প্রিয়ংবদা পর্ব ১৯

#প্রিয়ংবদা
#উনবিংশ_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

অপরাহ্নের শেষাংশ!কমলাটে রবি দিগন্তের শেষ প্রান্তে বিলীন হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল।তবে পৃথিবীকে নিজের জ্যোতি থেকে বঞ্চিত করেনি তখনও!খানিক আগেই অস্ত যাওয়া পশ্চিম আকাশটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সিঁদুররাঙা জিমূত!
সেই লালচে আকাশের নিচে ফাঁকা পিচঢালা রাস্তার ওপরেই পাশাপাশি হেঁটে চলেছে এক প্রেমিক যুগল!দুজনের হাতে হাত রেখে খুব ভরসায় পড়ছে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ!
পথ চলার মাঝে হঠাৎ আদৃত ডেকে ওঠে,
“হৃদ!”

হৃদিতা রক্তিম গগনের বুকে চোখ মেলেছিল!হঠাৎ আদৃতের ডাকে তার দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকালো। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করে,
“হুম!কিছু বলবেন?”

আদৃত মাথা নেড়ে সায় জানাতেই হৃদিতা সম্মতিসূচক হেসে বলে,
“আচ্ছা। বলুন!”

আদৃতের অকপট জবাব,
“ভালোবাসি আপনাকে হৃদ!”

হৃদিতা লাজুক হেসে চোখ সরায়।লজ্জার লালচে আভায় ভরে যায় কোমল কপোলদ্বয়!আদৃত সে লজ্জা আরো বাড়িয়ে দিতেই আগুনে ঘি ঢালার মতো পুনরায় বলে ওঠে,
“আপনি এত লজ্জা কেন পান হৃদ?এত লজ্জা পাবেন না তো!এখনই এত লজ্জা পাচ্ছেন সামান্য ভালোবাসার স্বীকারোক্তি শুনে!বিয়ের পরে যখন সেই স্বীকার করা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তা আপনারই ওপরে প্রয়োগ করা হবে, তখন কি করবেন হৃদ?”

হৃদিতা এবারে দুহাতে মুখ ঢেকে নেয়!লুকনো মুখের আড়ালেই চাপা পড়ে যায় তার লজ্জা রাঙা হাসি!ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাসের যাতায়াত!

তবে আদৃত বুঝে যায়! হৃদিতার মুখ ঢেকে রাখা হাত দুটোর ওপরে হাত রাখে খুব যত্নে!তারপর তার কাছ ঘেষে দাঁড়ায়! একদম কাছে!খুব খুব খুব কাছে!
হৃদিতা কেঁপে ওঠে! হৃৎস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পায় মুহূর্তেই।আদৃতের শ্বাসবায়ু ছড়িয়ে পড়ে গলায়, কপালে, হাতের ওপরে সর্বত্র!
হৃদিতা সারা শরীরে কোন জোড় পায়না আর। কেমন যেন অসাড় হয়ে আসে ক্ষণেই!আদৃত মুখ থেকে হাত দুখানা সরিয়ে দেয় অনায়াসেই!
হৃদিতার বদ্ধ আঁখিপল্লব কম্পিত হচ্ছে তখনও!আদৃত দ্বিতীয়বারের মতো আপন ওষ্ঠের হালকা স্পর্শ এঁকে দিয়েই আবার সরে দাঁড়ায় ইঞ্চি চারেক দূরত্বে!
হৃদিতা চোখ মেলে চায়! আচমকা ঘটা ঘটনার স্মৃতিচারণ বারবার ঘুরপাক খায় মস্তিষ্কের প্রতিটা শিরা-উপশিরায়! হতবাক দৃষ্টিতে আদৃতের দিকে তাকিয়ে তদাপেক্ষা অবাক স্বরে প্রশ্ন করে,
“এটা কি করলেন আদৃতবাবু?আমি কি ঠিক বুঝলাম?ইউ হ্যাভ কিসড মি?”

আদৃত ওপর-নিচে মাথা নাড়তেই হৃদিতা ঘনঘন পলক ফেলে অবিশ্বাস্য স্বরে স্বগোতক্তি করে,
“সত্যি! ”

আদৃত হেসে ফেলে। হৃদিতার দুবাহু ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয় আবারো। তারপর ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
“একদম সত্যি, সত্যি,সত্যি! ”
হৃদিতার চোখে তখনও অবিশ্বাস!আদৃত তা দেখে আবারো হাসে।দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বলে ওঠে,
“বিশ্বাস হয় না?আবার করে দেখাবো?”

