#প্রেমের_হাতেখড়ি
#পর্ব:০২
#ফাতেমা_জান্নাত (লেখনীতে)
ঘড়ির কাঁ’টা রাত সাড়ে এগারো টার ঘরে এসে থেমেছে।কিন্তু জুনায়েদ আজমী আর শাহরিয়ার পাবেল এর গল্প এখনো শেষ হয়নি।দুই জন বন্ধু সাথে পাক্কা রাজনীতিবিদ ছিলো। সে সব নিয়েই গল্প করছে এখন।শাহরিয়ার পাবেল হচ্ছে প্রান্তিক এর বাবা।শাহরিয়ার পাবেল রাজনীতি থেকে নিজেকে ঘুটিয়ে নিয়েছে। এখন তার-ই মতো রাজনীতি এর পথে পা বাড়িয়ে কাজ করছে তার বড় ছেলে।জুনায়েদ আজমী এক বছর আগেই রাজনীতি থেকে সরে এসেছে।মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে।শ’ত্রু পক্ষের মেয়ের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়তে বেশি সময় লাগবে না।তাই তো রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।একমাত্র মেয়ের দিকে তাকিয়ে।
—বুঝলি পাবেল?অনেক দিন পরেই মনে হলো দুই বন্ধু সেই আগের জীবনে ফিরে গিয়েছি।
জুনায়েদ আজমীর কথায় শাহরিয়ার পাবেল হেসে উঠে বলে,
—তা কি আর বলতে?ভাগ্যিস অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দুই জনে পাশাপাশি বাসা কিনেছি। এবার রাত ভর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
—তো রাজনীতি পথটা ছাড়লি কেন?ভালোই তো করছিলি তুই?
—বয়স হয়েছে চারদিকের দৌড়াদৌড়ি তে শরীর খারাপ হয়ে যায় আরো।আমার এই অবস্থা দেখে বড় ছেলে বলেছে সে রাজনীতি তে যোগদান করবে।আমি যাতে এবার সরে আসি।আর ছেলেটা ও দেখলাম রাজনীতি করার প্রতি একটা আলাদা ঝোক আছে সাথে ভালোই বুঝে রাজনীতি। তাই আর না করিনি।এখন ওই-ই করছে সব।
—ছেলেটা কে তো দেখলাম না।এখানে থাকে না নাকি?
—ও শহরের বাইরে আছে কাজে।আগামীকাল আসবে ইনশাল্লাহ।
—যাক ভালোই।
🌸🌸
সকাল সাতটা বাজে।জান্নাত নাস্তা করতে নিচে এসেছে।জুনায়েদ আজমী টিভিতে নিউজ দেখছে।জান্নাত একবার নিউজটা দেখে আবারো সেই দুই বিরোধী দলের মা’রামা’রির খবর।এসব প্রতিদিন দেখতে দেখতে বিরক্ত। বাবা কিভাবে এসব দেখে তার বুঝে আসছে না।রাহেলার ঢাকে জুনায়েদ আজমী আর জান্নাত দুই জনে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে নাস্তা করতে।কিছুক্ষণ পরে জুরাইন ও চলে আসে।
—আব্বু তুমি বিরক্ত হও না প্রতিদিন এসব নিউজ দেখতে দেখতে?
খাবার মাঝেই জান্নাতের এমন কথায় থমকে যায় জুনায়েদ আজমী। রাজনীতি মেয়েটা পছন্দ করে না তিনি সেটা জানে।কিন্তু কেন পছন্দ করে না তাও উনার জানার বাহিরে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
—আম্মু তুমি কি ভুলে গেছো তোমার বাবা একজন রাজনীতিবিদ ছিলো?
—না ভুলিনি আব্বু।কিন্তু প্রতিদিন এত রে’ষারে’ষি খবর দেখতে ভালো লাগে না।মানুষের সমস্যা গুলো তো সমাধান হয়না।উল্টা দুই দলের কাড়াকাড়ি তে নির্দোষ মানুষ এর প্রাণ যায়।
—একদল চায় মানুষের ভালো করতে অন্যদল চায়না।তাইতো মা’রামা’রির সৃষ্টি হয়।তবে ইনশাল্লাহ একদিন গরীব মানুষের দেখা শুনার জন্য আল্লাহ কাউকে পাঠাবে।
—এসব কল্পনা করাও ভুল।
—পাবেল এর বড় ছেলে এবার এমপি পদে দাঁড়াবে। ছেলেটা মাশাল্লা বড্ড ভালো। ও যদি এমপি হয়ে যায়।মানুষের ভালোর জন্য লাগামহীন কাজ করে যাবে আমি জানি।তখন দেখবে নির্দোষ মানুষ গুলো ও শান্তি পাবে।
পাবেল এর বড় ছেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়া জুনায়েদ আজমী কে দেখে সন্দেহের চোখে তাকালো জান্নাত। ইদানীং জুনায়েদ আজমী পাবেলের বড় ছেলের প্রশংসা একটু বেশি করছে তার কাছে।কিন্তু কেনো? তা বুঝতে পারছে না এখনো?
