প্রেমোবর্ষণ পর্ব -০৫

#প্রেমোবর্ষণ

৫.

‘তোর ব্যক্তিগত পুরুষ হিসেবেই থাকব তোর পাশে। সাধ্য থাকে তো দূরে সরিয়ে দিস।’

পশ্চিমাকাশের লালচে আভা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কথা শেষ করে চলে গেছে পরশ ভাই। যেতে পথে একটিবারও আর ফিরে তাকাননি কলির দিকে। রাজশাহী ছেড়ে ঢাকায় তিনি কলির জন্য নয় নিজ কাজেই এসেছিলেন। সিভিল ইন্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডির সুযোগটা তিনি হাতের মুঠোয় পেয়েও হারাতে বসেছিলেন। ভুলত্রুটি কিছু ছিল কাগজপত্রে মূলত সেই ঝামেলার সুরাহা করতেই ঢাকায় এসেছেন। ভেবেছিলেন সেই ফাঁকে কলির সাথেও একটা মানসিক বোঝাপড়া করে নেবেন যেন শেষ মুহূর্তে ওই পুচকে মেয়েটিকে আপন করে পাবার একটি পথ তৈরি হয়। কিন্তু নাহ্ এমব্যাসির কাজ ভালোয় ভালোয় মিটলেও কোথাও কোন সুতো বাঁধা পড়েনি কলির মনে তার নামের। সেদিন ফুপুর বাড়িতে পা রেখেই দেখতে পেল পাত্রপক্ষ। ঠান্ডা, রসিক তার মেজাজটাতে গরম ঘি পড়ল যেন পাত্র দেখে। তবুও নিজেকে সাধ্যমত কুল এন্ড কিউট মানুষের মত বরফশীতল রেখে মিষ্টি কথায় পাত্র বিদায় করল। এতে ফলাফল কি! কলি উল্টো কল দিয়ে যাচ্ছে তাই আচরণ করল। পরশ ভাই প্রথমে চুপচাপ সব শুনে গেল তার পর যতটা সম্ভব ধীর গলায় বলল, ‘কাল বিকেল ঠিক চারটায় আসবি টিএসসিতে।’

এইটুকু বলেই পরশ ভাই কল কাটলেন। কলি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল আশফাক ভাইয়ের ঘরে। তারপাশে ছিল অন্য ভাই-বোনরাও। তাদের পেটুক আশফাক ভাই প্রেমিকাসহ ধরা পড়েছে চাচার সামনে সেই নিয়েই চলছিলো বাড়িতে হুলস্থুল কারবার। বোকাসোকা ভাইটা অনেক সুন্দর একটা মেয়ে পটিয়েছে এই নিয়েই চলছিল ভাইবোনদের আড্ডা। সে আড্ডায় কলির হাসি মিলিয়েছে ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা এক বাক্যে। কাজিনমহল ছেড়ে মাথাব্যথার বাহানায় এসে শুয়ে রইলো সেই দিন-রাত পুরো সময়। পরের দিনের অর্ধেকটাও কাটলো তেমন করেই। ভার্সিটিতে যাওয়ার তাড়া রইলো না, আর না বাড়ির কারো সামনে বসে গল্প করার আগ্রহ। বইয়ের পাতা উলটে-পালটে রেখে দিলো বিছানায়। পড়াশোনার ধার দিয়ে যাওয়া হলো না সারাদিন। দুপুরের পর গা ঝাড়া দিয়ে ঢুকে গেল বাথরুমে। ভালো করে চুল শ্যাম্পু করে গোসল শেষ করলো।নিজের ওয়্যারড্রোব খুঁজে খুঁজে বের করল বছর দুই পুরনো এক কূর্তি। পুরনো হলেও কূর্তিটা ছিল রাজশাহী থেকে কেনা। উহু, শুধু রাজশাহী নয় বরং পরশ ভাইয়ের নিজ ইনকামের টাকা থেকে কেনা। স্মৃতির পাতা থেকে একটু খানি নজর বুলাতেই দেখতে পেল সোনালি সেই দিনটা। কলি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে নানার বাড়ি গেল। মামা খুশি হয়ে হাজার তিনেক টাকা দিলেন পরশ ভাইকে। বলেছিলেন, এই টাকা নিয়ে কলি আর পিয়াকে কিছু খাইয়ে আনিস।

