#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্ _মৌমিতা
#পর্ব__________২৪.
এক জোড়া শালিক পাখি উড়ে এসে বসলো ইলহামের পায়ের কাছে। ইলহামের হাতে তার লাভবার্ডস জোড়ার খাবার। হয়তো খাবারের আশায় এই নতুন কপোত-কপোতীর আগমন। ইলহাম হাতের খাবার গুলো লাভবার্ডসেদের খাঁচায় ঢেলে দিয়ে আরেক মুঠো খাবার নিলো। সেগুলোই শালিকের জোড়াকে নিবেদন করলো নীচে মেঝেতে। খাবার পেলেও অজানা মানবীর ভ/য় তারা কাটাতে পারছিলো না। তাই ইলহাম পা টিপে টিপে চলে গেলো ছাদের অন্যপাশে। সে চলে যেতেই শালিক পাখি দুটো নির্ভয়ে ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলো খাবার গুলো। ইলহাম দেখছিলো মনোযোগ দিয়ে। ঠিক তখনই তার ফোনটা ডাক চিৎকার পেড়ে কেঁদে উঠলো। ইলহাম হাতের প্যাকেটটা নিয়েই দৌড়ে গেলো ফোনটার কাছে। তার পায়ের ধপধপ শব্দে শালিক পাখি দুটো ভ/য়ে উড়ে গিয়ে ছাদের রেলিঙের উপর বসে পড়লো। ইলহামের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বললেই চলে। কাল সকালে রাদকে ওমন অদ্ভুত একখানা প্রস্তাব করে বসলে কোনোরূপ জবাব না দিয়েই লাপাত্তা হয়ে যায় রাদ। কি অদ্ভুত মানুষ। এতো ভালোবাসে তাকে। বিয়ে করারও স্বপ্ন দেখে। অথচ সামান্য একটা উত্তর দিতে গোটা একদিন পার করে ফেলেছে। না জানি আরও কতকাল পার করবে।
ফোনটা হাতে তুলতেই ফোনের স্ক্রিনে একটা অপরিচিত নাম্বার দেখতে পেলো ইলহাম। কয়েক মুহুর্ত কেবল তাকিয়েই রইলো নাম্বারটার প্রতি। মনে মনে গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করলো এটা কার নাম্বার? ওপাশের মানুষটি অধৈর্য্য হয়ে বারবার ফোনটা দেখতে লাগলো। একটা কল পিক করতে কারোর এতোটা সময় লাগে? অদ্ভুত।
কলটা কেটে যাওয়ার ঠিক দুই সেকেন্ড আগে কলটা রিসিভ করে ইলহাম। প্রথমে কি তার কথা বলা উচিৎ নাকি শোনা উচিৎ? ভাবতে ভাবতে আরও পাঁচ সেকেন্ড সময়কে ভাসিয়ে দিলো ইলহাম। তার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওপাশের অধৈর্য্য ব্যাক্তিটি অধৈর্য্য গলাতেই বলে উঠলো,
—-“থ্যাংক গড। সামান্য একটা ফোন কল সুইটহার্ট! একটা ফোন কল পিক করতে তোমার কত সময় প্রয়োজন?”
কন্ঠটা শুনে ইলহামের তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি মানুষটাকে চিনতে। পূর্বের সব অভিমান জাগ্রত হয়ে উঠলো হঠাৎ। ভারী বি/রক্ত গলা বলল,
—-“কেন ফোন করেছেন! কি চাই?”
রাদ থতমত খেয়ে গেলো। যা তার কাশির শব্দেই বেশ স্পষ্ট।
—-“কি আবার চাইবো! যা প্রয়োজন ছিলো, অলরেডি আই গট ইট। সো?”
—-“সো না তো আমি দেখে নিবো। আর শুনুন, ইউ হ্যাবে’ন্ট গট ইট! আমি চাইলে এখনও আপনাকে রিজেক্ট করতে পারি।”
—-“হোয়াট?”
—-“ইয়েস।”
ইলহাম বেশ ভাবের সাথে ইয়েস বলল। ওদিকে রাদ ফুঁসে উঠলো। কোমরে হাত চেপে বলল,
—-“থ্যংক গড, তুমি এখন আমার সামনে নেই। নয়তো বোঝাতাম…”
—-“ইশশ! কি বোঝাতেন হু? আমি কি ভ/য় পাই আপনাকে?”
—-“আর ইউ সিরিয়াস? তুমি আমাকে ভ/য় পাও না!”
—-“প্রশ্নই আসেনা। আমি আপনাকে ভ/য় পাবো? শুনেন রাখুন মিস্টার? এই ইলহাম না কাউকে ভ/য়/টয় পায়না।”
—-“ও রিয়েলি। একটা টেস্ট হয়ে যাক তবে?”
—-“হু হু! আই ডোন্ট কেয়ার!”
ইলহামের ভাব ক্রমাগত বাড়ছে। যা বুঝে মুচকি হাসছে রাদ। তার ভেতরে ঘটে চলা শ/য়/তানি বুদ্ধিটা আজ যদি কাজে লাগাতে না পারে, তবে জীবনই বৃথা। কথাটা ভেবেই হেসে উঠলো। বলল,
—-“ওকে। আমি তোমায় একটা ডেয়ার দিচ্ছি। তুমি যদি এক্ষনি আমাকে দেখে ভ/য় পাও, তবে তুমি আমাকে একটা গাঢ় চুমু খাবে। অন মাই লিপস। উইথআউট এনি এক্সকিউজ। যদি কোনো এক্সকিউজ দেখিয়েছো, তবে কিন্তু তার শা//স্তি হবে। ডান?”