—তা এমপি পদে দাঁড়াক বা এম্বি লোড পদে দাঁড়াক। তাতে আমার কি?তুমি ওই ছেলের প্রশংসা আমার কাছে করছো কেন?
—এমনি বললাম আরকি।
মেয়েটার সামনে রাজনীতিবিদ কোনো ব্যক্তি কে নিয়ে সুনাম করা যায় না।চেঁতে উঠে।
জুনায়েদ আজমী খেয়ে উঠে চলে গেছেন। আজ দুই বন্ধু বের হবে একসাথে। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হতে চলে গেছে।
জুরাইন খাবার নিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।জান্নাত সেই দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ নজরে।তার ভাইয়ের মতিগতি তার কাছে ভালো ঠেকছে না।সামথিং ইজ ফিশি।
খাবার খেতে খেতে জুরাইন কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
—কিরে জুরু?খাচ্ছিস না যে। কোনো সমস্যা নাকি?
হঠাৎ জান্নাত এর কথায় জুরাইন কিছুটা আ’তকে উঠে।জান্নাত তাকিয়ে আছে ভাইয়ের মুখের দিকে।কি এমন বিষয় নিয়ে এতটাই চিন্তায় মগ্ন ছিলো যে জান্নাতের কথায় আতকে উঠলো। এই ছোট্ট ভাইয়ের এত কিসের চিন্তা ভাবনা?
জুরাইন চারদিকে একবার চোখ ভুলিয়ে নিলো। মা কিংবা বাবা আশেপাশে আছে কিনা?বাবা মাকে ধারেকাছে না দেখে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে জান্নাতের আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসে।কেউ যাতে না শুনে তাই অতি সন্তর্পণে জান্নাত কে সুধায়,
—আপু প্রেমে পড়লে কি খাওয়ার রুচি চলে যায়?
জুরাইন এর মুখ থেকে আচমকা প্রেমের কথা শুনে জান্নাত তব্দা খেয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।তার দশ বছরের ভাই কিনা প্রশ্ন করছে প্রেম নিয়ে?প্রেমে ট্রেমে পড়লো নাকি আবার?
জান্নাত অতিশয় নিজেকে ধাতস্থ করে জুরাইন কে বলে,
—কেন সে সব জেনে তোর কি কাজ?আর এই সব প্রেম ট্রেম এর কথা তোর মুখে কেন?এই বয়সে প্রেমের বুলি ফুটেছে মুখে।
জুরাইন ও নাছোড়বান্দা। সে আজ জেনেই ছাড়বে তার প্রশ্নের উত্তর। তাই বোনের কথায় পাত্তা না দিয়ে আবার বলে,
—এই আপু আরেকটা প্রশ্ন শুননা?প্রেমে পড়লে কি পেটের ভিতরে গুড়গুড় করে?
জুরাইন এর মুখ থেকে প্রেম ভিত্তিক রসায়ন এর কথা যত শুনছে তত জান্নাতে অষ্টম আশ্চর্য এ পৌছে গেছে।তার ভাই আবার এই বয়সে প্রেমে পড়লো না তো?
প্রশ্ন টা জুরাইন কেই ছু’ড়ে দিলো,
—জুরু বাই এনি সান্স, তুই আবার প্রেমে পড়িস নি তো?
জান্নাতের কথায় জুরাইন ব্লাশিং করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। যাওয়ার আগে পিছন ফিরে জান্নাত কে বলে গেলো,
—এইসব তুই বুঝবি না আপু।এসব বুঝার বয়স তোর এখনো হয় নাই।
বলেই জুরাইন এক ছুটে নিজের ঘরের দিকে চলে গেছে।আর রেখে গেছে জান্নাতের মাথায় ঘুরতে থাকা এক ঝাক প্রশ্ন। জান্নাত এখনো ভেবে পাচ্ছে না সে বড় নাকি জুরাইন বড়?জুরাইন কিনা তাকে বলে,প্রেমের বিষয়ে বুঝার বয়স এখনো হয় নাই?অথচ জুরাইন এর দশ বছর বয়স-ই এসব বুঝার বয়স?
