#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১০
১৯.
আমার প্রশ্নে বিশেষ ভাবাবেগ হলোনা রাফিদ ভাইয়ার। তিনি তার খেয়ালে থেকেই ধপ করে বসলেন আমার পাশে। তার মনন চিত্ত কোনো একটা ভাবনাকেই বেশি প্রধান্য দিয়ে চলেছে। আশেপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো বেশিরভাগই তার মগজ এড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমার বাবার অসুস্থতায় তার বেশি কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে তিনি বেশি ভাবছেন!
—-” ভাইয়া,আপনি ঠিকাছেন তো?”
রাফিদ ভাইয়া চমকে উঠলেন। আমার দিকে তাকিয়ে শুঁকনো মুখে কিছু একটা বলতে নিয়েও বলতে পারলেন না। বোধকরি তার গলাটা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। আমি আর বাক্য আওড়ালাম না। একপ্রকার দৌড়ে গিয়েই একটা পানির বোতল নিয়ে এলাম। উনার পাশে বসতে বসতে বোতলটা উনার দিকে এগিয়ে দিতেই উনি বলে উঠলেন,
—-” নিধি, অর্ণব ইজ নট পারফেক্ট ফর ইউ।”
—-” জ্বী?”
রাফিদ ভাইয়ার কথাটা রসকষহীন লাগলো। বুঝতে পারলাম না কি বুঝাতে চাইলেন তিনি। তাই বোকা গলায়ই প্রশ্ন করে উঠলাম। আমার প্রশ্নে উনি নড়লেন না। আমার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন খানিকটা। অতঃপর বোতলটা আবারও আমার হাতে ঠেসে দিয়ে বললেন,
—-” সবাই সবার জন্য পার্ফেক্ট হয় না। পার্ফেক্ট কাউকে খুঁজে নিতে হয়। প্রত্যেক টা মানুষের জন্য তার জীবন সঙ্গী হিসেবে অবশ্যই পার্ফেক্ট কাউকে বেছে নেওয়া উচিৎ। অন্তত একটা দিন ভালো কাটানোর লোভে পড়েও খোঁজা উচিৎ। তোমারও তাই করা উচিৎ।”
কথা গুলো বলেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আমি ফ্যাকাশে মুখে বললাম,
—-” অর্ণব নিধির জন্য এতোটাও অযোগ্য নয়।”
আমার কথার জবাবে উনি হাসলেন। বোধকরি তাচ্ছিল্যের হাসি। তিনি আর কোনো কথা পাড়লেন না। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকালেন অবশ্য। উনার চোখ মুখ কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু বাঁধা হানছে উনার মন। যেন নিধিকে রাফিদ এক্ষনি কিছু বলে ফেললে পৃথিবীতে ধ্ব/স নামবে।
“নিধু!”
পাশ থেকে হৃদের ডাক পড়তেই রাফিদ ভাইয়ার থেকে দৃষ্টি সরে গেলো। হৃদ দাঁড়িয়ে আছে। আমি হৃদের দিকে তাকিয়ে আবারও রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি চলে গিয়েছেন কয়েক সেকেন্ডের মাঝে। বুকের ভেতরটা হঠাৎই শূন্যতা বিরাজ করলো। উনার উপস্থিতি ক্ষনিকের চিন্তা দূর করলেও উনার অনুপস্থিতি আবারও ঢেলে দিলো একরাশ চিন্তক।
হৃদ পাশে বসতে বসতে আমার হাতটা উঠিয়ে নিলো তার হাতে। ভরাট কন্ঠে বলল,
—-” আঙ্কেলের এখন কি অবস্থা?”
—-” হু?”
—-” ডক্টর কি বলেছেন?”
—-” চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। এর আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা!”
—-” আঙ্কেলের হঠাৎ কি হলো বলোতো? এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন!”
—-” জানি না!”
—-” মনটা খুব খারাপ তোমার তাইনা?”
—-” নাহ্ ঠিকাছি আমি। নিধি এতো সহজে ভে/ঙে পড়ার পাত্রী নয় বুঝেছো?”