ইলহাম বেশ ভাব নিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো কেউ কোথাও আছে কিনা। না, দূর-দূরান্ত অব্দি সে ব্যতীত আর কেউ নেই। এমনকি শিরিনও নেই। তাই ভাবটা আরও এক ধাপ বেড়ে গেলো। গলা উঁচু করে বলল,
—-“হ্যাঁ ডান।”
ইলহামের কথাটা শেষ করতে দেরী হলেও রাদের তার সম্মুখে এসে দাঁড়াতে দেরী নেই। অবশ্য সম্মুখে বললে ভুল হবে। তার পেছনে। ইলহাম তখনও সামনের দিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছিলো। যতদূর সে জানে, রাদ অফিসে। সুতরাং এই মুহুর্তে তার সামনে এসে হাজির হওয়াটা অসম্ভবই বটে।
রাদ ধীরগতিতে ইলহামের কাঁধের উপর হাত রেখে আলতো করে চাপ দিতেই আকস্মিক চমকে উঠলো ইলহাম। রাদের ভ/য়ে নয়, মানুষের ভ/য়ে। কিন্তু পেছন মুড়ে যা দেখলো, তাতে আরও দিগুন মিলিয়ে চমকে উঠলো। অর্থাৎ ভ/য়া/ন/ক রকমের ভ/য় পেলো। ইলহামের একের পর এক চমকে ওঠা দেখে রাদ ফিক করে হেসে দিলো। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে কল কেটে ইলহামের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে করলো। এক ভ্রু নাচিয়ে বলল,
—-“আই ডিডেন্ট এক্সপেক্ট দ্যাট, তুমি এতোটাও ভ/য় পাবে।”
ইলহামের হেঁচকি উঠে গেলো। পূর্বের ন্যায় কানে ফোনটা চেপে রেখেই ক্রমাগত হেঁচকি দিতে লাগলো৷ রাদ তার কান্ড দেখে না হেসে পারছেনা। হাসতে হাসতে ইলহামের কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিলো। কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলল,
—-“ডেয়ার ভুলে যাওনি তো আবার?”
ডেয়ারের কথা শুনে ইলহামের হেঁচকির বেগ আরও কয়েকগুন বেড়ে গেলো। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে একখানা অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রাদের দিকে। রাদ একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রেলিঙের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। ইলহাম হেচকি দিতে দিতেই বুলি আওড়ানোর চেষ্টা করলো,
—-“আ..আপনি!! ক..কক-কোত্থেকে এলেন?”
—-“আমার রুম থেকে পায়ে হেঁটে চলে এসেছি। রাস্তা সরু এমন স্বল্প তাই গাড়ি আনতে পারিনি।”
ইলহাম হেঁচকি দিতে দিতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এই মুহুর্তে সে মজা করার অবস্থায় নেই। তার আসল ভ/য় যে ঐ ডেয়ারে।
—-“তো… আব.. এখন কি…”
টেনে টেনে কথাটা বলে এক পা এগিয়ে ইলহামকে দেওয়া ডেয়ারের কথা মনে করাচ্ছে রাদ। ইলহামের গলা শুঁকিয়ে আসছে ভয়ে। সবটাই হয়েছে নিজের বোকামির ফল। সে যে আস্ত একটা বোকার হদ্দ সেটা আজ আবারও প্রমান হলো। রাদ এতোটাও বোকা নয় যে খালি কলসি বাজিয়ে এমন একটা ডেয়ার দিবে! সে বুঝেশুনেই ফাঁদে ফেলেছে তাকে।
—-“অন মাই লিপস। এন্ড অভিয়েসলি ডিপলি। রিমেম্বার দ্যাট।”
রাদ আঙ্গুল তাক করে নির্দেশিত কন্ঠে বলল কথাটা। ইলহাম আঁ/তকে ওঠা ভঙ্গিতে মুখ থেকে হাত নামিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বুকের ভেতরটা কেমন আকুপাকু করছে তার। এটাকেই হয়তো বলে অন্যের নামে গ/র্ত খুঁ/ড়লে নিজেকেই পড়তে হয়।
রাদ এক পা এক পা করে ক্রমান্বয়ে ইলহামের দিকে এগিয়ে আসছে। ইলহাম ভ/য়, অস্থিরতা এবং এক নাম না জানা অনুভূতিতে ক্রমান্বয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই বারবার মনে হচ্ছে, নীচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে। দুরু দুরু কাঁপছে অন্তরের অন্তস্তল।
—-“ম্ ম্ মা! মাআআ…”
ইলহাম বেশ জোরেশোরে চেঁচিয়ে উঠে মায়ের নাম নিলো। রাদ ঘটনার আকস্মিকতায় চমকালো বেজায়। চমকানো দৃষ্টি জোড়া পেছনের দিকে নিক্ষেপ করতেই সুযোগ বুঝে তাকে পাশ কাটিয়ে দৌড় দিলো ইলহাম। কিন্তু সে পথ সহজগম্য হলোনা। তার পূর্বেই তার চালাকি ধরা পড়লো একদম হাতেনাতে। তাকে ছুট্টে পালাতে দেখে ক্ষপ করে হাতটা ধরে নিলো রাদ। একটানে নিজের খুব কাছে টেনে আনলো। নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
—-“বলেছিলাম না, নো এক্সকিউজ?”
—-“ম্ মা, সত্যি এসেছিলো!”
—-“তাই? তাহলে এবার সত্যি সত্যি শা/স্তি/র জন্য তৈরি হয়ে যাও। মনে আছে তো?”
—-“ক্ ক্ কেনন!!”(কাঁদো কাঁদো মুখ করে)
—-“উফ! এভাবে তাকালে আমার হার্ট এ/ট্যা/ক এসে যাবে তো। তুমি কি চাও? গোটা একটা ক্রিকেট টিম, একটা ফুটবল টিম তৈরি না করেই আমি ম//রে যাই?”
রাদের নির্লজ্জ বানীতে লজ্জায় কুঁকড়ে পড়লো ইলহাম। শুঁকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,
—-“আ্ আপনি খুব খা/রা/প!”