জান্নাত কে ভ্যাবলা এর মতো বসে থাকতে দেখে রাহেলা এগিয়ে এসে জান্নাতের কাঁধে হাত রেখে বলে,
—কিরে এভাবে বসে আছিস কেন?খাচ্ছিস না যে?কি ভাবছিস এতো?
মায়ের কথায় জান্নাত সম্বিৎ ফিরে আসে।রাহেলার মুখের দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে বলে,
—আম্মু!আমি বড় নাকি জুরাইন বড়?
জান্নাতের মুখ থেকে এমন আবা’ল মার্কা কথা শুনে রাহেলা চটে গেলো। এই মেয়ে পা’গল টা’গল হলো নাকি?ও কি ভাবে জুরাইন এর ছোট হবে?রাহেলা তেজি গলায় জান্নাত কে স্বগতোক্তি করে,
—তোর মাথা ঠিক আছে?জুরাইন তোর বড় হতে যাবে কেন?
—না কিছু না।
বলেই জান্নাত উপরে চলে গেলো। আর পিছনে রাহেলা ছেলে মেয়ে দুটো কে বকছে।আজকাল দুইটা সন্তানের কথা কাজ উনার পছন্দ না।
🌸🌸
সময়ের কাঁ’টা সেকেন্ড মিনিটের ঘর ফেরিয়ে ঘন্টার ঘর ও অতিক্রম করছে। সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। প্রান্তিক এসেছে জুরাইন কে পড়াতে।ড্রয়িংরুম এ জান্নাত বসে আছে।প্রান্তিক কে উপরে যেতে দেখেই জান্নাত উঠে দাঁড়ায় প্রান্তিক এর সামনে গিয়ে বলে,
—আসসালামু আলাইকুম মিষ্টার ভুক্তভোগী টিউটর। কেমন আছেন?
জান্নাতের মুখে ভুক্তভোগী টিউটর কথাটা শুনে প্রান্তিক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
—ভুক্তভোগী টিউটর মানে?
—ওই যে আপনি বললেন না?আপনি আমার ইভটিজিং এর ভুক্তভোগী।আর জুরাইন এর টিউটর আপনি।তাই সব মিলিয়ে আপনার নাম ভুক্তভোগী টিউটর।
—একদম আজে বাজে নামে ডাকবেন না আমায়।আমার নাম প্রান্তিক। শাহরিয়ার প্রান্তিক।
—সে আপনার নাম প্রান্তিক হোক বা কার্তিক হোক।তাতে আমার কি?আমি তো আপনাকে ভুক্তভোগী টিউটর বলেই ডাকবো। আমার বাবার কাছে এসে আমার নামে নালিশ করা না?
—নালিশ দিয়েছি.বেশ করেছি।পথেঘাটে ছেলেদের ইভটিজিং করে আবার কথা বলছে।ইভটিজার কোথাকার।
—ভালো হবে না কিন্তু ভুক্তভোগী টিউটর। একদম আজে বাজে কথা বলবেন না।আমি ইভটিজিং করিনি।আমি গান গেয়েছি।আরেকবার গানটা শুনাই?
বলেই জান্নাত হাসতে হাসতে গাওয়া শুরু করবে তার আগেই প্রান্তিক দ্রুত কদমে জুরাইন এর ঘরে চলে যায়।দুই ভাই বোন কোন দিন তাকে পা’গল বানিয়ে পাবনার পা’গলা গারদে পাঠায় সেই চিন্তায় প্রান্তিক এর ঘুম চলে আসে চোখে।
🌸🌸
প্রান্তিক জুরাইন এর ঘরে এসে দেখে জুরাইন পড়ার টেবিলের মন ম’রা হয়ে বসে আছে।প্রান্তিক ভাবছে আজ আবার হলো কি?ছ্যাকা খেয়েছে নাকি?
প্রান্তিক গিয়ে চেয়ারে বসে।জুরাইন প্রান্তিক এর দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে আবার আগের ন্যায় মুখ চুপসে বসে থাকে।প্রান্তিক জুরাইন কে বলে,
—কি হয়েছে জুরাইন? কোনো কারণে মন খারাপ.?
