#বন্ধ_দরজা
পর্ব-১৩
…..
ফজরের নামাজের পর তানভীরের পাশে এসে শুয়ে আছে সুহায়লা। আকাশে এখনো আলোর রেখা ফুটেনি। অন্ধকারই আছে। গতরাতে তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তানভীরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুবে। কিন্তু তানভীরকে জড়িয়ে ধরতেই অনেকটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। সেই সাথে এটাও জানিয়ে দিলো তানভীরকে যেনো কখনোই ঘুমানোর সময় জড়িয়ে না ধরা হয়। ঘুমের সময় কেউ তার উপর হাত পা রাখবে সেটা তার খুবই অপছন্দ। তানভীরের বারণ সত্ত্বেও সুহায়লা জোর করে তানভীরের কাছে গিয়েছে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। তখন তানভীর ভীষন রকমে ক্ষেপে গিয়েছিলো আর মুখে যা এসেছে সুহায়লাকে তাই শুনিয়েছে। এরপর আর সুহায়লা তানভীরের কাছে ঘেষেনি। খাটের অন্যপাশে যেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সুহায়লা। এখন তানভীরের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর আবার ইচ্ছে হচ্ছে ওকে জড়িয়ে ধরতে। ধরবে কি ধরটে না এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা পর্যায়ে তানভীরের গায়ের উপর এক হাত, এক পা ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরলো। মিনিট দশেক পরই কেউ একজন তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে সেটা টের পেতেই চোখ মেলে তাকালো তানভীর। সুহায়লাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। তানভীর শোয়া থেকে উঠে খুব জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
-” এতো নির্লজ্জ কেনো তুমি?”
-” আমি তোমার ওয়াইফ। তোমাকে জড়িয়ে ধরবো এতে নির্লজ্জের কি আছে?”
-” তোমাকে না করেছি সেটা কি কানে যায় না? আর মানুষ বউকে বুকে নিয়ে ঘুমায় অন্য কাউকে না।”
-” তো অামি তো তোমারই বউ। আমি কি অন্য কেউ?”
-” তোমাকে আমি বউ হিসেবেই স্বীকার করি না।”
-” তাহলে কি হিসেবে স্বীকার করো?”
-” জানি না আমি।”
-” কে বলেছে জানো না? অবশ্যই জানো? মনে যেটা আছে সেটা বলে ফেলো তানভীর। তুমি আমাকে একটা প্রস্টিটিউটের চেয়ে বেশি কিছু ভাবো না। সেটা আমি জানি। কথাটা তুমি আমাকে মুখের উপর বলতে পারো আমি কিছুই মনে করবো না।”
-” জানো যেহেতু তাহলে জিজ্ঞেস কেনো করো?”
-” শোনো তানভীর, তুমি আমাকে বউ ভাবো আর না ভাবো সেটা নিয়ে তোমাকে আমি কিছুই বলবো না। কিন্তু আমি তো তোমাকে আমার হাজবেন্ড মানি। তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর অধিকার আমার আছে। এবং আমি ঘুমাবোও। এখন তোমার সেটা পছন্দ হোক আর না হোক। তুমি আমাকে যত খুশি দূরে সরাতে পারো কিন্তু আমি তো দূরে সরার জন্য আসিনি। আমি তোমার কাছে আসবোই।”
-” ধুর…….”
সুহায়লার আত্মবিশ্বাসের সাথে পেরে উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো তানভীরের। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো অন্য রুমে ঘুমাতে। সুহায়লা যেয়ে পথ আটকালো তানভীরের।
-” কোথায় যাচ্ছো?”
