বন্ধ দরজা পর্ব ১৫

বন্ধ দরজা ১৫
…..
সেইবারের যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলো তানভীর। টানা দুদিন আই.সি.ইউ.তে ওকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি হয়েছিলো। জানে বেঁচে গেলেও সুস্থ হতে সময় লেগেছিলো পুরো দেড়মাস। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলো সে। ডান পা টা ভেঙে গিয়েছিলো। ডান হাতের আঙুলগুলো থেতলে গিয়েছিলো, ঘাড়ের একটা রগ কেটে গিয়েছিলো। পনেরোদিন হসপিটাল থাকার পর বাসায় আনা হয়েছিলো ওকে। তখন সে নিজহাতে খেতে পারতো না, গোসল করতে পারতো না।হাঁটাচলা তো একদমই বন্ধ। বাসায় আনার পর থেকে প্রায় রাতেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতো। দুটো কম্বল জড়ানোর পরও কাঁপুনি বন্ধ হতে চাইতো না। তখন সুহায়লা তানভীরকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরতো। ধীরে ধীরে তার কাঁপুনি বন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো সুহায়লার বুকে। সে সময়টাতে দুদিন পরপরই সুহায়লার মা, ভাইবাবা চলে আসতো তানভীরকে দেখতে। সাবার হাজবেন্ড ইমরান এসেছিলো দুদিন। খুব জমিয়ে গল্প করেছে তানভীরের সাথে। আর পুরো দেড়মাসই সাবা তার বোনের সাথে তানভীরের বাসাতেই ছিলো। তানভীরের সমস্ত কাজ সুহায়লা করেছে। ওকে খাওয়ানো, গোসল করানো, কাপড় পাল্টে দেয়া, ধরে ধরে হাঁটানো সব করেছে সুহায়লা। আর বোনকে পুরো সাপোর্ট দিয়েছে সাবা। তানভীরের পায়ের প্লাস্টার একমাস বাদে খোলার পরও ও হাঁটতে পারছিলো না। তখন সাবা আর সুহায়লা মিলে ওকে দুপাশ থেকে আঁকড়ে ধরে সকাল বিকাল বাড়ির বাহিরে হাঁটাতো। সাদমান আর ফাহিম খুব ঘন ঘন চলে আসতো এ বাড়িতে তানভীরকে সঙ্গ দিতে। সুহায়লার মা আর সাবা সেদিন ফাহিমের পার্টিতে সমস্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা জেনেছে আরো আগেই। তবু উনারা তানভীরের এমন বিপদে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। এমনকি সুহায়লার কথা হচ্ছে, যেহেতু সে এখনও আমার হাজবেন্ড সে হিসেবে তার এমন বিপদে তাকে ছেড়ে দেয়াটা হবে জঘন্য খারাপ কাজ। এতটাও অমানুষ সুহায়লা না। তার মা বোনেরও একই যুক্তি ছিলো। তাই সুহায়লা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তানভীর সুস্থ হোক এরপর সে চলে যাবে। সেই দেড়মাসে খুব কাছ থেকে সুহায়লাকে দেখেছে তানভীর। এতোটা লক্ষ্য করে সে কখনো সুহায়লাকে দেখেছি অথবা দেখতে চায়নি। মেয়েটা সত্যিই ভিন্ন। এত অপমানের পরও যে মেয়ে তার এভাবে দিনরাত সেবা করে যাচ্ছে সে কিভাবে স্বার্থপর হয়? দিন যাচ্ছিলো তানভীরের মনে জায়গা হচ্ছিলো সুহায়লার। পুরোপুরি জায়গা তো করে নিয়েছিলো সেদিন যেদিন রাহাত ফের এসেছিলো সুহায়লাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে। পায়ের প্লাস্টার খোলার পাঁচদিন আগে রাহাত এসেছিলো তানভীরের বাসায়। সুহায়লাকে এই বিয়েতে রাজি করানোর জন্য। অনেক চরনের লোভ দেখিয়েছে ওকে। কোনো লাভ হয়নি। শেষমেষ ওকে ঘর থেকে তাড়ানোর জন্য সুহায়লা বঠি হাতে নিয়েনিয়েছিলো। এসব তানভীর দুতলার উপর থেকে হুইলচেয়ারে বসে দেখেছে সে তখনকাউকে কিছুই বলেনি। রাতে ঘুমানোর সময় সুহায়লাকে খুব আস্তে আস্তে বলছিলো
,-” রাহাতের প্রস্তাবে রাজি হওনি কেনো? যথেষ্ট ভালো অফার দিয়েছিলো ও। তাছাড়া ও তোমাকে ভালোওবাসে। আমার চেয়ে বেশি সম্মান দিবে তোমাকে।”
সুহায়লা খুব শান্ত গলায় উত্তর দিয়েছিলো,
-” তুমি আমাকে যতটা স্বস্তা মনে করো ততটা স্বস্তা আমি নই। মধ্যবিত্ত মানেই স্বস্তা নোংরা চরিত্রের না যে পয়সাওয়ালা পুরুষ মানুষ অফার করলেই তার পিছন পিছন দৌড় দিবো বা সব খুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে যাবো। তবে অবশ্য তোমাকে সেসব বলেও লাভ নেই। তোমার নজরে আমি খারাপ। কারন আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে সেটা আমার গায়ে সিল লাগানো। এই সিল জীবনে কখনো তুলতেও পারবো না, তোমার নজরে কখনো ভালোও হতে পারবো না। তাছাড়া তোমার নজরে ভালো হওয়ার আশা এখন করিও না।”
কথাটা বলেই সুহায়লা চলে যাচ্ছিলো ছাদের দিকটাতে। তখন তানভীর ওকে পিছন থেকে ডেকে বললো,
-” ওখানে কেনো যাচ্ছো? ঘুমাবে না?”