প্রান্তিক এর প্রশ্নে জুরাইন একটু নড়েচড়ে বসে।প্রান্তিক এর দিকে প্রশ্ন তাক করে বলে,
—আচ্ছা ভাইয়া? প্রেমে পড়লে কি পড়াশুনায় মন বসে না বা থাকে না?
জুরাইন এর থেকে এমন কথার আশা প্রান্তিক করেনি।তাই কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। বুঝে গেছে তার স্টুডেন্ট বন্ধুদের সঙ্গ দোষে আজেবাজে কথায় আসক্ত হয়ে আজেবাজে চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছে।একে বুঝাতে হবে ঠান্ডা মাথায়।
প্রান্তিক শান্ত দৃষ্টিতে তে জুরাইন এর দিকে তাকিয়ে বলে,
—শুনো জুরাইন!এই সব প্রেম সম্পর্কিত সত্যিকার অর্থে তুমি কিছুই জানোনা বা বুঝোনা।আসল কথা হচ্ছে স্কুলে তোমার ফ্রেন্ড দের থেকে তুমি যা শুনো সেই গুলো তুমি মাথায় ক্যাচ করে নিয়ে ভাবতে থাকো সেই সব।তাই তোমার মাথায় আজেবাজে ভাবনা গুলো আসে।আর পাখি হয়তো তোমার সাথে একটু মিষ্টি করে আদর করে কথা বলছে। আর তা দেখে তুমি ভাবছো ও তোমাকে পছন্দ করে এমন করে।তাই তুমি ও ভাবছো তুমি ওর প্রেমে পড়ে গেছো? কিন্তু আসল সত্যি তা না।তুমি বন্ধুদের কথা গুলো বেশি ভাবার কারণেই পাখিকে দেখলে তোমার তা মনে হয়।একটা কথা মাথায় রাখো।তুমি চতুর্থ শ্রেণীতে আর পাখি ষষ্ঠ শ্রেণীতে। তোমার থেকে দুই বছরের বড় পাখি।এসব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পড়াশুনায় মন দাও।আর আগের বন্ধু দের থেকে সরে এসো।খারাপ বন্ধুদের সাথে মিশলে খারাপ চিন্তা ভাবনায় মাথায় আসবে।তোমার এই ছোট্ট বয়সে এসব কি ভাবে মাথায় আনো?সব কথার শেষ কথা।পাখিকে নিয়ে কিছু ভাবার দরকার নেই।পাখির থেকে যথেষ্ট দূরত্ব নিয়ে থাকবে।বন্ধুদের আজেবাজে কথায় কান দিবে না একদম।
অনেকক্ষণ কথা বলার পর প্রান্তিক থামে।তপ্ত নিশ্বাস ফেলে।জুরাইন এর দিকে তাকিয়ে দেখে জুরাইন চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।প্রান্তিক প্রাপ্তির হাসি হাসে।আশা রাখে জুরাইন তার কথা বুঝতে পেরেছে।তাই জুরাইন কে স্বগতোক্তি করে,
—আমি কি বলেছি বুঝতে পেরেছো জুরাইন??
প্রান্তিক এর প্রশ্নে জুরাইন নিরবতার ছেদ ঘটিয়ে প্রান্তিক এর দিকে তাকিয়ে বলে,
—জি বুঝেছি ভাইয়া।
প্রান্তিক মুচকি হেসে বলে,
—কি বুঝেছো?
— I love him
জুরাইন এর এমন কথায় প্রান্তিক পুরো তাজ্জব বনে গেলো যেনো। এতক্ষণ এই ছেলেকে কি বুঝিয়েছে।আর ও কি বলছে?প্রান্তিক মৃদু চেঁচিয়ে বলে,
—What??
—ইংরেজি বুঝেন না ভাইয়া? মানে আমি পাখিকে ভালোবাসি।
বলেই জুরাইন চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রান্তিক সেই দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকে।এই কোন স্টুডেন্ট এর পাল্লায় পড়লো? শখের বসে টিউটর হয়েছে। এমন স্টুডেন্ট কে পড়াতে আসছে যে অল্প বয়সে সব বুঝে পেকে বসে আছে।
প্রান্তিক মাথাটা উপরের দিকে তুলে হাত দুটা ও উপরে মোনাজাত এর মতো করে বলে
—হে আল্লাহ! এই পেকে যাওয়া পিচ্ছি বাচ্চাকে হেদায়েত দান করো।
বলুন সবাই আমিন..