-” আমি ঘুমাতে চাই।”
-” তো এখানে ঘুমাও।”
-” তোমার অত্যাচারে ঘুমাতে পারলে তো ঘুমাবো।”
-” চলো তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো। তাহলে জলদি ঘুম চলে আসবে।”
কিচ্ছু করতে হবে না।আমি নিজে নিজেই ঘুমাবো। ঘুমানোর টাইমে কেউ আমার গায়ে হাত দিলে অসহ্য লাগে আমার।”
-” গায়ে হাত দিবো কে বললো? আমি তো মাথায় হাত বুলাবো।”
-” একই কথা। তুমি দূরে থাকো কাছে আসবা না আমার। ”
তানভীরকে শক্ত করে জড়িযে ধরে সুহায়লা বললো,
-“১০০ বার আসবো। আমার তানভীরের কাছে আমি আসবো না তো কি অন্য কেউ আসবে?”
তানভীরের এবার রাগে মন চাচ্ছে দেয়ালে নিজের মাথা নিজেই ঠুকতে। সুহায়লাকে চাইলে সে পারে ধাক্কা মেরে দূরে সরাতে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। ও আবার চলে আসবে তানভীরের কাছে। তাই সে কোনো গতি না দেখতে পেয়ে চলে গেলো নিজের বিছানাতে ঘুমাতে।
এভাবেই যাচ্ছিলো তানভীর সুহায়লার দিনগুলো। তানভীর তাকে যতই কটু কথা বলুক বা দূরে সরাক সেগুলো একদমই পাত্তা দিতো না সুহায়লা। ও ওর মতন করে তানভীরকে আগলে রাখতে চাইতো। প্রতি দেড় দুইঘন্টা পরপর তানভীরকে ফোন করতো কথা বলার জন্য। সারাদিনে যদি সুহায়লা বিশ বার ফোন দিতো তানভীর রিসিভ করতো দুবার কি তিনবার। কখনো আবার সারাদিনে একটা ফোনও রিসিভ করতো না। সুহায়লা বিয়ের চারমাস পর তানভীরকে আই লাভ ইউ বলেছিলো। সেদিন প্রতিউত্তরে তানভীর বলেছিলো,
-” তোমার থেকে তেরো বছরের বড় একটা লোককে আই লাভইউ বলছো তুমি। ভেবে চিন্তে বলছো তো?”
-” ভেবে চিন্তে বলার কি হলো? তেরো বছর কোনো ফ্যাক্ট না তানভীর। তুমি আমার হাজবেন্ড। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমাকে আই লাভ ইউ বলেছি। এখানে তুমি বয়সের পার্থ্যক্যটা কে কেনো টানছো?”
-” অবশ্যই এটা বড় একটা ফ্যাক্ট। তেরো বছরের পার্থক্যে আর যাই হোক ভালোবাসা হয় না। তুমি যেটা বলছোসেটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। আর মিথ্যা কথা আমার মোটেই পছন্দ না।”
-” তোমাকে মিথ্যা কেনো বলবো? সত্যিই আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
-” দেখো সুহায়লা তুমি আমাকে ভালোবাসো কি
বাসো না সেটা আমার জানা নেই। আর আমি জানতে চাইও না। এসব ব্যাপারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। নেক্সট টাইম তুমি আমাকেএই কথা বলবে না এ্যান্ড এটাই ফাইনাল।বুঝেছো?”
