প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ১৭

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত

#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—–১৭

——- এখন তো কয়েকটা লোম ছিঁড়েছি মাত্র। দ্বিতীয় বার ত্রি-কোয়াটার পড়লে আপনার পায়ের ওপর বোল্ডোজারই চালিয়ে দিব আমি!

হনহনিয়ে জায়গা ছেড়ে প্রস্হান করে আরশী। “টকটক ” শব্দ তুলে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায় নিচে।আর জায়গায় দাঁড়িয়েই তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় ইরশাদ! দৃষ্টিতে বিষ্ময় তার,আর মনে প্রশ্নের ঝড়! বুকের ভেতরটা অদ্ভুত ভাবে জ্বলছে এখন তার! আবার কলিজার ভেতর রাগ অগ্নিরুপে ছলতে উঠছে! তার আজ খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
” এতো বছর পর এই ঢং না করলেও হয়।দরকার নেই আমার কাউকে!”
নাহ, তার আর বলা হলো না কথাটি।

আসলে সব কথা আমরা সবসময় বলতে পারি না।যদি মনের চাপা সব কথাগুলো সামনের জনের সামনে ঠিকভাবে মেলে ধরা যেত, তাহলে হয়তো জিবনটা সহজ হয়ে যেত মানুষের।কিন্তু মানুষ সেইটা পারে না।কিছু মানুষ আছে যারা তাদের মনের আবেগটুকু উজার করে বলতে পারে, কিন্তু কারো প্রতি অনুযোগটা দেখাতে পারে না।তারা রেগে কষ্ট পায়, নিজের কল্পনায় ভিন্ন কাহিনী বানিয়ে বেদনায় দগ্ধ হয়।কিন্তু সামনের মানুষটির কাছে অতি স্বাভাবিক ভাবেই ধরা দেয়।এইটা তার দোষও বলা চলে আবার তার গুণ ও। দোষ একারণে, সে নিজেকে কষ্ট দেয়। আর গুণ এজন্যই বলা চলে, সে সামনের মানুষটির কষ্টের কারণ হয়ে উঠে না। তবে সবকিছুর সহনশীলতার একটি মাত্রা থাকে। যেদিন তা অতিক্রম করে, সেদিনই ব্যাক্তি ভূল করে বসে! এই ভূল কেবল সাধারণ ভূল নয় এই ভূল সামনের জনকে কোন ধারালো বস্তু ছাড়ায় ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়াএমন ভূল!

এই কারণেই হয়তো গুনিজনরা বলেন, মনের কথা চেপে রাখার চেয়ে মুখের সামনে বলে দেওয়াটা উত্তম। তবে ইরশাদ মূলত চাপা স্বভাবের মানুষ। সে নিজের সবকিছুই চেপে রাখতে ভালোবাসে। আবেগী ইরশাদ তার আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণ করেই আনন্দ পায়! আর তাই হয়তো আরশীর এতো কথা নিঃশব্দেই শুনে গেছে সে আজ। কিন্তু সময়টা সবসময় একরকম হয় না। মাঝে মাঝে ধর্যের ও বাধ ভাঙ্গে।আর আরশী হয়তো খেয়ালই করে নি তার করা এই ব্যবহার, চেপে থাকা আবেগের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে! আর এর সময়টা সে তার অজান্তেই সনিকটে নিয়ে আসছে!

সবাই মিলে বের হয়েছে রাতের খাবার খেতে।রাজ্য যুব কেন্দ্রের ডরমেটরির (মৌলালি) ঠিক উল্টো পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান। মাত্র ১৫-২০ টাকায় লুচি আর আলুর দম বিক্রি করছে এখানে।আর এর শেষে মিষ্টিও মিলবে। শুকনো পাতার তৈরি ছোট ছোট বাটিতে পরিবেশন করা খাবারের দোকানগুলো আহামরি সাজানো-গোছানো না হলেও খাবার যে বেশ মজার হবে দেখলেই যেন বোঝা যায়।

তারা আশপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলো। হুট করে কিছু কেনার চেয়ে ঘুরে দেখতেই বেশী ইচ্ছে হলো তাদের। কলকাতার বাঙ্গালীরা প্রচন্ড আন্তরিক। যেকোন বিষয় সম্পর্কে জিঙ্গেস করলেই মুচকি হেঁসে জবাব দেয় তারা। আর একারণে ঘুরতেই একধরনের মজা কাজ করছে তাদের মাঝে।