চলবে ইনশাল্লাহ ✨#প্রেমের_হাতেখড়ি
#পর্ব:৩
#ফাতেমা_জান্নাত (লেখনীতে)
রাতের আধারে বেলকনিতে বসে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে জান্নাত।রাত বারোটা বাজে। এখনো চোখে ঘুম ধরেনি।তাই তো বেলকনিতে এসেছে।কাজের মেয়ে আহ্লাদী সিরিয়াল দেখছিলো। ড্রয়িংরুম এ এসে আহ্লাদীর সামনে গিয়ে দাড়াতেই চোখ তুলে তাকিয়ে জান্নাত কে বলে,
—কিছু লাগবো আপামণি?
জান্নাত একবার টিভির দিকে তাকায় এখনো সিরিয়াল চলছে টিভিতে। মেয়েটা একেবারে সিরিয়াল খোর।জান্নাত তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে,
—আমাকে কপি করে দিতে পারবি?
—আপনি ঘরে যান।আমি নিয়ে আসছি আপামণি।
—আচ্ছা।
বলেই জান্নাত আবার নিজের ঘরে এসে বেলকনিতে দাঁড়ায়। প্রান্তিকদের বাড়ির বাইরে একটা লাইট জ্ব’লছে। সেই লাইটের আলোয় তাদের সেই দিকটা পুরো আলোকিত হয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পরেই আহ্লাদী কপি নিয়ে এসে জান্নাতের হাতে দেয়।জান্নাতের পাশেই দাঁড়ায়। জান্নাত সেই দিকে তাকিয়ে বলে,
—রাত সোয়া বারোটা বাজে।ঘুমাবি না?
—ঘুম আসতেছে না আপামণি।
—তোর বাড়ির সবাই এখন কেমন আছে?
—আছে এখন আল্লাহর রহমতে ভালোই।আম্মা এখন ভালোই আছে।তাই বিকেলেই রওনা দিছি বাড়ি থেকে।আসতে আসতে আর কি রাত আটটা বাজি গেছে।
—ওহ!
বলেই জান্নাত চুপ করে গেলো। আহ্লাদী গেলো না।জান্নাতের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলো। দুই জনের মধ্যেই নিরবতা চলছে।হঠাৎ গাড়ির শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই দুই জনে বেলকনির নিচের দিকে তাকায়।পাশের বাসার দিকে কালো একটা গাড়ি এসে থেমেছে। পাশের বাসা তো প্রান্তিক দের বাসা।প্রান্তিক দের বাসার সামনেই গাড়িটা থেমেছে।
জান্নাত ভেবে কিছু বলবে তার আগেই আহ্লাদী চি’ৎকার করে বলে উঠে,
—চো’র আপামণি, প্রান্ত ভাইগো বাড়িত চো’র আইছে।
জান্নাত তব্দা খেয়ে যায়।চো’র মানে?কি বুঝাতে চাইছে আহ্লাদী। তাই আহ্লাদী এর দিকে তাকিয়ে বলে,
—মানে?কিসের চো’র? কই চো’র?
আহ্লাদী উৎকণ্ঠ হয়ে বলে,
—আপামণি এখনকার চো’ররা হাইফাই হয়ে মাইক্রো করে আসে।যাতে কেউ না বুঝতে পারে ও চো’র। প্রান্ত ভাইগো বাড়ির সামনে যেই গাড়ি থামছে।ওইটা চো’র গো গাড়ি।
জান্নাত অ’বাক হয়ে একবার গাড়ির দিকে তাকায়।আবার আহ্লাদীর দিকে তাকায়।গাড়ি থেকে এখনো কেউ বের হয়নি।তবে কি সত্যি এটা চো’র দের গাড়ি।
—আসলেই কি তাই?
