#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২১.
আদ্রিয়ান এর দৃষ্টি এতক্ষণ অনিমার কাধের ক্ষত আর ছেঁড়া পোশাকের অংশেই ছিল। অনিমা বুকের ওপর পরাতেই আদ্রিয়ানের হুশ এল। অনিমা এখনও কেঁপে কেঁপে উঠছে আর নিঃশব্দে কাঁদছে। অতিরিক্ত কান্না আর মেন্টাল প্রেশারে দুর্বল হয়ে পরেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তিটুকু নেই। আদ্রিয়ান একহাতে অনিমাকে জড়িয়ে নিয়ে ওপর হাতে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
” স্টপ ক্রায়িং, কিচ্ছু হয়নি, আমি এসে গেছি তো। চুপ!”
অনিমা শক্ত করে আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরল। সবাই চরম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে। সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন। অনিমার সাথে আদ্রিয়ানের কী সম্পর্ক? এরমধ্যে ওখানে অভ্রও চলে এল, সাথে আদ্রিয়ানের দেহরক্ষীরাও। অনিমাকে এভাবে দেখে অভ্রও বেশ অবাক হল। সবাই শক থেকে বেড় হতেই ফোন বেড় করল ভিডিও করব বলে, অনেকে তো এই পরিস্থিতিতেও সেল্ফির জন্যে এগোচ্ছিল। তখনই আদ্রিয়ান একটু জোরে বলল,
” একজনের ফোনও যাতে ওপরে না ওঠে।”
সাথে সাথেই দেহরক্ষীরা সবাইকে আটকে নিল। এবং কাউকে ভিডিও করতে দেয়নি। দ্রুত ক্যান্টিন ফাঁকা করে দিল। অনিমার কোন রেসপন্স না পেয়ে আদ্রিয়ান বুঝতে পারল যে ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। তাই ওকে দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরল আদ্রিয়ান। ফর্সা মুখ লালচে আভা ধারণ করেছে ওর। অভ্রও যে কিছু বলবে সেই সাহস পাচ্ছেনা। আদ্রিয়ান অরুমিতার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
” কী নাম ছেলেটার?”
অরুমিতা তোতলানো কন্ঠে বলল,
” র-রবিন। মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ার।”
আদ্রিয়ান ওর দুজন লোকের দিকে তাকাতেই ওনারা মাথা নেড়ে কোথাও একটা গেল। এরপর ও অনিমাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
” মিডিয়ার কোন লোক যাতে ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করো। একটা লোকও না। আর ডক্টর ডাকো ফাস্ট!”
অভ্র মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে নিয়ে এগোতে নিলেই ডিন আর কিছু প্রফেসর এলো ওখানে। আসলে ওনারা আদ্রিয়ানের আসার খবর শুনেই এসেছেন। আদ্রিয়ান শক্ত চোখে ওনাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এখন খোশ গল্প করতে পারব না। শী নিড রেস্ট। জায়গা এরেঞ্জ করুন, ফাস্ট !”
ওনাদের একজন বলল,
” শিওর আমি এরেঞ্জ করে দিচ্ছি। আপনি ওকে নিয়ে আসুন।”
ডিন আর ডিপার্টমেন্টের অনেকেই চেনে অনিমাকে। ভর্তির সময় আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আদ্রিয়ান। আর যারা চেনেনা তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন আদ্রিয়ানের সাথে কী সম্পর্ক এই মেয়ের? আদ্রিয়ান ভেতরে নিয়ে অনিমাকে শুইয়ে দিল। অরুমিতা এসে অনিমার মাথার কাছে বসল। অনিমার কাধ থেকে চুইয়ে রক্ত বেড় হচ্ছে। আদ্রিয়ানের দৃষ্টি ওখানেই আটকে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে রাগে ফেটে পরছে ও। কিন্তু ও এখনো একবারও জানতে চাইছেনা পুরো ঘটনাটা কারণ এখন ওর কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে অনি। তখন তীব্র আর স্নেহা প্রায় হাফাতে হাফাতে এলো ওখানে। তীব্র বলল,
” অরু অনি ঠিক আছে। আসার সময় শুনলা..”
এটুকু বলে দেখল অনিমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। স্নেহা দ্রুত পদে এসে অনিমার মাথায় হাত রেখে বলল,
” কী হয়েছে ওর? এভাবে শুয়ে আছে কেন?”