হৃদিতা বড় বড় চোখ করে তাকায়! খুব দ্রুত ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়!আদৃত এবারটা উচ্চস্বরে হেসে ফেলে।উন্মুক্ত আকাশ,দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ,সন্ধ্যের আগমণে ঘর ফিরতি বিহঙ্গ দল, সকলে সাক্ষী হয়ে রয় সেই মোহনীয় হাসির।জনশূন্য পথটার চারিধারে বার কয়েক ঝংকার তুলেই তা মিলিয়ে যায় হাওয়ায়!
হৃদিতার দীঘল নয়নজোড়া মুগ্ধতায় ছেয়ে যায়!সামনে দাঁড়ানো যুবকটির সবকিছুতেই সে মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর হতে থাকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে!
আদৃত সে মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে হাত নাড়ায়।বিভোর দৃষ্টির ঘোর কাটে!হৃদিতা চকিতে তাকায়। আদৃত ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি দেখেন?”

হৃদিতা অপ্রস্তুত হেসে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“কিছু না!”
আদৃত মেনে নেয়!তারপরে হৃদিতার ডান হাতটাকে নিজের বাঁহাতের মুঠোয় ভরে সামনের দিকে এগোতে এগোতে বলে ওঠে,
“সন্ধ্যা নেমে গেল হৃদ। বাড়ি ফিরতে হবে। তাড়াতাড়ি পা চালান!”

হৃদিতা কথা শোনে। আদৃতের সাথে একতালে হেঁটে চলে বাড়ি ফেরার পথে!
ততক্ষণে দিনের আলোর পুরোটাই ক্ষয়ে গেছে রাত্রির প্রগাঢ় অন্ধকারে। সায়াহ্নবেলার কালচে গগণের এককোণে ঠাঁই নিয়েছে নবমীর বাঁকা শশী!
একটা দুটো তারাও মিটমিটিয়ে জ্বলছে তারই আশেপাশে!
আদৃত আর হৃদিতা তারই ক্ষীণ আলোতে এসে পৌঁছে “খাই-খাই হোটেল”-এর মোড়ে।হোটেলের বাইরেটা তখন ফাঁকা!কোন ক্রেতার যাতায়াত নেই বললেই চলে। বাইরে টাঙানো বিশাল সাইনবোর্ডটাতে হরেক রঙের আলোকসজ্জায় ” হোটেল খাই-খাই” লেখাটা জ্বলজ্বল করছে যেন!পাশের পানের দোকানটার সামনেটাও তখন খালি।দোকানের টিনের ঝাপটার এক কোণে টিমটিমে একটা হলদে বাল্ব জ্বলে আছে মোমের মতো! সেই আলোতেই দোকানি দোকানের সামনে ধূপকাঠি জ্বেলে রেখে দিলেন একটা কোণে।
আদৃত সেদিকে এগোলো।হৃদিতা অবাক হলেও প্রশ্ন করলোনা একটাও!সাথে সাথে সেও গিয়ে দাঁড়ালো দোকানের সামনে!
দোকানি তখন মোটা লোহার সস্তায় সুপুরি কাটতে ব্যস্ত। আদৃত ডাক দেয়,
“মামা!”
দোকানি চোখ তুলে চায়। একগাল হেসে উত্তর দেয়,
“হ বাবা, কিছু কইবা?”
আদৃত নম্র কন্ঠে বলে,
“তিনটে পান দিন তো,ভালো করে মিষ্টি জর্দা দিয়ে! আর সুপুরিটা ভালো দেবেন। যেন মাথায় না ধরে!”

