প্রেমনগর পর্ব ২১

#প্রেমনগর
পর্বঃ২১
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
রাফিকে তুলির দিকে চেয়ে থাকতে দেখে রৌদ্র কাশি দিয়ে উঠলো। কাশির শব্দ শুনে রাফির হুশ হয়। রাফি কিছু বলতে যাবে তখনই মনিরা বেগম রুমে এসে উপস্থিত হলেন।
মনিরা বেগমঃ একি তোমরা সবাই এখানে এসে ভিড় জমিয়েছো কেন। আমার ছেলেটাকে এখন একটু বিশ্রাম নিতে দাও! যা ধকল গেছে ওর ওপর। ও সুস্থ হলে গল্প করো কেমন! তোমরা বরং এখন নিচে এসো। আমি নাস্তা দিচ্ছি। এসো।
.
মনিরা বেগমের কথা শুনে রাফির মুখে মুক্তোর হাসি ছড়িয়ে পরছে।
রাফি হাসতে হাসতে বলছে, জি আন্টি! ওর এখন প্রচুর বিশ্রাম নেয়া উচিত!
মনিরা বেগমঃ হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক বলেছো,
মনিরা বেগম তুলির দিকে তাকিয়ে ওকেও উদ্দেশ্য করে বললো, তোমরা দুজনেই বরং এখন নিচে এসে গল্প করো৷ ছেলেটা আমার বিশ্রাম নিক।
.
রাফির কপালে এভাবে সুযোগ চলে আসবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। মনিরা বেগম রুম ত্যাগ করার পর তুলিও নিচে চলে গেল। আর রাফি রুম থেকে বের হওয়ার আগে হাসতে হাসতে রৌদ্রের তাকিয়ে এক চোখ টিপ দিলো।
রৌদ্রঃ কি ব্যাপার! তোকে এতো খুশি খুশি লাগছে যে!
রাফি তার ডান হাতটা বুকের পা পাশে ধরে বলে উঠলো, দিল তো পাগল হ্যায়!
বলেই দরজার পর্দা সরিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। কেন যেন রৌদ্রের কাছে ব্যাপারটা অসহ্য লাগলো।
.
তুলি ড্রইংরুমে না বসে রুমে চলে গেছে। রাফি ড্রইংরুমে বসে উঁকিঝুঁকি মারছিলো। তখনই অহনা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছিলো। রাফিকে উঁকি মারতে দেখেই অহনা নিচে নামতে নামতে বললো, এ্যাই ছেলে তুমি কাকে খুঁজছো! হুম?
অহনার কথায় রাফি কাশি দিয়ে ওঠে। অহনা নিচে নেমে এসেছে৷
রাফিঃ মানে আন্টিকে খুঁজছিলাম!
.
মুখে রাফি এটা বললেও মনে মনে রাফি তুলিকে খুঁজছিলো। তার তো তুলির সাথে গল্প করার কথা ছিলো। কিন্তু তুলি তো এখানে না বসে ভিতরে চলে গেছে।
অহনাঃ এ্যাই ছেলে আবার কি ভাবছো?
রাফিঃ আমি আন্টিকেই খুঁজছিলাম। আমার আবার বাড়ি যেতে হবে তো। তাই ভাবছিলাম আন্টিকে বলেই যাই।
তখনই আফতাব চৌধুরী ড্রইংরুমে চলে এলো৷
আফতাব চৌধুরীঃ যাবে মানে! এখনি কিসের যাওয়া। আমার ছেলের পিছনে তুমিও কম খাটুনি করো নি। তাই আজ আমাদের সবার সাথে রাতের খাবার খেয়ে তবেই যাবে!
রাফিঃ ইয়ে মানে আংকেল!
আফতাব চৌধুরী রাফির পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, কোনো মানে টানে নেই! বড্ড ভালো ছেলে বাবা তুমি! তুমিও তো আমার ছেলের মতোই। বাবার কথা ফেলতে নেই৷
রাফিঃ জি আংকেল।
.
