প্রিয়ংবদা পর্ব ২২

#প্রিয়ংবদা
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

২২.

“মেঘকুঞ্জ!” বিশাল লোহার ফটকটার বাইরেই বাঁধিয়ে রাখা নেমপ্লেটটাতেই জ্বলজ্বল করছে বাড়ির নামটা!হৃদিতা গাড়ি থেকে নেমে বেশ ক’বার মনে মনে আওড়ে নিল নামটা!
দিদা,আদৃতবাবু সবার মুখে বহুবার শুনেছে!তবে আজ প্রথম সে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেঘকুঞ্জের সামনেই,একদম সশরীরে!
আদৃতের ডাকে ঘোর কাটে হৃদিতার!পাশ ফিরে মুখের দিকে তাকাতেই আদৃত হৃদিতার ডান হাতটা বন্দী করে নিজের হাতের মুঠোয়! বাড়ির ভেতরে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে,
“আসুন,ভেতরে আসুন!”
হৃদিতা দ্বিরুক্তি করেনা।আদৃতের সাথে পায়ে পায়ে পৌঁছে যায় মেঘকুঞ্জের অন্দরে!ভেতরে ঢুকতেই সবার আগে হৃদিতার চোখ পড়ে, সারে সারে সাজানো নানা রঙের ফুলগুলোর দিকে, একেকটা থেকে ভেসে আসা একেক রকম সুঘ্রাণে শ্বাস নেয় প্রাণ ভরে!
আদৃত হাসে!সহাস্যে স্বগোতক্তি করে,
“অনেক রকমের ফুলগাছ আছে হৃদ!তবে আপনার প্রিয় ফুলটিই নেই!তবে চিন্তা করবেন না, বিয়ের পর, আমাদের ব্যালকনিতে আমি ঠিক লাগিয়ে দেব!রোজ সকালে উঠে স্নান সেরে আপনি যখন ভেজা তোয়ালে মেলে দিতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াবেন,ঠিক তখনই সদ্য ফোটা ফুলগুলোর সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে আপনার সমগ্র চেতনা জুড়ে!আপনি, মুগ্ধ হবেন, স্নিগ্ধ হাসির রেখা ফুটবে আপনার অধরাঙ্গনে, আর সেই মুগ্ধতা, সেই স্নিগ্ধতা সবটা নিষ্পলক দেখে যাব আমি!তখন আপনার সেই সদ্য স্নাত সৌন্দর্য আমি শুধু দেখে যাব,দেখে যাব,আর দেখেই যাব!আর তারপর!”

হৃদিতা কৌতুহলী নয়নে তাকায়!সন্দিহান কন্ঠে শুধায়,
“তারপর?”

আদৃত ফিচেল হাসে,সে হাসিতে খেলে যায় দুষ্টুমির রেখা!হৃদিতাকে লাজের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে বলে ওঠে,
“তারপর কি?কাছে আসবো, ভালোবাসবো,খুব ভালোবেসে আদর করবো!বিনিময়ে কিন্তু আমারো আদর চাই হৃদ।
যে আদরের যোগ্য তাকেই কিন্তু আদৃত বলে।সে হিসেবে আপনার অনেক অনেক ভালোবাসা,আর আদর কিন্তু আমার পাওনা!দেবেন তো?”

হৃদিতা লাজুক হাসে।লজ্জায় নুঁইয়ে পড়ে সদ্য অঙ্কুরিত লজ্জাবতী গাছটির ন্যায়! উত্কর দেয়না আদৃতের করা প্রশ্নের!

আদৃত প্রসঙ্গ পাল্টায়!ভাবুক কন্ঠে প্রশ্ন ছোড়ে,
“ব্যালকনিতে আপনার প্রিয়ফুল গাছ লাগানোয় আপত্তি নেই তো হৃদ?”

হৃদিতা এবার ভ্রু কুচকে তাকায়! সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি জানেন আমার প্রিয় ফুল কি?”