মেয়েরা টুকিটাকি শপিং এ ব্যাস্ত৷হালকা পাতলা শপিং না করলে যেন তাদের চলছেই না। নিজেদের ভেতর আলাপ করতে করতে কয়েক দোকান ঘুরে এইটা ঐটা কিনছে তারা। আর সেদিকে তাকিয়ে কোমড়ে হাত গুঁজে, হতাশ স্বরে বলে উঠলো সাগর,
—– এদের কে তুই মাটির নিচে পাঠায় দে।দেখবি সেখানেও কিছু না কিছু শপিং করে নিয়ে আসবে এরা। বুঝলি ইরশাদ মেয়েদের অন্যনামই হলো শপিং। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও নাকি ধান ভাঙ্গে।আর এরা সেখানে গেলেও শপিংএ ব্যাস্ত হয়ে যাবে!

সাগরের কথায় খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে সবাই! আর বন্যা সেদিকে তাকিয়ে ভেঙ্চি কাটে। তারপর আবার তারা নিজেদের কাজেই মগ্ন হয়ে যায়।

ছেলেদের কোন কিছু কেনার নেই আর তাই তারা দোকান থেকে বেরিয়ে ডরমেটরির পাশে এসে দাঁড়ায়। আশেপাশে চোখ বোলাতেই একজন দোকানি চোখে পড়ে তাদের।দোকানির কাজ দেখে অবাক হয় সবাই।
দোকানি বিশাল একটি পরোটা ছিঁড়েছিঁড়ে নিক্তিতে মাপছেন। ১০ টাকায় একশো গ্রাম পরোটা আর পাঁচ টাকার বুটের ডাল, সঙ্গে বেশ বড় পেয়াজের টুকরো প্লেটে সাজিয়ে দিলেন তিনি দুই পুলিশকে! ইরহামকে প্রচন্ড অবাক করলো বিষয়টি!৷ সে পরোটা ছেঁড়ার কারণ জানতে চাইলে দোকানি বলার আগে দুই পুলিশের একজন বলে উঠলেন,
—— বিশাল বিশাল পরোটা, একটি একজনের পক্ষে খাওয়া মুশকিল। আর চায়লে আপনারাও খেয়ে দেখতে পারেন, আপনাদের ঢাকায় এমন পরোটা পাবেন না।

তার কথায় মুচকি হেঁসে তারাও নিল একপ্লেট। খেতে বেশ ভালোই। তবে নিউমার্কেট এলাকার আশপাশের দোকানগুলোতে বড় লুচি বা পুরির সঙ্গে চানাবুট, ডাল বা সবজিগুলো দেখতেও দারুণ মনে হচ্ছে তাদের । আর এগুলোর দাম ৪০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যেই। যা অন্যান্য এলাকার তুলনায় একটু বেশি। কিন্তু মেয়েরা আসতেই তারা সেখান থেকে খেতে চায়লো।
সত্যিই অসাধারণ খাবারগুলো একেকজন যেন পেট পুরে খাওয়ার কম্পিটিশনে লেগে গেল। হুট করে ইরশাদ বাকি অর্ডার গুলো ক্যান্সেল করে দাঁড়িয়ে পড়লো! বন্যা সেদিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বলল,
—– ইয়ার আর একটু খায়।মাত্র সাতটা বাজে। সকাল হতে হতে আমার পেটের মধ্যে ঘোড়ার দৌড় লাগবে খাবারের অভাবে।পেট বলবে ভাই খাবার দে, খাবার দে নাহয় তোর কলিজা চিবিয়ে খাব!
—- আরো কিছু খাব তো আমরা। এখন উঠ। চল হেঁটে এলাকাটা ঘুরে দেখি।
ইরশাদের কথাটি পছন্দ হলো সবার।তারা আবার হাঁটতে লাগলো।

কলকাতার হাওড়া ব্রিজের উপর বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসার সাজিয়ে বসেন অসংখ্য নারী-পুরুষ। সেখানে মাত্র ৩০ রুপিতে বিক্রি হচ্ছে ক্যাপসিকাম। গাজর ও আছে যা সরু আর লম্বা ধরনের। মার্চের শেষ দিকে কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় যখন পাকা আম বিক্রি হচ্ছে তখন আমাদের দেশের আম ডালে দেওয়ার মতো বড় হয়েছে।