-” তুমি ঘুমাও। আমার ঘুম আসছে না।”
সেদিন তানভীর সুহায়লার কথায় দিব্যি বুঝতে পারছিলো মেয়েটা তার কথায় কষ্ট পেয়েছে। সরি বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো খুব। শুধু সেদিনের কথার জন্য না, গোটা দেড় বছরের জন্য। কিন্তু কি যেনো একটা ওকে আটকে রাখছিলো।মুখে আনতে যেয়েও পারেনি। সেদিন সারারাত সুহায়লা ছাদের সোফার উপর পা এলিয়ে বসে ছিলো। আর তানভীর অন্ধকার রুমে শুয়ে সুহায়লাকে দেখেছে। কেউই ঘুমায়নি সেদিন সারারাত। সুহায়লার মাঝে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলো তানভীর। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হতো আগের মতো পাগলামি এখন আর করো না কেনো? মাঝরাতে আমাকে জড়িয়ে ধরো না কেনো? কিন্তু জিেস করতে পারতো না। হতে পারে সেটা ছিলো তার ভিতরের অপরাধবোধ যেটা তাকে আটকে রাখতো। প্লাস্টার খোলার পনেরোদিন পর থেকে তানভীর আগের মতই হাঁটতে পারতো। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তানভীরকে সেভাবে সুহায়লার কাছে যেতে দেখা যায়নি। একধরনের জড়তা কাজ করতো। হতে পারে সেটা তার অনুশোচনা বোধ ছিলো। তানভীর সুস্থ হওয়ার পর আবার অফিস জয়েন করলো। সুহায়লা প্রতিঘন্টায় ফোনে তার খোঁজ নিতো। প্রতিবেলায় খবর নিতো তানভীর ঠিকঠাকভাবে ঔষধ খেয়েছে কিনা। তানভীরকে দুমাসের মেডিসিন দেয়া হয়েছিলো। গতকাল তার মেডিসিনের ফুল কোর্স কমপ্লিট হয়েছে। সুহায়লার দায়িত্বের অবসান ঘটেছে গতকাল। তানভীরের আজ সকালের ফ্লাইট ছিলো চিটাগাং এর। গতরাতে তানভীরের লাগেজ গুছাতে গুছাতে সুহায়লা তানভীরকে বললো,
-” তুমি কি এখন পুরোপুরি সুস্থ?”
– ” হুম পুরোপুরি।”
-” মাথা যন্ত্রনা হয় না তো?”
-” না, একদম নেই।”
-” শোনো, তোমার গাড়ির চাবি, ওয়ালেট, সানগ্লাস ওগুলো ড্রেসিং টেবিলের সেকেন্ড ড্রয়ারে আছে। আলমারীর চাবি থাকে প্রথম ড্রয়ারে। তোমার স্যুট কালেকশন সবকয়টা আলমারির ডানপাশের দরজাটায় রেখেছি। গেন্জি শার্টগুলো মাঝের দরজায়। আর প্যান্ট ট্রাউজার মোজা এগুলো বাম পাশের দরজায়। জুতা সব নিচে র্যাকে রাখা আছে। নয়নকে বললেই বের করে দিবে। আর যদি দেখো যে মাথা ব্যাথা করছে তাহলে ঐ বক্সটায় মেডিসিন রেখেছি। কোনটা কি নিয়মে খাবে সেগুলো মেডিসিনের পিছনে কাগজে লিখে দিয়েছি।”
-” এসব আমাকে কেনো বলছো?”
-” তোমার প্রয়োজন হবে তাই বললাম।”
-” তুমি তো আছোই। প্রয়োজন হলে তুমিই তো দেখবে। আমি সেসব জেনে কি করবো?”
