বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৪৮

#বর্ষণের সেই রাতে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব: ৪৮
.
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে।হঠাৎ করেই লোকটা কতোটা বদলে গেলো। রিক কে কষ্ট পেতে দেখে ওরও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই। রিক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আমি একটু আসছি। আদিব আর অভ্র নিচে বসে আছে।”

বলে রিক চলে গেলো স্নিগ্ধা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ওও চলে গেলো কিচেনে কী রান্না হচ্ছে দেখতে।

অনিমা আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে এখনো কেঁদে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান এবার অনিমাকে ছাড়িয়ে ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল,

— ” অনি আমি কিন্তু কান্না থামাতে বলছি। প্লিজ থামো এবার।”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বলশ,

— ” আমাকে নিয়ে চলুন এখান থেকে। প্লিজ।”

আদ্রিয়ান অনিমার দুই গালে হাত রেখে বলল,

— ” যাবেতো। এক্ষুনি নিয়ে যাবো তোমাকে। একটু সুস্হ হও।”

অনিমা অস্হির হয়ে বলল,

— ” আমি পুরো সুস্হ আছি প্লিজ আমাকে এক্ষুনি নিয়ে চলুন।”

আদ্রিয়ান কিছু একটা ভেবে বলল,

— ” আচ্ছা চলো।”

বলে অনিমাকে কোলে তুলে নিতে গেলেই রিক এসে বলল,

— ” কোথাও যাবে না তোমরা এখন।”

রিক কে দেখেই অনিমা বেশ ঘাবড়ে গেলো। আদ্রিয়ানের শার্ট খামচে ধরে ওর সাথে লেগে রইলো। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত রেখে ওকে আশ্বস্ত করে, দাড়িয়ে রিকের সামনে গিয়ে বলল,

— ” কে আটকাবে আমাদের? তুমি?”

রিক আদ্রিয়ানের চোখে চোখ রেখে বলল,

— ” যদি বলি হ্যাঁ?”

আদ্রিয়ান চোখ সরিয়ে হালকা হেসে আবার রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোমার এখনো মনে হয় যে তোমার সেই ক্ষমতা আছে? ”

রিক গম্ভীর কন্ঠেই বলল,

— ” হুম আছে। শত্রু হিসেবে না হোক বন্ধু হিসেবে তো আটাকাতেই পারি তাইনা?”

বলে মুচকি হাসি দিলো রিক। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে তাকালো আর ভাবতে শুরু করলো যে রিক অভিনয় করার মানুষ নয়। ও যা করে যেটুকু করে সেটুকু প্রকাশ্যেই করে। তবে হঠাৎ বদলের কারণ কী? অনিমাও রিকের শেষ কথাটুকু শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রিক হেসে বলল,

— ” কী ভবছো? হঠাৎ এভাবে বদলে গেলাম কীকরে তাইতো? হ্যাঁ দেরীতে হলেও বুঝেছি যে ও আমার ভাগ্যে নেই। ও তোমার সাথেই ভালো থাকবে আর ওর ভালোথাকাটাই সবচেয়ে বেশি ইমপর্টেন্ট। জানি আমাকে বিশ্বাস করা কষ্টকর কিন্তু একবার করেই দেখো, ঠকবেনা।”

আদ্রিয়ান মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে রিকের কাধে হাত রেখে বলল,

— ” ভুল সব মানুষই করে তবে সেটা সঠিক সময়ে বুজতে পারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তুমি যদি সত্যিই নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে থাকো তাহলে তার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারেনা।”

রিক এবার অনিমার কাছে গেলো। রিক অনিমার সামনে বসতেই ও হালকা পিছিয়ে গেলো। সেটা দেখে রিক মলিন হেসে বলল,

— ” ক্ষমাটুকুও চাইতে দেবেনা?”

