❄️পড়ন্ত বিকালের বিচ্ছেদ ❄
দ্বিতীয় পর্ব
মিহি
ডায়েরিটা খুঁজতে খুঁজতে কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই বড় একটা ধাক্কা খেল রহস্য।কফি মিষ্টি লাগছে অথচ রহস্যের বেশ ভালোমতো মনে আছে সে চিনি দেয়নি কফিতে।তবে কফির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবার ডায়েরি খুঁজতে লাগল সে।পেঁচাটা আবার ডাকছে।ঘড়ির কাঁটায় টং করে একটা শব্দ শুনে তাকাল রহস্য।বারোটা বাজে??রহস্যের সবকিছু যেন কাল্পনিক মনে হতে লাগে।টেবিলের তলায় এককোণে ডায়েরিটা পড়ে থাকতে দেখে,হাতে তুলে নিয়ে ময়লা ঝারতে ঝারতে আবার টেবিলে এসে বসে।নীল মলাটের একটা ডায়েরি অবশ্য রহস্যেরও ছিল।তনয়া গিফট করেছিল জন্মদিনে তবে সম্ভবত ডায়েরিটা পুড়িয়ে ফেলেছিল রহস্য।একটা সময় রহস্যই বলত,”কারো দেওয়া জিনিস পুড়িয়ে কিংবা ছিঁড়ে ফেলা মানে মানুষটার মৃত্যু কামনা করা।”রহস্যও কি তবে তনয়ার মৃত্যু কামনা করেছে??না,করেনি।রহস্য শুধু তনয়া নামটার সাথে জড়িত স্মৃতিগোলোর মৃত্যু কামনা করেছিল।এসব ভাবতে ভাবতেই আবার ডায়েরিটা খুলল রহস্য কিন্তু পিনপতন নীরবতায় পেঁচার ডাকটা এবার বড্ড বেশি বিরক্তিকর লাগতে লাগল রহস্যের।অন্যদিকে ঘড়ির টিকটক থেকে ট্যাপের পানির টুপটাপ শব্দটাও যেন তীক্ষ্ম হয়ে কানে ভাসছে রহস্যের।মাথার ভেতর যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে রহস্যের।এইমুহূর্তে ব্ল্যাক কফিও আর কাজে লাগবে না রহস্যের।এখন দরকার এক থালা মারাত্মক ঝাল দেওয়া আলুর দম,ঠিক যেমন তনয়া বানাত।দুই বছরের প্রেমে দুই হাজার বারেরও বেশি খেয়েছে সে ঐ আলুর দম।ওর মাথা ব্যথার একমাত্র ওষুধ তবে ওষুধের অভ্যাস হওয়ার পর যে তা ছাড়িয়ে নিতে হবে তা তো জানত না রহস্য।মাথা ব্যথা কমানোর জন্য ঘুমোতে যাবে ঠিক করল রহস্য কিন্তু ঘুমও যেন হাতছানি দিয়ে বেড়াচ্ছে,ধরা দিতে চাচ্ছে না।বিছানায় বেশ কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম আর আসে না রহস্যের।তিনটির পর চোখ লেগে আসে যা একটু,রাজিবের ফোন করায় সে ঘুমটাও ভেঙে যায়।
–হ্যাঁ রাজিব বলো।
–স্যার ইমরান সাহেবের ব্যবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল।আরেকবার স্ট্রোক করেছেন তিনি।ডক্টর বলছে বাঁচানো খুব কষ্টের।ইমরান সাহেব কোন কারণে খুব আতঙ্কিত রয়েছেন এবং প্রতিমুহূর্তে প্রেশার ওঠানামা করছে তার।যেকোন সময় যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে।
–ওনার সাথে গার্ড রাখো একটা।আমি আসছি এখনি।
–এত রাতে আসার দরকার নেই স্যার।সকালে আসবেন।
–না।আমি আসছি।
কল কেটে ফোনটা বেড-সাইড টেবিলে রেখে ইউনিফর্ম গায়ে জড়াল রহস্য।ড্রয়ার থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেরিয়ে গেল রহস্য।বিদঘুটে অন্ধকারে পেঁচার ডাক আরো বিদঘুটে শোনাচ্ছে।অফিসের জিপ বের করতে নিয়েও করল না রহস্য।বাইকটা নিয়েই আগাল হসপিটালের দিকে।
❄️
ইমরান সাহেব থরথর করে কাঁপছেন।হাত-পা অবশ হয়ে এসেছে।গলাও যেন অনুভূতিশূণ্য হয়ে আছে।তার বারবার মনে হচ্ছে এই বুঝি সায়ন আসবে আর তাকে মেরে ফেলবে।তনয়ার সাথে সম্পর্কে জড়ানোটা এখন জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মনে হচ্ছে।তার অসুস্থ স্ত্রীও ফেলে গেছে তাকে।অবশ্য পুলিশ যখন ফোন করেছিল তখনই চলে যাওয়ার কথা তবুও যে তিনি এসে ইমরান সাহেবকে দেখে গেছেন,এটাই ইমরান সাহেবের ভাগ্য।কোন স্ত্রীই বা সহ্য করতে পারবে যে তার স্বামীর পরনারীর সাথে সম্পর্ক আছে।চিন্তায় আর অনুতাপে চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগে ইমরান সাহেবের।হঠাৎ দেখতে পান সায়নকে।সায়ন তার সামনে দাঁড়িয়ে।সেই ভয়ঙ্কর লাল চোখের চাহনি,চেহারায় কাঠিন্যতা।সায়ন সেই কড়া গলায় বলে উঠল,
তোমরা কি পৃথিবীর পুরুষদের প্রতি অগ্রসর হও এবং তোমাদের প্রভু যাদেরকে সঙ্গিনী হিসেবে বানিয়েছে তাদেরকে (নারীদেরকে) ত্যাগ করো? তোমরা তো এমন এক সম্প্রদায় যারা সীমালঙ্ঘন করছে।
— কুরআন 26:165–166
ইমরান সাহেব ছটফট করতে লাগলেন।রাজিব গার্ডসহ দৌড়ে আসল কিন্তু ঘরে কেউ নেই অথচ ইমরান সাহেব ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।
❄️
–সায়ন সাহেব,ঠিক আছেন??