সুহায়লা পাল্টা তাকে কোনো উত্তর দেয়নি। সে জানাতে চায়নি যে আজ সকালে সে চলে আসবে বাবার বাড়ি। সারারাত ঘুমায়নি সুহায়লা। বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ করেছে। মাঝরাতে উঠে ছাদে যেয়ে ভোর পর্যন্ত পায়চারি করেছে। গতরাতই ছিলো এই সংসারে তার শেষ রাত। দেড় বছরের সংসারের ইতি টানতে যাচ্ছে সে। সিদ্ধান্তটা কোনদিক দিয়েই ছোট ছিলো না। দেড় বছর সে যুদ্ধ করেছে। নিজের সাথে যুদ্ধ। অন্যের সাথে সহজে যুদ্ধ করা যায়, কিন্ততু নিজের সাথে যুদ্ধ করাটা খুবই যন্ত্রনাদায়ক। সেই যুদ্ধ না কেউ দেখে, না কেউ বুঝে। সাড়ে পাঁচটার দিকে তানভীরকে ডেকে তুললো সুহায়লা। চিটাগাং যেতে হবে তাকে। নয়টার ফ্লাইট তার। সকালে গোসল আর নাস্তা সেড়ে সাড়ে ছয়টায় ঘর থেকে বেরিয়েছে সে। তানভীর বেরোনোর ঘন্টাখানেক পরই সুহায়া তার সমস্ত জিনিস গোছানো শুরু করলো। সাড়ে নয়টার দিকেসেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আসার সময় রফিক ড্রাইভার খুব করে বলেছিলো গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য। সুহায়লা রাজি হয়নি।
-” মামা, কোন গলিতে ঢুকমু?”
সি.এন.জি ড্রাইভারের কথায় ঘোর কাটলো সুহায়লার।
-” সামনে গিয়ে বামের গলিতে যাবেন।”
দরজায় বেল বাজাচ্ছে সুহায়লা। সুহায়লার মা মিতা এসে দরজা খুললো। তার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা বড় লাগেজ সহ। বিকের ভেতর কেমন যেনো ছ্যাত করে উঠলো তার। ঘরের মেয়ে আজ তার সংসার ছেড়ে ফের বাবার ঘরে ফিরে এসেছে। ব্যাপারটা যেকোন মায়ের জন্যই মেনে নেয়াটা কষ্টের। দুচোখে পানি ছলছল করছে তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। তবুও তিনি চোখের পানি আড়াল করে মেয়ের হাত ধরে এনে ঘরে বসালেন। বাসার কাজের বুয়াকে ডেকে বললেন লাগেজগুলো ঘরে এনে ঢুকাতে। সুহায়লা সোফায় বসতে বসতে বললো,
-” সাবা কোথায় আম্মা?”
-” কলেজে।”
-” ওহ্।”
-” তানভীরকে বলেছিস তুই যে আজ চলে এসেছিস?”
-” না।
-” বলে আসাটা প্রয়োজন ছিলো না?”
– ” ওকে বলে কি হবে? আমার থাকা বা না থাকাতে ওর কিছু আসে যায় না।”
– ” একটা কথা বলি, ছেলেটার মধ্যে বিগত কয়েকদিনে আমি বেশ পরিবর্তন দেখেছি। ছেলেটাকে একটাবার ডিভোর্সের কথা বলে দেখতি। এমনও তো হতে পারে ও রাজি নাও তে পারে।”
– কি বলো আম্মা এসব তুমি? তানভীরের মাঝে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আর ও রাজি হবে না বলছো? এই কথা শুনলে ধেই ধেই করে রাজি হয়ে যাবে।”
-” আমার মন বলছে অন্য কিছু।”
-” থামো তো। ভালো লাগছে না সেসব কথা। অনেকদিন হয় ঠিকমতো ঘুমাই না। আমি ঘুমাবো। আর আমাকে একদম ডাকাডাকি করবে না। যতক্ষন ইচ্ছে হয় আজ আমি ঘুমাবো।”
কথাটা বলেই সুহায়লা নিজ রুমে যেয়ে শুয়ে পড়লো। ফোনটা বন্ধ করে দিলো যাতে কেউ ফোনে বিরক্ত না করতে পারে। হালকা পাওয়ারের স্লিপিং পিল খেয়েছে সে যাতে ঘুমটা ভালোভাবে হয়।
দুপুর দুইটা বাজে। হোটেলে ভ্রু কুঁচকে মোবাইল হাতে বসে আছে তানভীর। মিটিং শেষ করে মাত্রই হোটেলে এসেছে সে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত সুহায়লা একটা ফোনও করেনি। এমন তো কখনো হয়না। এই মেয়ে তো ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে। সুহায়লা কেনো ফোন দিচ্ছে না সেই চিন্তায় মিটিংয়েও মন দিতে পারেনি তানভীর। এই কয়দিন সুহায়লা বাসার ল্যান্ডফোন দিয়েই ওকে কল করেছে। তাই কললিস্টে সুহায়লার নাম্বারটা নেই। নাম্বারটা সেইভ করাও নেই। কোনো উপায়ন্তর না দেখে পনেরো মিনিট আগে নয়নের কাছ থেকে সুহায়লার নম্বর নিয়েছে সে। ফোনটা বন্ধ। দুশ্চিন্তা হচ্ছে তানভীরের। কার কাছ থেকে খবর নেবে সে এখন। শ্বশুড়বাড়ির কারো নাম্বারই তো ওর মোবাইলে সেইভ নেই। ফাহিম কে কি একবার পাঠাবে সুহায়লাদের বাসায় দেখে আসার জন্য মেয়েটা আছে কোথায়? ভাবতে ভাবতে ফোন দিয়েই দিলো ফাহিমকে। সেও ফোন রিসিভ করছে না। সব মিলিয়ে এই মূহূর্তে তানভীরের রাগ আকাশে উঠার উপক্রম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here