বন্ধ দরজা পর্ব ৩২

#বন্ধ_দরজা
পর্ব-৩২
লেখা-মিম

পরদিন বিকালে সাড়ে তিনটার দিকে সাদমান বাসার সামনের দোকানে ঢুকেছে মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করতে। দোকানে ঢুকে দেখে তানভীরও সেখানে এসেছে মোবাইলে রিচার্জ করবে বলে। এই সময়ে তানভীরকে ঘরে পড়ার গেন্জি ট্রাউজারে এখানে দেখে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সাদমান। তানভীর তখনও সাদমানকে দেখেনি। ফোন নম্বর লিখায় ব্যস্ত ছিলো সে। সাদমানের ডাকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো তানভীর।
-” আরে তুমি? অফিস থেকে চলে এলে এত তাড়াতাড়ি?”
-” আপনি এইসময় এখানে কি করেন? আপনি তো কখনোই এই সময়ে আমাদের বাসায় আসেন না।”
-” তোমাদের বাসায় এসেছি কে বললো?”
-” তো কোথায় এসেছেন?”
-” আমি এখন তোমাদের প্রতিবেশী। ঐ যে বাড়িটা দেখছো সেটা এখন আমার।”
-” মানে?”
-” কিনে নিয়েছি। এখন তুমি বলো এই সময়ে এখানে কেনো তুমি? অফিস নেই?”
-” অফিসের কাজে ট্যুরে গিয়েছিলাম গতকাল। আজ ফিরলাম। তাই অফিস যাইনি। সোজা বাসায় চলে এসেছি। ইয়ে….. তানভীর ভাই তখন আপনি কি বললেন? ঐ বাড়ি আপনার? কিনে নিয়েছেন মানে?”
– ” হুম কিনেছি। তোমার বোন রাগ করে চলে এসেছে বাপের বাড়ি। উঠতে বসতে বলে আমার বয়স বেশি তাই আমি নাকি প্রেম করতে জানি না। জীবনে ভুল করেছে এ্যারেন্জ ম্যারেজ করে। লাভ ম্যারেজ করা উচিত ছিলো। নিরামিষ লাইফ লিড করছে ও। আরো কত কি! সেদিন তো এসব নিয়ে ঘরে তুলকালাম বাজিয়ে ফেলেছিলো ঘরে। কোনোভাবেই ও ঘরে থাকবে না। শেষমেষ বাধ্যহয়ে ওকে এখানে দিয়ে গেলাম।”
-” সুহা আপনাকে এসব বলেছে?”
-” তো আবার কি? আরো কতকিছু শোনায় তোমার বোন। সব সহ্য করি। একটাই বউ কিনা তাই। আমার কাছে একটু আধটু শখ করতেই পারে তাই না? বেশি কিছু তো আর আবদার ধরেনি। একটু প্রেমই তো করবে বলেছে। করবো ওর সাথে প্রেম। ১৮-১৯ বছরের ছেলেদের মতো করে। আমি চাইনা আমার ওয়াইফের কোনো শখ অপূর্ন থাকুক।”
-” সেটা না হয় বুঝলাম। বাড়ি কেনো কিনেছেন সেটা বুঝিনি।”
-” ঐ যে বললাম প্রেম করবো । পাশাপাশি বাড়িতে থেকে প্রেম করবো আমি।
-” তাই বলে একটা বাড়ি কিনে ফেলবেন?”
-” হুম তাতে কি হয়েছে? নিজের ওয়াইফের খুশির জন্য কিছু করবো না তো কার জন্য করবো?”
সাদমান আর কিছু বলছে না। মেজাজ খারাপ হচ্ছে বোনের উপর। বয়স বেশি বলে কি লোকটাকে এভাবে শোনাবে নাকি? তাছাড়া তানভীরকে দেখলে তো মনে হয় ২৭-২৮ বছর। মানুষটা ওকে যথেষ্ট ভালোওবাসে। তবু কেনো মেয়েটা এমন করে মানুষটার সাথে?
-“তো ভাইয়া আপনি আমাদের বাসায় এসে পড়েন। খাওয়া দাওয়া তো বোধহয় কষ্ট হচ্ছে আপনার। এত পুরোনো বাড়িতে তো আপনি থেকে অভ্যস্ত না। আপনার বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে।”
-” নাহ। কোনো সমস্যা হচ্ছেনা। আমার যা প্রয়োজন সব ব্যবস্থা করে নিয়েছি। কাজের লোক দারোয়ান সব ঠিক করে ফেলেছি।”
-” তবুও কোনো সমস্যা হলে প্লিজ আমাকে জানাবেন।”
-” হ্যা তা তো জানাবোই। তুমি এসো আমার বাসায় বেড়াতে। একসাথে কফি খাবো আর আড্ডা দিবো।”
-” জ্বি আসবো।”
-” যাও, বাসায় যাও। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও যেয়ে।”
সাদি ঘরে ঢুকছে আর সুহায়লাকে জোরে চেঁচিয়ে ডাকছে। বাসার কাজের লোক দরজা খুলেছে। তাদের মা ঘুমাচ্ছিলো। সাবা আর সুহায়লা দুজন শুয়ে ছিলো। চিৎকার শুনে তিনজনই রীতিমতো পড়িমড়ি করে দৌঁড়ে এলো ড্রইংরুমে।
-” কি রে? চেঁচাচ্ছিস কেনো?”
