বসন্ত এসে গেছে পর্ব ২১

#গল্পঃবসন্ত এসে গেছে
#লেখাঃনুশরাত জেরিন
#পর্বঃ২১
,

,
চারিদিকে কোলাহলে পরিপূর্ণ। মানুষে গিজগিজ করছে আশপাশ।এতো এতো কথাবার্তা হচ্ছে যে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার উপক্রম।
এতো কোলাহলের মাঝেও দুএকজনের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
হুহু করে বুক ফাটা কান্না।
অপু নিশ্চল হয়ে বসে আছে।চোখ দিয়ে ফোটায় ফোটায় অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পরছে।
মুখ চোখ ফুলে লাল বর্ন ধারন করেছে তার।
অতিরিক্ত কান্নায় মাথা ধরে আছে।
পাশে নয়না খালা বসে আহাজারি করছে।
রুজি খালা মিসেস রিচিকে সামলাচ্ছে।

মিসেস রিচিও কাঁদছে।
আকুল হয়ে কাঁদছে। যেমনই মানুষ হোক না কেন তিনি তবুও তার স্বামীর মৃত্যুতে তিনি ভেঙে মুষড়ে পরেছেন।
অপু ভেজা ঝাপসা চোখে আরমান খানের নিষ্প্রান দেহ দেখছে।
সকালে যাকে চা দিয়ে হাসি মুখে ভার্সিটি গিয়েছিলো অপু আর এখন একটু সময়ের ব্যবধানে সে নেই?
এতোক্ষণ যার একটা নাম ছিলো এখন তার নাম পরিবর্তন হয়ে গেলো?নতুন নাম হলো লাশ?

আরমান খানের মুখের দিকে তাকাতেই তার হাসিমাখা মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
তার আদরমাখা মা ডাকটা আর কখনো শুনতে পাবেনা অপু?

মায়ের পরে এই লোকটাই তো অপুকে এতোটা আপন করে নিয়েছিলো।আর এখন সেও চলে গেলো?
এ বাড়িতে আরমানের খানের ভরসায় ই তো অপু থাকতে পেরেছিলো।মাথার ওপর বটগাছের মতো দাড়িয়ে ছিলো লোকটা।

অপু ডুকরে কেদে উঠলো।
মাথার উপর ঠান্ডা রুগ্ন এক হাতের উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ মেলে উপরে তাকালো সে।
এক বয়স্ক বৃদ্ধা।অপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তার চোখও ভেজা।গালে শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ।
কেমন মমতাময়ী চোখ!
তবে মুখ চোখ কুঁচকে আছে বেশ,বয়সের ছাপ স্পষ্ট।

অপু অবাক হয়।
এই বৃদ্ধাকে আগে কখনো দেখেনি সে।
ইনি কোথা থেকে এলেন?
অপুর চোখে মুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে রুজি খালা এগিয়ে এসে অপুর উদ্দেশ্যে বলে,

—ইনি বড় সাহেবের মা।তোমার দাদি শাশুড়ী।

অপু সালাম দেয়।
কন্ঠ কেমন যেন শোনায়।এতক্ষণ যাবত কান্নার ফলে গলা ভেঙে গেছে।

বৃদ্ধা মহিলাটি সালামের উত্তর নিয়ে অপুকে জড়িয়ে ধরে।অপু ডুকরে কেঁদে ওঠে।
বৃদ্ধাও কেদে ফেলেন।
কাউকে সান্তনা দিতে গিয়ে কাঁদতে নেই তিনি জানেন,তবু তিনি নিজেকে সংযত করতে পারেননা।

—–

জানাযা,দাফন শেষ হয়েছে।
বাড়িতে এখন শুনশান নিরবতা।একটা টু শব্দও শোনা যাচ্ছে না।
একটু আগে যেখানে মানুষের কোলাহলে কানে তালা লাগছিলো সেখানে এখন নিস্তব্ধতায় গা ছমছম করছে।

রুজি আর নয়না খালা রাতের রান্না শেষ করে বসে আছেন।
কেউ একটা দানাও মুখে তোলেনি।
অপু একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে নোমানের দাদির রুমে যায়।

বৃদ্ধার বয়স হয়েছে খুব।গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে,সোজা হয়ে ঠিক মতো হাটতেও পারেননা।
হাটতে গেলে একটু কুঁজো হয়ে হাটতে হয়।
তবুও তিনি নাকি ভীষন রকমের রাগী মহিলা।
কাজের একটু এদিক ওদিক হলেই নাকি বাড়ি মাথায় তোলেন।

তিনি এ বাড়িতে থাকতেননা।
গ্রামে থাকতেন।আরমান খানের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিলোনা তার।
তিনিই নিজেই সম্পর্ক ছেদ করেছিলেন।
কারন ছিলো আরমান খানের দ্বিতীয় বিয়ে।
নোমানের মাকে ফেলে রিচিকে বিয়ে করায় ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলেন তিনি।এমনকি মেনেও নিতে পারেননি এ বিয়ে।
ছেলের কৃতকর্মের জন্য তার সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে গ্রামে থাকতেন বৃদ্ধা।
কিন্তু এখন ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে আর রেগে থাকতে পারেননি তিনি।তাইতো ছুটে এসেছেন ছেলেকে শেষবারের মতো একনজর দেখতে।

অপু এসব কিছু শুনেছে রুজি খালার মুখ থেকে।
বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে সালাম দেয় অপু।
বৃদ্ধা খাটে বসে তজবি পরছিলেন।অপুকে দেখে তজবি হাতে নিয়ে সোজা হয়ে বসেন।বলেন,

—-আয় বইন,ঘরে আয়।

অপু হাতের খাবারের প্লেট পাশে রেখে বলে,

—খাবার খাননি কেনো দাদি?