অরুমিতা বলল,
” ডক্টর আসছে তোরা বস এখন।”
অাদ্রিয়ান চুপচাপ বসে আছে। আপাতত ওর কিছু বলার ইচ্ছে নেই। সারা ক্যাম্পাস জুড়ে কানাঘুষা হচ্ছে এই বিষয়টা নিয়ে, কয়েকজন প্রফেসরও এই বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তিত। ডক্টর এসে ফার্স্ট এইড করে দিয়ে, একটা ইনজেকশন দিল। আস্তে আস্তে ওর জ্ঞান ও ফিরে এলো। কিন্তু ও চুপচাপ শুয়ে আছে কিছু বলছেনা। ঔষধ লিখে দিয়ে বলল,
” আসলে ভয় আর মেন্টাল স্ট্রেসের কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। এখন উনি ঠিক আছেন। একটু খেয়াল রাখবেন।”
অভ্র গিয়ে ডক্টরকে একটু এগিয়ে দিয়ে এলো। ডিন এসে বলল,
” মিস্টার জুহায়ের আপনি ভাববেন না। আমরা দেখব ব্যাপারটা।”
আদ্রিয়ান সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে অনিমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অরুমিতাকে বলল,
” কী হয়েছিল শুরু থেকে বলো।”
আদ্রিয়ান এর বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে অরুমিতা কিছু না ভেবে গড়গড় করে সব বলে দিল। ঐ ম্যামের কথাও বলল। সবটা শুনে আদ্রিয়ান শুধু ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। আর কেউ না জানলেও অভ্র জানে এই হাসিটার মানে। ডিন আবার বলল,
” দেখুন আমরা স্টেপ নেব। কিন্তু প্লিজ এ খবরটা যেন কলেজের বাইরে না যায় প্লিজ। আমাদের কলেজের রেপুটেশনের প্রশ্ন।”
আদ্রিয়ান একটু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” ম্যাডামকে ডাকুন! সবার সাথে আলাপ হল ওনার সাথেই হলোনা। ডাকুন, ডাকুন।”
ডিন দ্রুত সেই ম্যামকে ডেকে পাঠালো নিজের রুমে। আদ্রিয়ান অরুমিতা আর স্নেহাকে অনিমার খেয়াল রাখতে বলল। এরপর ডিনের সাথে ডিনের রুমে গেল। ওর সাথে অভ্র আর তীব্রও গেল। ডিনের রুমে কয়েকজন প্রফেসর আছেন। তীব্র আর অভ্র সাইডে দাঁড়িয়ে আছেন। আদ্রিয়ানের সামনের চেয়ারে ম্যাম বসে আছেন। ওনার মনে এখন ভয় ঢুকে গেছে। আগে যদি জানতো যে অনিমা আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের পরিচিত কেউ তাহলে রবিনের কথায় এসব করত না। আদ্রিয়ান নিজের নখ দেখতে দেখতে বলল,
” তো ম্যাম? আপনি যখন ক্যান্টিনে গেলেন? কী করছিল মেয়েটা?”
ম্যাম ভয়ে ভয়ে বললেন,
” বসে ছিল।”
” আর?”
” কাঁদছিল।”
” আর কিছু?”
” হ্যাঁ কাধ কেটেও গেছিল।”
আদ্রিয়ান এবার চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
” তো এগুলোর মধ্যে কী এমন বৈশিষ্ট্য ছিল যেটা দেখে একটা মেয়েকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া যায়?”
ম্যাডাম চুপ করে আছে। আদ্রিয়ান উত্তরের আশায় কিছক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” কী হল বলুন!”
উপস্থিত সবাই হালকা কেঁপে উঠল। আদ্রিয়ান এবার রাগী কন্ঠে বলল,
” জাস্ট বিকজ অফ ঐ ছেলেটা আপনার রিলেটিভ আপনি একটা মেয়ে হয়ে একটা মেয়েকে অপমান করতে দুবার ভাবলেন না? যেখানে আপনার গিয়ে ওকে সাহস দেওয়ার কথা, সামলানোর কথা সেখানে উল্টো ওকে এধরণের জঘন্য কথা বলতে বিবেকে বাঁধে নি। আবার আপনাকে সবাই ম্যাম বলে ডাকে? নিজেকে মহিলা বলে দাবী করেন আপনি?”