পরশ ভাই টাকাটা নিলেও কলি আর পিয়াকে নিয়ে কোথা গেল না বরং একটা পিজ্জা আর দুটো কোল্ডড্রিংস বাড়িতে এনে বলল খেয়ে নিস। বাকি টাকা নিজের পকেটে রেখে তিনি প্ল্যান করলেন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবেন। পিয়া বোকার মত পিজ্জা পেয়েই খুশি কিন্তু কলি সহজে ভুলল না। সে পরশকে বলল, মামাকে বলে দিব তুমি টাকা মেরে দিয়েছো। এক কথা, দুই কথায় অত বড় মেয়ে কান্নাকাটিই শুরু করে দিলো। পরশ সত্যিই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সেদিন কলির কান্ড দেখে। না পারতেই সে দুজনকে নিয়ে গেল মার্কেটে। টাকা সে আগেই খরচ করে ফেলেছিল সে মুহূর্তে তার কাছে হাজার খানেক টাকা তাও কিনা পুরনো পিসি বিক্রির সেটা দিয়েই কিনে দিলো কূর্তি দুটো। বাইরে থেকে কেনা সাড়ে চারশো টাকার সুতির সেই কূর্তি কলি কখনো পরেনি এর আগে। আজ হঠাৎ সে কূর্তিটাই গায়ে চড়িয়ে কপালে ছোট্ট একটা টিপ লাগিয়ে রওনা হলো পরশের বলা ঠিকানায়। তখনো সে জানতে পারলো না তার জন্য টিএসসির লোক সমাগমে অপেক্ষা করছিলো ভীষণই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সে যখন এসে দাঁড়ালো পরশের বলা জায়গায় সেখানে ছিল একঝাঁক বাইকার। প্রথমে ঘাবড়ে গেল অচেনা মুখের ভীড়ে যখন চেনা মুখটির দেখা মিলল না। সেকেন্ড গড়িয়ে, মিনিট পেরুলো দশ থেক বারোটি তখন চোখে পড়লো একটু দূরে ছোট্ট একটা কাজের ঠোঙা হাতে তার দিকেই আসছে মানুষটা। হাওয়ার বেগে সেকেন্ডে এসে দাঁড়িয়ে গেল তার সামনেই। কলি কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, ‘স্যরি রে সব গুছিয়ে নিতে একটু সময় লাগল।’

কলি বুঝলো না রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পরশ ভাই ঠিক কি গুছিয়ে নিলেন৷ সে কিছু বলতে প্রস্তুতি নিলো সে সময় আবার একটু ভীত হলো প্রত্যেকেটা বাইক একসাথে চালু হওয়ায়। কারা এরা! ভাবতে না ভাবতেই জবাব এসে গেল।

‘ভয় পেয়েছিস নাকি! কি পাগল দ্যাখ আমার রাজশাহী, ঢাকা আর চট্টগ্রামের সব বন্ধু এরা। আসলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম না সেদিন ‘অন দ্য ওয়ে’ সাথে নেদারল্যান্ডের ফ্লাগ তাতেই ইনবক্সে ঝড়। সবগুলোই বলল দেখা কর তাই সুযোগ বুঝে সবগুলোকে ট্যুরের নামে এক করলাম৷ রাতে ব্যাচেলর পার্টি দিচ্ছি তেজগাঁও।’

পরশ ভাই যতোটা উত্তজনা নিয়ে গল্প শোনাচ্ছেন কলির ততোটা ধৈর্য্য কুলোচ্ছে না। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এসব গল্প ফাঁদতে কি আমায় ডেকেছেন?’