হৃদ মুচকি হাসলো। আমার মাথাটা ধরে কাঁধের উপর রেখে বলল,
—” আমি জানি তো লক্ষী। আমার নিধি এতো সহজে ভে/ঙে পড়ার পাত্রীই নয়।”
হৃদের হাসি দেখেও তৃপ্তি পেলাম না আজ। মনটা আবারও ভীষণ ছটফট করছে। হৃদের উপস্থিতি ভীষণ অস্বস্তি দিচ্ছে আমায়। ওর উপস্থিতিতে শান্তি নয় বরং বিরক্ত হচ্ছি আমি। ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে চলে যাই এখান থেকে। ওর মুখ আর কখনো যেন না দেখি। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে হৃদকে আমি অকারণে এতো বড় শা/স্তি কেন দিতে চাচ্ছি? কি দোষ তার? সত্যিই তো! কি দোষ তার?
ডক্টরের কথা অনুযায়ী চব্বিশ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই বাবার সেন্স ফিরেছে। ডক্টর হাসি মুখেই বলেছেন, “পেশেন্ট ইজ অল রাইট। তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।” বড় চাচা আর চাচী সন্ধ্যা হতেই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। হিমেল ভাই আর নিতু আপু যায়নি। হৃদ বেরিয়ে গিয়েছে ঘন্টা খানিক হলো। রাফিদ ভাইয়াও যাননি। এক মুহুর্তের জন্যও বাবার কাছ ছেড়ে নড়েননি সে। তাকে সঙ্গ দিতেই আরফান ভাইয়া আর রূপ ভাইয়া এসেছেন। আজ আর কেউ আমার সাথে রূঢ়ভাবে কথা বলছেননা। সবার কন্ঠই খুব কোমল। যদিও এতে আমি মোটেই অবাক নই। কেননা, সবাই আমার বাবার কথা চিন্তা করেই আমার সাথে নরম সুরে কথা বলছেন। হিমেল ভাইয়ার জন্য শুধু আসতে পারেননি রাফিন ভাইয়া। তবুও আমায় কল করে অনেকক্ষণ কথা বলেছেন। বলেছেন “আমার বাবা একদম ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার কোনো কারন নেই।”
বাবার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সবাই। রাফিদ ভাইয়া আর আরফান ভাইয়া ডক্টরের সাথে কথা বলছেন। রূপ ভাইয়া আর নিতু আপু আমার পাশে দাঁড়িয়ে। নিতু আপু বলল,
—-” রাফিদ সত্যি আজ বড্ড উপকার করলো আমাদের। ঠিক সময় চাচাকে নিয়ে হসপিটালে আসতে পেরেছে। আর নয়তো আজ কি যে হতো!”
আমার বুক চিঁড়ে তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। রূপ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আমি কৃতজ্ঞতার সহিত বললাম,
—-” অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আজ আপনারা সবাই সত্যিই বড় উপকার করলেন আমার।”
রূপ ভাইয়া হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন,
—-” আমরা আবার কি করলাম হু? যা করলো সবই তো ঐ যে রাফিদ মহাশয় করলেন। ধন্যবাদ তো তারই প্রাপ্য!”
আমি হাসলাম ছোট্ট করে। রাফিদ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনার ম্লান মুখটা নজর কাড়লো আমার। একদম পরিপাটি গোছালো ছেলেটা হঠাৎ ভীষণ অগোছালো হয়ে যাওয়ার কারন ঠিক ধরতে পারছিনা আমি। তার মন কাড়া চুল গুলোও আজ বড্ড ক্লান্ত হয়ে হেলে পড়েছে একজন আরেকজনকে আঁকড়ে। ক্লান্ত ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আরফান ভাইয়ার একটা হাত তার কাঁধে চেপে আছে। রাফিদ ভাইয়ার চিন্তাক্লেশ মুখের আড়ালে একরাশ ভয়। আরফান ভাইয়ারও একই মুখ ভঙ্গি। আমার মনের ভেতরটা হঠাৎই ধুক করে উঠলো! পাছে বাবাকে নিয়ে ডক্টর কোনো খারাপ সংবাদ দিচ্ছেন না তো? কথাটা মনে হতেই স্থীর থাকতে পারলাম না! ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। রাফিদ ভাইয়ার পেছনে দাঁড়াতেই উনার ক্লান্তস্বর এসে বারি খেলো আমার কানে,
—-” দিস ইজ নট ডান মি. রেহমান! এটা মেডিকেল হসপিটাল! এখানে এই রোগের ট্রিটমেন্ট না হলে আর কোথায় হবে?”
