প্রেম পায়রা ২ পর্ব ২৩

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব___২৩

পুরুষ অবয়ব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো। অতঃপর বিমোহিত সুরে উত্তর দিল,

‘মি. প্রোপার্টি!’

‘উনি কোথা থেকে আসবে?’

তিথির বিস্ময় মিশ্রিত কন্ঠ কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে স্বপ্ন আর বাস্তবতার টানাপোড়েনে দুলছে সে। চোখ জোড়া অন্ধকারেও বড় বড় হয়ে গেছে। পলকহীন দৃষ্টি সামনের লম্বা দেহের মানবটির উপর নিবদ্ধ। মানবটির মুখ স্পষ্ট নয়। তবে ঝকঝকে দাঁত গুলো অন্ধকারে ঝলমল করছে। তিথি বিষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অস্ফুটস্বরে জিগ্যেস করলো,

‘কে?’

মানবটি এগিয়ে এসে তার খুব কাছাকাছি দাঁড়ালো। ডান হাতটা তিথির গাল স্পর্শ করতে সব চমক কেটে গেল। সব ধরনের বিপদের আশংকা কেটে অনুভূতি গুলো নাড়া দিয়ে উঠলো। সেই চেনা স্পর্শ অস্তিত্বে অনুভব করতে মাথা নত হয়ে এলো তিথির। বুকের গহীনের দুঃখের দিনগুলো সোনাঝরা বিকেলের মতো রৌদ্রময় হয়ে উঠলো। বিড়বিড় করে দু বার উচ্চারণ করলো,

‘সম্পদ! সম্পদ?’

সম্পদ তিথির গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। দু পা পিছিয়ে দাঁড়ালো। কিন্নর কন্ঠে বলল,

‘হু সম্পদ। কোনো সন্দেহ?’

নিজের মাঝে ফিরেছে তিথি। মস্তিষ্ক খোলাসা হয়েছে৷ প্রতি মুহূর্ত অভাববোধ করা মানুষটা চোখের সামনে। ভাবতে মনটা সুখের জোয়ারে ভেসে গেল দ্বিগবিদিক। অন্ধকারে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের মানবটির দিকে। সম্পদ অন্ধকারে চারিদিকে নজর বুলিয়ে নিল। গাঢ় স্বরে বলল,

‘দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’

মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল তিথির। কিছু রুক্ষ কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল। অভিমানে কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। চোখের পাতা ভারী অনুভব করতে দ্রুত পেছন ঘুরে দাঁড়াল। কিছু সময় অতিক্রম হতে স্বাভাবিক হয়ে এলো। পেছনে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পদের দিকে ঘুরে বলল,

‘ভালো যাচ্ছে।’

‘কতটুকু ভালো?’

‘অনেক ভালো।’

সম্পদ স্মিত হেসে জবাব দিল,

‘তাই বুঝি? আমাকে মিস করা হচ্ছে না?’

‘মিস করতে যাবো কেন? আমি কাউকেই মিস করি নাহ।’

‘বাহ! কন্ঠে এত জোর? তাহলে এসব খুদেবার্তার মানে কি?’

সম্পদ প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করার জন্য উদ্যত হতে তিথি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। সে আর লজ্জায় পড়তে চায় না। এমনিতে তার এখন নাকানিচুবানি অবস্থা। সম্পদ মনে মনে কি না কি ভাবছে। ছি! সে এতটা আবেগপ্রবণ না হলেও পারতো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে অনুনয়ের সুরে বলল,

‘এত রাতে আপনি কোথা থেকে এলেন?’

তিথির ধরে রাখা হাতটা সম্পদ উঁচু করলো। মুচকি হেসে বলল,

‘সিক্রেট!’

সম্পদের হাত ছেড়ে মাথা নিচু করলো তিথি। বুকের নদীতে কেমন উথাল পাথাল ঢেউ খেলছে। ছন্দময় ঢেউয়ের দোলায় কেমন অগোছালো লাগছে নিজেকে। মাথা ঝিমঝিম করছে। মাঝরাতে এভাবে ঘুম ভাঙতে সেই চির পরিচিত কন্ঠটা শুনতে পাবে, এক পলক দেখার জন্য ছটফট করতে থাকা মনটা এতবড় সারপ্রাইজ পাবে তার কল্পনায় ছিল না। মানুষের সাথে সবসময় কল্পনার বাহিরের ঘটনা গুলো কেন ঘটে?

ঘটনা যেটাই ঘটুক সে আপাতত খুশি। একটু নয়, অনেক বেশি খুশি। তবুও নিজের খুশিভাব যথাসম্ভব লুকিয়ে গুটিয়ে নিল নিজেকে। কম্পমান ঠোঁট জোড়া নেড়ে শুধাল,

‘সত্যি করে বলুন তো। এতরাতে কোথা থেকে আসলেন?’

সম্পদ পিঠ বাঁকিয়ে মুখটা নিচু করলো। তিথির চোখে চোখ রেখে ভুবনভুলানো হাসি উপহার দিল। নেশাক্ত সুরে বলল,

‘কেউ আমায় মিস করছে এটা শোনার পর আমি না এসে পারি? এই দেখো! অফিসের ড্রেস পরিবর্তন করার সময় পাইনি। একজনের ডাকে সবকিছু ফেলে রেখে এক পোশাকে ছুটে এসেছি।’

সম্পদের কথায় তিথি কেঁপে উঠলো। অন্য রকম মাদকতায় মন ডুবে গেল। কারো কন্ঠ নিঃসৃত সামান্য কথা যে প্রতিটি লোমকূপ কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তা সে জানতো না। সম্পদের সামনে থাকার আর সৎ সাহস হলো না। সে এক দৌঁড়ে মায়ের রুমের দিকে চলে গেল।

২৯.