-” না বুঝিনি। আমি তোমাকে বলবোই।”
-” আমার পছন্দ না।”
-” সেটা তোমার সমস্যা। আমার না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এই কথাটা আমি তোমাকে প্রতিদিন জানাতে চাই। আমিও দেখতে চাই কতদিন তুমি আমাকে আই লাভ ইউ টু না বলে থাকতে পারো”
-” মানুষ এতটা নির্লজ্জ হতে পারে সেটা তোমাকে না দেখলে আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না। তোমাকে এত অপমান করি, আমার অপছন্দের ব্যাপারগুলো করতে নিষেধ করি, তোমাকে দূরে সরাতে চাই। আর তুমি কিনা প্রতি মূহূর্তে জোর করে আমার কাছে আসো। ”
-” হ্যাঁ আমি নির্লজ্জ। তোমাকে ভালোবাসাটা যদি নির্লজ্জতা হয় তবে সেটাই। আজীবন তোমাকে নির্লজ্জের মতই ভালোবাসবো তোমাকে।”
কথাগুলো বলেই সুহায়লা চলে গিয়েছিলো অন্য ঘরে। দরজা আটকে নীরবে কেঁদেছিলো কিছুক্ষন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে আর কাঁদবেনা। কিন্তু ধৈর্য্যের বাঁধ ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু হয়েছিলো সুহায়লার। প্রতি মূহূর্তে ওকে এভাবে দূরে সরিয়ে দেয়াটা সহ্য হচ্ছিলো না। এভাবে আর কতদিন? সুহায়লার শ্বশুড় একদিন ওকে বলেছিলো তানভীর যখন ছোট ছিলো তখন ওকে কেউ খাইয়ে দিলে খুব খুশি হতো। বড় হওয়ার পরও এই ভালোলাগাটা তানভীরের ফুরিয়ে যায়নি। মায়ের কাছে প্রায়ই আবদার ধরতো খাইয়ে দেয়ার জন্য। কখনো উনি খাইয়ে দিতেন কখনোবা অন্য কোনো অযুহাত দেখিয়ে খাওয়াতেন না। যেদিন তানভীরের মা ওকে খাইয়ে দিতো না সেদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে বাবা খাইয়ে দিতো। তানভীরের মা চলে যাওয়ার পর থেকে সে আর কখনো আবদার ধরেনি তাকে খাইয়ে দিতে। সেদিন সুহায়লার শ্বশুড় তাকে বলেছিলো সে যেনো মুখে তুলে তানভীরকে খাইয়ে দেয় দেয় মাঝে মাঝে। ছেলেটা খুশি হবে । এরপর থেকে সুহায়লা প্রায় প্রতিদিনই তানভীরকে জোর করতো ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে কখনোই তানভীরের সাথে এদিকটা দিয়ে পেরে উঠেনি। সুহায়লা প্রায়ই আবদার ধরতো চলো না কোথাও থেকে ঘুরে আসি। এসব আবদার কখনোই তানভীর কানে তুলেনি। ওর খুব শখ ছিলো একদিন ভরা জোছনার রাতে তানভীরের হাত ধরে ছাদের ঐ সোফাগুলোতে বসে সারারাত গল্প করবে। এই আবদারগুলো তানভীরের কাছে ফালতু ন্যাকামি ছাড়া কোনোদিন কিছু মনে হয়নি। বিয়ের আটমাসের মাথায় সুহায়লার জন্মদিন ছিলো। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন তার। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তানভীরকে জানালো আ তার জন্মদিন। তানভীর কথাটা শুনেই তার পারসোনাল ড্রয়ার থেকে পনেরো হাজার টাকা বের করে বললো,
-” এটা রাখো। আর কার্ডে টাকা আছে না?”
-” হুম আছে।”
-” শর্ট পড়লে সেখান থেকে খরচ করো।”
-” কোথায় খরচ করবো?”
-” আজ না তোমার বার্থডে?”
-” হ্যাঁ”
-” আজকে তো বন্ধু বান্ধব ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরবে তাই দিলাম।”
-” তানভীর তোমার কাছে কি আমি টাকা চেয়েছি?”
-” তাহলে বলেছো কেনো আজ তোমার বার্থডে? টাকা লাগবে এজন্যই তো বলেছো।”
-” ছিঃ, তুমি কিভাবে ভাবলে আমার টাকা লাগবে তাই তোমাকে বলেছি আজ আমার বার্থডে? আমি চেয়েছিলাম তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে একটাবার উইশ করো। আর কিছু তো চাইনি।”
-” তোমার এই সমস্ত নাটক আমার একদম পছন্দ না সুহায়লা। তুমি যে কেনো আমাকে বিয়ে করেছো তা আমি জানি। বাবা মায়ের সংসারে টাকা লাগবে, নিজের ফিউচার সিকিউরড করতে হবে এসব ভেবেই তো আমাকে বিয়ে করা।”
-” তুমি আমাকে বলো ঠিকাছে। কিন্তু তুমি আমার আব্বা আম্মাকে নিয়ে কেনো টানাটানি করো?”