আদ্রিয়ানের কথাগুলো যেন রুমে কম্পিত হচ্ছে। কেউ কিছু বলতে পারছেনা। ঐ ম্যাম তোতলানো কন্ঠে বলল,
” আমি জানতাম না যে ও আপনার কেউ হয়?”
” ওও। জানতেন না? মানে একটা মেয়ে যদি কোন রেপুটেড, হাই ক্লাস ফ্যামিলি থেকে বিলং করে তাহলে ও নিরাপদ? কিন্তু সেই মেয়েটাই যদি মিডেলক্লাস হয় দেন ওর সাথে যা ইচ্ছে করা যায়? এটাই চিন্তা আপনার।”
ম্যাম আর কিছু বলতে পারলেন না। অযুহাত দেওয়ার মত কিছু আর অবশিষ্ট নেই। আদ্রিয়ান একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” আপনি একজন মেয়ে বলে এবং একজন প্রফেসর বলে আজ আমার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। নইলে যার কারণে ঐ মেয়েটার চোখ দিয়ে জল বেড় হয় তাকে আমি ছেড়ে দেই না। কিন্তু, সরি টু সে ম্যাম আজকের পর আমি আপনাকে এই কলেজে আর দেখতে পারব না।”
ম্যাম অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
” দেখুন আপনি শুধুই একজন রকস্টার। তাই এই ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আপনার নেই।”
আদ্রিয়ান বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলল,
” সেটা কাল সকালে বুঝতে পারবেন।”
এরমধ্যেই সেই দুজন লোক এসে বলল,
” স্যার নিয়ে এসছি ওকে মাঠে আছে।”
আদ্রিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে বেড়িয়ে গেল। অভ্রর গেল পেছন পেছন। তীব্র একটু অবাক হয়েছে আজ। আদ্রিয়ানকে এভাবে কখনও দেখেনি। ডিনও কিছুই বললেন না। চেয়ারে বসে ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করে ফেললেন। কারণ আদ্রিয়ানকে উনি কিছুটা হলেও চেনেন। ক্যাম্পাসের বাইরে মিডিয়া চলে এসছে ওলরেডি কিন্তু কড়া পাহারার জন্যে ভেতরে আসতে পারছেনা। আদ্রিয়ান সোজা অনিমার কাছে গেল গিয়ে দেখে অনিমা চুপচাপ বসে আছে। আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে বলল,
” চল।”
অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছেনা ওদের অনুসরণ করে বাকিরাও আসছে। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিয়ে মাঠের মাঝে গেল। অনিমা তাকিয়ে দেখে রবিন আর ওর সেই গ্যাং এর লোকেরা দাঁড়িয়ে আছে। অনিমা একটু ভয় পেয়ে পেছাতে নিলেই আদ্রিয়ান হাত শক্ত করে ধরে টেনে রবিনের সামনে নিয়ে দাঁড় করালো।রবিন আদ্রিয়ানকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ সবার মুখে শুনেছে ব্যাপারটা। কিন্তু এটা বুঝতে পারছেনা এতোবড় রকস্টারের সাথে অনিমার কী সম্পর্ক? আত্মীয় নয় তো? হলে বা কী? ওর বাবারও কী কম পাওয়ার না-কি? যা করেছে বেশ করেছে। তবুও নিজেকে সামলে রবিন বলল,
” আপনি আমাদের এখানে নিয়ে এলেন কেন?”
আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
” থাপ্পড় মারো ওকে। এখন, আমার সামনে। যতগুলো ইচ্ছে। চাইলে তোমার জুতো খুলেও মারতে পারো। যেভাবে ইচ্ছে। জাস্ট গো ফর ইট!”
অনিমা অবাক হয়ে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। রবিনও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আদ্রিয়ানের কোন ভাবান্তর নেই।
#চলবে…
[ চাইলেও আগের মত বিশাল বিশাল পর্ব দিতে পারবনা। লেখার সময় কম পাই খুব। তবুও স্বাভাবিক পর্বই দিচ্ছি। তাই কেউ বড় পার্ট চেয়ে কমেন্ট করবেন না আপাতত। ]