সম্পদের খাওয়ার এক ফাঁকে তিথি চট করে নিজের রুমে চলে গেল। বিয়ের পর থেকে বাড়িতে একটা রুম তার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। কেউ থাকে না। সে নিজেও থাকে না। শুধুমাত্র সম্পদ আসলে এ রুমে ঘুমানো হয়। সম্পদের অবর্তমানে সে ফুপির সাথে ঘুমাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

রুমে ঢুকে তাড়াহুড়ো করে গোছগাছ শুরু করলো। ঠোঁটের কোণে তার উপচে পড়া হাসি। সম্পদের হঠাৎ আগমন তার অন্ধকার কুঠুরিতে আলোর ন্যায় কাজ করেছে। তার এতদিনের জমে থাকা সব অন্ধকার, নিস্তব্ধতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা সব ভারী দুঃখগুলো কেমন ঝরে পড়ে গেছে। নিজেকে কেমন হালকা, ফুরফুরে মনে হচ্ছে।

বিছানায় নতুন বেডশিট টা বিছিয়ে তিথি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বালিশ দুটো পাশাপাশি রেখে আনমনে হেসে ফেলল। মাঝরাতের এই অত্যাচার যে এত ভালো লাগবে তা ভাবনার অতীত। মোটামুটি গোছানো রুমটাতে নজর বুলিয়ে সে সম্পদের অপেক্ষায় রইলো। তার খাওয়া বোধ হয় এতক্ষণে শেষ।

দক্ষিণ দিকের জানালার পাল্লা খুলে দিতে বাতাসের ঝাপটা এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে রুমের ভেতরের গুমোট অবস্থা দূর হতে লাগলো। হালকা হয়ে গেল বাতাস। জানালার ওপাশে অন্ধকার ধানক্ষেত। গ্রামের প্রান্তরে কানাকানি করছে পক্ষীকূল। কিছু সময় পর রোজকার নিয়ম মতো সূর্য উঠবে, সমস্ত অন্ধকার কাটিয়ে সূর্যোদয় হবে, পৃথিবীর বুকে ভোরের আলো ফুটবে, আবার অস্ত যাবে, সাগরে জোয়ার আসবে, ঋতু গিয়ে ঋতু আসবে! সবই হবে! শুধু সে মাঝরাতের এই আনন্দ মিশ্রিত ছুটোছুটি, সম্পদের হঠাৎ আগমনে সৃষ্ট ভালোলাগা কখনো ভুলবে না।

কারো হালকা পদধ্বনি কানে আসতে বুক কেঁপে উঠলো তিথির। খোলা জানালার সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলো। দরজার ছিটকিনি লাগানোর শব্দ কানে যেতেও সে ঘুরে দাঁড়াল না।

‘তিথি।’

সম্পদের আকস্মিক ডাকে তিথি ঘুরে দাঁড়াল। কয়েক মুহূর্ত জড়সড় রইলো। তারপর নিচু স্বরে বলল,

‘হু!’

‘ড্রেস তো কিছু আনলাম না। জার্নি করে গায়ের পোশাক নোংরা হয়ে গেছে। লম্বা একটা শাওয়ার দরকার। কি করা যায় বলো তো?’

‘শাওয়ার নিয়ে ফেলুন।’

‘শাওয়ার শেষে কি পরবো?’

বলে সম্পদ কয়েক পা এগিয়ে এলো। ইতোমধ্যে শার্টের বেশ কয়েকটা বাটন সে উন্মুক্ত করেছে। তিথি ঝট করে জানালা থেকে সরে দাঁড়ালো। ওয়াশরুমের পাশের ছোট্ট ওয়ারড্রব খুলে কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করলো। একটুপর সাদা একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে সম্পদের দিকে তাকালো। হাতের প্যাকেটটা বিছানার উপর নামিয়ে রাখলো। মিনমিন করে বলল,

‘এখানে নতুন লুঙ্গি আছে। সম্পূর্ণ প্যাকেটজাত। বিয়ে উপলক্ষে আপনাকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কখনো পরেননি! আজ ব্যবহার করতে পারেন। যদি আপনার……. ‘

বাক্য শেষ না করে তিথি জিভ কাটলো। সম্পদকে কখনো লুঙ্গি পরতে দেখেনি সে। আজও নিশ্চিত রাজি হবে না। ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হওয়া ছেলের জন্য লুঙ্গি অস্বস্তিকর একটা বস্তু। কৌতূহল নিয়ে সম্পদের দিকে তাকালো। সম্পদের বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নজরে পড়তে সে দ্রুত প্যাকেট টা হাতে নিল। মাথা নেড়ে বলল,

‘ঠিক আছে৷ ঠিক আছে। পরার দরকার নেই!’

তার বাক্য শেষ হতে না হতে চোখের পলকে সম্পদ কাছে চলে এলো। হাতের প্যাকেট টা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে নিল। উল্টেপাল্টে দেখে বলল,

‘ওয়াশরুম পরিষ্কার আছে?’

তিথি মাথা নাড়তে সম্পদ ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হওয়ার পর তিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ঝপাৎ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। এমন অস্থির লাগছে কেন? সম্পদের উপস্থিতি বার বার অস্বস্তিতে ভরপুর ভালো লাগার সমুদ্রে কেন নিক্ষেপ করছে?

(চলবে)

যতটুকু লিখতে পেরেছি ততটুকু দিয়ে দিলাম। ভালো মতো রি-চেক করার সময় পাইনি। 🧡

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here