-” কেনো টানবো না? উনারা কি দুধে ধোঁয়া তুলসী পাতা নাকি?”
-” আমার আব্বা আম্মা কি করেছে তোমার সাথে?”
-” উনারাও তো লোভী। এই যে তোমার ভাই আমাকে সপ্তাহে দুদিন ফোন করে। আমি তো তাকে একদিনও ফোন দেই না। তার তো বুঝা উচিত যে আমি তার সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্টেড না তাই তাকে ফোন করি না। যে মানুষ প্রতি সপ্তাহে আমাকে ফোন করে তাকে তো আমার উচিত মাসে একটা হলেও ফোন করা। তোমার ভাই ব্যাপারগুলো বুঝে ঠিকই। তবুও নির্লজ্জের মতো আমাকে ফোন করে। কেনো জানো? আমাকে সে হাতে রাখতে চায়। আমার পরিচয় দিলে তোমার ভাইয়ের ভালো একটা জায়গায় জব হবে। মোটা অংকের সেলারি পাবে। তোমার ছোট বোনের বিয়ে নেক্সট মান্থ। তোমার মা বাবা আমাকে এই নিয়ে পাঁচবার ফোন করেছে যাতে আমি বিয়েতে এটেন্ড করি। দুদিন আগেই যেনো চলে যাই তোমার বাড়িতে। এসব কেনো করে জানি না ভাবছো? তোমার বোনের আকদের খরচটা যেনো আমি বহন করি সেজন্য। ছোট্ট একটা আকদের খরচ বহন করার এ্যাবিলিটি তোমার বাবার নেই। সেটা মেয়ের জামাইর কাছ থেকে নেয়ার জন্য রেডি হয়ে আছেন।”
তানভীরের কথা শুনে সুহায়লার কান গরম হয়ে আসছিলো রাগে। অঝোরে চোখ থেকে পানি ঝড়ছিলো তার। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-” আমার ভাই কি বলেছে আমাকে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন? আব্বা কি তোমার কাছে সাবার বিয়ের জন্য টাকা চেয়েছে? কখনোই না। তাহলে কেনো এসব মনগড়া কথা বলছো? আমার বাপ ভাই এতটাও ছেচড়া না যে মেয়ের জামাইর কাছে হাত পাতবে। জীবনের সেরা উপহার আজ পেলাম তানভীর। আজীবন মনে থাকবে এবারের জন্মদিনের কথা। সেদিন আর সহ্য হচ্ছিলো না সুহায়ার। ফোনে সাবাকে সমস্ত কথা বলে দেয়। সেদিনই রাতে ফোন করে তানভীরকে বলে,
-” আমার বোন আপনাকে ভালোবাসে তাই এত অপমানের পরেও আপনার কাছে পড়ে আছে। আমার বোনের আত্মসম্মানবোধ খুব বেশি। তবুও এই আটমাস তার এই আত্মসম্মানকে মাটিচাপা দিয়ে আপনার সাথে সম্পর্কটা ভালো করার চেষ্টা করছে আর আপনি কি না মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন? এতদিনেও আপনি টের পেলেন না যে আমার বোন কেমন? সে আপনাকে কতটুক ভালোবাসে। দেখবেন দুলাভাই আমার বোনকে বুঝতে এতটাও দেরি করে ফেলবেন না যেনো আমার বোন চিরতরে আপনার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সুহা যদি একবার মনের দরজা বন্ধ করে দেয় আপনি কখনো সেই দরজা হাজার চেষ্টা করেও খুলতে পারবেন না।”
সেদিন কথাগুলো তানভীর কানেই তুলেনি। পাল্টা কোনো উত্তরও দেয়নি। কথাগুলো শুনে চুপচাপ ফোনটা রেখে দিয়েছিলো।
(চলবে)
.
.
.
.