—-“জানি তো। এবার ফটাফট চুমু খাও৷ নয়তো ডাবল শা/স্তি/র জন্য তৈরি হও।”
ইলহাম আঁ/ত/কে উঠল। আর কত শাস্তি এড করবে লোকটা? কথাটা বলে রাদ তার আরও কাছে চলে এলো। ইলহামের শরীর,মন জুড়ে অদ্ভুত এক অনুভূতির অদম্য অস্থিরতা বিরাজ করছে। সর্বাঙ্গের প্রতিটা লোমকূপ শিহরণে স্তব হয়ে উঠেছে। ভ/য়, জড়তা কিংবা লজ্জা কোনো কিছুই কাটিয়ে উঠে সে রাদকে চুমু খেতে পারবেনা। এ যে অসম্ভব। কিন্তু চুমু না খেলে যে রাদ আরও ভ/য়া/ন/ক কিছু করে বসবে। একদম বিশ্বাস নেই তাকে দিয়ে।
—-“শ..শুনুন না? ব..বলছিলাম যে…”
—-“অলনি কিস। ডিপলি ডিপলি ডিপলি। নয়তো…”
ইলহামের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো রাদের কন্ঠে। কেমন মাতাল করা কন্ঠ তার। এক্ষনি তো এমন ছিলোনা। হঠাৎ তবে…
আর কিছু ভাবতে পারলোনা ইলহাম। তাহার পূর্বেই তার কোমর আলিঙ্গন করে আরও খানিকটা কাছে টেনে আনলো রাদ। বাঁকা হেসে বলল,
—-“থ্যাংকস টু মি, সুইটহার্ট। কত সহজ করে দিলাম তোমায়। এখন তো এটলিস্ট চুমু খাও!”
—-“আ্ আমি পারবোনা!”
ফট করে বলে উঠলো ইলহাম। রাদ শুনেও শুনলোনা যেন। তার অপেক্ষা দৃঢ়তম হচ্ছে। ইলহাম প্রায় অনেক্ষন বাহানা করলো। কিন্তু রাদ যখন তার কোমরে ক্রমাগত গভীর ছোঁয়া আঁকছিল তখন এর ভবিষ্যৎ ভেবে ভয়েই হঠাৎ চুমু আঁকল রাদের গাঢ় লাল ঠোঁট জোড়াতে। রাদ প্রথম দফায় ভড়কে গেলেও পরক্ষণে নিজের অধিকার বুঝে নিতে কোনোরূপ ব্যয়কুণ্ঠ করলো না। অর্থাৎ কৃপণতা করলোনা। ইলহাম তাকে ঠোঁটের পরশ দিতে গিয়ে যেন গ্লুর মতো আঁটকে গেলো। রাদের বুকে দু-হাত ঠেসে দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে গেলেও বৃথা হলো। রাদ তাকে আরও শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে নিজের সাথে। গাঢ় ছোঁয়াকে গাঢ় থেকে গাঢ়তর করেও থামছেনা একদম। ইলহাম একটা সময় ইচ্ছে মতো কিল-ঘুষি বসালো রাদের বুকে। রাদ ইলহামের কান্ড দেখে না পেরে তাকে ছেড়ে দূরে সরে এলো। কপাল কুঁচকে নিরাশ কন্ঠে বলল,
—-“নিজে না পারো, এটলিস্ট আমাকে তো বাঁধা দিওনা। এটা আমার মৌলিক অধিকার।”
ইলহামের মুখটা হা সূচক হয়ে গেলো। চোখ মুখ কুঁচকে মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,
—-“চুমু খাওয়া মৌলিক অধিকার তা কোন কাব্যে প্রকাশিত?”
রাদ ভাবনা সূচক ভঙ্গিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা চুলকে হাসলো। বাচ্চা সুলভ কন্ঠে বলল,
—-“কার আবার? রাদকাব্যে!”
—-“আপনি না সত্যি খুব খা/রা/প। খা/রা/পের খা/রা/প। চরমের খা/রা/প। আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। আপনি রিজেক্ট।”
—-“বিয়ে না করলে এসব মৌলিক অধিকার আমি ঠিকই আদায় করে নিবো। তো ভাবো বিয়ে করে সওয়াব নিবে নাকি বিয়ে না করে..”
—-“উফফ! চুপ করুন। মা-কে বলে দিবো।”
কাল যখন রাদ ইলহামকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে, মান্নাত বেগম ইলহামকে দেখে ভীষণ কান্না করেন৷ কেন সে না জানিয়ে এমন করে চলে গেলো? তার কি একটুও মনে হয়নি এই মায়ের কথা? সে না থাকলে ঘরটা যে একদম ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে কি বোঝেনা?
মান্নাত বেগমের কান্নার বেগ ক্রমাগত প্রকান্ড হচ্ছিলো। তাকে শান্ত করতেই হঠাৎ ইলহাম তাকে মা বলে সম্মোধন করে। এবং যথারীতি ইলহামের মুখ থেকে এই ডাকে সে তার কান্না ভুলে যায়। রাদও সবার মতোই ভীষণ অবাক হয়। সেই থেকেই ইলহাম মান্নাত বেগমকে মা বলে ডাকছে।
রাদ হেঁসে উঠলো। আচমকা ইলহামের হাত ধরে ঠিক পূর্বের ন্যায় নিজের কাছে টেনে আনলো। বলল,
—-“কি বলবে মাকে? আমি তোমায় ভালোবাসার গভীর ছোঁয়ায় আলিঙ্গন করেছি?”
ইলহামের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সত্যি লোকটার মুখে কিছু আটকায় না। নির্লজ্জ প্রেমিক পুরুষ।
চলবে#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_________২৫.