ফলের দোকানগুলোতে আস্ত আলু বোখারা দেখা গেল। খয়েরি রঙের ফলটি আস্ত অবস্থায় আগে কখনও দেখেনি তারা। কলকাতার ফলের দোকানগুলোতে বিক্রি হতে আরো দেখা গেল ‘টমাটিলো’ নামে বুনো এক ধরনের টমেটো জাতীয় ফল। আমাদের এখানে বনে-জঙ্গলে খোসায় মোড়া টমেটোর মতো ফলটি দেখেছিলো তিতাস ছোটবেলায়। তবে এটি এখনও আমাদের কাছে বাণিজ্যিক রূপ পায়নি। কিন্তু এখানে গণহারে বিক্রি হচ্ছে।

মার্কুইস স্ট্রিট, গালিব স্ট্রিট ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে আবদুল খালেক হোটেল, প্রিন্স, রাঁধুনী, কস্তুরী, ধানসিঁড়িসহ বেশ কয়েকটি মাঝারি মানের খাবারের হোটেল রয়েছে।ইরশাদ একটি দোকানে ডুকেই ওয়েটার থেকে জিজ্ঞেস করলো এখানে মাংস জবাই ইসলামী কায়দায় হয়েছে কিনা । আরশী অবাক হয়ে তাকালো তার দিকে! তারপর বিস্মিতভাবেই জিঙ্গেস করলো,
—– কিছু মনে করবেন না ওনারা? এভাবে বললেন কেন?
ইরশাদ না সূচক মাথা ঝাঁকালো তারপর,
—– বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ পর্যটক এই এলাকায় বেশি থাকেন বলে এমন প্রশ্নে অভ্যস্ত এখানকার হোটেল কর্তৃপক্ষরা। দেখেন নি কতো সহজভাবে উত্তর দিল?
আরশী মুচকি হেঁসে বুঝদার ভাবে মাথা ঝাঁকালো।আর তারপর তারা কস্তুরী হোটেলেই খাবারের অর্ডার দিল।

এ হোটেলগুলোর মধ্যে কস্তুরীর খাবার বেশ মজার, এরপরেই রাঁধুনীর অবস্থান। তাছাড়া আবদুল খালেকের খাবারও সুস্বাদু তবে সেখানে বসার জায়গা পাওয়া কঠিন তাই তারা এখানে বসলো।
কস্তুরী হোটেলের আলুপোস্ত, চিংড়ি আর পোস্ত দিয়ে কঁচুশাক, সরষে দিয়ে ভেটকি এবং ভাপা ভেটকির স্বাদের তুলনা হয় না।তারা এগুলোই অর্ডার দিল। খাবার দেখে বন্যার মাথায় হাত! সে নাক ফুলিয়ে বলল,
—- পেটে জায়গা আছে নাকি আমার? এখন কি এগুলো পেটের বাইরে বেঁধে নিব? আগে বললি না ক্যান?ইশ দেখতে কতো ইয়ামী লাগছে!
—— আপু পোস্ত দিয়ে কচুশাক টা খাও। ইশ এই রেসিপি লাগবে আমার।
চোখ বুঝে খাবারের স্বাদ নিতে নিতে বলল আরশী। ইরশাদ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো৷ আরশীকে এখন দেখাচ্ছে বাচ্চাদের মতো। তার হলদে মুখটি যেন লাইটের অালোতে সোনালী মনে হচ্ছে! ইরশাদ অপলকে কিছুসময় ধরে দেখলো তাকে।ঠিক তখন বন্যা তাকে ধাক্কিয়ে আবার বলল,
—– এখন আমার কি হবে রে? পেটে তো জায়গায় নাই!
ইরশাদ শুনেনি এমন ভাব করে খাবার খাওয়ায় মন দিল কারণ এখন কথা বলা মানে বন্যার পেনপেন সহ্য করা!
তাদের ভাতের সঙ্গে পাপড়ও পরিবেশন করা হলো যা তাদের জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা।

কলকাতার অন্যতম আকর্ষণ মাটির ছোট ভাড়ে চা পরিবেশন। চলার পথে আনাচে-কানাচে এমন চায়ের দোকানের অভাব নেই। পাঁচ রূপিতে ছোট্ট মাটির পাত্রে একবার চা পান না করলে যেন আফসোস থেকে যাবে পর্যটকের।তারপর আয়েস করে রাস্তার পাশে বসেই চা পান করলো সবাই।