‘নাহ্ আমার দেশ ছাড়ার আর মাত্র তিনদিন বাকি। কাল গায়ে হলুদের আয়োজন করে নিস। ইয়ে মানে… বিয়ের অনুষ্ঠান পরে হয় কি না হয় কে জানে তাই আরকি আফসোস যেন না থাকে।’

কলির মনে হলো হলো পরশ ভাই বোধহয় ডেট ফেল নিষিদ্ধ জিনিস খেয়ে উল্টাপাল্টা বকছে। এ মুহূর্তে এখানে থাকতেই ভয় হচ্ছে তার। ভয়টা আরও তিনগুন বাড়িয়ে দিয়ে সবগুলো বাইক একসাথে গোল হয়ে তাকে আর পরশ ভাইকে ঘিরে নিলো। আচমকা এ আয়োজন ত্রাসের সৃষ্টি করলো কলির মনে আর কৌতূহলের উদ্রেক করল পথচারী আর মেইন সড়কের যাত্রীদের মাঝে। রাস্তায় ধীরে ধীরে যানবাহনের গতি শ্লথ হলো, জমে উঠলো ভীড়।
‘এসব কি?’ আঁতকে উঠে প্রশ্ন করলো কলি। ততক্ষণে কেউ একজন ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত হয়ে গেছে। পরশ জবাব দিলো না কলির কথার। সে আকস্মিক এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো কলির সামনে। হাতে থাকা কাগজের ঠোঙা থেকে বের করলো বেলি ফুলের ছোট্ট মালা। শুভ্র বেলির মাঝে শুভ্র, হলদে মিশেলের কাঠগোলাপ। ছোট একটা মালা তবে দেখতে চমৎকার ছিল। পরশ তা কলির হাত টেনে পরাতে পরাতে বলল, “ইংরেজি বাদ বাংলায় বলি একশো আটটি পদ্ম কিংবা তোর পছন্দের হিমু হয়ে হলুদ পাঞ্জাবী পরে জীবনেও ঘুরতে পারব না কিন্তু তুই চাইলে আষাঢ়ে বর্ষণে রাত বিরাতে তোর বৃষ্টি বিলাসের সঙ্গী হব। আগামী তিনটি বছর বাদ দিয়ে ওপরওয়ালা হায়াত দিলে বাকি জীবন তোর সঙ্গে তোর সুখ দুঃখের সঙ্গী হব। ধুর প্রপোজ ঠিকঠাক করতে পারতেছি না তুই কি আমারে বিয়ে করবি?”

পরশ হাঁটু তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।সকল প্রস্তুতিতে পানি ঢেলে সে সরাসরি আবার বলল, শোন কলি তিনদিন পর চলে যাব কিন্তু তোকে এভাবে রেখে গেলে ফিরে এসে অন্য ব্যাটার বাচ্চাকাচ্চার মামা ডাক শুনতে হবে এ অসম্ভব। তাই পরশুই বিয়ে করব রেডি হয়ে চলে আসবি আমি মেসেজে জায়গা বলে দেব।

কলি হা হয়ে আছে পরশের বলা কথাবার্তা শুনে। একটু আগেও ভয়ে, আতঙ্কে তার হাঁটু কাপছিল কিন্তু এখন পরশের কথা শুনে রাগে পুরো শরীর কাঁপছে এদিকে পরশের বোকামিতে তাদের ঘিরে থাকা প্রতিটা দৃষ্টি আশ্চর্যান্বিত, হতবিহ্বল, আর বিষ্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুহূর্তেই আশপাশ থেকে ভেসে আসছে চাপা গালি, কেউ কেউ হাসছেও ভীষণ।

‘এ্যাই ছেলে এভাবে প্রপোজ করলে মেয়ে বিয়ে তো দূর ফিরেও তাকাবে না।’

‘এসব কি নাটক।ছেলেটা গুন্ডা মাস্তান নকি?’

