বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব ৬৫+৬৬

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৬৫.

রিকের কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো একপ্রকার। অনিমা আপেলের একটা টুকরো মুখে নিয়েছিল। রিকের কথা শুনে আপেলটা মুখে নিয়েই চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। মানিক আবরার, মিসেস রিমা আর লিমা, অভ্র সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা চমকে তাকাল রিকের দিকে। রিকের বলা কথাটা ওর মোটেও বোধগম্য হচ্ছেনা। কী বলল রিক এটা? ওকে বিয়ে করতে চায়? এটা স্বপ্ন নয়তো? কিন্তু আদ্রিয়ানের চোখেমুখে অবাক হওয়ার কোন লক্ষণই প্রকাশ পেলোনা। বরং ও হেসে উঠে গিয়ে রিকের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল,

” এইতো! এতোদিনে একটা ঠিকঠাক ডিসিশান নিয়েছিস। আমার বিয়ের প্রায় একবছর পেরিয়ে গেলো আর এই গবেটটার এখনো বিয়ে-সাধির নামই নেই। বাবা, এবার চটজলদি বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করে ফেলোতো।”

মানিক আবরার এবার দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,

” হ্যাঁ কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি?”

রিক এবার একটু অভিযোগের কন্ঠে বলল,

” তো কতদিন আর সিঙ্গেল লাইফ পার করব। বিয়েতো করতেই হতো একদিন। তাছাড়া চোখের সামনে একভাই যখন হ্যাপি ম্যারিড লাইফ কাটাচ্ছে, ক’দিন পর বাচ্চার বাপও হয়ে যাবে। আর আমি এখনও বিয়েটাই করতে পারিনি। এটা কী ঠিক?”

স্নিগ্ধা এখনো একটা ঘোরের মাঝে আছে। রিক ওকে বলেছিল, বিয়ে যদি কোনদিন করে ওকেই করবে। কিন্তু সেই দিনটা যে এতোটা তাড়াতাড়ি চলে আসবে সেটা স্নিগ্ধা কল্পনাও করতে পারেনি। ও শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিকের ব্যবহার দেখছে।

রিকের এমন সিদ্ধান্ত শুনে সবাই প্রথমে অবাক হলেও একটু পরেই সবাই ভীষণ খুশি হয়েছে। মানিক আবরার এক সপ্তাহ পরেই ওদের বিয়ের ডেট ফিক্সট করেছে। সবাইকে সাথেসাথেই ফোন করে জানানো হয়েছে সবটা। সকলেই অবাক হওয়ার সাথে সাথে খুশিও হয়েছে। বিশেষ করে অনিমা। রিককে দেখলে সবসময়ই ওর মধ্যে একটা অনুতাপবোধ কাজ করত। যদিও এতে ওর কোন দোষ ছিলোনা তবুও। কিন্তু এখন আর সেটা থাকবেনা। ও জানে স্নিগ্ধা রিককে ভালো রাখবে।

________

রাত দশটা বাজে। ছাদের রেলিং ধরে পাশাপাশি বসে আছে রিক আর স্নিগ্ধা। দুজনেই অনেক্ষণ যাবত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে অনেক কথাই জমে আছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করে উঠতে পারছেনা। গত ছয়মাসে রিক নিজের অজান্তেই স্নিগ্ধার প্রতি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পরেছে। স্নিগ্ধা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এটা ভালোবাসা কি-না সে সম্পর্কে ও নিশ্চিত নয়। আর সেইজন্যই বিয়ের কথা ভাবেনি। কিন্তু মাসখানেক যাবত স্নিগ্ধাকে নিয়ে অনেক বেশি ইনসিকিউরিটি ফিল করতো ও। কোন ছেলের সাথে নরমালি কথা বললেও ওর রাগ হতো। আর আজ বিকেলে সেই রাগের বশেই স্নিগ্ধার সাথে তর্ক হয়। আর সেই তর্কের মধ্যেই একপর্যায়ে স্নিগ্ধা বলে ওঠে,

” কোন অধিকারে এসব বলছো তুমি? তুমি আমার স্বামীও নও আর না আমার বয়ফ্রেন্ড। তাহলে? আমার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে এতো কথা বলার অধিকার কী তোমার আছে?”