রাস্তার ধার ঘেসে হাঁটছে সবাই। সময় রাত নয়টা। আকাশে থালার মতো একফালি চাঁদ উঠেছে। চতুর্পাশের ঝকঝকে আলোতে চাঁদের চাঁদনী দেখা মুসকিল। তবে এই ঝিকিমিকি পরিবেশটাও মনোমুগ্ধকর! সবাই যে যার মতো গল্পে মত্ত। ইরশাদ আর সাগর আশেপাশের এইটা ওটার সাথে অন্যকিছুর সাদৃশ্য করে হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে। মাঝে মাঝে তাদের সাথে যুক্ত হচ্ছে বন্যাও। অন্যদিকে তিশা-তিতাসের কথা ভিন্ন। তারা একজনের মুঠোর ভেতর অন্যের হাত পুরে প্রকৃতির নির্মলতা উপভোগ করছে। তিশা আলতোভাবে মাথা এলিয়ে দিয়েছে তিতাসের কাঁধে। আর তিতাস সেইভাবেই তার সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে চলছে! এমন ভালোবাসাময় একটি জুড়ি দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায় সবার!

আরশী আনমনে কিছু চিন্তা করতে করতে সবাইকে ছেড়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছে।আচমকা ইরহাম দৌড়ে গিয়ে তার হাতটি চেপে ধরলো! আরশী চমকে অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে,তাড়াতাড়ি হাতটি সরিয়ে নিতে চায়লো। কিন্তু ইরহাম তা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, আরো জোরে চেপে ধরলো তার হাত! তারপর ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো
—- প্রি হানিমুনে এসেছি আমরা। হাতটাও তো ধরা যায় কি বল?
আরশী আমতাআমতা করে তাকায় তার দিকে। এই মুহূর্তে ইরহামকে কিছু বলার ভাষা যেন নেই তার মাঝে। অন্যদিকে তার হাত সরিয়ে নেওয়াটাকেও অন্য মিনিং দিচ্ছে ইরহাম! সে ইতস্ততভাবে ভাবতে লাগলো কি করা যায়!

আরশী দৃষ্টিতে বিষ্ময় ঢেলে তাকিয়ে আছে ইরহামের দিকে! ঠিক তখনি তাদের দিকে চোখ পড়লো ইরশাদের!
ইরহামের মুখটি আরশীর গালের অনেকটা কাছে আর আরশী তাকিয়ে আছে ইরহামের দিকে! দুজনের হাতদুটো মুষ্টিমেয়! ইরশাদের চোখের সামনে যেন কেবল এই দৃশ্যটি ধরা পড়লো! বুকের ভেতরটা সাথে সাথে ধক করে উঠলো তার! ঠিক তখুনি হাসতে হাসতে বলে উঠলো সাগর,
—– আহ্হারে দু’দুইটা কাপলের মাঝে সিঙ্গেল পাবলিক কেবল আমরা। এই জিবন রেখে আর লাভ কি রে আমাদের! চল ইরশাদ কচুগাছের সাথে ফাঁসি দিয়ে আসি আমরা।
—– ও কেন যাবে? তুই যা। শুধু কচু না শক্ত কোন গাছের সাথেই ঝুলে পড় তুই।যাতে একদম ওপরের টিকেট কাটে তোর।
—- কিহ্! তুই আমার মৃত্যু কামনা করিস!

সাগরের করুণ চেহারাটির দিকে তাকিয়ে ভেঙ্চি কাটে বন্যা।অন্যদিকে ইরশাদ কান দিয়ে যেন কিছুই ডুকছে না। সে একপলকে সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
—– ওরা বিয়ে করবে সামনে। জামাই বৌ রোমান্স করবে না তো কে করবে?

ইরশাদের কথায় চমকে তার পানে তাকায় আরশী! কিন্তু ইরশাদ তা সম্পূর্ণ ইগনোর করে হনহনিয়ে হেঁটে হোটেলের ভেতর ডুকে পড়ে।যা আর কেউ বুঝতে না পারলেও আরশীর বুকের ভেতর ঝড়ের সৃষ্টি করে!

চলবে
( নেক্সট কালকেই দিব ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here