অনিমা কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিলো। রিকের অনিমাকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়াটা বুকে গিয়ে লাগল, কিন্তু এই ভেবে নিজেকে শান্তনা দিলো যে এটা ওর পাওয়নাই ছিলো। রিক এবার সোজা বেড থেকে নেমে অনিমার সামনের ফ্লোরে বসে হাত জোড় করে বলল,

— ” আমি জানি আমি সবচেয়ে বেশি অন্যায় তোমার সাথেই করেছি। যেইমুহূর্তে আমি তোমার লাইফে এসছিলাম আমি চাইলেই পারতাম তোমার জীবণটাকে সুন্দর করতে। কিন্তু আমি জানার চেষ্টাই করি নি যে তোমার লাইফে কোনো প্রবলেম আছে কী না। যখন তোমার মামা মামী কটা টাকা পেয়েই তোমাকে আমায় দিয়ে দিতে রাজী হয়ে গেছিলো আমার সেই মূহুর্তে বোঝা উচিত ছিলো যে তোমার সাথে ওখানে কী কী হয়। কিন্তু আমি সেটা বোঝার চেষ্টাও করিনি। জানি আমি যেটা করেছি তার ক্ষমা হয়না। কিন্তু যতক্ষণ তুমি আমাকে ক্ষমা না করবে শান্তি পাবোনা আমি। আমাকে ক্ষমা করা এতো সহজ নয় আই এগরি কিন্তু প্লিজ কষ্ট করে হলেও আমাকে ক্ষমা করে দাও। আইম রিয়েলি ভেরি সরি ফর এভরিথিং। প্লিজ। ”

রিকের চোখ হালকা ছলছল করছে। অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে একবার রিকের জোড় করা হাতের দিকে দেখছে একবার রিকের দিকে, ওর কী করা উচিত ও সেটাই বুঝতে পারছে না। কেউ ওর সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা না করাটা কী সত্যিই ঠিক? এরমধ্যে স্নিগ্ধাও চলে এলো আর এই দৃশ্য দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেলো। অনিমার চোখ দিয়ে পানি পরছে, ও কী করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। অনিমাকে চুপ থাকতে দেখে রিক এবার অনিমার পা ধরলো। অনিমা চমকে গিয়ে সাথেসাথেই পা সরিয়ে নিয়ে বলল,

— ” প্লিজ, আপনি আমার বড়। এসব করবেন না।”

রিক মুচকি হেসে বলল,

— ” ক্ষমা চাওয়ার অধিকার প্রত্যেক অপরাধীর আছে। সেখানে বড় ছোট মেটার করেনা। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান চোখের ইশারায় বলল ক্ষমা করে দিতে। অনিমা রিকের দিকে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,

— ” আপনি যদি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে থাকেন তাহলে ক্ষমা চাইতে হবেনা। আপনি বুঝতে পেরেছেন সেটাই অনেক।”

রিক এবার বাচ্চাদের মতো মুখ করে বলল,

— ” আজব! চাইলাম চকলেট তুমি লজেন্স দিয়ে ভাগিয়ে দিচ্ছো? এটা কিন্তু ঠিক না। আমি ওসব বোকা বাচ্চাদের দলে কিন্তু একদমি পরিনা যে চকলেটের বদলে লজেন্সে কাজ চালিয়ে নেবে ওকে?”

রিকের কথা শুনে অনিমা ফিক করে হেসে দিলো। আদ্রিয়ান আর স্নিগ্ধাও হাসলো তবে নিঃশব্দে। রিক মুখ ফুলিয়ে বলল,

— ” হাসতে বলেনি সরি এক্সেপ্ট করতে বলেছি।”

অনিমা হাসতে হাসতেই বলল,

— ” আচ্ছা করেছি ক্ষমা। আমি আবার কিপ্টে নই যে চকলেটের বদলে লজেন্স দিয়ে দেবো।”

রিক তো অনিমার হাসিটাই দেখছে আর ওর ভেতরের অপরাধবোধ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এমন একটা দিন ছিলো যখন এই মিষ্টি হাসিটাকেই ওর মুখ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো ও। তবে এটুকু ভেবে ভালোও লাগছে যে প্রথমবার হলেও অনিমার হাসির কারণ হতে পেরেছে ও। রিক নিজেকে সামলে নিয়ে অনিমাকে বলল,

— ” গার্লফ্রেন্ড তো হলেনা। সে ব্যাপারনা। বাট ফ্রেন্ড তো হতেই পারো তাইনা?”