মনে মনে রাফি বেশ খুশিই হলো। এই সুযোগে তুলির সাথে হয়তো আবারও দেখা হয়ে যাবে। মনিরা বেগম রৌদ্রের ঘরে কফির মগ হাতে নিয়ে ঢুকতেই খেয়াল করলেন রৌদ্র খুব মনোযোগ দিয়ে উপরে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে।
মনিরা বেগমঃ কি বাবা! কি এতো চিন্তা করছিস!
মায়ের কথায় রৌদ্র এদিকে ঘাড় ঘোরালো৷
রৌদ্রঃ কিছুনা মা! রাফি চলে গেছে?
মনিরা বেগমঃ না। রাতের খাবার খেয়ে যাবে।
রৌদ্র মনে মনে ভাবছে, আগে তো বেটা আমার বাড়িতেই আসলেই নানান রকমের তাড়া দেখাতো। এখন হঠাৎ করে সেটা কিভাবে পাল্টে গেল! ওরে তো আমি ভালো করেই চিনি। ঘাবলা তো একটা নিশ্চয়ই আছে! ব্যাটার মতলবটা কি!
.
অহনা তুলির রুমটায় এসে দেখলো তুলি বিছানায় বসে বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন এক মনে চিন্তা করছে। অহনা যে রুমে এসেছে, সেটা ও বুঝতেই পারেনি৷
অহনাঃ কিরে কি এতো ভাবছিস!
অহনার কথায় তুলি চমকে উঠলো।
তুলিঃ আপা তুই? দুলাভাই কোথায়?
অহনা বিছানায় বসতে বসতে বললো,ওর আর কাজ কি, ডাক্তার সাহেব হাসপাতালে গেছেন রোগী দেখতে। কিন্তু তোর মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেন?
তুলিঃ আপা?
অহনাঃকি?
তুলি বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেল। অহনাও উঠে তুলির পিছনে পিছনে যেতে যেতে বললো, আরে কি হয়েছে?
তুলি অহনার দিকে মুখ করে ঘুরলো।
তুলিঃ আপা শোন?
অহনাঃ হুম। কি হয়েছে?
তুলিঃ আপা আমার কি জানি হইছে!
অহনাঃ কি হয়েছে?
তুলিঃ আপা! আপা আমি সারাক্ষণ তোর ছোট দেবররে নিয়া ভাবি! বড়ই শরমের কথা! আমি এক সেকেন্ডের লিগা তারে ভুলবার পারিনা। আমার লাইগাই তার এমনডা হইছে! আমার এহন সারাক্ষণ শুধু হের চিন্তা হয়! আমি কি করুম আপা?
অহনাঃ ধুর পাগলী!
তুলিঃ আপা আমি তার চিন্তায় ঘুমাইবার পারিনা। সারাক্ষণ তারে চোক্ষের সামনে দেখবার মন চায়!
অহনা এবার তার দুই ভ্রু নাচিয়ে বললো, প্রেমে ট্রেমে আবার পরিস তো! হুম?
তুলিঃ পিরিত? আমি কিছু জানিনা আপা! আমি তার চিন্তায় খাইবার পারিনা, ঘুমাইবার পারিনা, সব সময় তার সুন্দর মুখডা আমার চোক্ষের সামনে ভাসে!
অহনাঃ হুম বুঝলাম। সিরিয়াস কেস! তোর প্রেম রোগ হয়েছে।
তুলিঃ কি কস আপা! এহন আমার কি হইবো!
অহনাঃ কি আর করবি! প্রেমে ডুবে থাক। হাহাহা…
তখনই অহনার ফোনের রিংটন বাজতে শুরু করে। আকাশ ফোন দিয়েছে। অহনা কলটা রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
.