আদৃত হাসে!নিজহাতে বন্দী হৃদিতার হাতটাকে আরো কিছুটা শক্ত করে আকড়ে ধরে প্রত্ত্যুত্তর করে,
“আপনি না একটু আগেই গোটা আপনিটাকে বোঝার দায়িত্ব দিলেন আমাকে!
আপনাকে বুঝতে হলে তো আগে আপনার পছন্দ -অপছন্দ বুঝতে হবে হৃদ!তবেই না বুঝবো আপনাকে!”

হৃদিতা প্রসন্ন হেসে শুধায়,
“আচ্ছা? তো বলুন দেখি, আমার কি ফুল প্রিয়! দেখি কেমন বুঝেছেন আমার পছন্দ?”

আদৃত স্নিগ্ধ হেসে উত্তর দেয়,
“মাধবীলতা!ঠিক তো?”

হৃদিতা মুগ্ধ হয়! মুগ্ধতাময় হাসির আবেশে সেজে ওঠে কৃষ্ণ মুখশ্রীর প্রতিটা অংশ!উত্তর দেয়,
“একদম!”

আদৃত হাসে!খুব সুক্ষ্ম নজরে অবলোকন করে যায় প্রিয়তমার মুখে হাসির তালে সৃষ্ট সকল ভাজ!তারপরে ঘোর লাগা কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনি খুব সুন্দর হৃদ!কেন বলুনতো?”

হৃদিতা ক্ষণিকের তরে থমকায়!থমকানো দৃষ্টি মেলেই একদম অনুভূতিহীন মানবীর মতো জবাব দেয়,
“আপনার মনটা খুব সুন্দর আদৃতবাবু!সেজন্যই আমি সুন্দর! বাস্তবিক না হই!আপনার দৃষ্টিতে অন্তত সুন্দর। খুব সুন্দর!”

আদৃত উত্তর দেয়না আর। শুধু অধরদ্বয়ে ফুটিয়ে তোলে একটা সরু হাসির রেখা!সে হাসির রেখা হাসি ফোটায় হৃদিতার মুখেও!অনুভূতিহীন চাহুনী, মুহূর্তে ভরে ওঠে ভালোবাসার তীব্র অনুভূতিতে!

আদৃত আবারো হাতে টান দেয়, বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
“আসুন। বাড়িতে আসুন!”

হৃদিতা কথা বাড়ায় না।বাধ্য মেয়েটির মতো পা চালায় আদৃতের সাথে!পদার্পণ করে কাদম্বিনী দেবীর নিজ হাতে গড়া সংসারের অন্দরমহলে!
.
আদৃত ভেতরে যেতেই সবার আগে চোখ পড়লো অন্বেষার দিকে।সোফার ওপরে পা তুলে বসে সে তখন “টম এন্ড জেরী” দেখতে ব্যস্ত!বাঁহাতে একটা চিপসের প্যাকেট ধরে ডানহাতে মুখে পুরছে একটা পর একটা!বোনের ছেলেমানুষী দেখে আদৃত হাসে।ডাক দেয়,
“ছুটকি?”

অন্বেষা অলস আঁখিজোড়া টেলিভিশনের পর্দা থেকে সরিয়ে নেয় বিরক্তিতে। আদৃতের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই নজর আটকায় হৃদিতার ওপরে।কলেজ ড্রেস পড়া হৃদিতাকে দেখে অবাক হয়ে যায় অন্বেষা। অবাক স্বরেই জিজ্ঞেস করে,
“হৃদ!তুমি?
দাভাই ও কখন এলো?”

আদৃত সোফায় বসে পড়ে অন্বেষার পাশেই।রিমোট হাতে নিয়ে পাল্টে দেয় চ্যানেল।কোন একটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচের পুনঃপ্রচার হচ্ছে। আদৃত সেখানেই চোখ রেখে বলে,
“এক্ষুনি এলো।আমি নিয়ে এলাম।”

অন্বেষা উঠে দাঁড়ায়। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় হৃদিতার দিকে। হৃদিতার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বলে ওঠে,
“আমি তো ভাবতেই পারছিনা হৃদ,তুমি আমার বাড়িতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো!কি যে খুশি লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না।এসো ভেতরে এসো!”

হৃদিতা ভেতরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার মা, মানে দিদার বৌমা কই অনু?ওনাকে ডাকো তো!ওনার সাথে বোঝাপড়া আছে আমার!”

