বন্ধ দরজা ৪
……
ফরহাদ সাহেবের পাশে ড্রাইভার রফিক এসে দাঁড়ালো। ফরহাদ সাহেব চোখের ইশারা দিয়ে ড্রাইভার রফিককে পাশে বসতে বললেন।
-” এত দেরী করেছো কেনো?”
-” ছোটবাবা আপনাদের মিথ্যা বলেছে স্যার। ও বাসার কাছাকাছি এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আপনাদের বলেছে যে মাত্র এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছে। আপনারা সবাই বের হওয়ার পরপরই গাড়ি নিয়ে বাসায় যেতে বললো। এরপর কোনোমতো গায়ের শার্টটা খুলে বিছানায় শুয়ে ছিলো এতক্ষন। আসতে চাচ্ছিলো না। অনেকটা জোর করে নিয়ে এসেছি।”
-” এই ছেলের যন্ত্রনায় আমি অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি রফিক।”
-” স্যার, এই মেয়েটাকে ছোটবাবার জীবনে এনে কোনো ভুল করছেন না তো? ছোটবাবা যদি ওকে মেনে না নেয়?”
-” মানতে বাধ্য হবে সে। সুহায়লাকে আমি বুঝে শুনেই পছন্দ করেছি। ওর জায়গা ও ঠিক দখল করে নিবে।”
-” ছোটবাবার জ্বর এসেছে সন্ধ্যায়। বিয়েটা দ্রুত শেষ করেন স্যার। জানেনই তো জ্বর আসলে ছেলেটা সবকিছুতেই কেমন খিটখিট করে। এত লোকের মাঝে কখন আবার কার সাথে…….”
-” হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই সুহায়লার বাবাকে বলছি কথাটা।”
বিয়ে শেষ হয়েছে আধাঘন্টা আগে। দুজনকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। সুহায়লা এখন পর্যন্ত তানভীরের দিকে তিনবার আড়চোখে তাকিয়েছে। কিন্তু তানভীর এখনো একবারের জন্যও সুহায়লাকে দেখেনি। সুহায়লার বান্ধবীরা আর সাবা অনেক্ষন ধরে তানভীরকে খোঁচাচ্ছে কিন্তু তানভীর কোনো উত্তরই দিচ্ছে না। সুহায়লার বাবাকে ফরহাদ সাহেব বললেন,
-” সাজ্জাদ, মেয়েকে এবার বিদায় দাও।”
-” মাত্রই তো বিয়ে শেষ হলো। জামাইকে তো এখনো খাওয়ানোই হয়নি। আর আপনি বলছেন এখনি বিদায় দিতে?”
-” আমার ছেলেটা অসুস্থ। তাই বলছি আরকি।”
সাদমান পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। এ কথাটাও তার পছন্দ হচ্ছে না। সেই প্রথম দিন থেকে লক্ষ্য করে আসছে সে। দেখতে এলো যেদিন সেদিনও ছেলে চলে গেলো। আজ তার বিয়ে অথচগতকাল রাতে সে চলে গেলো চিটাগাং। আজ এখানে আসতেও এত লেট করেছে। এখন আবার বলছে না খেয়ে চলে যাবে। ছেলে অসুস্থ তাই। সাদমানের মোটামোটি মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এত সমস্যা কেনো এই ছেলের? অসুস্থতার ব্যাপারটা সাদমানের কাছে কেমন যেনো লাগছে। তাই সে সোজা স্টেজে চলে গেলো দেখার জন্য আসলে ঘটনা কতটুক সত্য। স্টেজে উঠেই সে তানভীরের কপালে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই তানভীরের গায়ে জ্বর। এভাবে কোনো কিছু ন বলেই হুট করে তানভীরের কপালে হাত দেয়াটা একদমই পছন্দ হয়নি তার। তবু সে তার অপছন্দটুকু চেহারায় প্রকাশ হতে দেয়নি। তার মাথায় এই জ্ঞানটুকু অন্তত আছে যে এই বিয়ে বাড়িতে কোনো ঝামেলা করাটা মোটেই শোভনীয় হবে না।
-” ভাইয়া আপনার জ্বর কখন এসেছে?”
-” দুপুর থেকেই খারাপ লাগছিলো। সন্ধ্যার দিকে জ্বর এসেছে।”
-” আমি আপনার জন্য মেডিসিন নিয়ে আসছি।”
-” ওয়েট সাদমান…… তোমার নাম সাদমান তো?”