-” তুই তানভীর ভাইয়ের সাথে এমন করছিস কেনো?”
-” আমি কি করলাম?”
-” তুই নাকি উনাকে বলেছিস উনা বয়স বেশিতাই প্রেম করতে জানে না, লাভ ম্যারেজ করা উচিত ছিলো তোর। ”
-” আমি এসব কখন বললাম?”
-” তুই না বললে কি আমাকে এমনি এমনি বলেছে নাকি? তোর আবদার মিটাতে যেয়ে আরাম আয়েশ েছড়ে এই পুরান বাড়িতে এসে উঠেছে। কতগুলা টাকা খরচ করালি তুই উনার!”
-” আমার আবদার? কোন আবদার সাদি?”
-‘ তোর প্রেম করার আবদার।”
-” আমি?”
-” এমনভাবে বলছিস মনে হচ্ছে তুই কিছুই বলিসনি। অহেতুক তানভীর ভাই বানিয়ে বানিয়ে এসব বলেছে তাই না?”
-” সাদি, ঘটনা কি হয়েছে শোন? সুহা জাস্ট মজা করে বলেছিলো দুলাভাইকে কথাগুলো। উনি সুহাকে তেমন সময় দেয় না তাই।”
-” মজা করার একটা লিমিট থাকে। বয়স নিয়ে কথা বলবে কেনো ও?”
-” আচ্ছা ভুল হয়েছে। আর বলবো না।”
-” শোনো আম্মা, তানভীর ভাইয়ের খাবার কিন্তু এই বাসা থেকে পাঠাবা। উনি যখন যা খেতে চাইবে সব রান্না করবা। আর তুই, কোনোদিন যদি শুনি বয়স নিয়ে কথা বলেছিস তাহলে কিন্তু তোর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিবো আমি।”
কথাগুলো শেষ করে এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না সাদমান। হন হন করে ঘরে চলে গেলো। মা মেয়েরা মিলে ড্রইং রুমে বসে গবেষনা করছে কেনো তানভীর এতগুলো মিথ্যা কথা বললো? গবেষনার ফাঁকে তানভীরের ফোন এলো সুহায়লার মোবাইলে। রিসিভ করার পর সুহায়লা কিছু বলার আগেই তানভীর বলতে লাগলো
-” কি গো? ছাদে আসো না কেনো?
-” তুমি সাদিকে কি বলেছো?”
-” বকা দিয়েছে তাই না?”
-” সমস্যা কোথায় তোমার?”
সুহায়লার গলার আওয়াজ পেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সাদমান।
-” তুই উনার সাথে চেঁচাচ্ছিস কেনো?”
সাদমান ভ্রু কুঁচকে কোমড়ে দুহাত রেখে সুহায়লার দিকে তাকিয়ে আছে।
-” তোর জন্য কি এখন শান্তিমতো ঝগড়াও করতে পারবো না?”
-” নাহ, পারবি না। ঠিকমতো কথা বল উনার সাথে। কোনো ধরনের চেঁচামেচি শুনতে চাই না আমি।”
সুহায়লার প্রচন্ড রকমে বিগড়ে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে তানভীর হাসছে।
-” আসো না ছাদে? পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি।”
-” থাকো দাঁড়িয়ে আমি আসবো না। ”
-” সাদিকে বলে দিবো কিন্তু।”
-” ভালোই তো একটা সাপোর্টার পেয়েছো। যা খুশি বলে বেড়াবা আর সে তাই বিশ্বাস করবে।”
-” হয়েছে টুকটুকি। আর রাগ করে না। তোমার হাজবেন্ড সেই কখন থেকে তোমার ছাদে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে তোমাকে দেখার জন্য। একটু দেখা দাও না প্লিজ।”
-” আসছি…..”
কানে ফোন লাগিয়ে সুহায়লা ছাদে গেলো। তার পিছন পিছন সাবাও গেলো। ছাদে উঠে দেখে তানভীর কানে হেডফোন গুজে শর্টপ্যান্ট আর গেন্জি পড়ে বাসার সামনের গলিতে হাঁটছে আর ঝালমুড়ি খাচ্ছে।
-” শর্টপ্যান্ট পড়ে ঘুরছো কেনো? এটা তোমার শ্বশুড়বাড়ির এলাকা। মানুষ কি বলবে?”