পানের দোকানি সপ্রতিভ হেসে ঘাড় বাঁকায়!দক্ষ হাতে মিনিটেই বানিয়ে ফেলে তিনটে পানের খিলি। আদৃতের দিকে সেগুলো বাড়িয়ে দিতে দিতেই হৃদিতাকে এক পলক দেখে নেন তিনি। পান খেয়ে লাল টুকটুকে দাঁত গুলো বের করে খুশিমনে জিজ্ঞেস করে,
“ভালা আছো আম্মু?”
হৃদিতা মিষ্টি হেসে বলে ওঠে,
“আমি ভালো আছি! আপনি কেমন আছেন?”
দোকানি আবারো হাসিমুখে উত্তর দেয়,
“হ আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালাই আছি আম্মু!”
হৃদিতা হাসে!আদৃত তাদের কথোপকথনের সমাপ্তিতে দোকানির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছোড়ে,
“কত টাকা হলো মামা?”
দোকানদার পূর্বের মতো হাসি বজায় রেখে উত্তর দেয়,
“পনের! ”
আদৃত হাসিমুখে এগিয়ে দেয় একটা ১০ টাকা, আরেকটা ৫ টাকার নোট।
দোকানি হাত বাড়িয়ে তা নিতে নিতেই জিজ্ঞেস করে,
“এই আম্মু তোমার কি হয় বাবা?”

আদৃত একপলক হৃদিতার দিকে তাকায়!হালকা হেসে বলে,
“এখনো অবধি তো কেবলই ওর বাবা-মার গচ্ছিত সম্পদ মামা!তবে খুব শীঘ্রই বউ হয়ে যাবে!
দোয়া রাখবেন!”

দোকানি সপ্রতিভ হেসে জবাব দেয়,
“হ নিশ্চয়ই! ফি-আমানিল্লাহ! ”

আদৃত-হৃদিতা চলে আসে কাঁচা রাস্তাটার সামনে।হৃদিতা এবারে কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলে,
“আপনি হঠাৎ পান কেন নিলেন?কে খাবে?মা-বাবা তো সচরাচর পান খায়না।যদি কোন অনুষ্ঠান থাকে তখন খায় যা এক আধটা। তবে আজ কেন? ”

আদৃত মুচকি হেসে বলে ওঠে,
“সারপ্রাইজ! ”
.
হৃদিতার বাড়ি!ড্রয়িংরুমের বড় সোফাটায় পাশাপাশি বসে আছেন, আশুতোষবাবু ও ঋতমবাবু!দুজনেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন অনবরত!অন্বেষা বসে আছে দাদুর ঠিক পাশের সিঙ্গেল সোফাটায়!ঋতমবাবু আর আশুতোষবাবুর এমন গুরুগম্ভীর আলোচনার জেরে তার কর্ণে তালা পড়ার মতো অবস্থা! অলস নয়নে তাকিয়ে সেসব গম্ভীর আলোচনাই গলধকরণ করতে হচ্ছে তাকে। তাছাড়া তো উপায় নেই!
টাপুর দেবী রান্নাঘরে। কড়াইতে খুন্তি চালানোর টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে সেদিক থেকেই!
দরজা চাপিয়ে রাখাই ছিল।হৃদিতা তা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আসতেই হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সামনে বসে থাকা আশুতোষবাবু ও অন্বেষার দিকে!তার দিকে একনজর তাকিয়ে ঋতমবাবু ও আশুতোষবাবু আবারো ডুব দেয় তাদের গম্ভীর আলোচনায়!তবে উঠে দাঁড়ায় অন্বেষা। সে হৃদিতার সামনে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আলতো করে। হৃদিতা একপলক আদৃতের দিকে তাকিয়ে আবারো অন্বেষার দিকে তাকাতেই অন্বেষা হালকা হেসে প্রশ্ন ছোড়ে,
“তুমি তো হৃদ?মানে হৃদিতা তাইনা?”

হৃদিতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।অন্বেষা আবারো শুধায়,
“আমাকে চেনোনি তাইতো?”
হৃদিতা বোকা বোকা চাহুনিতে না বোধক ইশারা করতেই অন্বেষা একগাল হেসে বলে ওঠে,
“আমি অন্বেষা, অন্বেষা সেন!তোমার আদৃতবাবু মানে দাভাইয়ের বোন!
আমি কিন্তু তোমার সাথেই পড়ি!একসাথেই পরীক্ষা দেব!তাই তোমাকে নাম ধরেই ডাকছি!জানি, বৌদিভাই হবে!তবুও, আমি নাম ধরেই ডাকবো!তোমার কোন সমস্যা নেই তো?”

হৃদিতা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হেসে উত্তর দেয়,
“না,সমস্যা নেই!ডেকো নাম ধরেই!”
অন্বেষা খুশি হয়!মুখে থাকা হাসি বজায় রেখেই বলে,
“আমাকে তুমি অনু ডাকতে পারো হৃদ!অন্বেষা ইজ আ বিগ নেইম। অনু ইজ শর্ট টু কল!”