আহ্লাদী আবার বলে উঠে,
—হ আপামণি। আমি যাই চো’র রে ধরতেছি।আপনে খালুজান রে নিয়ে আসেন।আজকে চো’রের গুষ্টি শুদ্ধ পুলিশে দিবো।
বলেই আহ্লাদী দৌড়ে চলে যায়।যাওয়ার সময় চো’র চো’র বলতে যায়।জান্নাত ও কপির মগটা বেলকনিতে রেলিং এর উপরে রেখে দৌড়ে যায় জুনায়েদ আজমীর ঘরের সামনে।
জুনায়েদ আজমীর ঘরের সামনে এসে দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করতেই জুনায়েদ আজমী উঠে এসে দরজা খুলে জান্নাত কে দেখে কিছু বলবে তার আগেই জান্নাত বলে উঠে,
—আব্বু পাবেল আংকেল দের বাসায় চো’র এসেছে।তাড়াতাড়ি চলো।
বলেই জান্নাত ছুট লাগালো।তার পিছনে জুনায়েদ আজমী ও ছুটতে লাগলো।রাহেলা ও ঘর থেকে মোবাইল টা নিয়ে তাদের পিছনে পিছনে ছুটে গেলো।
প্রান্তিক দের বাসার সামনে এসে দেখে কালো একটা গাড়ির সামনে চারটা ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।চারটার মুখেই মাক্স লাগানো। এবার আরো শিউর হয়ে গেলো এরা চো’র।
জুনায়েদ আজমী দৌড়ে গিয়ে ক্যাপ মাথায় দেওয়া একটা ছেলেকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাকি ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে,
—একদম পালাবি না।যেমন আচত তেমন দাঁড়িয়ে থাক।চু’রি করতে এসেছিস তাইনা?আজকে সব কটা কে পুলিশে দিবো।
বলেই জান্নাতের দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
—জান্নাত, তুই প্রান্তিক আর তোর পাবেল আংকেল কে ফোন দে তো।বল চো’র ধরেছি।তাড়াতাড়ি নিচে আসতে।
বলেই জুনায়েদ আজমী ধরে রাখা ছেলে টাকে আরো ঝাপটে ধরলো। আহ্লাদী একটা মোটা লাঠি নিয়ে বাকি তিনটা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আগন্তুক চার ছেলের মাথার উপর দিয়েই সব কিছু যাচ্ছে।কি হচ্ছে তাদের সাথে এসব কিছুই বুঝতে পারছে না।
জান্নাত জুনায়েদ আজমীর কথা মতো পাবেল কে ফোন করেছে।কিন্তু ফোন রিসিভ হচ্ছে না।তাই প্রান্তিক কে দিয়েছে।তিনবার রিং হতেই প্রান্তিক ফোন ধরে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,
—এতো রাতে ফোন দেওয়ার মানে কি?কে আপনি?
জান্নাত প্রান্তিক এর কথার উত্তর না দিয়ে বলে,
—মিষ্টার ভুক্তভোগী টিউটর। চো’র ধরা পড়েছে।তাড়াতাড়ি নিচে আসুন। আপনাদের বাসার সামনে চো’র ধরেছি।
চো’রের কথা শুনতেই প্রান্তিক ঘুম থেকে লাফ মে’রে উঠে ফোন কানে রেখেই চো’র চো’র করে চিল্লিয়ে উঠে।
ওই দিকে প্রান্তিক এর চিল্লানিতে জান্নাতের কানের পর্দা ফেটে গেলো যেন।জান্নাত খেঁকিয়ে উঠে ফোনেই বলে,
—এই চুপ করুন। চো’র নিচে আপনাদের বাসার সামনে ধরা পড়েছে।তাড়াতাড়ি নিচে আসুন আংকেল কে নিয়ে।
বলেই ফোন কে’টে দেয়।পাবেল কে আরো দুই বার ফোন দিতেই তিনি ফোন রিসিভ করে।জান্নাত সব কিছু বলে উনাকে।
প্রান্তিক নিচে এসে দেখে জুনায়েদ আজমী একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছে।ছেলেটা নড়চড় করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য।এবার প্রান্তিক ও গিয়ে ছেলেটা কে জড়িয়ে ধরে বলে,
—কিরে চো’র আমাদের বাসায় চু’রি করতে এসেছিস? এখন তো ধরা পড়ে গেলি।কি করবি এবার?
—প্রান্তিক আমাকে ছাড়।
হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ কানের কাছে আসতেই প্রান্তিক থেমে যায়।তবে ছেলেটা কে ছাড়ে না।ছেলেটা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
—এই চো’র তোর গলার আওয়াজ আমার বড় ভাইয়ার গলার আওয়াজ এর মতো কেন?ও তুই কণ্ঠ ও চেঞ্জ করতে পারিস বুঝি?
প্রান্তিক আরো কিছু বলবে ছেলেটা কে এর আগেই পাবেল এর কথায় থেমে যায়।চেঁচিয়ে বলে উঠে,
—প্রান্তিক প্রণয় কে ছাড়।তোরা ওকে এভাবে ঝাপটে ধরে আছিস কেন?