অনিমা প্রায় অবাক হয়েই তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। রিকের একেকটা আচরণে আজ আবাকের ওপর অবাক হচ্ছে অনিমা। তবে স্নিগ্ধা একটুও অবাক হচ্ছেনা কারণ রিকের এই রুপ ও আগেও দেখেছে। মাঝখানের কয়েক বছরের জন্যেই ও হারিয়ে ফেলেছিলো ও ওর রিক দা কে । কিন্তু আজ আবার সেই রূপ দেখতে পাচ্ছে। আর আদ্রিয়ান ও অবাক হয়নি কারণ ও জানতো যে এটা একদিন হওয়ার ছিলোই। রিক অনিমার সামনে চুটকি বাজিয়ে বলল,

— “হ্যালো? বন্ধু হবেনা আমার?”

অনিমা মুচকি হেসে বলল,

— ” হুম।”

রিক হালকা হাসল। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে বলল,

— ” এবার আমাদের বেড়োতে হবে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”

রিক কিছু বলবে তার আগেই স্নিগ্ধা বলল,

— ” বেড়তে হবে মানে কী ভাইয়া? আজ আপনাদের কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। ডিনারের ব্যাবস্হাও করা হচ্ছে। আদিব আর অভ্র ভাইয়াকেও বলা হয়ে গেছে, আপনি থাকলে ওনারাও থাকবেন।”

আদ্রিয়ান বলল,

— ” কিন্তু..”

রিক আদ্রিয়ানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

— ” কোনো কিন্তু না। দেখো এখানে থাকার কারণটা আর নেই। সো কালকেই ফিরে যাবো আমরা বাংলাদেশে । আর মনে হয় তোমরাও কালকেই ব্যাক করতে চাও। তো আজ রাতটা এখানে থেকে কাল একসাথেই বেড়হই না? সমস্যা কী?”

আদ্রিয়ান কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বলল,

— ” আচ্ছা ঠিকাছে।”

স্নিগ্ধা খুশি হয়ে বলল,

— ” চলো তো আপাদত স্নাকস এর ব্যাবস্হা হয়ে গেছে। নিচে আদিব ভাইয়ারা ওয়েট করছে।”

আদ্রিয়ান স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোমরা দুজন যাও আমি অনিকে নিয়ে আসছি।”

রিক আর স্নিগ্ধা নিচে চলে গেলো। আদ্রিয়ান অনিমার কাছে বসে বলল,

— ” এটাই ভাবছো তো হঠাৎ রিক এতো বদলে গেলো কীকরে?”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে তাকালো। আদ্রিয়ান অনিমাকে একহাতে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” দেখো। ও একটু বখে গেছিলো ঠিকি। কিন্তু মনের দিক দিয়ে খুব একটা খারাপ নয়। আর এইসব মানুষদের নিজের ভুল সম্পর্কে বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেটা। শুধু হঠাৎ কোনো এক ঘটনাই যথেষ্ট। বুঝেছো?”

অনিমা মাথা নাড়লো। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় একটা চুমু দিয়ে মনে মনে ভাবলো, তুমি ভাবলে কীকরে যে তোমাকে এতো কষ্ট দিয়েছে তাকে আমি ক্ষমা করে দেবো? ও শাস্তি পাচ্ছে আর ভবিষ্যতেও পাবে। তবে শারিরীক নয় মানসিক। পরপর কয়েকবার বড় কয়েকটা মানসিক ধাক্কার সম্মুখীন হবে ও। তাই ওকে আর বিশেষ কোনো শাস্তি দিলাম না। এসব ভেবে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” এই কয়েকটা দিন অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা? আমারি আরেকটু চোখ কান খোলা রাখা উচিত ছিলো। আ’ম সরি।”

— ” বাদ নিন এসব। এখন তো সব ঠিকই হয়ে গেছে।”

আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল,

— ” এখনো সব ঠিক হয়নি। মিস্টার সিনিয়রের সাথে এতো বড় অন্যায় যারা করেছে তাদের শাস্তি দেওয়া এখোনো বাকি আছে।”

অনিমা ভ্রু কুচকে বলল,

— ” মিস্টার সিনিয়র?”

আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

— ” কিছুনা। এখন নিচে চলো ওরা ওয়েট করছে।”

অনিমা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওকে নিয়ে নিচে চলে গেলো আদ্রিয়ান।

_____________________

অরুমিতা, তীব্র আর স্নেহা অফিস করে বাইরে ফুচকা খাচ্ছে। আপাদত ওরা ফ্রেশ মাইন্ডে আছে। কারণ আদ্রিয়ান ওদের ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে সব ঠিক আছে। তাই ওরা এখন ফ্রেশ মাইন্ডে এনজয় করছে। হঠাৎ করেই ওরা আশিস কে দেখতে পেলো। আশিস আর অরুমিতার মধ্যকার সমস্যাটা তীব্র আর স্নেহা জানেনা। স্নেহা আশিসকে দেখে বলল,

— ” আরে আশিস ভাইয়া?”