হৃদিতা এবারে স্বাভাবিক হয়ে আসে। অন্বেষা মেয়েটির খুব দ্রুত মিশে যাবার গুণটাই তার মনে ধরে যায় খুব।
মিনিট কয়েকের মাঝেই হৃদিতা আর অন্বেষার মাঝে গড়ে ওঠে গভীর সখ্যতা। তাদের গল্প,হাসি,দুষ্টুমি সবটাই ছাপিয়ে যায় প্রথম আলাপের সীমা। দেখে মনে হতে থাকে যেন কত দিনের বন্ধু দুজনে!
আদৃত হাসে। ঋতমবাবু বেশকিছুক্ষণ মেয়ের হাসিখুশি মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক!জীবনে প্রথমবারের মতো বাস্তবিক বন্ধুত্বের সাহচর্যে তার রাজকন্যাটি যে বসন্তে ফোঁটা পুষ্পকুড়ির মতোই ঝলমল করছে তা দেখে প্রসন্ন হয় পিতৃহিয়া!
গল্পের মাঝেই টাপুর দেবী হাতে জলখাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকেন!সেন্টার টেবিলের ওপরে খাবার গুলো নামিয়ে রেখে খেতে শুরু করতে বলেন সকলকে।
হৃদিতা উঠে পড়ে। টাপুর দেবী খেতে বসার জন্য বলতেই সে চটপট উত্তর দেয়,
“আমি এখন খাবো না!বাকিরা খাক!খিদে পেলে পরে খাবো।”
টাপুর দেবী কথা বাড়ান না।
খাবার মুখে তোলে সকলেই। ঋতমবাবু স্ত্রীকে চোখের ইশারায় কিছু বলতেই টাপুর দেবী হৃদকে বলে ওঠেন,
“হৃদ!আয় তো আমার সাথে ঘরে।কাজ আছে!”
হৃদিতা বাধ্য মেয়েটির মতো চলে যায় মায়ের সাথে।
ও চলে যেতেই ঋতমবাবুর উদ্দেশ্যে আদৃত প্রশ্ন ছোড়ে,
“ও কি জানে আঙ্কেল! ”
ঋতমবাবু মাথা নেড়ে বলেন,
“না না।তুমি বললে না চমকে দেবে।তাই বলিনি!তৈরি হয়ে আসুক।তখনই জানবে!”
.
হৃদিতাকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই টাপুর দেবী দরজাটা লাগিয়ে দেন। কাবার্ডের দিকে গিয়ে বের করেন লাল পাড় কালো একটা তাঁতের শাড়ি!হৃদিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“শাড়ি বের করছো কেন মা?কি হবে?”

টাপুর দেবী শাড়ির ভাজ খুলতে খুলতে উত্তর দেন,
“তোকে পড়াবো!”
হৃদিতার অবাক হবার মাত্রা বেড়ে যায়।সে ভ্রু কুচকে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে? কেন?হঠাৎ শাড়ি পড়াবে কেন?”

টাপুর দেবী হালকা হেসে উত্তর দেন,
“সারপ্রাইজ!”