পাবেলের কথায় এবার প্রান্তিক ছেলেটা কে ছেড়ে দেয়।সাথে জুনায়েদ আজমী ও ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ পিছন থেকেই ঝাপটে ধরে ছিলো।
ছেলেটা মাথা থেকে ক্যাপ আর মুখ থেকে মাক্স সরাতেই প্রান্তিক আর জুনায়েদ আজমী হাজার বো’ল্টের ঝট’কা খায়।প্রান্তিক তো অ’বাক হয়ে বলে,
—ভাইয়া তুমি?
এবার তো জান্নাত, রাহেলা আর আহ্লাদী ও অ’বাক হয়ে তাকিয়ে আছে।তারমানে এতক্ষণ তারা সবাই যাকে চো’র ভেবেছিলো সে চো’র নয়।শাহরিয়ার পাবেল এর বড় ছেলে?
পাবেল এগিয়ে এসে জুনায়েদ আজমীর কাছে দাঁড়ায়। প্রণয় এর দিকে তাকিয়ে বলে,
—কিরে চিনতে পারিস নি ওকে?ও আমার বড় ছেলে প্রণয়। শাহরিয়ার প্রণয়।
পাবেলের কথায় জুনায়েদ আজমী বলে,
—ওকে তো চিনতে পেরেছি। মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছিলো। তাই পিছন থেকেই ওকে না চিনে ছেপে ধরেছি ভেবেছিলাম চো’র টোর হবে।
জুনায়েদ আজমীর কথায় প্রণয় সালাম দিয়ে হেসে বলে,
—আমি বুঝতে পেরেছি আংকেল। তাইতো জোর দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করিনি।পরে যদি আপনি ব্য’থা পেতেন ছাড়াতে গিয়ে।ভাগ্যিস আমাদের দুই বাসা ছাড়া কোনো বাসার কেউ আসেনি।তাহলে মান সম্মান সব যেতো আজ।
প্রণয়ের কথায় পাবেল,জুনায়েদ আজমী হেসে দেয়।
।প্রান্তিক ভ’য়ে চুপ করে আছে।ভুল বুঝে ভাইকে চো’র ভেবে ঝাপটে ধরেছে।তার ইচ্ছে করছে এখন গিয়ে জান্নাতের মাথাটা ফাটিয়ে দিতে।দুই ভাই বোন আস্ত বেজা’ল।
পাবেল হেসে জুনায়েদ কে বলে,
—তা এই চো’রের খবর তোকে এত রাতে দিলো কে?একেবারে ছুটে এলি।
পাবেলের কথায় জান্নাত মুখ কাছুমাছু করে রাহেলার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাহেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে দেয়।
জুনায়েদ আজমী কিছু বলবে তার আগেই জান্নাত রাহেলার পিছন থেকেই বলে উঠে,
—আব্বু আমাকে আহ্লাদী বলেছে।তাই তোমাকে বলেছি ।
জান্নাতের কথায় আহ্লাদী সামনে এসে বলে,
—খালুজান আমি কালা গাড়ি দেখেই ভাবছি চো’র। এখনকার চো’র রা তো হাইফাই স্টাইলে আসে।তাই আরকি।
—চুপ থাক।গ’র্দভ কোথাকার যা বাসায় যা।জুরাইন একা বাসায়।
জুনায়েদ আজমীর কথাই আহ্লাদী এক দৌড়ে বাসায়।এতক্ষণে রাহেলার আড়াল থেকে বের হয়ে আসে জান্নাত।প্রান্তিক বাসার ভিতরে চলে যায়।রোকসানা (প্রণয়,প্রান্তিক এর মা)রাহেলার সাথে কিছু কথা বলে তিনি ও বাসার ভিতরে চলে যায়।জুনায়েদ আজমী পাবেলের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।প্রণয় ও বাকি তিনটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছিলো।
জান্নাত ইতস্তত ভাবে প্রণয়ের পাশে গিয়ে বলে উঠে,
—শুনুন!