মেঘ নীলাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসেছে। নীলাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মেঘ নীলাকে বলছে, দয়া করে এবার বাড়ির ভিতরে যা! তোর বাবা মা নিশ্চিয়ই অনেক চিন্তা করছে। পরে এসব ব্যপার তো সেই আমার ঘারে এসেই পরে। তোর বাবা তো শুধু আমাকেই সন্দেহ করে!
তখনই উপরে দুতলায় বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে নীলার বাবা রেজা খান জোরে জোরে চেচিয়ে বলে উঠলেন,কে? জামাই বাবা? তা বাবা তুমি বাহিরে দাঁড়িয়ে কেন! ভিতরে এসো! আমার মেয়েকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে এসো বাবা!
.
নীলার বাবার কন্ঠস্বর শুনে ভয়ে মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। ফিসফিস করে নীলার কানে কানে বললো, সেই তো আমায় আবার বিপদে ফেললি! এতোক্ষনে তুই তোর বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেই পারতিস! ইয়া মাবুদ আজ আমায় রক্ষা করো। আবার না কোন বিপদে আমায় ফেলে!
রেজা খানঃ কি হলো তোমরা এখনো বাহিরে দাঁড়িয়ে কেন।
.
ভয়ে মেঘ ঘামতে ঘামতে নীলাকে নিয়ে নীলাদের বাড়িতে পা দিলো। ভিতরে যাওয়ার পরও রেজা খান মেঘকে জামাই বাবা জামাই বাবা বলেই ডেকে যাচ্ছে। ভয়ে মেঘ আরও ঘামতে শুরু করেছে। আজ নিশ্চিত জামাই আদর করেই এরা ছেড়ে দেবে।
রেজা খান চিল্লিয়ে বললেন,কই গো আমাদের জামাই বাবার খাতির যত্ন আর খাবার দাবাবের ব্যবস্থা করো।
এসব শুনে মেঘের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। নীলা তার রুমে চলে গেছে ফ্রেস হতে।
মেঘঃ এসব আপনি কি বলছেন আংকেল!
রেজা খান এবার চেচিয়ে উঠলেন, আরে, কিসের আংকেল! বাবা বলো বাবা!
.
ভয়ে মেঘ ঢোক গিলতেও পারছে না। গলায় কিছু যেন আটকে পরেছে। আজ নিশ্চিত বড় রকমের কোনো গনধোলাই দেয়ার জন্য উনি এরকম নাটক করে অভিনয় কার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। উনাকে আজ পাকা ভিলেন মনে হতে লাগলো।
মেঘঃ পানি! আমি পানি খাব!
রেজা খান মেঘের পিঠে চাপড় দিয়ে মেঘকে শোফার দিকে ঠেলে দিলেন তারপর বললেন, আরে বসো বেটা! আরাম করে বসো!
কই গো, জামাই বাবার জন্য শরবত পাঠিয়ে দেও।
মেঘ ধপ করে শোফায় বসে পরলো। ভয়ে মেঘ প্রচুর ঘামতে শুরু করেছে। রেজা খান মেঘের এমন অবস্থা দেখে বলে উঠলো,বাবা কোনো সমস্যা?
মেঘের কথা যেন আটকে গেছে। সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না বোধহয় উত্তর দিলো। ড্রইংরুমে সত্যি সত্যি শরবতসহ বিভিন্ন রাজকীয় সব খাবার এসে গেলো।
রেজা খানঃ নেও বাবা এবার খাওয়া শুরু করো করো! আমি নীলাকেও ডাকছি। নীলা? মামনি এখানে এসো!
.
