#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২২.
অাদ্রিয়ানের এরকম রূপ অনিমা এরআগে কোনদিন দেখেনি। আদ্রিয়ানকে খুব শান্ত ছেলে বলেই জানে ও। কিন্তু আজ রবিনকে এভাবে মারতে বলাতে ও হতবাক হয়ে গেছে। রবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল ও ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান একটু শক্ত চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী হল মারো।”
অনিমা মাথা নিচু করে ফেলল। রবিন এবার বলল,
” দেখুন আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন এবার। যেতে দিন আমাকে আমার কাজ আছে।”
আদ্রিয়ান রবিনের কথায় পাত্তা না দিয়ে অনিমার হাত ধরে ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
” তোমাকে কিছু বলছি আমি। মারো ওকে। আমি আছি তোমার সাথে। বাকিটা আমি বুঝে নেব।”
অনিমা কিছু বলবে তার আগেই আদ্রিয়ান ধমকের সুরে বলল,
” ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথা মুখে আনলে এবার আমি তোমাকে চড় মেরে দেব। সকলের সামনে মিস বিহেভ করেছিল না তোমার সাথে। আর ছেড়ে দেবে ওকে তুমি? ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের ন্যাকা টাইপ নাইকা সাজতে ইচ্ছে করছে?”
অনিমার এবার রবিনের ক্যান্টিনের করা বিহেভিয়ার এর দৃশ্যগুলো চোখ ভেসে উঠল। মুহূর্তেই সব ভয়গুলো রাগে পরিণত হল। তাছাড়া এখন তো আদ্রিয়ান আছে ওর পাশে। অনিমা দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে গিয়ে ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে দিল রবিনের গালে। রবিন ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়েছিল কিন্তু আদ্রিয়ান চোখে চোখ পরতেই ওর সব তেজ শেষ হয়ে গেল। নিমেষেই চুপসে গেল। কিন্তু একটা দিয়ে ওর রাগ যেন কিছুতেই মিটলো না অনিমার। তাই আরও তিন চারটা থাপ্পড় মারল। তবুও রাগে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আদ্রিয়ান বলল,
” রাগ মেটেনি এখনো তাইনা? ওয়েট! হ্যাঁ জুতো খুলো।”
অনিমা অবাক চোখে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। রবিনও বিস্ফোরিতো চোখে তাকিয়ে আছে। সকলে অবাক হলেও কেউ কিছু বলছেনা বরং নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অনেকের ইচ্ছে করছে দৃশ্যগুলো ভিডিও করতে কিন্তু গার্ডদের জন্যে কেউ ফোন উপরেও তুলতে পারছেনা। অনিমা অবাক কন্ঠে বলল,
” কী?”
” বাংলায় বলেছি। বোঝনি? জুতো দিয়ে মারো। দেখবে রাগ অনেকটা কমেছে। বিশ্বাস হচ্ছেনা?ট্রায় করে দেখ? কাজ না হলে টাকা ফেরত।”
স্নেহা ফিক করে হেসে দিল। তীব্র আর অরুমিতাও ঠোঁট চেপে হাসছে। অনিমা রবিনের দিকে তাকালো সত্যিই ওর রাগ এখনও কমেনি। তাই আদ্রিয়ানের কথামতো সত্যি সত্যিই জুতো খুলে হাতে নিল। রবিন এবার ভয় পেয়ে গেল। সবার সামনে জুতোপেটা হলে সম্মানের কিছু থাকবেনা। ও যেতেও পারছেনা কারণ গার্ডরা আটকে রেখে দিয়েছে ওকে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে অনিমা জুতো ফেলে আবার পায়ে পরে নিল। আর যাই হোক একটা মানুষকে, তাও ওর চেয়ে বয়সে বড় একজনকে জুতো দিয়ে মারতে পারবেনা ও। এমনিতেই কতগুলো চড় মেরেছে। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,
” কী হল?”