প্রভাতের একফালি মিষ্টি রোদ ঘরময় বিচরণ করতে নড়েচড়ে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো ইলহাম। রাদ স্নিগ্ধ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। আজ তাদের গায়ে হলুদ। এই তো আর তিনঘণ্টা বাদে। অর্থাৎ ঠিক সকাল ৯টায়। এখন বাজে ৬টা। ইলহামের মুখের উপর পড়ে থাকা অগোছালো চুল গুলো বাধ্য প্রেমিকের ন্যায় হাত এগিয়ে সরিয়ে দিলো রাদ। দ্বিতীয় বার বিয়ে করার কথা কখনোও ভাবেনি সে। মানুষ যা ভাবে তা কখনোও সত্যি হয়না। অথচ যা ভাবনাতেও থাকেনা কোনোদিন, সেই ঘটনা গুলোই ক্রমাগত রিপিট হতে থাকে। অবশ্য রাদের এতে কোনো আফসোস নেই। বরং আলাদা একটা তৃপ্তি আছে। কেননা, ইলহাম নিজ থেকে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে। তার প্রতি তার পবিত্র অনুভূতির টান সময় নিয়ে হলেও বুঝতে পেরেছে। এটাই বা কম কিসে? মানুষের গোটা জীবনটা আনন্দে, উচ্ছাসে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য এটুকু পাওনাও অনেক বেশি।
রাদ কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোনের হাসিটুকু প্রসারিত করে। এগিয়ে গিয়ে ইলহামের ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভালোবাসার ছোট্ট একটা পরশ এঁকে দেয়। অতঃপর চোখ বুঁজে টেনে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাসের বিসর্জন দিয়ে ভাবে অতীতের কথা,
তখন কি ইলহামের বয়স টা ১৮এর গন্ডিতে এসেছিলো? মনেমনে প্রশ্ন করে রাদ। ফের নিজেই জবাব দেয়। না সূচক মাথা নেড়ে আনমনেই বলে ওঠে,”নাহ্! তখন আমার প্রিয়দর্শিনী কেবল ১৭। বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলো। কত প্যাঁচালো ভাবে এই মেয়েটাকে জোর করে তার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।”
ভাবে আর হাসে রাদ। সে এক ইতিহাসই বটে। ঐ সতেরো বছর বয়সেও ইলহামের ম্যাচিউরিটি ছিলো বিশের উপরে। তাদের বিয়েটা অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা হলেও সবটা একদম নিখুঁত হাতে সামলেছিলো সে। নিজের স্বামীকে বসিয়েছিলো সর্বোচ্চ আসনে। আর মাকে-; অর্থাৎ মান্নাত বেগম ছিলো তার নয়নের মনি। ছোট বেলায় মা-কে হারিয়ে সদাসর্বদা মামীর অ*ত্যা*চা*র, নি*পী*ড়*ন সহ্য করে এসে হঠাৎ এমন অমায়িক একজন মা পাবে, সেটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিলো ওর কাছে। রাদকে সবসময় বলতো, “আপনি আরও আগে কেন এলেন না আমার জীবনে?”
রাদ তার কথার জবাবে হাসতো। তার হাসিতে এক নাম না জানা সুখের ঠিকানা পেতো ইলহাম। তখন আর নিজেকে ধরে রাখা সহজগম্য হতো না। রাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সবটা উজাড় করে দিতো প্রিয় মানুষটার প্রতি। একবার কথায় কথায় রাদ জানতে পারে ইলহামের মা একজন বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ছিলেন। নাম,যশ, খ্যাতি কোনো কিছুরই অভাব চিলো না তার। কিন্তু হঠাৎ, মিডিয়া পাড়া থেকে এমন একজন মানুষ হারিয়ে গেলো যার একটা নিউজমাত্র হলোনা! ব্যাপারটা সন্দেহ জনক। কিন্তু, এই নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখা ইলহামের একার জন্য সহজ ছিলোনা। অনেকবার চেষ্টা করলেও এই রহস্যের র’টা অব্দি ছুঁতে পারেনি সে। তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু রাদ হাল ছাড়ার লোক ছিলোনা। এই রহস্য তাকে উদঘাটন করতেই হবে। তাই ইলহামের থেকে মোটামোটি আকারে অনেক কথাই জেনেছিলো রাদ। যার মধ্যে সবচেয়ে সন্দেহজনক ব্যাপার ছিলো, ইলহামের বাবার সাথে তার মায়ের কোনো সম্পর্ক ছিলোনা। কোনো এক কারনে এই সম্পর্কের ফাটল ধরেছিলো। যা আর কোনোদিন কেউ ঠিক করে নেওয়ার মিনিমাম চেষ্টাটুকুও করেনি।
একই সাথে মিশমিশ, অর্থাৎ ইলহামের বেস্ট ফ্রেন্ড! যে মৃ//ত্যু//টাতেও একটা রহস্যের দানা বেঁধেছিলো রাদের মনে। যার সবটাই মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে ছেড়ে দিলো রাদ। যার,কারন ছিলো ইলহামের সবটা ভুলে যাওয়া। তার সুখের সংসারে এক বি//ষাদের ছায়া নেমে এসেছিলো ইলহাম যখন সবটা ভুলে যায়। বড় বড় ডাক্তারদের পরামর্শ নিলেও এই শর্ট টার্ম মেমোরি লসের কোনো প্রোপার সলিউশন আজও অব্দি পায়নি রাদ। যার কাছেই ইলহামের এই রো/গ/টা সম্মন্ধে বলেছে সেই বলে দিয়েছে, “অপেক্ষা ব্যতীত আর কোনো সলিউশন নয়। উপরওয়ালা চাইলে ইলহামের আবারও মনে পড়বে সবটা। পাশাপাশি ইলহাম রিসেন্ট ঘটা সমস্তটা ভুলে যেতে পারে। “অপেক্ষা”। হ্যাঁ, গত দেড় বছর যাবত রাদ সেই অপেক্ষাটাই করে যাচ্ছে। এই আশায়, যদি ইলহামের সবটা মনে পড়ে যায়।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসের আনাগোনা মিলল। লোকে বলে, অতীত আঁকড়ে বাঁচা যায় না। অথচ তার বেঁচে থাকার কারনটাই তার অতীত৷
—-“এ-কি! আপনি কখন এলেন? ৭টা কি বেজে গেল?”