রিক তখন বলেছিল,

” আমি কিন্তু তোকে কথা দিয়েছি স্নিগ্ধা।”

স্নিগ্ধাও ভীষণ কঠোর স্বরে জবাব দিয়েছিল,

” তো? মাথা কিনে নিয়েছো আমার? তোমার ঐ একটা কথার ভিত্তিতে কী আমার জীবন চলবে? না-কি আমি সারাজীবন বসে থাকব? এরকম ভাবাটাও বোকামি নয় কী?”

রিক তৎক্ষণাৎ নিজের মনকেও একই প্রশ্ন করল। একটা মেয়ে নিঃস্বার্থভাবে ওর জন্যে আর কত করবে? তাছাড়াও একবার নিজের ভুলের জন্যে নিজের নীলপরীকে হারিয়ে ফেলেছে ও। এখন যদি স্নিগ্ধাকেও হারিয়ে ফেলে তাহলে ও বাঁচতে পারবেনা। একদম পারবেনা। তারপরই স্নিগ্ধার হাত ধরে একপ্রকার টেনে বাড়িতে নিয়ে এসে সবার সামনে নিজেদের বিয়ের ঘোষণা করে দেয়।এসব কথা একবার ভেবে নিয়ে নিরবতা ভেঙ্গে স্নিগ্ধা নিজেই বলল,

” আমি কিন্তু তোমাকে ফোর্স করিনি রিক দা। আমি জাস্ট এমনিই বলেছিলাম কথাটা তোমাকে।”

রিক একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” কথাটা এমনি বললেও সত্যি বলেছিলি। এভাবে তো দিন চলেনা। আর নিজেকে সুযোগ না দিলে, মুভ অন না করলে। যত সময়ই নেই না কেন লাভ হবেনা। তাই এবার আমি চাই আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক। আমি সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে চাই।”

স্নিগ্ধা একদৃষ্টিতে রিকের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” সত্যি বলছো?”

রিক ঘুরে স্নিগ্ধার হাতদুটো নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

” একদম! আমি চাই তোকে ভালোবাসতে। ভীষণভাবে ভালোবাসতে। আমি বড্ড অগোছালো স্নিগ্ধু। তোকেই দায়িত্ব নিয়ে আমায় গুছিয়ে দিতে হবে। কথা দিচ্ছি তোকে সর্বোচ্চ সুখ দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে একটাই অনুরোধ_”

স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রিকের দিকে। রিক একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” নীলপরীকে ভুলে যেতে বলিসনা প্লিজ। সেটা আমি পারবনা। কথায় আছে ভালোবাসতাম বলে কোন শব্দ হয়না। কিন্তু ভালোবাসার রূপ বদলায়। ঠিক যেমন শক্তি বা পাওয়ার কখনও শেষ হয়না কেবল রূপ পরিবর্তন করে ঠিক তেমনই সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ভালোবাসা তাঁর রূপ বদলে নেয়। আগে আমি ওকে ভালোবাসতাম নিজের করে পাওয়ার জন্যে, নিজের প্রেয়সী হিসেবে। আর এখন আমি ওকে আমি ভালোবাসি শুধুমাত্র ওকে ভালো রাখার জন্যে, ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে। তবে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। মেনে নিতে পারবি এই সত্যিটা?”