আদৃত আর অন্বেষা দুজনেই হতবাক নয়নে চেয়ে রয় হৃদিতার ভাবলেশহীন মুখপানে।হৃদিতা তাদের অবাক হবার মাত্রা বাড়িয়ে দিতেই চেঁচিয়ে ওঠে,
“এই যে মিসেস মল্লিকা সেন, আমার দিদার বৌমা!কোথায় আপনি?আসুন তো দেখি,আপনার চাঁদমুখ খানা একবার দর্শন করি!”

আদৃত বিষম খায়!হৃদিতা সেদিকে একবার তাকিয়ে আবারো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে হাকডাক শুরু করে মল্লিকা দেবীর উদ্দেশ্যে! অন্বেষা ডায়নিংয়ের ওপর থেকে একটা গ্লাসে জল ঢেলে নিয়ে ছুটে আসে আদৃতের কাছে। আদৃতের হাতে জলের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
“এই দাভাই?কাহিনি কি রে?হৃদ এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করছে?মাকে এভাবে ডাকছে?আমার তো নিজের চোখ,কান কোনটার ওপরই বিশ্বাস হচ্ছে না! ”

আদৃত একেবারে জলের গ্লাসটা ফাঁকা করে অন্বেষার মুখপানে তাকায়! ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ে, যার অর্থ তারও একই অবস্থা!
অন্বেষা চিন্তায় ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে।দম আটকে বসে রয় বাড়িতে কোন একটা তুলকালাম হবার অপেক্ষায়! তবে তেমন কিছু হয়না!
মল্লিকা দেবী দোতলা থেকে অত্যন্ত শান্ত ভাবে নেমে আসেন সিড়ি ভেঙে!হৃদিতার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন,
“বলো!আমিই মল্লিকা সেন!তোমার দিদা মানে আমার শাশুড়ীমার বৌমা!”

হৃদিতা এতক্ষণ চেঁচালেও এবারে খানিকটা হকচকিয়ে যায় মল্লিকা দেবীর এমন শীতল ব্যবহারে।তবে তা প্রকাশ না করে আবারো গলা চড়িয়ে বলে,
“ওহ্!তো আপনিই সে?মানে দিদার বৌমা, আই মিন টু সে আমার হবু শাশুড়ী মা!”

মল্লিকা দেবী একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকান আদৃত ও হৃদিতার দিকে। মল্লিকা দেবীর দৃষ্টিপাত মাত্র তারা সরিয়ে নেয় নিজেদের দৃষ্টি, ব্যস্ত হয়ে পড়ে মায়ের দৃষ্টি হতে লুকোতে!
মল্লিকা দেবী ক্লান্ত শ্বাস ফেলে জবাব দেন,
“হ্যাঁ!কি বলবে বলো!”

হৃদিতা বুক ভরে একটা বড়সড় শ্বাস গ্রহণ করেই মল্লিকা দেবীর চোখে চোখ রাখে।কাঠ কাঠ কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনার জন্যই যে মানুষটা নিজের ঘর-সংসার ছাড়া, তাকে ফিরিয়ে আনবার দায়িত্বটাও কি আপনার নয় দিদার বৌমা!”

মল্লিকা দেবী কাতর নয়নে তাকান!ছলছল করে ওঠে সেই নয়নের ভাষা।হৃদিতার কষ্ট হয়,মায়ের বয়সী কারো চোখের অশ্রু দেখে, তবুও কঠোর স্বরে বলে,
“আপনার অপরাধবোধ হয়েছে তার মানে কিন্তু এটা না আপনি অপরাধবোধ তার থেকেই লুকোবেন যার সাথে অপরাধ করেছেন!বরং তার সামনে দাঁড়িয়ে অপরাধটা স্বীকার করে তার থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করুননা!আমি দিদাকে যা চিনি,উনি বিনাবাক্যে ক্ষমা করে দেবেন!আপনিও জানেন সেটা। তবুও কেন এই দূরত্ব দিদার বৌমা!কেন ফিরিয়ে আনছেন না মানুষটাকে? একটা কথা মাথায় রাখবেন, মানুষের থেকে লুকোনো যায়, নিজের বিবেকের থেকে না!আপনি তো রোজ রোজ সে মানুষটার জন্য চোখের জল ফেলেন, আত্মগ্লানিতে পুরে মরেন, তবুও কেন একটু সাহস করে তাকে ফিরিয়ে আনছেন না? কেন? ”