জান্নাতের কথায় প্রণয় জান্নাতের দিকে তাকায়।এতক্ষণ মেয়েটার দিকে তেমন ভাবে তাকায়নি। এখন জান্নাতের কথায় একটু মনযোগ দিয়ে তাকায়।প্রণয় জান্নাতের দিকে এক পলক তাকিয়েই অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নেয়।তবে মেয়েটার পুরো মুখশ্রী এর মধ্যে নাকের ডগায় ঠিক মাঝখানের লালছে কালো তিলটা নজর কাড়া।মুখের দিকে তাকালে ওই তিলেই সর্বপ্রথম চোখ যায়।
—সরি!!
জান্নাতের পুনরায় কথায় প্রণয় সম্বিৎ ফিরে আসে।ভ্রুকুটি কুঁচকে বলে,
—সরি ফর হোয়াট??
—আসলে আমি বুঝতে পারিনি।তাই আব্বু কে বলেছিলাম আর আব্বু আপনাকে ইয়া ভেবে ঝাপটে ধরেছে তাই সরি।
—ইট’স ওকে।আপনার বাবা ঝাপটে ধরেছে।আপনি তো ধরেননি। তাই সমস্যা নেই।
বলেই প্রণয় হেসে বাসার ভিতরে চলে যায়।আর পিছনে রেখে যায় তার কথায় স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া জান্নাত কে।
🌸🌸
—আপু আজকে তুই ভার্সিটি যাবি?
জুরাইন এর কথায় মোবাইল থেকে চোখ তুলে সেই দিকে তাকায় জান্নাত।স্কুলের ইউনিফর্ম গায়ে জুরাইন প্রশ্নাত্মক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।জান্নাত জুরাইন কে স্বগতোক্তি করে,
—কেন?কোনো প্রয়োজন তোর?
—গেলে আসার সময় আমার জন্য দুইটা লাল গোলাপ নিয়ে আসিছ।
—‘লাল গোলাপ দিয়ে তুই কি করবি? এই বয়সে লাল গোলাপের কি কাজ তোর’?
জান্নাতের কথায় জুরাইন বিরক্ত হলো।এত কেন প্রশ্ন করবে তাকে?তাই বিরক্ত নিয়েই খেঁকিয়ে উঠে বলে,
—আনতে বলেছি আনবি।এত কথা কেন বলছিস তুই?
জান্নাত ভাইয়ের কথায় এবার সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে বলে,
—সত্যি করে বল কি করবি গোলাপ দিয়ে।নয়তো আনবো না।
জুরাইন তেঁতে উঠে বলে,
—গোলাপজল বানাবো। তোর জামাই এর খাবারে গোলাপজল মিশিয়ে দিবো। যাতে ওয়াশরুমে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে যায়।তখন দেখবো কি করে আমাকে আর এত প্রশ্ন করিস তুই? বিরক্তিকর!
বলেই জুরাইন বাইরে গেলো জান্নাতের রুম থেকে।জান্নাত অ’বাক হয়ে ভাইয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে।এই তো ওপেন থ্রেড দিয়ে গেলো। একি আসলেই তার ভাই?আর জামাই আসলো কোথ থেকে?
🌸🌸
আহ্লাদী গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে জান্নাতের রুমে আসে।জান্নাত ড্রেসিংটেবিল এর সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছে। আহ্লাদী এসে জান্নাতের পাশে দাঁড়ায়। জান্নাত সেই দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচু করে বলে,
—‘কী’?
—আপামণি একটা দরকার ছিলো?
জান্নাত এবার মুখে বলে,
—বল কি দরকার।
—আপামণি জসীম বেবি পাওডার আছে আপনার কাছে?
আহ্লাদী এর কথায় জান্নাত তার দিকে তাকায়।জসীম বেবি পাওডার?এই আবার কোন রকমের পাওডার? এই প্রথম শুনলো এই নাম।জান্নাত নিজেকে অ’বাক এর চূড়া থেকে বের করে এনে বলে,
—জসীম বেবি পাওডার টা আবার কিরে আহ্লাদী? এই নামে কোনো পাওডার এর নাম আজ শুনলাম।
জান্নাতের কথার বিপরীতে আহ্লাদী কিছু বলবে।তার আগেই জান্নাতের রুমে ঢুকতে ঢুকতে জুরাইন বলে,
—আপু ওটা জনসন বেবি পাওডার। আদি আপা জসীম বেবি পাওডার বলে।
জুরাইন এর কথা শুনে জান্নাত পেট ছেপে হাসতে লাগলো। জসীম বেবি পাওডার। আহ্লাদী না থাকলে হয়তো এমন আজব পাওডার এর নাম শুনা হতো না।
চলবে ইনশাল্লাহ✨🖤