স্নিগ্ধা মুচকি হেসে রিকের চোখে চোখ রেখে বলল,

” ভালোবাসি বলে দাবীতো অনেকেই করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ভালোবাসতে পারে ক-জন? আর যেই পুরুষ এভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারে তাঁকে নিজের স্বামী হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের। আমি শুধু আপনার প্রেয়সীর স্হানটুকু চাই, অর্ধাঙ্গিনী হতে চাই। আমি চাই আপনার ওপর শুধু আমার অধিকার থাকবে। আর কিচ্ছুনা।”

রিক হালকা হেসে স্নিগ্ধার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

” আজ থেকে আমি সম্পূর্ণ আপনার ম্যাডাম। যা ইচ্ছা হুকুম করুন।”

স্নিগ্ধা হেসে ফেলল রিকের কথায়। রিকও হেসে দিল। এ হাসিতে অনেক না পাওয়াকে পেয়ে যাওয়ার খুশি আছে, তৃপ্তি আছে, ভালোবাসা আছে।

_________

আজ স্নিগ্ধা আর রিকের হলুদ সন্ধ্যা ছিলো। দু-জন এক বাড়িতেই থাকে তাই এক জায়গাতেই দুটো স্টেজ সাজিয়ে দুজনের হলুদের প্রোগ্রাম করা হয়েছে। বিয়ে বাড়ির নানারকম ব্যস্ততা আর অনেক হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই কেটেছে দিনটা। জাবিন চট্টগ্রাম থেকে আজকেই এসেছে। এক সপ্তাহের জন্যে থাকবে এখানে এরপর আবার চলে যাবে। তবে যেই জাবিন সারাক্ষণ অভ্রর পেছন পেছন ঘুরঘুর করতো, বিরক্ত করতো সেই জাবিন আসা থেক‍ে এখনো অবধি অভ্রর দিকে ঠিকভাবে তাকায় অবধি নি। আর এই পরিবর্তন অভ্র স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। সেটা দেখে এক শূন্যতা গ্রাস করে চলেছে ওর মনকে। কিন্তু সবটাতো ওই করেছে। ও ঠিক যেটা চেয়েছে সেটাইতো হয়েছে। তাই এরকম কষ্ট পাওয়া এখন একদমই ভিত্তিহীন। বেশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনিমা বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিল। বিয়ে বাড়িতে প্রচুর কাজ থাকে। তারওপর এতো হৈচৈ। অরুমিতা, তীব্র, স্নেহাকে কিছুক্ষণ আগেই বিদায় দিলো। এখন প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। এরমধ্যে চোখও লেগে এলো ওর। বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান ঢুকলো রুমে। রুমে এসে অনিমাকে এভাবে এলোমেলোভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো ও। এই মেয়েটাকে দিনরাত ননস্টপ বকাবকি করলেও এ শোধরানোর নয়। অনিয়ম করবেই করবে। এটা করা একপ্রকার বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে ওর কাছে। কীভাবে পোশাক চেঞ্জ না করে, ফ্রেশ না হয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাতে ঠিকভাবে খায়ও নি কিছু এতো কাজের চক্করে। ও নিজেও ভীষণ ব্যস্ত ছিল তাই খোঁজ নিতে পারেনি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে দরজাটা লক করে টি-টেবিলে দুধের গ্লাসটা রেখে অনিমার কাছে গিয়ে দেখল অনিমা একদম গুটিয়ে শুয়ে আছে। শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে, কুচি প্রায় খুলে গেছে, চুলগুলো সব ছড়িয়ে আছে এপাশ ওপাশে, মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ভেবেছিল ঘুম থেকে তুলে মেয়েটাকে আচ্ছামতো বকুনি দেবে। কিন্তু অনিমাকে এভাবে ঘুমোতে দেখে আদ্রিয়ানের সব রাগ এমনিই চলে গেল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডাকতে যাবে তখনই খেয়াল করল যে মাথাটা গরম। পরে গলায় হাত দিয়ে বুঝলো যে অনিমার জ্বর এসছে। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে কয়েকবার ডাকার পর চোখ খুলল অনিমা। কিন্তু এখনো ওর চোখে প্রচুর ঘুম। আদ্রিয়ান হাত ধরে আস্তে করে বসিয়ে দিয়ে বলল,

” বারবার বলেছি ভেজা শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ থাকবেনা। জ্বর বাঁধিয়ে ছাড়ল মেয়েটা। এখন খুশি?”