মল্লিকা দেবী নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন!হৃদিতা ওনার হাত ধরে বাড়ির বাইরের দিকে যেতে যেতে বলে ওঠে,
“আমার সাথে চলুন!”
বাঁধা দেয়না কেউই!মল্লিকা দেবী পুতুলের মতো পায়ে পা মেলায় হৃদিতার সাথে, তিি জানেন হৃদিতা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তাকে!
তবুও চুপ রইলেন। আজ তিনিও চান এতদিন ধরে ফেলে রাখা অসমাপ্ত কাজটা করতে।হৃদিতাই হয়তো সেই অসমাপ্তিকে সমাপ্ত করার দূত!
.
জীবনকথা বৃদ্ধাশ্রমের বাইরেটায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন কাদম্বিনী দেবী ও মল্লিকা দেবী! হৃদিতা দাঁড়িয়েছে ওনাদের থেকে একটু দূরে।ওনাদের আলাদা কথা বলার সুযোগ দিতেই এই ব্যবস্থা!

মল্লিকা দেবী এসছেন থেকে একবারের জন্যও নাড়েননি ঠোঁট দুটো!চুপচাপ নতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন কেবল! কাদম্বিনী দেবীই প্রথম কথা বললেন,
“কেমন আছো মা?”

মল্লিকা দেবী মুখ তুলে দেখেন শাশুড়ী মায়ের মুখের দিকে!চোখের কোণে এখনো চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু! কম্পিত কন্ঠে তিনি উত্তর দেন,
“আমাকে ক্ষমা করে দিন মা!আমি পিসিমার কথা শুনে অনেক বড় ভুল করেছি!অনেক বড় ভুল মা!
কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি বুঝতে পেরেছিলাম নিজের ভুল, তবুও আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি।এটা জেনেও যে,আপনি আমি না ফেরালে ফিরবেন না।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি মা,তবে তীব্র অপরাধবোধ আমাকে আপনার মুখোমুখি হবার সাহস দেয়নি!পারিনি আমি!তাই তো এত দেরি হয়ে গেল!তবে মা,আজ এই মেয়েটা,হৃদিতা, যাকে আপনার দাদুভাই পছন্দ করেছে সেন বাড়ির বউ করার জন্য, সেই আমাকে বুঝিয়ে নিয়ে এসছে আপনার সামনে মা, সাহস জুগিয়েছে আপনার সামনে দাঁড়ানোর!
আপনি ফিরে চলুন মা। আমি নিতে এসেছি আপনাকে, আপনার নিজের সংসারে, আপনার মেঘকুঞ্জে।আপনি যাবেন না?”

কাদম্বিনী দেবী অশ্রুসজল চাহুনি মেলে রেখেই হাসেন।পুত্রবধূর মস্তকে আশির্বাদের হাত রেখে উত্তর দেন,
“যাব মা। নিশ্চয়ই যাব। আজ যে আমার অপেক্ষার অবসান হলো মা। যাব তোমার সাথে। আবার ফিরবো আমার সংসারে!”

হৃদিতা দূর থেকেই দুচোখ ভরে দেখে গেল, বহুদিনের নড়বড়ে একটা সম্পর্কের শক্ত ভীত স্থাপন!অনেক অপেক্ষার সমাপ্তি শেষে ,একটা খন্ড পরিবারের আবারো একত্র হবার সূচনা!

#চলবে!

[অগোছালো হয়েছে। বুঝতে পেরেছি। তবে থিম সাজাতে পারছিলাম না। এতটুকু বহু চেষ্টার পর লিখেছি,ছোটও হয়েছে সেজন্য! আপনারা দয়া করে উপন্যাস সম্পর্কে দু লাইন বলে যাবেন?আমার তাহলে লিখতে একটু সুবিধা হত!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here