ওদিকে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে রাফির চোখ শুধু তুলির দিকেই যাচ্ছিলো। তুলি একটু খেয়েই উঠে যায়। মুখটা ছিলো তার ভীষণ মলিন। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে সোজা রৌদ্রের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যা হবার হবে এটা ভেবে তুলি সাহস নিয়ে ভিতরে ঢুকে পরলো। ভিতরে ঢুকে দেয়ালের দিকে চোখ যাওয়ার সাথেই লজ্জায় তুলি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দাঁড়ালো৷ রৌদ্র শুয়ে থেকে ওয়াল টিভিতে ভিডিও গান দেখছিলো। সেদিনের মতো শুধু ব্রা পেন্টি পরা মেয়েদের নাচ দেখছিলো সে। রৌদ্র টিভিটা তাড়াতাড়ি অফ করার জন্য রিমোটটা চাল্লাচ্ছে কিন্তু ওটা কোনো কাজ করছেনা। লজ্জায় তুলি রুম থেকে বের হয়ে যেতেই দরজার কাছে এসে রাফির সাথে ঢাক্কা খেল। রাফি তখনই রুমের ভিতরে ঢুকছিলো। সেই সময়ই রৌদ্র টিভিটা অফ করতে সক্ষম হয়।
তুলিঃ আরে ধ্যাত! আপনে খালি আমার লাগে বারি খান ক্যান?
রাফি তার মুখ সামনের দিকে বারিয়ে তুলির মুখের কাছে গিয়ে বললো, কেন ভালোই তো লাগে!
শুয়ে থেকেই রৌদ্র বলে উঠলো, তুই! আর তুমি কেন এসেছিলে তুলি?
তুলিঃ আপনি ঠিকমত রাইতে খাইছেন কিনা হেইডাই জানবার আইছিলাম! আপনে না খাইলে যে আমিও খাইবার পারিনা হেইডা কি আপনে জানেন?
.
তুলির মুখে এই কথা শুনে রাফির মুখ আমাবস্যার অন্ধকারের মতো হয়ে গেলো। রাফির মুখের ভঙ্গি এভাবে বদলে যাওয়াটা রৌদ্রের চোখ এড়ালো না। কেন যেন এতে সে একটু সস্তি পেল আর তুলির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বললো,আমি খেয়েছি তুলি! তুমি খাওনি?
তুলি মাথা নিচু করে আছে৷
রৌদ্রঃ কি হলো! তুমি খাওনি?
রাফি তো নিজের চোখে দেখেছে তুলি অল্প একটু খেয়েছে। রাফির মনে এবার ভয় ধরতে লাগলো। রৌদ্রের প্রতি কি তুলির কোনো দুর্বলতা জন্মেছে। না তা হতে দেয়া যায় না। তার আগেই তুলিকে হাত করে নিতে হবে।
.
তখনই রৌদ্র আর রাফির ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন সুন্দরী ক্লাসমেটরা হুড়মুড় করে রুমের ভিতরে ঢুকে পরলো। যারা তাদের ক্রাশ বয়ের প্রেমে পরে ডুব সাঁতার কাটছে। ওরা রৌদ্রকে দেখতে এসেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে রৌদ্রের মনোযোগ এখন তুলির দিকে। রৌদ্র রাফির গতিবিধি তাকিয়ে তাকিয়ে লক্ষ্য করছে৷
রাফিঃ তোরা কিছুক্ষণ গল্প কর! আমি একটু আসছি!
মেয়ে গুলোকে দেখে তুলি রুম থেকে বের হতেই রাফিও তুলির সাথে রুম থেকে বের হয়ে গেল৷ ব্যপারটা রৌদ্রের কাছে ভাল লাগলো না। রৌদ্রের খুব অসহ্য লাগছে। এরা কি বলছে কিছুই রৌদ্রের কানে যাচ্ছে না। এক পর্যয়ে বিরক্ত হয়ে এদের রুম থেকে চলে যেতে বললো। রৌদ্র বালিশের পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে রাফিকে কল করলো,কই তুই?
রাফিঃআমি তুলিকে নিয়ে একটু ছাদে এসেছি! কেন?
এটা শুনে রৌদ্রের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। এবার সে বির বির করে বলতে লাগলো, যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, নিশ্চয়ই ব্যাটার তুলির দিকে নজরটা পরেছে!
.
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here