অনিমা পিটপিটে চোখে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে বোঝাই যাচ্ছে যে প্রচন্ড দুর্বল আর অর্ধঘুমে আছে। আদ্রিয়ান দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অনিমার মুখের কাছে নিতেই অনিমা নাক ছিটকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,

” নাক ছিটকালেই থাপ্পড় মারব। চুপচাপ শেষ করো।”

একপ্রকার জোর করেই পুরো দুধটা অনিমাকে খাইয়ে দিল আদ্রিয়ান। এরপর একটু পানি খাইয়ে ঔষধও খাইয়ে দিল। অনিমা আবারও ঘুমে ঢলে পরল আদ্রিয়ানের বুকে। আদ্রিয়ান অনিমার পড়নের শাড়িটা খুলে নিলো গা থেকে। এরপর ওয়াসরুম থেকে পানি এনে ভেজা কাপড় দিয়ে মুখ গলা হাত ভালোভাবে মুছে দিল। এরপর চুলগুলো ভালোভাবে বেঁধে দিয়ে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে দিল।কিন্তু অনিমার শরীরের জ্বর বেড়েই চলেছে তাই বেশ অনেক রাত অবধি জেগে থেকে জলপট্টি দিয়েছে আদ্রিয়ান। জ্বরটা অনেকটা কমতেই নিজেকে সহ একটা চাদরে অনিমাকে জড়িয়ে নিয়ে জাপটে ধরল নিজের সাথে। এরপর শেষ রাতের দিকে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল।
#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৬৬.

আজ রিক-স্নিগ্ধার বিয়ে। সারা বাড়িতে সকলের আনন্দ, হৈচৈ আর কাজের মধ্য দিয়ে কাটছে। কিন্তু অনিমা এখনো ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। কেউ ওকে ডাকতেও আসেনি কারণ আদ্রিয়ান সবাইকে বারণ করে দিয়েছে। শরীরে জ্বর না থাকলেও অনিমার একটু রেস্ট দরকার। সময় হলে আদ্রিয়ান নিজেই ডাকতে যাবে। জানালা দিয়ে রোদের আলো সরাসরি চোখে এসে পড়তেই এতো আলোতে অনিমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে বসতে গিয়ে বুঝতে পারল বেশ দুর্বল, মাথা ভার ভার লাগছে। কোনরকমে বসে, পিটপিটে চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। বেশ চমকে উঠল ও। এতো কখন বেজে গেলো? তারপর মনে পড়ল আজতো রিক আর স্নিগ্ধার বিয়ে। আর ও এখনো ঘুমাচ্ছে? কিন্তু কাল রাতে রুমে এসে ঘুমালো কখন? নাহ, ওকে উঠে এখন নিচে যেতে হবে। সকলে কী ভাবছে কে জানে? অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে শাড়িটা ভালোভাবে পরে নিল। এরপর বের হতে নেবে তখনই খাবারের ট্রে নিয়ে আদ্রিয়ান রুমে ঢুকল। ট্রে টা টি-টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,

” উঠে পড়েছো? কেমন লাগছে এখন?”

অনিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,

” উঠে পড়েছো মানে? কত বেলা হয়েছে দেখেছেন? কেউ ডাকতেও আসেনি আমায়।”

” আমি বারণ করেছি।”

” বারণ করেছেন মানে? আজ বাড়িতে বিয়ে আর আমি? বাড়ির বউ হয়ে এতক্ষণ অবধি ঘুমাচ্ছি? কী বলবে সবাই?”