–……..
–সায়ন??
–জ্বী আর্শাদ সাহেব।আমি ঠিক আছি।
–স্ত্রীকে খুন করার পর ঐ লোকটাকেও মেরে ফেলতে পারতেন।
–আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিনি।
–মিথ্যা অন্তত আমার কাছে বলিয়েন না।আপনি যদি নিজের স্ত্রীকে খুন করার ইরাদা না রাখেন তাহলে অলৌকিক শক্তি শেখার জন্য কেন এসেছিলেন আমার কাছে?
–আমার স্ত্রীও এই একই শক্তির জন্য আপনার বিছানায় যেত, তাই না??
–সায়ন!!কি বলছেন যা তা??আমার সম্পর্কে এসব বলার সাহস কি করে হলো আপনার??
সায়ন মুচকি হেসে আর্শাদের দিকে তাকাল।আর্শাদ সাহেবের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসলো,মুখের রঙ বদলাতে লাগল।দুহাতে দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন তিনি।ডাঙায় থাকা মাছের মতো ছটফট করতে করতে সারা ঘরে খুঁজতে লাগলেন সেই বইটা।সায়ন জোরে জোরে হাসছে।এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট লুকিয়ে আছে তা হয়তো তিনি ছাড়া কেউ জানে না।নিজের প্রথম ভালোবাসার থেকে এতবার প্রতারিত হওয়ার পর একটা মানুষের মধ্যে কি পরিমাণ পাশবিকতা ঢুকে যেতে পারে তারই যথাযোগ্য উদাহরণ সায়ন।প্রথমবারের মতো ইমরান সাহেবের সাথে তনয়াকে দেখে রাগে তনয়াকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু তনয়াকে মারা সম্ভব না তার পক্ষে।ধীরে ধীরে তনয়ার এত পরকীয়ার কারণ তল্লাশি করে সায়ন।তারপরই সায়ন জানতে পারে তনয়া আসলে ভালোবেসে কিছুই করেনি।যা করেছিল তা এক অলৌকিক অতৃপ্ত বাসনার প্রভাবে।এই অলৌকিকতার সাথে যারা যারা জড়িয়ে আছে সেই সকলের সাথে তনয়ার সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু সায়নের সাথে অলৌকিকতার কি সম্পর্ক বুঝে উঠতে পারছে না সে,এমনকি এখনো বুঝে উঠতে পারেনি সে।অলৌকিক শক্তি কয়েকটা বেশ ভালোই আয়ত্ত করেছে সে।বইটা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারলেই হবে।আর্শাদ ছটফট করতে করতে মেঝেতে পড়ে গেছে।মুখ থেকে রক্ত পড়ছে।ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে লুকানো স্থান থেকে বইটা বের করল সায়ন।
–ইমরান সাহেব মারা গেলেন কি করে?
–রহস্য স্যার,আমরাও ঠিক বুঝতে পারছিনা।গার্ড ভেতরে এলাওড না তাই সবাই দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।আমরা যখন ভিতরে ঢুকি,ইমরান সাহেব ছটফট করতে করতে নিচে পড়ে যান।
–হঠাৎ??কোন কারণ ছাড়াই??গার্ড এলাওড না বুঝলাম ,তো ঘরে একটা নার্স রাখা যেত না?
–স্যরি স্যার।
–টু হেল উইথ ইওর স্যরি।লাশ মর্গে পাঠাও আর তনয়ার লাশ দেখাও আমায়।
–জ্বী স্যার চলুন।
ইমরান সাহেবের লাশ নিয়ে মর্গের দিকে এগোতে লাগল রাজিব ও রহস্য।রহস্যের কপালে চিন্তার ভাঁজ খেলা করছে।অকারণ চিন্তার কারণ খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছে সে।ইমরান সাহেবের চোখমুখের রঙ এখনো কেমন একটা হয়ে আছে।মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্কে মুখের রঙ যেন উরে গেছে।
❄️
“স্যার স্যার!!তনয়া নামের যে মেয়েটা খুন হয়েছে তার লাশটা পাওয়া যাচ্ছে না।গতরাতে পুলিশ লাশটা রেখেই চলে যায়।”চিন্তিত কণ্ঠে কথাগুলো বলল ওয়ার্ডবয়।মর্গের ডাক্তার রফিক সাহেব ভ্রু কুঁচকে ওয়ার্ডবয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।বেশ কয়েকটা ওয়ার্ডবয় দেখেছেন তিনি টাকার লোভে লাশ বেঁচে দিতে কিন্তু এই ছেলেটাকে দেখে তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।বিগত দুই বছর ধরে এখানে কাজ করছে সে।এর আগে তো এমন কোন ঘটনা ঘটায়নি সে।রফিক সাহেব বেশ গম্ভীর মুখে বললেন,”আমি কিছু বলছি না।পুলিশ আসছে।ওরাই যা বোঝার বুঝে নিবে।ওনারা যা প্রশ্ন করে?ঠিকঠাক উত্তর দিবে।আমি আসছি এখন।”রফিক সাহেবের কথায় ঘামতে লাগল ওয়ার্ডবয় ছেলেটা।পুলিশ অকারণে তাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো?এই ভয়ে হাত-পা কাঁপতে লাগল তার।
চলবে……
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।ধন্যবাদ সবাইকে।]