হৃদিতা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে।টাপুর দেবী সেদিকে ধ্যান না দিয়ে মেয়েকে খুব যত্ন করে পড়িয়ে দেন শাড়িটা!শাড়ির কুচিগুলো হৃদিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাড়ের দিক থেকে প্রতিটা কুচিতে টান মেরে তা সোজা করে নিয়ে গুঁজতে বলে।হৃদিতা তাই করে!তবে মাথায় ঘুরপাক খায় একটাই প্রশ্ন,”সারপ্রাইজ! কি সারপ্রাইজ? আর আজ কি যে সবাই সারপ্রাইজের ওপর সারপ্রাইজ দিতে চাইছে!”
কিন্তু মুখ ফুটে প্রশ্ন করা হয়না।
টাপুর দেবী শাড়ির আঁচলটা থাকে থাকে ভাজ করে কাধের ওপরে সেফটিপিনে আটকে দেন!ছেড়ে রাখা চুলগুলো মধ্য সিঁথি করে খুব যত্নে বেঁধে দেন হাত খোপা।কাদম্বিনী দেবীর সাথে দেখা করতে যাবার আগে আদৃতের এনে রাখা বেলীর গাঁজরাটা আলতো করে জড়িয়ে দেয় খোপায়!
তারপরে আলমারির লকার খোলেন তিনি। মেয়ের জন্য জমিয়ে রাখা গয়নার বাক্সটা বের করে এনে রাখেন বিছানার ওপর!সেখান থেকেই মনমতো একজোড়া কানের ঝুমকো, আর একটা হার বের করে পড়িয়ে দেন হৃদিতার গায়ে!একজোড়া বালা বের করে হাতে পড়িয়ে দিয়ে বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা কেটে নেন দাঁতে!
বিরিবির করে বলেন,
” যেন কারো নজর না লাগে!”
তারপর হৃদিতাকে দাঁড় করিয়ে মাথায় আচল টেনে ঘোমটা দিয়ে দেন তিনি।
মেয়েকে সাজিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলেন,
“আমি যাচ্ছি! তুই আস্তে আস্তে আয়!ঘোমটা দিয়ে রাখবি!”
হৃদিতা মায়ের কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরেও সম্মতি জানায়!যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াতেই কি মনে করে যেন আয়নার সামনে দাঁড়ায়! ড্রেসিংটেবিলের এককোণে আদৃতের দেয়া সেই কালো টিপের পাতাটা থেকে একটা টিপ তুলে পড়ে নেয় কপালে!
মনে পড়ে পড়ে আদৃতের বলা সেই অনুনয়ের সুর,
“আপনি সবসময় কালো টিপ পড়বেন হৃদ! কালো টিপে আপনাকে খুব সুন্দর মানায়,একদম রাজকুমারীর মতো!প্লিজ পড়বেন!”
হৃদিতা হেসে ফেলে। মনে মনে কল্পনা করে, তাকে এই রুপে দেখে আদৃতের প্রণয়রাঙা দৃষ্টি যা থেকে অঝোরে ঝরে পড়ে লজ্জারাঙা তীর!আর সেই তীরের ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় হৃদিতার সুপ্ত সকল লজ্জা!
হৃদিতা নিজের মনেই লাজুক হাসে। তারপর মায়ের কথা মতো পা চালিয়ে চলে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে!
.
ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াতেই হৃদের চোখ পড়ে আদৃতের। সে চোখের গভীর দৃষ্টি হৃদিতার লজ্জার পারদ চড়িয়ে দেয় তুঙ্গে! হৃদিতা চোখ নামায়,তাকায় না আর।
আশুতোষবাবু হালকা হেসে বলতে শুরু করেন,
“আচ্ছা, ঋতম!মেয়ে তো তৈরী!তাহলে তুমি বললে এবারে আশির্বাদের কাজটা সেড়ে নিই?”
ঋতমবাবু সম্মতিসূচক হাসেন।
হৃদিতা এতক্ষণে বুঝতে পারে, এত আয়োজনের কারণ!আজ তাদের আশির্বাদ!তার আদৃতবাবুর সাথে বাঁধা পড়ার প্রথম ধাপ!!
আর প্ল্যান টা যে আদৃতের তা বুঝতে একটুও সময় লাগে না হৃদিতার!
সে আড়চোখে একবার আদৃতের দিকে তাকাতেই দেখে সে এখনো তার দিকে তাকিয়ে, নিষ্পলক ভাবে!
হৃদিতা তড়িঘড়ি চোখ সরায় দ্বিতীয় বারের মতো! আদৃত চাপা হাসে।
ঋতমবাবু টাপুর দেবীকে ইশারা করতেই তিনি, প্রদীপ,ধান,দূর্বাতে সাজানো একটা কাসার থালা নিয়ে এসে রাখে টেবিলের ওপর।ঋতমবাবু উঠে দাঁড়ান। আদৃতের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার মাথায় ধান-দূর্বা দিয়ে আশির্বাদ করে পকেট হাতরে বের করেন একটা লম্বা মতোন লাল রঙা বক্স!সেটা দু হাতে খুলতেই দৃষ্টিগোচর হয় একখানি স্বর্ণের চেইন! আদৃতের গলায় চেইনটা পড়িয়ে দিয়ে তিনি আদৃতের মাথায় হাত রেখে স্নেহময় কন্ঠে বলে ওঠেন,
“আশির্বাদ করি সুখী হও বাবা!আর আমার মেয়েটাকে দেখে রেখ। ”
আদৃত ঋতমবাবুর পায়ে হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে নেয়!বিনম্র স্বরে স্বগোতক্তি করে,
“নিশ্চয়ই আঙ্কেল! হৃদকে আমৃত্যু দেখে রাখার দায়িত্ব নিয়েছি আমি। আর আজ কথা দিচ্ছি আপনাকে, সে দায়িত্ব সারাজীবন পালন করে যাব!”
ঋতমবাবু হেসে সরে আসেন।
এবারে আশির্বাদ করেন টাপুর দেবী!তারপরে হৃদিতাকে বসানো হয় আশুতোষ বাবুর পাশে। আশুতোষ বাবু, নাতবৌটিকে আশির্বাদ করে তার হাতে পড়িয়ে দেন, মোটা একখানি চূর!বাৎসল্যমন্ডিত স্বরে বলেন,
“এটা আমার ঠাম্মির!তিনি দিয়েছিলেন আমার মাকে, আমার মা আমার স্ত্রীকে, আমার স্ত্রী দিয়েছিলেন আমার বৌমাকে আর বংশানুক্রমে আমি তোমাকে দিলাম!যত্নে রেখ দিদি!তুমি পরে তোমার পরবর্তী প্রজন্মকে দিও!”
হৃদিতার হঠাৎই মন খারাপ হয়ে যায়! সে টলমলে চোখে প্রশ্ন করে,
“কিন্তু, আমাকে তো দেবার কথা ছিল আপনার বৌমার দাদু!উনি কেন দিলেন না?আমাকে কি ওনার পছন্দ নয়?”