আদ্রিয়ান পকেটে হাত রেখে অনিমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

” কে কী বলবে সেই চিন্তা তোমার করার প্রয়োজন নেই। কাল রাতে কত জ্বর ছিল খেয়াল আছে তোমার? সারারাত জেগে ছিলাম তোমার জন্যে। বারবার বলেছি নিজের খেয়াল রাখো একটু কিন্তু আমার বকা না শোনা অবধি তুমিতো কথা শোনার মানুষ-ই নও।”

অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান সারারাত জেগে ছিল ওর জন্যে? আর ও কি-না পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল? আদ্রিয়ান বলল,

” এভাবে তাকিয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। কাল রাতেতো তেমন কিছুই খাওনি। দুধটাই যা খাওয়া হয়েছে। শরীর এমনিতেই দুর্বল হয়ে আছে। যাও।”

অনিমা ভাবল এমনিই দেরী হয়ে গেছে উঠতে। খেতে গেলে আরও সময় নষ্ট হবে। তাই ইতস্তত করে বলল,

” কিন্তু_”

অনিমা কথা শেষ করার আগেই আদ্রিয়ান বেশ রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। কারণ ও জানে অনিমা কী বলবে। অনিমা আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলো না। ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নেড়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। লোকটাকে অকারণেই ভয় পায়। যেখানে এটা ও জানে যে ওকে সামান্য আঘাত করতেও আদ্রিয়ানের হাত কাঁপবে। তাহলে এই ভয় কীসের? এটাকে কী ভয় বলা যায়? নাকি এটা অনিমার আদ্রিয়ানের প্রতি শ্রদ্ধা? যার কারণে আদ্রিয়ানের কোন কথা অমান্য করতে পারেনা ও।

________

কিছুক্ষণ আগেই রিক আর স্নিগ্ধার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হলো। এখন অতিথিদের খাওয়াদাওয়া চলছে। অনিমা দেরী করে নিচে নামাতে কয়েকজন একটু কানাঘুষা করা শুরু করেছিল ঠিকই কিন্তু মিসেস রিমাও হাসি মুখে সঙ্গে সঙ্গে তাদের জবাব দিয়ে দিয়েছে। অনিমা শুধু মুচকি হেসে সরে এসেছিল ওখান থেকে। ওনারাও আর কিছু বলার মত মুখ পান নি। আসলে নিজের পরিবার যদি ঠিক থাকে তাহলে বাইরের মানুষ সুযোগ পায়না। হাসান কোতয়াল খানিকটা দেরী করেই পৌঁছেছেন আজ। অনিমা ওনাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিল। কারণ এবার বেশ লম্বা সময় পর নিজের বাবার সাথে দেখা হয়েছে ওর। ওর মামা-মামি এলেও অর্ককে কোথাও দেখতে পেলোনা অনিমা। তাই হাসান কোতয়ালকে অর্কর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন কয়েকদিন আগেই অর্কর বেশ বাজেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে। হাত পায়ের অনেক জায়গাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে। সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে। কখনও পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে কি-না সেটাও জানা নেই। অনিমা ভীষন অবাক হলো কথাটা শুনে। এতো বড় একটা ঘটনা আর ওকে কেউ জানায়নি? হাসান কোতয়ালকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই উনি একপ্রকার এড়িয়ে গেলেন। তাই অনিমাও আর জিজ্ঞেস করেনি।

আদ্রিয়ান সহ বাড়ির সকল ছেলেরা গেস্টদের খাওয়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে প্রচন্ড ব্যস্ত আছে তাই অনিমা, অরুমিতা, স্নেহা, তনয়া, রাইমা সবাই মিলে স্নিগ্ধার কাছে চলে গেল। বিকেলের দিকে সব কাজকর্ম সেড়ে সব রিল্যাক্স হওয়ার পর বসার ঘরে এসে বসল সবাই। সবাই মিলে কথাবার্তা বলে ডিনার শেষ করে ফ্রেশ হতে হতে অনেকটা রাত হয়ে গেলো। সময়মতো রিক-স্নিগ্ধাকে বাসর ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিজেরা নিজেদের মতো বিশ্রাম করতে চলে গেল। এবার বিচ্ছুবাহিনীর সেই চির পরিচিত দুষ্টুমি আবার শুরু হল। এবারও রিক-স্নিগ্ধার বাসর ঘরে ওদেরকে বিরক্ত করার ফন্দি এঁটেছে। আদিব, নাহিদ, আশিস, তীব্র, অরুমিতা, স্নেহা, তনয়া আর জাবিনতো আছেই সাথে আজ অনিমাও যোগ দিয়েছে। আদিব বলল,