—খাবার কি আর গলা দিয়া নামবো আমার?

—কিন্তু কিছু না খেলে যে আপনি অসুস্থ হয়ে পরবেন।তখন কি হবে বলুনতো?

বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,

—কি আর হইবো,ছাওয়ালডার সাথে গিয়া একলগে থাকমু তখন।আমার আর কেডাই বা আছে?

–আমরা নেই?

বৃদ্ধা চকিত দৃষ্টিতে তাকায়।
সে দৃষ্টি অনুসরণ করে অপু আবার বলে,

—আমাদের কথা ভাববেন না দাদি?আমরা কি আপনার কেউনা?

বৃদ্ধা অবাক হয়।
চেনা নেই জানা নেই হুট করে একদিনের পরিচিত কাউকে কেউ এতোটা আপন করে নিতে পারে?এভাবে আকুল হয়ে তার সাথে কথা বলতে পারে?

তার চোখ ছলছল করে।
অনেকদিন পর এমন স্নেহার্দপূর্ন আচরনে তার বুক ভরে আসে।
অপু যেন তা বুঝতে পারে।
বৃদ্ধার রুক্ষ হাতদুটো নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।
যেন আশ্বাস দেয়,এইতো আমি আছি।আপনার আপন কেউ।

—-

বৃদ্ধাকে একমুঠো পরিমান খাবার খাইয়ে অপু নিজের রুমে আসে।
ক্লান্ত লাগছে তার।
শরীর মন দুটোই ক্লান্তিতে দুমড়ে মুচড়ে মুখ থুবড়ে পরছে যেনো।
কোনমতো শরীরটা টেনে হিঁচড়ে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।
ফ্রেশ হয়ে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়।
চোখ বুজে আসে।
আবার ফট করে চোখ খুলে বসে পরে।
আরমান খানকে তারা বাইরে কবরস্থানে রেখে এসেছে?
মাটির ঘরে শুয়ে আছেন তিনি আর অপুরা এতো নরম বিছানায়,আরাম করছে?
অপুর আবার কান্না পায়।
চোখ দিয়ে অঝোরে জল পরে।
বেলকনিতে শব্দ পেয়ে অপু থামে।
এতোরাতে বেলকনিতে কে?
পরমুহূর্তে মনে পরে,নোমান বাড়িতে আজ।
সে হয়তো বেলকনিতে আছে।
ধীরপায়ে বেলকনির দিকে এগোয় অপু।
নোমানের কি অবস্থা কে জানে।বাবাকে তো সে খুব ভালবাসতো।মুখেই বলতোনা শুধু।

বেলকনির দরজার কাছে দাড়িয়ে অপু থমকে যায়।
নোমানকে দেখে তার বুকটা মুচড়ে ওঠে।
এলোমেলো বিদ্ধস্ত অবস্থা তার।
চুলগুলো এলোমেলো,বুকের শার্টের উপরের বোতামগুলো খুলে আছে,নিচের দিকের শার্ট কুঁচকানো।
চোখদুটো অসম্ভব লাল।

অপুকে দেখে নোমান নরম গলায় বলে ওঠে,

—অপরুপা?এসো।

অপুর বুক ধক করে।
এই প্রথম হয়তো নোমান তার নাম ধরে ডেকেছে।

অপু ধীর পায়ে এসে নোমানের পাশে দাড়ায়।
নোমানের চোখ তখন গ্রীল ভেদ করে অন্ধকার আকাশ দেখায় ব্যাস্ত।
অপুর উপস্থিতি বুঝে সে অপুর দিকে ঝোঁকে।
অপু চোখ বন্ধ করে ফেলে।
নোমান অপুর মুখপানে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলে,

—আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে অপরুপা?খুব যন্ত্রনা হচ্ছে।

অপু মাথা ঝাকায়।এমন আকুতিভরা আবেদন ফেলতে পারেনা সে।
বলে,

—ঘরে আসুন দিচ্ছি।

—উহু,ঘরে না।এখানেই।

—এখানে?

—হু,এইযে এই দোলনার উপর বসো তুমি।

নোমানের কথা অনুসারে দোলনায় বসে অপু।
নোমান হাটু মুড়ে বসে অপুর কোলে মাথা রাখে।
দুহাত টেনে চুলে ঢুকিয়ে দেয়।
অপু যত্নকরে চুলে হাত বুলায়।

নোমান বলে,

—উত্তরার বাড়িটায় আমি খুব একা জানো অপরুপা,তুমি কি যাবে আমার সাথে?আমার আপন কেউ হয়ে?

,
,

,
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here