কারো ডাক শুনে ঘুরে তাকালো আশিস। আশিসকে দেখে অরুমিতার মুখের হাসিটুকু গায়েব হয়ে গেলো। আশিস ওদের দেখে এগিয়ে এলো। আশিস এসে অরুমিতা দিকে তাকাতেই অরুমিতা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আশিস অরুমিতার দিকে একবার তাকিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ভালো আছো?”

তীব্র হেসে বলল,

— ” জ্বি ভাইয়া? আপনি?”

আশিস ও মুখে হাসি রেখেই বলল,

— ” হ্যাঁ ভালো আছি।”

আশিস ভেবেছিলো ওকে দেখে হয়তো অরুমিতা ওখান থেকে চলে যাবে বা মন খারাপ করবে। কিন্তু আশিসকে অবাক করে দিয়ে অরুমিতা ওদের সাথে নিজের মতো করে মজা করছে আর ফুচকা খাচ্ছে। জেনো আশিসের থাকা না থাকা ওর কাছে ম্যাটারই করে না। যেটা ওর কাছে খুবই খারাপ লাগছে। স্নিগ্ধা এক্সাইটেট হয়ে বলল,

— ” ভাইয়া ফুচকা খাবেন তো?”

আশিস নিজেকে সামলে নিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” নাহ সময় নেই আসছি এখন।”

এটুকু বলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। তীব্র আর সিগ্ধা দুজনেই অবাক হলো। কিন্তু অরুমিতার কোনো ভাবান্তরই হলোনা ও ওর মতো ফুচকা খেয়ে যাচ্ছে।

_____________________

রিক ছাদের কিনারে চুপচাপ বসে আছে। সবকিছু মেনে নিলেও আদ্রিয়ান আর অনিমাকে একসাথে দেখলে বুকের ভেতরে এক অসহ্যকর যন্ত্রণা হয় ওর। কিন্তু ওর কিচ্ছু করার নেই। অনিমা ওর ভাগ্যে নেই সেটা ও মেনে নিয়েছে, কিন্তু কষ্টটাকে কিছুতেই কমাতে পারছেনা। আজকের মতো এরকম কষ্ট এর আগে ওর আর কোনোদিন হয়নি, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটাও করতে পারছেনা। বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্টটার যন্ত্রণা আরো বেশি হয়, সেটা বেশ বুঝতে পারছে। এরমধ্যেই ওর ফোন বেজে উঠলো, এইমুহূর্তে ফোন রিসিভ করার কোনো ইচ্ছেই নেই ওর কিন্তু মামার ফোন তাই রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল,

— ” বাবাই ওদিকে সব ঠিক আছেতো?”

রিক একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

— ” এতোদিন ছিলোনা এখন সব ঠিক আছে।”

কবির শেখ অবাক কন্ঠে বললেন,

— ” মানে?”

রিক মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ” অনিমাকে নিজের কাছে আটকে রাখার পাগলামো আমি আর করবোনা মামা। এতোদিন বুজতে না পারলেও আজকে বুঝতে পারছি যে ভালোবাসা জোর করে হয় না। ও যদি আদ্রিয়ানের সাথে ভালো থাকে তো থাকুক।”

কবির শেখ তো চরম অবাক হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

— ” বাবাই কী সব বলছো তুমি? পাগল হয়ে গেছো নাকি? ”

রিক একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

— ” পাগলতো এতোদিন ছিলাম মামা। আজ সুস্হ মস্তিষ্কে বলছি।”

কবির শেখ উত্তেজিত কন্ঠে বললেন,

— ” কিন্তু তুমি না ওকে ভালোবাসো? হার মেনে নেবে? ছেড়ে দেবে ওকে?”

রিক মুচকি হেসে বলল,

— ” ভালোবাসায় হারতে দোষ কোথায় মামা? তাছাড়া আমি যদি সত্যি অনিকে ভালোবেসে থাকি তাহলে অনি ভালো থাকবে। এর চেয়ে বেশি ভালো আমার কাছে আর কী হতে পারে বলো?”