” আজকের প্লানটা ফ্লপ হলে মোটাও চলবে না। গতবার ডাহা লস হয়েছে। কী খিচুড়ি পাকিয়েছিলো এরা কে জানে?”

বলে অনিমার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করল আদিব। অনিমা ঠোঁট চেপে হালকা হাসল। এই রহস্যের সমাধান ওরা এখনো করতে পারেনি। এবারের প্লানটা হচ্ছে দরজার নিচে ফোন রেখে একটু পরপর লাউড স্পিকারে গান চালিয়ে দেওয়া। তো প্লান মতো অনিমা ফোনটা দরজার নিচে রাখতে যাবে তখনই সামনে আদ্রিয়ান হাত ভাঁজ করে এসে দাঁড়ালো। অনিমা আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ও চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। অনিমা ফোনটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জোরপূর্বক একটা মেকি হাসি দিল। বাকিরা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। আদ্রিয়ানের এক ধমকে উপস্থিত সবাই একপ্রকার দৌড়ে পালালো। শুধু অনিমা পড়ে রইল। অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেও জাবিনের রুমের দিকে ছুট লাগাতে যাবে তার আগেই আদ্রিয়ান শক্ত করে হাত ধরে ফেলল। তারপর সাথেসাথেই অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

” মানুষ দিন দিন বড় হয় কিন্তু আপনি বাচ্চা হচ্ছেন। রুমে চলো বাচ্চামো বের করছি আমি।”

অনিমা মুখ কাঁচুমাচু করে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। না জানি এখন আবার কোন নতুন এঙ্গেলে টর্চার করবে।

_________

রাত সাড়ে তিনটা বাজে। স্নিগ্ধা আর রিক পাশাপাশি শুয়ে আছে। দুজনে দুজনের দিকে ফিরে শুয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি দুজনের চোখের দিকে। বলা, না বলা সমস্ত কথা যেনো চোখেচোখেই সেড়ে নিচ্ছে ওরা। বেশ অনেকটা সময় পর রিক মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার সামনে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,

” এভাবে আর কতক্ষণ দেখবে? এতক্ষণ দেখে শান্তি হয়নি?”

স্নিগ্ধা হেসে বলল,

” তোমাকে একপলক দেখেই আমার শান্তি। কিন্তু সারাজীবন দেখলেও তৃষ্ণা মেটেনা।”

রিক স্নিগ্ধার দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলল,

” সারাজীবন আপনারই থাকব ম্যাডাম। যতখুশি দেখে নিতে পারবেন। এখন আপাতত ঘুমিয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।”

স্নিগ্ধা রিকের বুকে মুখ গুঁজে বলল,

” তোমার মুখে ‘তুমি’ শুনতে কিন্তু বেশ লাগছে।”

রিক হালকা আওয়াজ করেই হেসে দিয়ে বলল,

” বকবক থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

স্নিগ্ধা আলতো করে রিককে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। রিকও স্নিগ্ধাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় একটা চুমু দিল। স্নিগ্ধার উন্মুক্ত শরীর চাদর দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিল। এরপর স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আপনাআপনি ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর।

_________

সময় নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে আরও ছয়টা মাস পার হয়ে গেছে। এই ছ’টা মাস যেন একটু বেশি-ই দ্রুত পার হয়ে গেলো। সকলের জীবন এখনো একই ধারায় চলছে। কারো সম্পর্কেরই কোনরকম পরিবর্তন ঘটেনি। সবকিছুই আগের মতই আছে।