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ইলহাম। রাদ তার এহেম লাফালাফিতে চমকে উঠলো আকস্মাৎ। চকমকানোর দরুন তার ভাবনাদের ছুটি মিললো। চমকানো দৃষ্টি অর্থাৎ,চোখ জোড়া বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
ঘুমে ইলহামের চোখ মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। রাদ ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে না সূচক মাথা নাড়লো। নির্লিপ্ত চাহনিতে বলল,
—-“৬টা বাজে। আরও এক ঘন্টা বাকি। তুমি ঘুমাও।”
—-“ধ্যাৎ! আপনি বসে আছেন আর আমি ঘুমাবো? তা কি হয়?”
রাদ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
—-“কেন হবেনা?”
ইলহাম বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
—-“হয় না ব্যাস হয়না। কেন হয়না, কেন হবেনা? এতো কথার উত্তর নেই।”
রাদ ইলহামের হাত ধরে আটকালো। যেতে দিবেনা, সেই উদ্দেশ্যেই বলল,
—-“এতো কিছু জানতে চাইনা। চুপটি করে বসো।”
—-“বসে কি হবে? আপনি তো কিছু খাননি বোধহয়। আপনাকে কিছু খাবার বানিয়ে দেই? ওদিকে কি এরেঞ্জমেন্ট শুরু হয়েছে? বাকিরা কি উঠে পড়েছে?”
একাধারে তার একাধিক প্রশ্ন শুনে কপাল চেপে মৃদু হাসলো রাদ। ঠোঁটের কোনে হাসিটুকু দীর্ঘময় করে বলল,
—-“আমি এখন কিছু খেতে চাইছিনা। এরেঞ্জমেন্ট অলরেডি অনেক্ষন আগেই শুরু হয়েছে। আর বাকিরাও উঠে পড়েছে। তাই তোমাকে আমার জন্য আলাদা করে কিছু বানাতে হবেনা। তুমি ফ্রেশ হয়ে এখানে চুপটি করে বসে থাকো। আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।”
—-“আপনি বানাবেন?”
—-“ইয়াহ। এনি ডাউট?”
—-“এই না!”
—-“কি না?”
—-“দেখুন, সকাল সকাল এসব পাগলামি ছাড়ুন। হাত-ফাত পুড়িয়ে ফেললে যাচ্ছে তাই হবে। আপনি বসুন। আমি যাচ্ছি।”
—-“বসতে বলেছি, চুপটি করে বসে থাকবে। এক পা নড়েছো তো..”
রাদের কড়া হুকুম। ইলহাম ঠোঁট উল্টে অসহায় মুখ করে তাকালো। রাদ গলল না ইলহামের ইমোশনাল ব্লা//ক//মে/ই/লে। বরং,মুখটা গম্ভীর রেখে বলল,
—-“কিপ সাইলেন্স। আই এ্যাম কামিং।”
এই বলে চলে গেলো রাদ। ইলহাম তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে স্মিত হাসলো। রাদের ভালোবাসা প্রকাশের এই ছোট্ট মাধ্যম গুলো একদম মনের মাঝে গেঁথে গেছে ইলহামের। না চাইতেও শত পাওয়া। এই অনুভূতি গুলোকেই হয়তো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি বলে আখ্যায়িত করেছেন গুনীমান্যিরা। সত্যি যে এই অনুভূতি গুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি।
দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলো ইলহাম। রাদ এখনও কফি নিয়ে আসেনি। হয়তো রান্নাঘর ফাঁকা নেই। তাই দেরি হবে বলে জানান দিচ্ছে তার অন্তঃকরণ। কিন্তু এই ঘরে একা থাকতেও যে ইচ্ছে করছেনা। তবে উপায় আর কি? রাদের হুকুম ভঙ্গ করে বের হওয়া তার সাধ্যের বাইরে।
—-“কফি ইজ রেডি।”
রাদের গলা পাওয়া গেলো। ইলহাম উচ্ছসিত মনে পেছন মুড়ে তাকালে দেখতে পেলো রাদ ট্রে হাতে রুমে ঢুকছে। ইলহাম এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো ট্রে-টা। রাদের হাঁপিয়ে ওঠা দেখে ইলহাম মুচকি হাসলো। যা দেখে রাদ বড়বড় দম ফেলে ইলহামের পিছু পিছু এগোলো। এক পর্যায়ে বলল,
—-“রান্না ঘরে তো দেখি পা ফেলারও জায়গা নেই। সরি ফর লেইট।”
ইলহাম পূর্বের ন্যায় হাসলো। একটা কফির মগ রাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
—-“জানতাম। আজ বাড়িতে বিয়ে বলে কথা। রান্নাঘর রান্নার দখলে থাকবে না তো কার দখলে থাকবে বলুন?”
—-“দিস ইজ ইওর’স। আ’ইম টেকিং মাইন।”
রাদ ইলহামের হাত ধরে কফিটা তার সম্মুখে ধরলো। কথাটা বলতে বলতে রাদ অন্যহাতে নিজের কফিটা তুলে তাকালো ইলহামের পানে। ইলহামের কফির মগের সাথে একটা ঠোকর লাগিয়ে বলল,
—-“আ’ইম নট প্রফেশনাল। মানিয়ে নিও প্লিজ।”
কথাটা বলে অসহায় মুখে হাসলো রাদ। অর্থাৎ সে কফিটা এতোটাও ভালো বানায়না। সুতরাং, খারাপ হলে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে।
ইলহাম জবাবে হেসে কফির মগে চুমুক দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রিয়াকশন স্বরূপ তার দৃষ্টি খানা রসগোল্লার রূপ নিলো। রাদের অসহায় মুখখানা আরও অসহায় হয়ে উঠলো। বলল,
—-“ভালো হয়নি তাইনা? আই ন্যিউ দ্যাট!”