ড. রেহমান গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন,
—-” একটাই অপশন রাফিদ, পেশেন্ট কে বিদেশ নিয়ে যাও। ইন্ডিয়াতেই এর খুব ভালো ট্রিটমেন্ট আছে।”
আরফান ভাই বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
—-” ইন্ডিয়া!”
—-” হ্যাঁ ইন্ডিয়া। দেখো আরফান-রাফিদ তোমরা আমার পরিচিত বলেই আমি কারোর সাথে আলোচনা না করে তোমাদের সাজেস্ট করলাম। অন্য কেউ হলে কিন্তু কখনোই বলতেননা। তারা চাইবেননা একটা পেশেন্ট কমে গিয়ে তাদের অর্থের লোকসান হয়ে যাক। আজকাল মানুষ জীবন নয় টাকা কে বেশি ভালোবাসে। তাই আমি বলছি এই রোগের যথাযথ ট্রিটমেন্ট করাতে হলো ইন্ডিয়া যাও। ওখানে আমার অনেক পরিচিত ডক্টর আছেন। দরকার পড়লে আমি তাদের সাথে কন্টাক্ট করে দিবো। শুধু শুধু পেসেন্টকে এভাবে ফেলে রেখে রি/স্ক বাড়িও না।”
রাফিদ ভাইয়া আরফান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। আরফান ভাই চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বললেন। কিন্তু রাফিদ ভাই শান্ত হতে পারলেও আমি শান্ত হতে পারলাম না। আতংকে আমার সারা শরীর কাঁপছে। দরদর করে ঘামছি আমি। বাবার কি এমন রো/গ হয়েছে? যার জন্য বাবাকে ইন্ডিয়া নিয়ে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে?
পা দুটো কাঁপতে কাঁপতে এবার বুঝি ভেঙেই যাবে। সামলাতে পারছিনা নিজেকে! হাঁটু ভেঙে লুটিয়ে পড়তে চাচ্ছি বারবার। কিন্তু না, মনে জোড় রেখে ডক্টরের উদ্দেশ্যে মোটা স্বরে বলে উঠলাম,
—-” ডক্টর, কি হয়েছে আমার বাবার?”
মনে হলো পুরো রুম কাঁপিয়ে বলেছি কথাটা! কিন্তু আমার কথা রাফিদ ভাইয়া ছাড়া আর কেউই শুনতে পাননি। পেছন মুড়ে আমাকে দেখতেই উনি চমকে উঠলেন! দৌড়ে এসে আমাকে বাহুডোরে নিতে নিতে আমি শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছি। বোধকরি উনার বুকেই আমি জ্ঞান হারিয়েছি!
২০.
মাথার মধ্যে ধপধপ করছে খুব। অসহ্য ব্যাথা নিয়ে শুইয়ে থাকাও সম্ভব হলো না। দু’হাতে ভর দিয়েই উঠে বসলাম। মাথায় কিসের এতো ব্যারাম উঠেছে বুঝতে পারছিনা! দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলাম মাথাটা। কখন ঘুমিয়েছি এভাবে তাও মনে আসছে না। ঘুমানোর আগেই হয়তো মাথা ব্যাথা ছিলো তাই এখনো ব্যাথা করছে। রানি কে বলতে হবে এক কাপ চা দিতে! আপাতত নিজের শক্তি দিয়ে নিজে আর চা বানানো সম্ভব না। বড় বড় করে দু’বার নিঃশ্বাস ছেড়ে সোজা হয়ে বসলাম। ক’টা বাজে?
