বন্ধ দরজা পর্ব ১৪

#বন্ধ_দরজা ১৪
…..
দিন দিন সমস্ত ধৈর্য শেষ হয়ে আসছিলো সুহায়লার। তিক্ততা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। বিশেষ করে বিয়ের দশ মাসের মাথায় শ্বশুড় মারা যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও বিগড়ে গিয়েছিলো। তানভীর বলতে গেলে অনেকটা নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিলো। সেই সকালে বের হতো আর মাঝরাতে বাড়ি ফিরতো। তানভীরের দুর্ব্যবহার আর অপমান চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম হচ্ছিলো। একাকিত্ব দারুনভাবে ভর করছিলো সুহায়লার উপর। সংসারের উপর থেকে মন ছুটে গেলেও হাল ছাড়েনি সে। দাঁতে দাঁত চেপে পড়েছিলো ঐ সংসারে। ধৈর্য্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙে গিয়েছিলো তো সেদিন যেদিন ফাহিমের বাসায় এক সন্ধ্যায় পার্টিতে গিয়েছিলো দুজনে তখন তাদের সংসারের এক বছর ছয় মাস চলছে। পার্টিতে সেদিন তানভীর ফাহিমের ছোটবেলার বন্ধু রাহাত এসেছিলো। দীর্ঘদিন পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছে সে। সুহায়লার সাথে তানভীরের সম্পর্ক কেমন সেটা পুরোপুরি জানা ছিলো রাহাতের। তার ধারনা ছিলো সুহায়লা দেখতে সুন্দর না। তার মাঝে আকর্ষনীয় কিছু নেই। কিন্তু সেদিন পার্টিতে প্রথম সুহায়লাকে দেখার পর চোখ আটকে গিয়েছিলো রাহাতের। এত সুন্দর মেয়ে! সে কি ভেবেছিলো আর এখন সে কি দেখছে? এমন মেয়েকে ভালো না বেসে কিভাবে থাকা সম্ভব? ভীষন রকমের টান অনুভব করছিলো রাহাত সুহায়লার প্রতি। একবার মনে হয়েছিলো এটা তো তার বন্ধুর বউ। পরক্ষনেই মনে হলো কিসের বউ? তানভীর তো তাকে বউ মনে করে না। বরং মেয়েটার লাইফ হেল করে দিচ্ছে । সে যদি মেয়েটাকে তানভীরের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের করে আগলে ধরে তাহলে এখানে দোষের কি আছে? পার্টিতে আসার পরপরই তানভীর রাহাতের সাথে সুহায়লার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। ঘন্টাখানেক সুহায়লাকে সে দূর থেকে দেখেছে আর স্বপ্নজাল বুনেছে। এমন মেয়েকে নিয়ে কে না স্বপ্ন বুনতে চাইবে? সুহায়লার পাশে এসে বসলো রাহাত।
-” সুহায়লা তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।”
-” জ্বি বলুন ভাইয়া।”
-” দেখো এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমি কথা বলতে পছন্দ করিনা। সোজাসোজি কথা বলতেই বেশি পছন্দ করি। আমি তানভীর আর তোমার সম্পর্কে সবটাই জানি। ও তোমাকে কোন নজরে দেখে সেটাও জানি। ওর কাছে তুমি কোনোদিনও সম্মান পাবে না। আমার মতে তুমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।”
-” কি?”
-” হ্যাঁ। ওকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমাকে বিয়ে করো। তানভীরের চেয়ে কোনো অংশে আমি কম না। এডুকেশন মানি এভরিথিং আমার আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা তানভীরের কাছে যে সম্মানটুকু তুমি পাওনি সেটা তুমি আমার কাছে পাবে। আমি তোমাকে দিবো।”
-” বুঝে শুনে বলছেন তো? আমি আপনার বন্ধুর বউ। আপনি কিভা…….”
-” ওয়েট সুহায়লা। তানভীর তোমাকে বউ মানে না।”
সুহায়লা আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসতে নিচ্ছিলো। ঠিক সে মূহূর্তে রাহাত ওর হাত ধরে ওকে কাছে নিয়ে আসে। সুহায়লা ধাক্কা মেরে রাহাতকে সরিয়ে দিলো। বেশ জোরে চেঁচিয়ে ইচ্ছামতো কিছুক্ষন রাহাতকে শুনিয়ে দিলো। সুহায়লার চেঁচামেচিতে আশপাশের লোকজন সবাই ওকে দেখছে। তানভীরের নাক কাঁটা পড়ছে সুহায়লার এমন কান্ডে । ভীষন রকমে ক্ষেপে যাচ্ছে সে সুহায়লার উপর। সুহায়লার হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরে দাঁত কিটমিট করে বলছে,
-” সমস্যা কি? পাবলিক প্লেসে এভাবে কেনো সিন ক্রিয়েট করছো?”
-” তোমার বন্ধু আমার হাত ধরে টানাটানি করবে কেনো?”