-” হ্যাঁ।”
-” সেদিন পরিচয় করিয়েছিলো তোমার বাবা। অনেকদিন হয়েছে তো তাই নামটা আবছা খেয়াল আছে। তোমাকে ঔষধ আনতে হবে না। আমি বাসায় যেয়ে মেডিসিন খেয়ে নিবো।”
-” আপনার বডি টেম্পারেচার তো খুব বেশি বেড়ে গেছে। বাসায় যাওয়া পর্যন্ত ওয়েট করাটা ঠিক হবে না।”
-” সেটা কোনো ব্যাপার না। বাসায় যেয়ে প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সাদমান তানভীরের চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে এখানে অসুস্থ শরীরে বসে থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে। সাদমান তার বাবাকে যেয়ে বললো,
-” আব্বা, তানভীর ভাইয়ের স ত্যিই জ্বর এসেছে। উনার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এত মানুষের ভীড়ে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ভালো হবে সুহাকে এখন বিদায় দেই। ভাইয়া বাসায় যেয়ে রেস্ট করুক।”
-‘ ঠিকাছে তোর আম্মাকে ডেকে আন। গিয়ে বল যে সুহা কে এখনই বিদায় দিবো।”
সাদমান তার মা খালা ফুপু সবাইকে নিয়ে আসলো সুহায়লাকে বিদায় দেয়ার জন্য। সাবা সুহায়লাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছে। সুহার মা বাবা সাদমান সবাই কাঁদছে। তানভীরের ওদের কান্না দেখে হাসি পাচ্ছে। মানুষ পারেও বটে। এত কষ্ট লাগলে বিয়ে দেয়ার দরকার কি?
সুহায়লার বাবা তানভীরের হাতের উপর সুহায়লার হাত রেখে বললো,
-” বাবা, আমার সম্পদ তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওকে কোনো কষ্ট দিও না বাবা। বহু যত্নে আমি আমার মেয়েকে বড় করেছি।”
তানভীরের মুখের দিকে সাজ্জাদ সাহেব তাকিয়ে আছেন উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় সে কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে। ছেলে উত্তর দিচ্ছেনা তাই ফরহাদ সাহেব নিজেই বললেন,
-” তুমি নিশ্চিন্তে থাকো সাজ্জাদ । তোমার মেয়েআমার বাড়িতে ভালো থাকবে।”
কিছুক্ষন আগে ফাহিমের বউ সুহায়লাকে তানভীরের রুমে দিয়ে গেছে। রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো। অনেক বড়ও বটে।সুহায়লার কাছেরুমটাকে ফুটবল খেলার মাঠ মনে হচ্ছে। পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছে সুহায়লা ঘরের প্রতিটা ফার্নিচার, দেয়ালের রঙ সবকিছুতেই রুচির ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। এগুলো কি সব তানভীরের পছন্দে করা? নাকি কোনো ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে করানো হয়েছে? রুমের দক্ষিন পাশটাতে থাই গ্লাসের দরজা দেখা যাচ্ছে। গ্লাসটা আটকানো। ওপাশে কি? বোধহয় বারান্দা আছে। সুহায়লা গ্লাস খুলে দাঁড়াতেই দমকা হাওয়া ওর গায়ে এসে লাগলো। অবাক চোখে দেখছে সে। এত সুন্দর বারান্দা? উহুম বারান্দা বললে ভুল হবে এটাতো একটা ছাদ। মাঝারি রকমের একটা ছাদ। ছাদের চারপাশটা জুড়ে কত ধরনের ফুলের গাছ। বেতের সোফা আর টি-টেবিল মাঝখানে সাজানো। বেডরুমের চেয়ে এই জায়গাটাতো আরো অনেক বেশি সুন্দর। উপরে খোলা আকাশে তারা মিটমিট করছে। সোফায় বসে তারাগুলো দেখছে সুহায়লা। সেই সাথে মাতাল করা বাতাস গায়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ভালোই হলো। উনার সাথে এখানে বসে মনখুলে গল্প করা যাবে। কষ্ট করে প্রেম করার জন্য পার্কে যেতে হবে না। এই