আমার ঘরের হাতের ডান পাশটাতে বড় আকারের ঘড়িটা উধাও। কথাটা মনে হতেই কপাল কুঁচকে এলো আমার। এখান থেকে ঘড়ি কে নিলো? নিশ্চয়ই বাবা নিয়েছে। বাম পাশে তাকালাম ঘড়ির সন্ধানে। কিন্তু না, বাম পাশেও নেই। সামনে তাকিয়ে বিছানা ছেড়ে নামতে নিলেই আঁতকে উঠলাম আমি। চারপাশের সব কিছুই গোলকধাঁধার মতো ঘুরছে। আমার ঘরের একটা জিনিসও জায়গা মতো নেই! কে সরালো সব? চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে। বেডের পেছনের দিকটাতে দেওয়ালে বিশাল এক ছবি ঝুলছে। চোখ জোড়া ঘোলাটে হলেও দেয়ালের মানুষটার শারীরিক বর্ননা দিতে পারবো। ফর্সা লম্বা করে দেখতে। লাল টি-শার্ট পরে আছেন। চোখে কালো সানগ্লাস। মাথার সিল্ক চুল গুলো খুব সম্ভবত বাতাসের তোড়ে এলোমেলো হয়ে আছে। মুখ জুড়ে নিষ্পাপ মায়াবী হাসি। সাইড ভাবে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দু’হাতে চোখ কচলে আবারও তাকালাম ছবিটার দিকে। ছবিটার আকৃতি এতোটাই সুন্দর যে মানুষটার মুখ খানা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
চোখ কচলাতে আপাতত সবটাই পরিষ্কার। চারপাশে তাকাতে তাকাতে ছবিটার দিকে তাকালাম। ছবির মানুষ টাকে দেখতেই তৎক্ষণাৎ বুকের ভেতরে কেউ ধমাধম ঢোল পেটালো মনে হলো। লাফিয়ে উঠে বিছানা ছাড়লাম। হা করে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতেই আমার অবচেতন মন ছটফট করে বলে উঠলো,
—-” এটা রাফিদ ভাইয়ার রুম! কেম্নে কি? আমি তার রুমে কি করে?”
“” আরে উঠে গিয়েছো তুমি? দাঁড়িয়ে কি করছো হ্যাঁ? তোমার শরীর ঠিক নেই। বসো বসো। আমি তোমার জন্য একটু স্যুপ দিতে বলি। বসো।”
অল্প বয়সী সুন্দরী এক রমণী দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। তার রূপের আলোতে আমার মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গিয়েছে। অবাক নয়নে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে উনি বাইরে গিয়ে আবার ভেতরে প্রবেশ করলেন। আবারও আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কন্ঠে বললেন,
—-” এই মেয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছো? বসছো না কেন?”
আমার মুখ থেকে কথা আসছেনা! বলতে পারছিনা রীতিমতো। শুধু হা করে উনাকেই দেখে চলেছি। উনি মুচকি হেসে এগিয়ে এলেন। আমার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলেন। কোমল স্নিগ্ধ স্বরে বললেন,
—-” তোমার শরীর এখন কেমন? এখনো কি মাথা ঘুরছে? আচ্ছা তোমায় কি নামে ডাকি বলোতো?”
উনার কথা গুলো গুলিয়ে ফেলছি। ধরতে পারছিনা। রুমটা রাফিদ ভাইয়ার। আর এই সুন্দরী মেয়েটাও এই বাসারই। রাফিদ ভাইয়ার সাথে কি কোনো যোগসূত্র আছে তার?
—-” ভাবি স্যুপ।”
ট্রে হাতে ঢুকে এলো রানির বয়সি একটা মেয়ে। আমার পাশে বসে থাকা রমণী মেয়েটা তার উদ্দেশ্যে বললেন,
—-” রাখ এখানে। আর রাফিদ কে গিয়ে বল তার গেস্টের সেন্স ফিরেছে।”
মেয়েটা খাবারের ট্রে-টা রেখে মাথা হেলিয়ে চলে গেলো। আমি উনার দিকে একই ভাবে চেয়ে আছি। ভাবছি কে উনি? মেয়েটা তাকে ভাবি ডাকলো? তবে কি রাফিদ ভাইয়ার বউ এটা?
—-” কি গো? নাম বলবে না তোমার?”
উনার ডাকে চমকে উঠে তাকালাম। মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বললাম,
—-” জ..জ্বী নীলাদ্রিতা!”
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,
—-” নীলাদ্রিতা? নাইস নেইম।”
আমি মাথা হেলিয়ে বললাম,
—-” হু নীলাদ্রিতা নিধি!”
—-” এতো সুন্দর নামটা কে রাখলো তোমার? ভারী মিষ্টি নাম কিন্তু। আচ্ছা আমি তোমায় কোন নামে ডাকি বলোতো? নীলাদ্রিতা নাকি নিধি?”