অনিমা নিচু কন্ঠে বলল,
” আমি পারবনা। যদিও লোকটা যা করেছে তাতে ওর জুতোর বারিই প্রাপ্য কিন্তু আমি নিজেকে এতোটাও নিচে নামাতে পারবনা।”
আদ্রিয়ান মুচকি হাসল। ও জানতো অনিমা এটা করবেনা। এ কয়েকদিনে খুব ভালোভাবে চিনে নিয়েছে ওকে। মেয়েটার এই স্বভাবটাই তো ওকে বেশি টানে। রবিন লজ্জায় মাথা তুলতে পারছেনা। ওকে অনিমা জুতোর বাড়ি না মারলেও কিছু বাকিও রাখেনি। আদ্রিয়ান রবিনের সামনে গিয়ে বলল,
” ইশ! দু গালেই দাগ পরে গেছে। কী সাহস এই মেয়েটার। তোর গায়ে হাত তুলেছে? ভাবা যায়! ”
রবিন চোখ তুলে তাকাল। চোখদুটো লালচে হয়ে আছে। আদ্রিয়ান বলল,
” সেদিন তোকে একটা থাপ্পড় মেরেছিল বলে আজ ওকে আঘাত করেছিস তুমি তাইনা? এখনতো মোট পাঁচটা থাপ্পড় মেরেছে। এবার বদলা নিবি না। তোর সামনেই আছে। ছুঁয়ে দেখা।”
রবিন আবার চোখ নামিয়ে নিল। আদ্রিয়ান রবিনের কলার ধরে টেনে কাছে এনে ধমক দিয়ে বলল,
” কী হল? একটু আগে ক্যান্টিনেতো খুব গায়ের জোর দেখাচ্ছিলি। এখন আমিও তো একটু দেখি তোরে গায়ে কত জোর। যদি ওর গায়ে টাচও করারও সাহস করতে পারিসতো ওকে তোর হাতে ছেড়ে দেব। প্রমিস।”
আদ্রিয়ানের চোখের দিকে তাকালেই প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে রবিন। কারণটা নিজেও জানেনা। তাই অনিমাকে ছোঁয়া তো দূরের কথা হাত বাড়ানোরও সাহস দেখাতে পারল না রবিন। আদ্রিয়ান কিছু বলবে তার আগেই অনিমার মাথা ঘুরে উঠল। আদ্রিয়ান সাথেসাথেই ধরে ফেলল ওকে। অরুমিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
” ওকে নিয়ে গাড়িতে বসাও আমি আসছি।”
অরুমিতা তাই করল। স্নেহা আর তীব্রও গেল সাথে। আদ্রিয়ান রবিনের দিকে তাকিয়ে এক রহস্যময় হাসি দিয়ে ইশারা করতেই গার্ডরা ওকে ছেড়ে দিল। লজ্জায় অপমানে ওখান থেকে চলে গেল রবিন। আদ্রিয়ান পাশে দাঁড়ানো অভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” বুঝলে অভ্র।”
” জি স্যার?”
” তোমার ম্যাম তো এটাকে ছেড়ে দিল। আসলে ওর মনে দয়ার একটা বিশাল সাগর আছে কি-না। কিন্তু আমার মনে তো পুকুরও নেই। কী করি বলোতো?”
অভ্র বুঝতে পারছে আদ্রিয়ান কী বলতে চাইছে তাই হেসে বলল,
” কখন আনতে হবে স্যার?”
” আজ রাতেই নিয়ে এসো। শুভ কাজে দেরী কীসের?”
বলে সানগ্লাসটা চোখে পরতে পরতে বলল,
” আর হ্যাঁ। আমি বেড়োলেই ওই ইউসলেসগুলো ( মিডিয়ার লোক) ভেতরে এসে কাহিনী শুরু করে দেবে। কিছুতো লিখবেই। যাই লিখুক তোমার ম্যামের নামটাও যাতে লিক না হয়। যত লাগে দিয়ে দাও।”
” আচ্ছা। কিন্তু এই হাইড এন্ড সিক আর কতদিন?”