-” আমি এখন একজন প্রেমিক। প্রেমিকরা তো এভাবেই শর্টপ্যান্ট পড়ে প্রেমিকার বাসার সামনে ঘুড়ে।”
-” কে বলেছে তোমাকে?”
-” ফাহিমকে দেখতাম তমার বাসার সামনে এভাবে ঘুরতো। তাছাড়া এই এলাকার লোকজন জানেও না যে এটা আমার শ্বশুড়বাড়ি। আমি এ বাড়ির জামাই।”
-” জানবে কি করে? আমার বাসায় কয়দিন এসেছো তুমি? সবসময় তো রাতে এসেছো। গাড়ি নিয়ে বাসার গেইট পর্যন্ত এসেছো আবার সেখান থেকে গাড়িতে উঠেছো।”
তানভীর মুড়ি খাওয়া শেষ করে নিজের ছাদের দিকে যাওয়ার জন্য এগোচ্ছে। ঠিক সে সময় ২২-২৩ বছর বয়সী এক ছেলে তানভীরকে ডেকে নিয়ে জেরা শুরু করে দিলো।
-” এখানে কি ভাই?”
-” এখানে কি মানে? আমার বাসার সামনে আমি ঘুরি না শুয়ে থাকি সেটা আমার ব্যাপার।”
-” কোনটা আপনার বাসা?”
-” যে বাসার সামনে তুমি দাঁড়িয়ে আছো সেটা।”
-” এটা কি আপনি কিনেছেন?”
-” হ্যা।”
-” ঠিকাছে যান, ভিতরে যান।”
যাবার আগে ছেলেটা একবার সুহায়লাদের ছাদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলো। ছেলেটা সুহায়লাদের পরিচিত। এই এলাকারই ছেলে। আসিফের চামচা। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আসিফের কাছে লাগাবে সে। সুহায়লার বিয়ের আগেও সে এই কাজটা করতো। সুহায়লার বাসার দিকে কেউ তাকাচ্ছে কিনা সেসব খোঁজ রাখতো। দিনশেষে সবকথা আসিফের কানে লাগাতো। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না নিশ্চয়ই। সুহায়লা আর সাবা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। তানভীর এখনো লাইনে আছে। সুহায়লার সাথে কথা বলছে। এ ব্যাপারে এখন কিছু বললেই সে শুনে ফেলবে। সুহায়লা চায় না তানভীর জানুক এটা আসিফের চামচা। এমনিতেই সেদিন আসিফের কথা শুনে যেভাবে রিয়েক্ট করেছে, এখন যদি জানে ওর চামচারা এখনও খবরদারি করে তাহলে তো তুলকালাম বাধিয়ে ফেলবে। ছাদে এসে দাঁড়ালো তানভীর।
-” সাবা কি তোমার লেজ?”
-” লেজ মানে?”
-” তুমি ছাদে আসলেই ও কেনো তোমার পিছন পিছন আসে?”
-” আসছে দেখতে আমরা কিভাবে প্রেম করি।”
সাবা হা হয়ে তানভীরকে দেখছে।
-” সুহা তোমার বোন আমাকে এভাবে দেখছে কেনো?”
-” এই তুই তানভীরকে এভাবে দেখছিস কেনো?”
-” দুলাভাই কত্ত রোমান্টিক। দেখ তোর দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে।”
-” দেখেছো সুহা, তোমার বোন আমার তাকানো দেখে প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। আর তুমি বুঝোনা? বুঝো না কেনো তুমি?”
-” সত্যিই তোমাকে বুঝতে পারছি না তানভীর।”
-” কাছে আসো বুঝিয়ে দেই।”
-” কতটুক কাছে আসবো?”
-” যতটা আসলে আমার হার্টবিট শুনতে পাবে।”
-” আসবো?”
-” উড়ে চলে আসো।”
-” ওয়েট।”
-” সিরিয়াসলি আসছো?”
-” হুম। তোমাকে বুঝতে চাই। পুরোপুরি ভাবে।”
-” জলদি আসো।”
সুহায়লা হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছিলো। তানভীর ওপাশের ছাদ থেকে জোরে চেঁচিয়ে বললো -” আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। তুমি দৌঁড় দাও।”
সুহায়লা মুচকি হেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। তানভীর দৌঁড়ে নিচে নেমে এসেছে। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। সুহা দরজার সামনে দাঁড়াতেই ওকে কোলে তুলে নিলো তানভীর।
-” বাসার সার্ভেন্টরা দেখে ফেলবে।”
-” দেখুক।”
-” এত নির্লজ্জ কেনো তুমি?”
-” নিজের রেজিস্ট্রি করা বউকে কোলে নিয়েছি। এখানে কারো কিছু বলার রাইট নেই।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here