কবির শেখ অস্হির গলায় বলল,

— ” কিন্তু বাবাই…”

রিক কবির শেখ কে থামিয়ে দিয়ে বলল,

— ” কোনো কিন্তু না মামা। আমি জানি তুমি আমার কথা ভেবেই এসব বলছো কিন্তু আমিতো বলেই দিয়েছি যে আমার কোনো সমস্যা নেই। তাই প্লিজ এই বিষয়ে আর কিচ্ছু বলোনা।”

বলেই ফোন রেখে দিলো রিক। তারপর একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।স্নিগ্ধা ছাদে রিককে ডাকতে এসে দেখে রিক এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা গিয়ে রিকের পাশে বসে বলল,

— ” আমি জানি রিক দা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

রিক নিজেকে সামলে মুচকি হেসে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী সব ফালতু বকছিস? কষ্ট হবে কেনো?”

স্নিগ্ধা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আমি তোমাকে চিনি রিক দা। এখন তুমি আমার সাথে কথা না বললেও একসময় কিন্তু আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম।”

রিক কিছু না বলে চুপ করে রইলো। স্নিগ্ধা মুচকি হেসে বলল,

— ” রিক দা যদি আদ্রিয়ান অনিমা একে ওপরকে ভালো না বাসতো তাহলে আমি একটা চেষ্টা নিশ্চই করতাম। কিন্তু..”

রিক মলিন হেসে বলল,

— ” অনিমা আমাকে ভালোবাসেনা এতে ওর কোনো দোষ নেই। আদ্রিয়ান আসার অনেক আগেই ওর লাইফে এসেছিলাম আমি। কিন্তু ও আমাকে নয় আদ্রিয়ানকে ভালোবাসে। কারণতো আছেই তাইনা? আমিতো ওকে কোনো ভালোবাসার কারণই দিতে পারিনি। তবে আমাকে ভালো না বাসার যথেষ্ট কারণ দিয়েছি।”

স্নিগ্ধা কী বলবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিক কে কিছু বলবে তার আগেই রিক উঠে বলল,

— ” চল। ওরা নিচে ওয়েট করছে নিশ্চয়ই।”

একুটু বলে রিক চলে গেলো আর পেছন পেছন স্নিগ্ধাও চলে গেলো।

সবাই মিলে ডিনার করছে। আর টুকটাক কথা বলছে। রিকের আচরণে কেউ বলবেই না যে এই ছেলেটার সকালেও ওদের শত্রু ছিলো। তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে অনিমা কারণ এইমুহূর্তে এক নতুন রিক কে আবিষ্কার করছে ও। যে সম্পূর্ণটাই বিপরীত। খাওয়া দাওয়া শেষে রিক বলল,

— ” আদিব আর অভ্র তোমার আমার ডান সাইডের রুমটাতে থাকো, স্নিগ্ধা আর অনিমা একসাথে, আমি আর আদ্রিয়ান একসাথে। প্রবলেম আছে? ”

আদিব আর অভ্র সম্মতি জানালো, আদ্রিয়ান কিছু বলছেনা তাই রিক মুচকি হেসে বলল,

— ” আরে ভাই বিয়ের আগেই বউকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই যদি মুখটা এমন কালো হয়ে যায় তাহলে বিয়ের পর কী করবে? একটু তো ধৈর্য ধরো, এতো বউ পাগল হলে হবে?”

ওরা সবাই হেসে দিলো রিকের কথা শুনে আর অনিমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আছে। আর স্নিগ্ধা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। আজ রিকের এক নতুন রুপ দেখলো ও, কীকরে ভেতরের কষ্টটাকে চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে দিয়েছে। এটা করা সবার জন্যে সহজ নয়।

_____________________

আদ্রিয়ান আর রিক রিকের রুমে বসে আছে। নিজেদের মধ্যেই টুকিটাকি কিছু কথা বলছে ওরা। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার রিক আদ্রিয়ানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। হঠাৎ আদ্রিয়ান বলল,

— ” আচ্ছা তোমার মনে হয়না যে তোমার বাবা বা মামা যেসকল অন্যায়গুলো করেছে তার শাস্তি পাওয়া উচিত?”