” চলুক আর কটাদিন। আমি এখনও চাইনা ওর কোন খোঁজ কেউ পাক। আগে আমাকে সবটা ক্লিয়ার হতে হবে এরপর বাকি সব। চলো।”
আদ্রিয়ান গিয়ে গাড়িতে বসল। অরু তীব্র স্নেহা ওদের বিদায় দিয়ে অনিমাকে নিয়ে চলে গেলো ওখান থেকে। অভ্র থেকে গেল বিশেষ কাজে। আদ্রিয়ান বেড়োনোর সাথেসাথেই মিডিয়ার লোকেরা ভেতরে চলে এলো। আদ্রিয়ানের গাড়ির ছবিও তুলেছে কিন্তু গ্লাস লাগানো ছিল তাই কে বা কারা আছে দেখতে পায়নি।
_____________
রাত বারোটা বাজে। একটু আগেই বাড়ি ফিরল আদ্রিয়ান। ফিরে এসে দেখে অনিমা ঘুমোচ্ছে। ওর পাশে জাবিনও ঘুমোচ্ছে। শরীর এমনিতেই ভালো নেই ওর। জাবিনের একহাত অনিমার ওপরে দেওয়া। দেখে মনে হচ্ছে দুই বোন। অনিমার এই গুনটাও ভালো লাগে আদ্রিয়ানের সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। আদ্রিয়ান ওর পাশে বসে গালে হাত দিয়ে দেখছে ওকে। ঘুমন্ত অবস্থায় সকলকেই নিষ্পাপ লাগে। কিন্তু এই মেয়েটাকে একটু বেশিই লাগে, একদম বাচ্চা। যদিও ওকে নিষ্পাপ বললে ভুল হবেনা। বাইরের জগতের এতো জটিলতা বুঝতে চায়না ও। সবকিছুই নিজের মত সরল করে ভেবে নেয়। কষ্ট পেলে বাচ্চাদের মত ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দেয়। খুশি হলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ওর সবটাই তো মায়ায় ভর্তি। তাইতো মায়াবিনী বলে ডাকে ওকে। ফোনের আওয়াজে হুশ এলো আদ্রিয়ানের। তাকিয়ে দেখে রিকের ফোন অনিমার ডিসটার্ভ হবে তাই তাড়াতাড়ি ফোনটা রিসিভ করে বলল,
” কীরে এতো রাতে হঠাৎ ফোন দিলি যে?”
” শুনলাম একটা মেয়ের সাথে মিসবিহেভ করেছিল বলে তুই নাকি কাকে একটা ধোলাই দিয়ে এসছিস? কী ব্যপার? প্রেমে পরেছ?”
” পরতেই পারি! আমি কী ব্রহ্মচারী নাকি?”
রিক হেসে দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝে গেছি যা বোঝার। নাম কী মেয়েটার?”
আদ্রিয়ান অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” মায়াবিনী।”
রিক ভ্রু কুচকে বলল,
” মায়াবিনী? এটা কারো নাম হয় না-কি?”
” ও তাহলে নীলপরী নাম হয়?”
” ওটাতো আমি ভালোবেসে ডাকি ওকে।”
” আমিও ভালোবেসেই ডাকি। কিন্তু তুই যেমন আমাকে তোর নীলপরীর নাম বলিসনি। আমি কেন আমার মায়াবিনীর নাম বলব?”
” যখন বিয়ে করবি এমনিই জেনে যাব। ছবিতো দেখা ইয়ার।”
” রিস্ক নেব না। যদি প্রেমে পরে যাস?”
রিক হেসে দিয়ে বলল,
” আরে বাঃ ভাই! আমার ডায়লগ আমাকেই?”
” একে রিভেঞ্জ বলে।”
দুই ভাইই হু হা করে কিছুক্ষণ হাসল। হাসি থামিয়ে বলল,
” এবার বিয়েটা করে ফেলনা। ওকে নিয়ে তোর বিয়ে খেতে চলে আসব।”
রিকের মনটা খারাপ হুট করেই খারাপ হয়ে গেল। অনিমার কথা খুব বেশি মনে পরছে। এমন কেন করল মেয়েটা? কেন চলে গেল? ও কী সত্যিই এতোটাই খারাপ? কোথায় খুঁজবে ও ওর নীলপরীকে। এই মুহূর্তে রাগ হচ্ছেনা কষ্টটাই বেশি হচ্ছে। তাই কথা ঘোরাতে বলল,
” মামা জিজ্ঞেস করছিল তোর কথা।”
” ও? কেমন আছে কংস মামা?”
রিক একটু হেসে বলল,
” শুধরালি না। ছোটবেলায় মজা করে বলতাম। কী রেগে যেত মামা। তাইনা?”