তানভীর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সুহায়লাকে টানতে টানতে গাড়িতে এনে তুললো। বাসায় এসে রুমে ঢুকেই সুহায়লার হাত খুব শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
-” লোকের সামনে আমাকে অপমান করতে খুব মজা লাগে তাই না?”
-” তানভীর আমার হাত ছাড়ো। আমি ব্যাথা পাচ্ছি।”
সুহায়লা একথা বলার পর আরো শক্ত করে চেপে ধরলো তানভীর।
-” ব্যাথা পাওয়ার জন্যই দিচ্ছি। আমাকে অপমান করতে খুব মজা লাগে না? ও হাত ধরেছে তো কি হয়েছে?”
-” তোমার বউয়ের হাত ধরে অন্য লোকে টানাটানি করবে এটা তোমার কিছুই আসে যায় না?”
-” না আসে যায় না। তোমার মতো মেয়ে এরচেয়ে বেশি কি আশা করো? তোমরা যে টাকার বিনিময়ে সবকিছু লুটিয়ে দাও সেখবর সবার জানা। তোমার হাত ধরে টানাতে কি এমন হয়ে গেছে শুনি? ওকি তোমার বুকে হাত দিয়েছে? বুকে তো আর হাত দেয়নি। আর যদি দিয়েও থেকে থাকে তাহলে সমস্যাটা কোথায়? তোমরা তো এই জাতেরই। তোমরা তো সব খুলেই দিয়ে রাখো। এই ন্যাকামিটা কেনো করছো বুঝলাম না। তুমি এমনভাবে রিয়েক্ট করছো মনে হচ্ছে ও তোমাকে টেনে হিঁচড়ে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে গেছে।”
তানভীরের কথা শুনে থ মেরে আছে সুহালা। কি বললো সে এটা? এতদিন কার ভালোবাসা পাওয়ার আশায় বসে ছিলো সে? এই মানুষটার যে কিনা তার বউয়ের বুকে অন্য পুরুষ হাত দিলেও কিছু আসবে যাবে না? গা ঘিনঘিন করছে সুহায়লার। প্রচন্ড রকমে ঘিনঘিন করছে। ইচ্ছে হচ্ছে তানভীরের মুখে থুঁতু ছিটিয়ে দিতে। এতোটা নিকৃষ্ট মানুষ হয়? চিরতরে রুচি উঠে গেছে তানভীরের উপর থেকে তার। তানভীর চলে গেছে রুম থেকে । বাহিরে গাড়ি বেরোনোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। তানভীর বোধহয় গাড়িনিয়ে বেরিয়েছে। আধাঘন্টা যাবৎ ফ্লোরে বসে আছে সুহায়লা। হাতে প্রচন্ড ব্যাথা করছে তার। আজ আর চোখ থেকে কোনো পানি ঝড়ছে না। হতে পারে প্রচন্ড ঘৃনায়। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে সুহায়লা। আজই সে এই ঘর ত্যাগ করবে। মানুষের সাথে এক ছাদের নিচে বাস করা সম্ভব। কোনো মানুষরুপি জানোয়ারের সাথে না। তানভীর একটা জানোয়ার। যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্সটা সেড়ে নিবে সে। ভুলটা তারই ছিলো। সে একটা জানোয়ারকে মানুষ বানাতে গিয়েছিলো। জানোয়ার কখনো মানুষ হয়না সেটা ভুলেই গিয়েছিলো সুহায়লা। লাগেজে এক এক করে নিজের সমস্ত জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে সে। সব গোছগাছ হতেই ফোন এলো ফাহিমের।
-” হ্যালো ভাইয়া”
-” ইমিডিয়েটলি হলি ফ্যামিলি হসপিটালে আসো। ”
-” কেনো?”
-” তানভীর এক্সিডেন্ট করেছে। হসপিটাল থেকে খবর এসেছে কন্ডিশন খুবই ক্রিটিক্যাল। বাঁচতেও পারে আবার…… তুমি জলদি আসো। আমিও রওয়ানা হয়েছি।”
ফোনটা কেটে দিলো ফাহিম। কেটে দেয়ার পরও কানে ফোন লাগিয়ে রেখেছে সুহায়লা। ব্রেইন এই মূহূর্তে কাজ করছে না তার। কি বললো ফাহিম? তানভীর এক্সিডেন্ট….. বাঁচা…… মরা……। ও না মাত্রই ঝগড়া করে বাসা থেকে চলে গেলো। কিছুক্ষনের মধ্যে কি হয়ে গেলো? খানিক বাদে হুঁশ হলো সুহায়লার। তানভীর হসপিটালে আছে। বাঁচতেও পারে মরতেও পারে। ওকে এক্ষুনি যেতে হবে হসপিটালে। রফিক ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সুহায়লা। দুচোখ বেয়ে অঝোরে পানি ঝড়ছে তার। একটু আগেই যে মানুষটার প্রতি প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছিলো তার জন্যই কেনো চোখ থেকে পানি ঝড়ছে সেটা তার জানা নেই।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here