আমি শুঁকনো মুখে জবাব দিলাম,
—-” আপনার যেটা ভালো লাগে।”
উনি আবারও হাসলেন। স্যুপের বাটিটা হাতে তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
—-” আমি আদ্রিতা। তুমি আমায় ভাবি বা আপু বলে ডাকতে পারো। নাও এটা খেয়ে নাও।”
যখন থেকে মনে হলো উনি রাফিদ ভাইয়ার বউ তখন থেকেই উনাকে আর ভালো লাগছেনা। মনে হচ্ছে উনি একটু বেশিই সুন্দরী। যেটাকে বলে প্রয়োজনের অধিক। আমি খাবার টা উনার থেকে নিলাম না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার ফোনের তল্লাশি চালালাম। সময়টা দেখা আমার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। হঠাৎ মাথাটা এভাবে শূন্য হয়ে খা খা করছে কেন তাও বুঝতে পারছিনা!
—-” তোমার ফোনটা আামর কাছে। ডক্টর তোমাকে দু-তিন ঘন্টা রেস্ট নিতে বলেছেন। তাই আমি তোমার ফোনটা আমার কাছে রেখেছি!”
কথা গুলো বলতে বলতেই রাফিদ ভাইয়া ঢুকে এলেন ভেতরে। আমি অবাক কন্ঠে বললাম,
—-” আমি আপনার বাসায় কি করছি? কে নিয়ে এসেছে আমাকে? আর ডক্টর, রেস্ট… এসব কি হচ্ছে? আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিনা।”
উনি মাথা নীচু করেই এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার সামনে এসে দাঁড়াতে আদ্রিতা আপু উঠে গেলেন। রাফিদ ভাইয়া সেই জায়গাতেই বসলেন চুপটি করে। স্যুপের বাটিটার দিকে তাকিয়ে শুঁকনো মুখে বললেন,
—-” স্যুপটা খেয়ে নাও নিধি। আধঘন্টার মধ্যে আমাদের হসপিটালে যেতে হবে।”
হঠাৎ ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। মনে হলো ভেতর থেকে ধাক্কা খেলাম! মাথার মধ্যে চিনচিনে ব্যাথা করতে শুরু করল। হাত তুলে মাথাটা চেপে ধরতে হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেলো, “বাবা হসপিটালে!”
লাফিয়ে উঠে বিছানা ছাড়লাম। ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো হঠাৎ। বাবাকে ডক্টররা কোথাও একটা পাঠাতে চান!______হ্যাঁ! ইন্ডিয়া। বাবার বিরল কোনো রোগ হয়েছে নিশ্চিত। তাই ডক্টররাও উনাকে রাখতে চাচ্ছেন না এদেশে! আমাকে এক্ষনি বাবার কাছে যেতে হবে। দৌড়ে রুম থেকে বের হতে নিলেই রাফিদ ভাইয়া আঁটকে দেন আমায়। আমার হাতটা টেনে ধরে অসহায় কন্ঠে বলতে লাগলেন,
—-” কোথায় যাচ্ছো একা? নিধি তোমায় শরীর ঠিক নেই। অল্প কিছু খাওয়া তোমার জন্য খুবই জরুরি। প্লিজ এই খাবারটুকু খেয়ে নাও। তারপর সোজা আমরা হসপিটালে চলে যাবো।”
পাশ থেকে আদ্রিতা আপুও রাফিদ ভাইয়ার সুর ধরলেন। বারবার করে বলতে লাগলেন,
—-” নিধি বোন একটু কিছু মুখে দিয়ে পরে না হয় যাও। এভাবে না খেয়ে গেলে তুমি আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।”
তাদের কারোর কথাতেই আমার মন গলছেনা। রাফিদ ভাইয়ার থেকে নিজের হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছি। মনের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে। খুব করে বুঝতে পারছি, আমি বাবাকে হারাতে বসেছি।
রাফিদ ভাইয়া আস্তে করে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমি আর এক মুহুর্তও দাঁড়িয়ে রইলাম না। এক দৌড়ে নীচে নেমে আসলাম। বাড়ির এরিয়াটা একটু বেশিই বড় যার দরুন আবারও মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার। পেছন থেকে গাড়ির হর্ন বাজতেই চমকে উঠলাম। পেছন মুড়ে অন্ধকার হাতড়ে গাড়ির হদিশ মিলতেই দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। রাফিদ ভাইয়া গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে কোমল স্বরে বললেন,
—-” তোমার বাবার কিচ্ছু হবেনা নিধি। তাকে সুস্থ করতে আমি সব কিছু করবো। প্লিজ নিজেকে সামলাও। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
#চলবে____________________
[ ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]