ইলহাম মুখের হাসির সাথে রিয়াকশনটাও একই ভাবে বজায় রাখলো। সঙ্গে সঙ্গে বলল,
—-“আপনি এতো ভালো কফি বানাতে পারেন আগে সত্যি জানতাম না। তাহলে কিন্তু, কফি করার গুরুদায়িত্ব আমি আপনাকেই দিতাম।”
রাদের মুখ থেকে একটা কালো ছায়া সরে পড়লো যেন। অর্থাৎ, সে অবাক বনে গেলো ইলহামের কথায়। নিজের কানকে বিশ্বাস করানোর সাথে সাথে নিজের জিহ্বাকেও টেস্ট নিতে বঞ্চিত করলো না। ইলহামের ন্যায় সেও চুমুক দিয়ে কফির স্বাদ মেপে বলল,
—-“নট ব্যাড এক্টচুয়েলি।”
ইলহাম মৃদু হেসে জানায়,
—-“আজকের পর থেকে এই মহান দায়িত্বটি কিন্তু আপনার। মনে থাকবে?”
রাদ বেশ গর্বের সাথে বুক ফুলায়। বেজায় ভাব নিয়ে বলে,
—-“হান্ড্রেড পার্সেন্ট।”
চলবে___#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব__________২৬.
আশ্বিনের শেষ। শরৎের শেষ প্রহর বলা চলে। চারিপাশে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা বিরাজমান। না অত্যাধিক গরম, আর না অত্যাধিক ঠান্ডা। সকালের সতেজ নির্মল বাতাসে প্রান জুড়িয়ে আসার পালা সকলের। ছাদে, রাদের সাজানো-গোছানো গার্ডেনকে নিয়েই গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। ৯টা বেজে গেছে অনেক্ক্ষণ। রাদের হলুদিয়া পাখিকে নববধূর বেশে সাজিয়ে নিয়ে এলো অনন্যা। রাদ তার এই সাজে অভ্যস্ত নয়। তাই প্রথম দেখাতেই বেহুঁশ হওয়ার কায়দা। কেননা, সেই প্রথমবার যখন সে ইলহামকে দেখে এবং একই সাথে তাদের বিয়ে হয় তখন ইলহাম খুব সাধারণ সাজে ছিলো। আর আজ যে একেবারে হলুদ শাড়িতে মোড়ানো তার হলুদ পাখি।
রাদের এই এক নজরের দৃষ্টি সবার নজরেই এলো। যা দেখে ইলহাম লজ্জায় গাঁট হয়ে বসলেও বাকিরা হেসে কুঁদে বেশ মজা নিচ্ছে।
—-“ এ বাবা, ভাইয়া? তুমি কি সব দেখা একবারেই দেখে ফেলবে নাকি? বেচারিকে নিঃশ্বাস ফেলার সময়টুকু দাও অন্তত।”
অনন্যার কথাটা ঠিক শুনলোনা রাদ। কিন্তু ওদিকে হাসাহাসির রোল পড়ে গেলো। রাদের মুগ্ধদৃষ্টির এই স্থীর চাহনিতে ইলহাম নড়াচড়া টুকুও করতে পারছেনা।
—-“তোমার কথা ও শুনছে না। ওর মন এবং মনোযোগ দুটোই ভাবির প্রতি।”
হাসির রকমসকম থামলো না। প্রণয়ের কথায় তা আরও বেড়ে গেলো তরতর করে। ইলহাম আরও শক্ত হয়ে বসলো। লজ্জার বান তার নামে না ছুটলেও তার গায়েই বেশি লাগছে। কেননা সে মানুষটার ন্যায় লজ্জা খুইয়ে তাকে দেখতে পারছেনা।
—-“কি রে তোদের হলো? উফফ বাপু, তোদের এতো সাজগোজ যে করতে হয়! ওদিকে সময় থাকেনা। আর এদিকে তোদের সাজগোজ শেষ হয় না। আয় এবার?”
—-“বড় মা, তুমি এসব বুঝবেনা! তোমরা হলে ওল্ড ফ্যাশনের মানুষ। শুধু স্নো আর পাউডার দিয়েই তোমাদের বিয়ে হতো। আজকাল কি সেই যুগ আছে বলো?”
মান্নাত বেগমের কথার পিঠে বিজ্ঞ গলায় বলে উঠলো অনন্যা। মান্নাত বেগম জিনিসাদির জোগাড় করতে করতে একবার তাকালেন অনন্যার পানে। ব্যস্ত মুখে না সূচক মাথা নেড়ে বললেন,
—-“না রে মা! সত্যি মিল নেই সেই যুগের সাথে। তাই এতো বুঝে কুলোতে পারিনা তোদের নিয়ম, সাজগোজ। তা বলছি অনেক হয়েছে! এবার নিয়ে আয় ওদের দু’জনকে।”
অনন্যা হেসে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,
—-“আমরা এসে গেছি। এই যে তোমার বউমা।”
‘বউমা’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে পেছনে মুড়ে তাকালেন মান্নাত বেগম। হলুদ শাড়ি এবং কাঁচা ফুলের গহনায় ইলহামকে সাজিয়েছে অনন্যা। আধুনিকতার ছোঁয়া অর্থাৎ মেকাপ-সেকাপ নেই বললেই চলে। যা দেখতে বেশি মন কাড়লো তার। তিনি বলতে নিলেই তার মুখের কথা হরন করে নিয়ে বলে ওঠে অনন্যা,
—-“বউ মা পেয়েছো তোমার মনের মতোই, বড় মা। বিশ্বাস করো একটু মেকাপের ছোঁয়াও লাগাতে দিলোনা।”
মান্নাত বেগম মন জুড়ানো হাসি দিলেন। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ইলহামের গালে রাখলেন। হাসি মুখেই হাতটা কতক্ষণ চেপে রাখলেন ইলহামের গালে। এই তিন বছরে মেয়েটা একটুও বদলায়নি।
—-“রাদ বলেছিলো, ‘ইলহাম যতদিন না বলবে ততদিন এই বিয়ে হবেনা। আর ততদিন ইলহাম আমার মেয়ের মতো থাকবে।’ আজ কি এই পদবিটা সরিয়ে ফেলতে হবে আমায়?”