আদ্রিয়ানের প্রশ্নে রিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” হুমম মনে হয়। কিন্তু কী বলোতো ঐ মানুষ দুটোকে ছোটবেলা থেকেই খুব ভালোবাসি আমি। ছোটবেলায় বুঝতাম না তো, ওনারা যা বোঝাতো সেটাই বুজতাম, যা করাতো সেটাই করতাম। বড় তো হলাম কিন্তু সেই অভ্যেসগুলো ছাড়তে পারলাম। একপর্যায়ে গিয়ে বুজতে পারতাম যে এগুলো ভুল কিন্তু ঐ যে ছোটবেলা থেকে পাওয়া শিক্ষাটাই অভ্যেস হয়ে গেলো। সব বুঝেও না বুঝে থাকতে বাধ্য হতাম । শখ করে ডক্টরি পরেছিলাম কিন্তু ড্যাড এর রাজনৈতিক কাজকর্মে জোড় করে ইনভল্প করলো, বিরক্ত লাগতো আমার এসব তবুও থাকতে হতো, ড্যাডের প্রেশারে। তাই জেদ করে হসপিটালে জয়েনই করলাম না। ”

আদ্রিয়ান চুপচাপ শুনলো রিকের কথা। তারপর রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোমার বাবা এবং মামা দুজনেই খুনী। একজন মা হারা মেয়ের কাছ থেকে তার একমাত্র সম্বল তার বাবা কে কেড়ে নিয়েছে। এছাড়া আর কার কার খুন করেছে তাড়াই জানে। আর অন্যসব পাপের কথা তো ছেড়েই দাও। তবুও তুমি চাওনা ওনাদের শাস্তি হোক?”

রিক চোখ বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” হ্যাঁ চাই। কিন্তু ওরা যতই খারাপ হোক আমার বাবা আমার মামা। ওরা খারাপ হলেও আমাকে খুব বেশি ভালোবাসে। ওদের সেই ভালোবাসার অসম্মান করতে পারবোনা আমি। তোমারা যদি পারো তো দাও ওনাদের শাস্তি। আমি তোমাদের বাধা দেবোনা। কিন্তু আমার কাছ থেকে কোনো সাহায্য চেয়ো না, প্লিজ। ”

আদ্রিয়ান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

— ” তোমার কী মনে হয় ওরা তোমাকে ভালোবাসে?”

রিক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

— ” অফকোর্স বাসে। আমার বাবা আমার মামা আমাকে ভালোবাসবেনা?”

আদ্রিয়ান ওর ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বার করে বলল,

— ” চলো তোমাকে কিছু দেখাই। তাতে হয়তো তোমার এই ধারণাটা ভেঙ্গে যাবে।”

________________________

মিস্টার রঞ্জিত ওনার রুমে বসে চা খাচ্ছেন আর ফাইল দেখছেন। এরমধ্যেই কবির শেখ হনহনে পায়ে ওনার কাছে বসে বলল,

— ” জিজু! আপনার ছেলে সব বরবাদ করে দেবে একদিন।”

মিস্টার রঞ্জিত কাপটা রেখে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” আবার কী করেছে?”

কবির শেখ বিরক্তিকর কন্ঠে বললেন,

— ” মহান আশিক হয়ে গেছে ও। হাসান কোতয়ালের মেয়েকে ছেড়ে দিচ্ছে। ঐ মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার মানে বোঝেন আপনি? কী হবে আপনার?”

মিস্টার রঞ্জিত অবাক হয়ে বললেন,

— ” তুমি বোঝাও নি ওকে?”

কবির শেখ অস্হিরতা প্রকাশ করে বললেন,

— ” বোঝাই নি আবার? আপনার ছেলে শুনলে তো? আপনার কী হবে বুঝতে পারছেন? শেষ হয়ে যাবেন আপনি। তোমার রেপুটিশন ফিউচার সব শেষ হয়ে যাবে যদি ঐ মেয়ে খোলা থাকে। আর বাবাই যখন আমার কথা শোনেনি কারোর কথাই শুনবেনা।”

মিস্টার রঞ্জিত চায়ের কাপটা আছাড় মেরে ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

— ” রঞ্জিত চৌধুরী তার পথের কোনো কাটাকেই বাঁচিয়ে রাখে না। সেই কাটা যদি তার নিজের ছেলে হয়, তাহলে সেই কাটাকে উপড়ে ফেলতে দুবার ভাববো না।”

কথাটা কবির শেখ এর ভীষণ ভালো লাগলো। তাই নিজের মনেই হাসলেন উনি।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here