‘সুন্দর একটা মুহূর্তকে ফালতু বানিয়ে দিলো।’
আরও অনেক অনেকরকম মন্তব্য ছুটে আসছে চারপাশ থেকে আর কলির রাগে চোখ ছলছল। পরশের বন্ধুরাও রাগ করলো অনেকে। সেই সকাল থেকে
কত কি বুঝিয়ে দিলো গাধাটাকে আর সে কি করল! পরশ কারো কথায় পাত্তা না দিয়ে কলির গালে এক হাত রেখে কিছু বলতে গেলে এবার সে জোরে ধাক্কা মারল। হঠাৎ এমন ধাক্কায় কিছুটা ছিটকে সরে গেল পরশ। কলি এবার চেঁচিয়ে উঠলো, এসব কি রকম অসভ্যতামি! এ কমন ভন্ডামি তোমার? ফাইজলামি করার জায়গা পাও না তাই এভাবে ভরা রাস্তায় আমাকে ডেকে ভন্ডামি শুরু করেছো?

-এসব কি বলছিস কলি? আমার কথা শোন..

-কি শুনবো হ্যা! এতসব ড্রামা কসের জন্য করছো? কখনো বাড়ি এসে বিয়ে ভাঙছো, কখনো হবু বউকে প্রেগন্যান্ট করে বিয়ে ভেঙে দিচ্ছো আবার কখনো…

– ওসব ভুয়া খবর কলি। আচ্ছা তুই আগে আমার কথা শোন আমি সবটা বলছ তোকে। কথাটা বলতে বলতে পরশ আবারও কলির গালে হাত রাখতে যাচ্ছিলো তখনই কলি হাত ঝাড়া দিলো।

-কথায় কথায় গায়ে হাত দাও কেন? লজ্জা করে না পরপুরুষ হয়ে মেয়েদের গায়ে হাত রাখতে….

কলির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কষে থাপ্পড় লাগালো পরশ। ‘মেয়দের’ কথা বলছে কলি তাকে! সে কতজন মেয়ের গায়ে হাত রেখেছে?আর গায়ে বলতে কি বোঝালো কলি! সহ্য হলো না তার এমন বাক্য। ধৈর্য্য হারিয়ে মেরেই বসলো কলিকে। সেকেন্ডই আবার মুখও খুলল, ‘এতবড় কথাটা বলার আগে একটুও বুক কাঁপলো না তোর! কি বলল তুই এটা?আমি মেয়েদের গায়ে হাত দেই বল দেই? একমাত্র তোর গালেই হাত রেখেছি আমি আর কি বললি পরপুরুষ! ঠিক আছে তবে তোর ব্যক্তিগত পুরষ হিসেবেই থাকব তোর পাশে। সাধ্য থাকে তো দূরে সরিয়ে দিস।’

মুখের কথাটুকু শেষ করে ভীড়বাট্টায় হারিয়ে গেল পরশ।কলি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো একই জায়গায় কিছুক্ষণ। পরশের বন্ধুরা সকলেই অস্থির হয়ে বাইক থেকে নেমে পরশকে খুঁজলো। পরশ চলে যেতেই ভীড় কমে এসেছিলো ধীরে ধীরে পুরো জায়গাটাও আগের মত হালকা হয় এলো৷ কলির তখনও মাথা ঝিমঝিম করছে, দৃষ্টি ঝাপসা। পরশের এক বন্ধু সামনে এসে কছু বলতে চাইলে কলি তাকে এড়িয়ে গেল। কোনমতে একটা রিকশা ডেকে তাতে করে চলে গেল বাড়িতে। বাড়ি এসে অনেকটা সময় ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলো চোখ বুঁজে। সন্ধ্যার অনেক পরে তখন প্রায় রাত সাড়ে আটটা বাজে ছোট চাচী এলো মিষ্টি নিয়ে। কলির তখন মাথাব্যথায় মরণদশা। কেঁদেছলো অনেকক্ষণ তাতেই এই ব্যথার সৃষ্টি। চাচী ঘরের বাতি জ্বেলে মিষ্টি এগিয়ে দিয়ে বলল, এখনো শুয়ে আছিস কেন ওদিকে যে বিয়ের সানাই বেজে গেল।

-কার!

-রূবাইবা মেহউইশ
(রি-চেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here