—-“না, মা। আমি যেমন তোমার মেয়ে ছিলাম তেমনই আছি। তবে হ্যাঁ, আমার আরেকটা নতুন পরিচয় হলো। মনে রেখো, এখন কিন্তু আমাকে এই দুই পরিচয়ে দুই ভাবে ভালোবেসতে হবে। আমার যখন ইচ্ছে হবে আমি তোমার কাছ থেকে বউমার আদর নিবো আবার যখন ইচ্ছে হবে, মেয়ের আদর নিবো। পাবো তো?”
খুশিতে হৈহৈ করে উঠলেন মান্নাত বেগম।
—-“একশবার পাবে। আমি চাই আমার মেয়েটা সারাজীবন আমার কাছেই থাকুক। আদর-ভালোবাসা কোনো কিছুরই কমতি হবেনা।”
—-“সে কি! সব ভালোবাসা তুমি এমন করে একপক্ষে ঢেলে দিচ্ছো মা? এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না বলে দিলাম!”
রাদের অভিযোগের সুরে বলা কথাটা ভেসে এলো এদিকটাতে। পরিপ্রেক্ষিতে পাশ ফিরে তাকালো সবাই। মান্নাত বেগম হাসতে লাগলেন। ইলহাম রাদকে দেখিয়ে মান্নাত বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,
—-“মা সব সময় আমাকেই বেশি ভালোবাসতো। অতএব ভালোবাসা সব এই পক্ষেই ছিলো মশাই!”
রাদ নাক ফুলিয়ে বলল,
—-“বললেই হলো নাকি? আমি কি তবে মায়ের কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে?”
—-“হতেও পারেন।”
ফোঁড়ন কেটে বলল ইলহাম। রাদ মেকি রা/গের সহিত তাকালো। এক ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট নেড়ে কিছু একটা বললো। যা ইলহাম খুব সহজেই ধরে ফেললো। সুতরাং এখন যেন রাদকে রা/গিয়ে তোলাটাই তার আসল কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো। তাই মুচকি হেসে মান্নাত বেগমকে আরও ভালো করে জড়িয় ধরে বলে উঠলো,
—-“আশ্চর্য, এমন করে তাকানোর কি হলো হু? বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, মা নিজ মুখে বললে তো বিশ্বাস করবেন? ওয়েট.. মা? তুমিই বলে দাও তো, যে তুমি উনাকে কোথায় কুড়িয়ে পেয়েছিলো?”
অনন্যা এবং প্রণয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো। আরও অনেক লোকজন। সবাই নব বর-বধূর মিষ্টি ঝগড়া দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। মান্নাত বেগমও হাসছেন বাকিদের ন্যায়। তার বারবার মনে পড়ছে সেই তিনবছর পূর্বের কথা। ঠিক যেন সেই পুরনো স্মৃতি গুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।
—-“ও মা? বলো না প্লিজ!”
মান্নাত বেগম হাসতে হাসতে বললেন,
—-“হ্যাঁ রে বাবু, তোকে আমি সত্যি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম! ঐ যে তোর রহিম চাচা আছেন না? মোড়ের মাথায় সেকালে তার ছোট্ট একটা চায়ের দোকান ছিলো। একদিন তুমুল বর্ষনে বাড়ি ফেরা কালিন আমি আর তোর বাবা তোকে ঐ রহিম ভাইয়ের দোকানের সামনে থেকে কুড়িয়ে পাই।”
বলতে বলতে আরও শব্দ করে হেসে ওঠেন মান্নাত বেগম। রাদ চোখ মুখ ছোট করে কুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ইলহামের পানে। এক পর্যায়ে, “দাঁড়াও হচ্ছে তোমার”— বলেই তেড়ে আসে রাদ। উপস্থিত জনগনের ফেটে পড়া হাসিতে ঝনঝন করে কাঁপছে গোটা ছাদ। রাদকে তেড়ে আসতে দেখে, ” মা বাঁচাও” বলে উল্টোদিকে দৌড়ে যায় ইলহাম। তার পিছু ছুটে রাদ। সবাই তাদের কান্ড দেখছে। অনেকেই হাসতে হাসতে বলাবলি করছে, “বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর এতো সুন্দর মিল আগে কোনোদিন দেখিনি।”।
ইলহাম দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে চিলেকোঠার ছোট্ট ঘরটিতে। রাদ এখনও বেশ দূরে। ইলহাম দাঁড়িয়ে পড়ে এক কোনে আড়ালে। নিঃশ্বাস গুলো দলা পাকিয়ে ভারী হয়ে বিসর্জন হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে আশেপাশে তাকায় ইলহাম। ছাদে ওঠার আগেই পরে এই চিলেকোঠার ঘর। আজই প্রথম পদার্পণ ঘটে তার। দেখতে বেজায় অগোছালো। ইলহাম মনেমনে ঠিক করে, তাদের বিয়েটা হয়ে গেলে এই ঘরটাই হবে তার অবসর সময় কাটানোর ছোট্ট সর্গ। এখানে তার সকল উপন্যাসের বই গুলো দিয়ে ছোট্ট একটা লাইব্রেরি বানাবে। শিরিনকে বলবে কালই ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে।
চারিপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ ইলহামের চোখ আঁটকে পড়ে ভাঙা আলমারির ভেতর অস্পষ্ট কোনো জিনিসের উপর। ইলহাম তীব্র কৌতুহল নিয়ে পা বাড়ায়। নীচে অজস্র ময়লার স্তুপ যেন। গুনে গুনে পা ফেলারও জায়গা নেই। তবুও সে পৌঁছে গেলো ভা/ঙা আলমারির সম্মুখ পানে। কেননা, এই অস্পষ্ট জিনিসটা দেখার অদম্য ইচ্ছেটা বড্ড জ্বা/লাচ্ছে তাকে। ময়লার পাহাড় জমেছে জিনিসটা উপর। ইলহাম হাত এগিয়ে জিনিসটা টেনে আনতে আনতে উপলব্ধি করলো, এটা একটা ডায়েরি। ডায়েরি টা হাতে নিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ময়লা গুলো নীচে ফেললো। ডায়েরির উপরে একটা নাম দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ময়লাগুলো এমন ভাবে সেঁটে আছে যে লেখাটা বোঝার উপায় নেই। তবুও হাত ময়লা করে ডায়েরি টা পরিষ্কার করার চেষ্টা করলো ইলহাম। ততক্ষণে রাদ এসে হাজির হয়েছে তার পেছনে। ঠোঁটের কোনে তার দুষ্টু হাসি।
ইলহাম স্বার্থক হয়েছে নামটা বের করতে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরোনো ডায়েরি। কম হলেও আরও দশ বছরের পুরোনো। কিন্তু কার এটা?