আদ্রিয়ান স্টুডিওতে বসে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। আজ ওর সাথে রিকও এসেছে। অভ্রতো সবসময়ই থাকে। আদিব আর আশিস দুজনকেই আদ্রিয়ান কাজে পাঠিয়েছে। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ানের ফোন বেজে উঠল। আননোন নাম্বার দেখে আদ্রিয়ান একবার রিকের দিকে তাকাল তারপর ফোনটা রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে কবির শেখ বলল,

” আদ্রিয়ান, তোমাকে এখনো বলছি আমার পেছনে লাগা ছেড়ে দাও। নিজে নিজের মত থাকো আমায় আমার মত থাকতে দাও। তুমি আমার ভাগ্নে হও। আমি আগের সব ভুলে যাব। শুধুশুধু শত্রুতা বাড়িয়ে লাভ কী?”

আদ্রিয়ান হাতের নখ দেখতে দেখতে মুচকি হেসে বলল,

” ভয় পেলে মামা?”

” না, সাবধান করছি। তোমার খালুর বের হতে আর মাত্র কয়েকটা মাস। এখনো বলছি আমাদের পেছনে না লাগাটাই ভালো হবে।”

আদ্রিয়ান হালকা আওয়াজ করে হেসে বলল,

” তোমাদের পেছনে লাগাটাই আমার কাজ মামা। আমি তোমাকে এরচেয়ে বেটার সল্যুউশন দিচ্ছি। এসব ছেড়ে দাও। আমিও তোমার পেছন ছেড়ে দেব। আর সেটা না পারলে এরকম ফোন-টোন করে নিজের মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ না করাই বেটার।”

কথাটা বলে আদ্রিয়ান ফোনটা রেখে দিল। লাউড স্পিকারে থাকায় রিক সবটাই শুনতে পেয়েছে। রিক একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” মামা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার মানুষ নয়। নিশ্চয়ই কিছু করছে।”

আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” জানি। আমি চাইছিই সেটা। আগেরবার প্রমাণের অভাবে ওনার কিচ্ছু করতে পারিনি। আমি চাইছি এবার উনি নিজেই সব করুক। কিন্তু সমস্যা একটাই। ওনার ফার্স্ট টার্গেট অনি-ই হবে। আই নো দ্যাট। কারণ উনি জানেন ওকে আঘাত করলেই আমায় দুর্বল করা সম্ভব। কিন্তু এটাই বুঝতে পারছিনা যে অ‍্যাটাকটা করবে কোন দিক দিয়ে।”

রিক কিছু বলবে তার আগেই ওদের জন্যে খাবার নিয়ে চলে এলো সার্ভেন্ট। অভ্র এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। আদ্রিয়ান বলাতে ওও বসে পড়ল খেতে। খাওয়ার মাঝে হঠাৎই আদ্রিয়ান বলে উঠল,

” আমার বোনকে রিজেক্ট করার কারণটা কী অভ্র?”

অভ্র বিষম খেয়ে গেল আদ্রিয়ানের আচমকা এমন প্রশ্নে। রিকও অবাক হয়ে তাকাল। অভ্র কোনরকমে পানি খেয়ে নিজেকে সামলে একটা ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,

” জি স্যার?”

আদ্রিয়ান এবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

” জাবিনকে ফিরিয়ে দেওয়ার রিজন কী? আর হ্যাঁ এটা বলোনা যে তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে বা তুমি কমিটেড। কারণ ঐ গাধিটা তোমাকে না চিনলেও আমি তোমাকে খুব ভালোভাবে চিনি। গার্লফ্রেন্ড অনেক দূরের কথা তোমার যেয়ে কোন স্বাভাবিক মেয়ে বন্ধুও নেই সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। আসল কারণটা বলো।”

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here