙের বেডশিটের উপর ছাই রঙা প্রলেপ। ছোটো ছোটো তারার আকৃতির সমাবেশ। অন্ধকার ঘরে বসে আছে আয়েন্দ্রি। অস্পষ্ট, আবছায়ায় তার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে না। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবিষ্ট হয় নিষ্প্রাণ। ঘরের অন্ধকার দূরীকরণের নিমিত্তে কৃত্রিম বাতির সুইচটা অন করে। বিছানার হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে আয়েন্দ্রি। তমসা কাটিয়ে উজ্জ্বল আলোক রশ্মি তার চোখে লাগতেই কনকন করে ওঠে। আয়েন্দ্রি টিমটিমে চোখে তাকায়। তার পরিবারকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে মাত্রই ফিরেছে নিষ্প্রাণ।
গায়ের শার্টটা খুলে ঝুড়িতে রাখে। তোয়ালে নিয়ে ঢোকে ওয়াশরুমে। বের হয়ে আসে মিনিট দশেক পর। আয়েন্দ্রি এখনো সেভাবেই বসে আছে। নিষ্প্রাণকে দেখছে সে। ছেলেটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে দুই বছরে। চোয়াল ভরেছে। গুছাল হয়েছে। আগের চেয়ে শক্ত হয়েছে অনেক। নিষ্প্রাণের বুকের দিকে তাকিয়ে চোখ সরায় আয়েন্দ্রি। ছেলেটার শরীরে তার- ই নখের আঁচড় জ্বলজ্বল করছে। জানালা বন্ধ করে নিষ্প্রাণ। শান্ত গলায় বলল—
“বসে আছিস কেন? ঘুমিয়ে পড়। রাত অনেক হয়েছে।”
“তুই বাবা, মাকে কেন এনেছিলি?”
আয়েন্দ্রির প্রশ্নে বিন্দুমাত্রও চমকাল না নিষ্প্রাণ। তাকে দেখে মনে হলো হয়তো সে জানত আয়েন্দ্রি এই প্রশ্নটা করবে। দরজা, জানালা বন্ধ করে এসি অন করে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির সামনে গিয়ে বসে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে শ্রান্ত গলায় বলল—
” তোকে দাদুর কাছে নিয়ে যাব। অনেকদিন থাকব আমার ওখানে। তাই ভাবলাম বাবা, মায়ের সাথে দেখা করিয়ে নেই। দাদু তোকে দেখলে খুশি হবে।”
নিস্পৃহ গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—
“কেন? আমি কী শোপিস, যে আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবি?”
“তুই আমার ভালোবাসারে পাগলি। আমার ভালোবাসা তুই। এই প্রাণের প্রাণস্পন্দন তুই।”
আয়েন্দ্রি চাপা রাগের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বলল—
“এই জন্যই বুঝি দুই বছর আমাকে মেন্টালি টর্চার করেছিস! তোর কারণে একটা রাতও আমি ঘুমাতে পারিনি। শ্বাস নিতে পারিনি আমি। এই তোর ভালোবাসা?”
নিষ্প্রাণ আবেশিত গলায় বলল—
“তুই তো আমাকে ভুলতে চেয়েছিলি! কী করে ভুলতে দেই তোকে আমি? আমি- ই তোকে ভালোবেসেছি, কিন্তু তুই আমাকে ভালোবাসতে পারিসনি। তা না হলে সারকের দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হতে পারতি না!”
গলা ধাক্কিয়ে কান্না শুরু করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ তার চিরায়ত কাজ করে। সিটির সুর তোলে তার ওষ্ঠাধরে। আয়েন্দ্রি কান চেপে ধরে। সরোষে বলল—
“বন্ধ কর, বন্ধ কর তোর এই সিটি। সহ্য হচ্ছে না আমার। ভুলতে দে আমাকে এসব।”
নিমীলিত চোখে আচ্ছন্নের মতো রোদনে মত্ত হয় আয়েন্দ্রি। তার কম্পিত অধরে অনিমেষ চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণের চক্ষু দর্পণে ভেসে ওঠে নয়নতারার সেই পাতলা ঠোঁট। সেই লাল তিল। নয়নতারার মৃত শরীর যখন পড়ে ছিল নিষ্প্রাণের সামনে তার ঠোঁটে প্রথমবারের মতো চুমু খেয়েছিল নিষ্প্রাণ। নিথর শরীরটাকে ধরে জীবনের শেষ বারের মতো সেদিন কেঁদেছিল নিষ্প্রাণ। এরপর আর কখনো তার চোখে জল আসেনি। কাঁদতে হয়নি তাকে।
আয়েন্দ্রির অধর চুম্বকের মতো টানছে নিষ্প্রাণকে। রোদনে আচ্ছন্ন কামিনীর কোমল অধরে ভয়ংকর চুমু বসাল নিষ্প্রাণ।
চলবে,,,
চলবে,,,