”আমি ইলহ….”
ডায়েরির নামটা পুরোটা পড়া হলোনা ইলহামের। তার পূর্বেই কারোর হাতে হেঁচকা টান খেয়ে বেসামাল হয়ে সোজা এসে তার বুকে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় হ/তভ/ম্ব হয়ে গেলো ইলহাম। ভী/ত নয়নে উপরের দিকে তাকাতেই আরও ভড়কে গেলো। উনি কখন এলেন? কথাটা মনের ভেতর তোলপাড় শুরু করলো। পেছন থেকে ডায়েরিটা হাত থেকে পড়ে আবারও ময়লার জগতে হারিয়ে গেলো। অবশ্য সেদিকে ইলহামের খেয়াল নেই।
রাদ তার কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো,
—-“এবার কোথায় পালাবে হ্যাঁ? আমাকে ভেংচি কাটা? তোমার তো মজা হচ্ছে!”
ইলহামের মনে পড়লো, সে তখন বারবার রাদকে ভেংচি কাটছিলো। যার দরুণ, রাদ ইশারায় তাকে বলেছিলো “একবার হাতের কাছে পাই?”। অতঃপর সে মান্নাত বেগমকে উস্কাচ্ছিলো তাকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে সে কথা বলতে! কথাটা মনে পড়তেই অসহায় মুখ করে তাকালো ইলহাম। বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁট উল্টে বলল,
—-“আ..আমি কিছু করিনি!”
—-“আচ্ছা? আপনি কিচ্ছু করেননি? আমি কি তবে ভুল দেখেছিলাম?”
ভাবুক হওয়ার ভান করে কথাটা বলল রাদ। ইলহাম তুমুল গতিতে উপর নীচ করে মাথা নেড়ে বলল,
—-“সত্যি! আমি কিচ্ছু করিনি। আমারও মনে হয় আপনি ভুল দেখেছেন!”
রাদ বাঁকা হেসে ইলহামকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে নিজের সাথে। ইলহাম পূর্বের চেয়েও অধিক অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। রাদের মাথায় শ/য়/তা/নি বুদ্ধিদের হাতছানি চলছে। সে ফট করে ইলহামের ঠোঁটে একটা গাঢ় চুমু খেয়ে ঠোঁট কামড়ে দিলো। ইলহাম অবাক হতে হতে তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিলো সে ব্যা/থা পেয়েছে। যার দরুন গোঙানির ন্যায় শব্দ করলো। রাদ তাকে ছেড়ে দিয়ে এমন করে তাকালো যেন সে কিছু করেনি। ইলহাম ক্ষে/পা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোঁটে হাত চেপে কাতর কন্ঠে বলল,
—-“এটা কি করলেন?”
রাদ সম্পূর্ণ অপারগ। কিছুই বুঝতে পারছেনা,এমন ভাব করে বলল,
—-“কি করলাম?”
—-“ক..কামড়..”
—-“এই মেয়ে কি বলছো এসব? এখনও আমাদের বিয়েই হয়নি। তার আগেই তুমি কা’ম/ড়া-কা’ম/ড়ি.. তওবা তওবা!”
নাটকীয় সুরে কথাগুলো এমন ভাবে বলল রাদ, ইলহাম রীতিমতো বোবা হয়ে রইলো! অসহায় মুখ করে চেয়ে থাকলেও আর কোনো কথা আওড়াতে পারলোনা। রাদ তার কান্ড দেখে মনেমনে হেসে উঠলো। আশেপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে ফিসফিস বলল,
—-“রাত অব্দি এটলিস্ট ওয়েট করো সুইটহার্ট। বিয়ে তো তোমাকেই করছি!”
ইলহামের বোবা দৃষ্টি এবার যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। রা/গে দাঁত খিটমিট করে বলল,
—-“কি বললেন আপনি? আপনাকে তো আমি…”
কথাটা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই রাদ আলতো ছোঁয়ায় আলিঙ্গন করলো ইলহামের ওষ্ঠদয়। ইলহাম আবারও স্তব্ধ হয়ে পড়লো। রাদ এবার শব্দ করেই হাসলো। বলল,
—-“এতো তাড়া কিন্তু ভালো না বলে দিলাম।”
বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো রাদ। ইলহাম দাঁড়িয়ে রইলো বোবা হয়ে। মনে মনে দু’চারটে বকা বেশ রসকষ মিশিয়েই দিলো।
চলবে