জায়গাটা পার্কের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর। আচ্ছা উনি কোথায়? কতক্ষন হয়ে গেছে উনি তো এখনও এলো না। উনার জ্বরের কি অবস্থা সেটাও তো জানা নেই। আচ্ছা উনি ঔষধ খেয়েছে তো? সে কি একবার বাহিরে যেয়ে দেখে আসবে লোকটা কোথায়? না না, সে তো নতুন বউ। এভাবে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘরের বাইরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলার আওয়াজ পেলো সুহা। তানভীর এসেছে। সুহায়লার কাছে কেমন যেনো লাগছে? তানভীরের সাথে তো আগে কখনো কথা হয়নি। আজ প্রথম তার সাথে সুহার কথা হবে। তাও আবার এই মধ্যরাতে বদ্ধঘরে আবদ্ধ হয়ে। লজ্জা, উৎকন্ঠা দুটোই জেঁকে ধরছে সুহাকে। মা বলেছিলো তানভীরকে দেখা মাত্রই সালাম দিতে। সে এগিয়ে এসে তানভীরকে সালাম দিলো। খুব আস্তে সালামের উত্তর নিলো তানভীর। উত্তরটা সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সুহায়লার দিকে তাকিয়ে না। শেরওয়ানীর বোতাম খুলতে খুলতে সুহায়লাকে তানভীর জিজ্ঞেস করলো,
-” বিয়েতে যে জিনিসগুলো এ বাড়ি থেকে তোমাকে দেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে এসেছো নাকি বাবার বাড়ি রেখে এসেছো?”
-” জ্বি না সব নিয়ে এসেছি। তিনটা লাগেজ পাঠিয়েছিলেন আপনারা। যেভাবে পাঠিয়েছেন সেভাবেই নিয়ে এসেছি। খুলে দেখিওনি লাগেজে কি আছে।”
-” লাগেজ থেকে নাইটি বের কর।”
-” জ্বি?”
-” নাইটি চিনো না কি? জীবনে নাম শুনোনি?”
-” জ্বি চিনি। কোন লাগেজে আছে সেটাতো জানি না।”
-” তোমার নাইটি কি এখন আমি খুঁজে দিবো নাকি? জানো না, খুঁজে বের করো । বাথরুমে যাও। এসব শাড়ি জুয়েলারি সব খুলো। ভালোভাবে শাওয়ার নিয়ে নাইটি টা পড়ে আসো। আমি বাহিরের এক ক্লাইন্টের সাথে ভিডিও চ্যাটে এখন মিটিং করবো। আমার মিটিং শেষ হওয়ার আগে তোমাকে আমি রেডি দেখতে চাই।”
সুহায়লার কাছে প্রস্তাবটা কেমন যেনো লাগছে।লোকটা তো কিছুক্ষন বসে ওর সাথে কথা বললেও পারতো। এরপর নাহয় শরীরের অধিকার চাইতে পারতো। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। আচ্ছা বাসর রাতের সংজ্ঞাটাই কি এমন? স্বামী আসবে, কথা নেই বার্তা নেই হুট করে এসেই নিজের অধিকার দাবি করবে। পাশের মানুষটার মতামত ইচ্ছা জানার কোনো প্রয়োজন নেই। কি জানি? সুহায়লার এ ব্যাপারে বিস্তারিত ধারনা নেই। বান্ধবী বা কাজিনদের বাসর রাতের গল্প শুনেছে সে। কিন্তু প্রতিটা গল্পেরশুরুটা ছিলো স্বামী ঘরে এসে বউয়ের হাত ধরে গল্প করে কিছুটা সময় কাটায়। কিন্তু ওর গল্পে এমন কিছুই নেই। হতে পারে তানভীর অন্য দশটা মানুষের মতো না।সে অন্যদের চেয়ে ভিন্ন তাই তার বাসর শুরুর ধরনটাও ভিন্ন। প্রথম লাগেজ খুঁজে নাইটির সন্ধান পায়নি সুহায়লা। দ্বিতীয় লাগেজে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে পাওয়া গেলো। বাথরুমে ঢুকার আগে তানভীরের দিকে একবার তাকালো সুহায়লা। সে ল্যাপটপের সামনে বসে কিছু একটা করছে।
(চলবে)
.
.
.
.
১ম পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/387990565374737?__tn__=K-R
৩য় পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/387992662041194?__tn__=K-R
৫ম পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/new.love.story.com.bd/posts/379883212852139?__tn__=K-R