আশুতোষ বাবু স্নেহার্দ্র পরশ বুলালেন হৃদিতার মাথায়। তারপরে বললেন,
“পাগল মেয়ে। পছন্দ হবে না কেন?
আসলে আদৃত বৌমাকে তোমার বিষয়ে কিছু না বললেও আমি জানিয়েছিলাম সবটাই!ও কোন দ্বিমত রাখেনি!
ওই নিজের হাতে গয়নাটা তোমাকে দেবার জন্য আমার হাতে তুলে দিয়েছে,তবে আদৃত তো ওর সাথে আজও কথা বলেনা, অনু দিদিভাইও না, সেজন্যই আর আসেনি আমাদের সাথে! ওর তোমাকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই দিদি!”
হৃদিতা কিছুটা শান্ত হয়!চূরটার দিকে তাকিয়ে কি মনে করে আবার শুধায়,
“আর আঙ্কেল? ”
আশুতোষ বাবু হেসে জবাব দেন,
“ওও জানে। ও আসতেও চেয়েছিল। তবে একটা বিজনেস মিটিংয়ের জন্য ও আপাতত আউট অফ দা সিটি।তাই আসতে পারলো না!”

হৃদিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়,
“ওহ্!”
আশুতোষবাবু হয়তো বুঝতে পারেন হৃদিতার মনের ভাব। তাই তিনি তাকে আস্বস্ত স্বরে বলে ওঠেন,
“চিন্তা নেই দিদিভাই!তোমাকে বুঝে গেলে তোমায় ভালো না বেসে থাকাই যায় না!তাই তোমার যদি মনে হয় কেউ তোমাকে মানতে পারছে না, তখন তুমি নিজের গুণেই তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করে ফেলবে তাকে।
তবে আমার মনে হয় না তেমনটা করতে হবে!তোমাকে মেনে নিতে আমার পু্ত্রবধু আর কোন দ্বিধা করবে না।তিন বছর আগে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি ও আর করবেনা বলেই আমার বিশ্বাস।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো!”

হৃদিতা আশুতোষ বাবুর কথা শুনে ম্লান হাসে!আদৃতের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখে সে সাবলীল, যেন এসবের কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।
হৃদিতা তপ্তশ্বাস ফেলে আপন মনেই স্বগোতক্তি করে,
“উনি কি সত্যিই আমাকে মানতে পারবেন? নিজ চোখে দেখার পরে, কালো আমিটাকে কি ওনার নিজের পুত্রবধু করার অযোগ্য মনে হবে না?”

উত্তরহীন এই গোলমেলে প্রশ্নটা বারংবার মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরণে বাঁধা পেয়ে আবারো হৃদিতাকে ডুবিয়ে দিয়ে যায় বিশ্রী এক চিন্তায়। আর সেই চিন্তাই ক্রমে দুশ্চিন্তা হয়ে উঠে উদগ্রীব করে তোলে দেহ, মন, সব!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here