আদ্রিয়ান মজা করে বলল,
” হ্যাঁ! এমন মনে হত যেন সত্যিই উনি কংস।আর আমরা দুজন কৃষ্ণ আর বলরাম, ওনার কাল।”
বলে আরও একদফা হেসে নিল দুজন। ব্যাপারটা যেন ভীষণ মজার কিছু। কিন্তু কে বলতে পারে মজা করে বলা এই কথাটা কবে বাস্তবতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।
_____________
সকালবেলা আদিব, রাইমা আর আশিস দেখতে এসছে অনিমাকে। অনিমা এখন সুস্থ কিন্তু আদ্রিয়ান ওকে নামতে দেয়নি তাই রুমেই বসেছে ওরা। অনিমা রাইমার সাথে কথা বলছে। ওর সামনে আদিব, আশিস আর অভ্র বসে আছে। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণের জন্যে একটু বেড়িয়েছে। জাবিন এসে সবাইকে কফি দিল। অভ্র কফিটা ও হাতে আওয়াজ করে টেবিলে রাখল। অভ্র ভ্রু কুচকে তাকাতেই জাবিন একটা ভেংচি কাটল। অভ্র ফু দেওয়ার স্টাইলে একটা শ্বাস ফেলল। মেয়েটা এমন বিচ্ছু কেন? তবুও পাত্তা না দিয়ে কফির মগটা নিল। জাবিনের ভালো লাগেনা আর এসব কী হয় একটু ওর দিকে তাকলে। মুচকি হাসলে। পরক্ষণেই নিজেই নিজেকে বকে ও এমন উদ্ভট চিন্তার জন্যে। আশিস বলল,
” ভাবি এখন সব ঠিক আছেতো?”
অনিমা ভ্রু কুচকে বলল,
” সবসময় আমায় ভাবী ভাবী করেন ভাবি। আপনার কোন ভাইয়ের বউ আমি?”
আদিব বলল,
” আদ্রিয়ান যেভাবে চব্বিশ ঘন্টায় বাহাত্তর বার তোমাকে বউ বউ বলে ডাকে ভাবী না বলে উপায় আছে?”
অনিমা অবাক হয়ে গেল। আদ্রিয়ান ওকে বউ বলে? তাও সবার সামনে? কই ওর সামনেতো বলেনা। তাই অবাক কন্ঠেই বলল,
” কী?”
আশিস বলল,
” হ্যাঁ। আমাকেতো শুরুতেই ওয়ার্ন করে দিয়েছিল যাতে তোমার দিকে না তাকাই। ভাবো!”
অনিমা আরও অবাক হল। তখন আদ্রিয়ানের ফোন এল। ও আদিব আর আশিসকে একটু যেতে বলল। তাই ওরা চলে গেল। জাবিন ব্রেকফাস্ট হয়েছে কি-না দেখতে গেল ওর সাথে রাইমাও গেল। ওখানে শুধু অভ্র আছে। এরমধ্যেই অনিমার ফোন বেজে উঠল। ফোনে কথা বলে অনিমা আরও অবাক হল। অভ্র বলল,
” কী হয়েছে ম্যাম?”
” রবিন নাকি হসপিটালে ভর্তি। অবস্থা খুব খারাপ”
” এটাতো হতোই। সেদিন বৃষ্টির রাতে জাস্ট আপনার ওড়না ধরেছে বলে ছেলেগুলার যা অবস্থা করেছে। যেখানে ওকেযে বাঁচিয়ে রেখেছে এটাই ওর ভাগ্য।”
অনিমা এবার বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
” কী?”
” হ্যাঁ সেদিন আপনাকে বেড় করে দিয়ে স্যারওতো এসছিলেন আপনার পেছন পেছন। আমার বেচারা ঘুমটাও ভাঙিয়েছে। কী আরামের ঘুম দিচ্ছিলাম। যাই হোক আপনি বসুন আমি আসছি।”
বলে অভ্র চলে গেল। অনিমা থ মেরে বসে আছে? কী বলে গেল ওরা? আদ্রিয়ান ওকে বউ বলে? ওর জন্য সেদিন ছেলেগুলাকে মেরেছে? আজ যা করেছে তা তো ও চোখেই দেখেছে। এরমানে তো একটাই যে আদ্রিয়ানও ওকে ভালোবাসে। সত্যিই তাই? আদ্রিয়ান ভালোবাসে ওকে? আদ্রিয়ান? ভাবতেই কেমন খুশি খুশি লাগছে ওর।
#চলবে…