বসন্ত এসেছে পর্ব -০৭

#বসন্ত_এসেছে
#পর্ব_৭
#মাহিমা_রেহমান

বাড়িতে ঢুকছিল বেলা,, অকস্মাৎ মায়ের ডাকে থেমে যায়। কঠোর কণ্ঠে বেলাকে নিজের কাছে ডাকে রুমি রওশন। ভোঁতা মুখে সেদিকে এগিয়ে যায় বেলা। মেয়ের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,

-“ভাইয়া কাল রাতে কি বলেছে মনে নেই তোর? রায়াযের থেকে দূরে থাকতে বলেছে না?”

কাঁচুমাচু করতে করতে বেলা উত্তর দিল,

-“বড় বাবা যা বলেছে আমরা তো তাই করছি। বড় বাবা বলেছে,,আমরা স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে পারবো না কিন্তু আগের মতো থাকতে পারবো। সেটাইতো করছি। কালকের এই ঘটনা যদি না ঘটতো? তাহলে তো আমাকে কলেজে রায়ায ভাই ভর্তি করিয়ে দিত তাই না?”

গরম চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে রুমি রওশন বললেন,

-“খুব বেশি পেকে গেছিস তাই না? অবশ্য পেকেই তো গেছিস। তা না হলে কী কাল রাতে এমন কাজ করতে পারতিস?”

মাথা নিচু করে নিল বেলা। কয়েক পল মেয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,

-“যা নিজের ঘরে যা।”

কথা না বাড়িয়ে বেলা নিজের রুমে চলে গেল। রুমে এসে বালিশে মুখ গুঁজে দিল। সবকিছু তার কাছে কেমন রঙিন রঙিন লাগছে। রায়ায ভাই তার হয়ে গেছে, তা যেমন বিশ্বাসই হচ্ছে না বেলার! কেমন ঘোরের মাঝে আছে সে। রায়ায ভাই এখন কেবল তার?ভাবেই কেমন শিরশির করে উঠল বেলার সর্বাঙ্গ।
বালিশে মাথায় লিয়ে দিয়ে কাল রাতের সকল ঘটনা ভাবতে লাগলো বেলা।

কাল রাতে…

রাত দশটার দিকে বাড়িতে ফিরলো রায়ায। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামল রাতের খাবার খেতে। ডিনার টেবিলে সকালে উপস্থিত থাকলেও যখন বেলা কে দেখতে পেলনা তখন জিজ্ঞেস করল,

-“বেলা কোথায়?”

প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে রুমির রওশন উত্তর দিল,

-“কোথায় আর হবে সে নিজের রুমে। রাতে নাকি খাবেনা। তাই আর জোর করিনি।”

রায়ায আর কিছু বলল না। মনোযোগ দিল নিজের খাবারে। খাবার শেষে এক এক করে সকলের চলে গেল যার যার রুমের দিকে। সকলে চলে যেতেই,,রায়ায যুথীকে ডেকে উঠলো,

-“এই যুথি একটা প্লেটের মধ্যে কিছু খাবার সাজিয়ে দেতো।”

রায়াযের কথা মতো খাবার সাজিয়ে দিতে প্লেট হাতে বেলার রুমের দিকে অগ্রসর হলো রায়ায। বেলার রুমের নিকটবর্তী আসতেই শুনতে পেল গুনগুন করে কারো কান্নার আওয়াজ। কৌতূহল বসত সম্মুখে দিকে এগিয়ে গেল সে। শব্দ টা ঠিক বেলার রুমের থেকে আসছে। ধক করে উঠল রায়াযের অন্তরাল। ব্যাগ্র পায়ে রুমের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল সে। বালিশে মুখ গুজে গুনগুন করে কাঁদছে বেলা। বেলা কে ডেকে উঠল রায়ায,

-“বেলা! কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?”

রায়াযের কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই বেলা ছুটে গিয়ে এক প্রকার হামলে পড়লো তার বুকে। জড়িয়ে ধরে এক মনে কাঁদতে লাগলো। বেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে রায়ায জিজ্ঞেস করল,

-“হয়েছে কী? বলবি তো নাকি? ছোটমা কী কিছু বলেছে? আমাকে বল।”

রায়াযকে ছেড়ে দিয়ে নাক টানতে টানতে বেলা উত্তর দিল,

-“মা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে রায়ায ভাই।”

বলেই কেঁদে উঠলো।কান্নারত অবস্থায়ই মাথা তুলে তাকালো রায়াযের দিকে । সহসা কেঁপে উঠলো বেলার সর্বাঙ্গ। রক্তিম চোখ, শক্ত চোয়াল, তার দিকে তাকিয়ে রায়ায। শক্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-” আর তুই কি বলেছিস?”

এহেন কঠিন কণ্ঠস্বর কর্নগোচর হতেই কিঞ্চিৎ ভয় অনুভব করল সে। কম্পিত কন্ঠে উত্তর দিল,

-“আমি না করেছি মাকে। কিন্তু কিছুতেই মা আমার কথা শুনছে না। আপনি কিছু একটা করুন রায়ায ভাই।”

সহসা নিজের শক্তপোক্ত হাত দ্বারা বেলার হাত চেপে ধরল রায়ায। টানতে টানতে তাকে নিচে নিয়ে যেতে লাগলো। ভীত হলো বেলার চিত্ত। ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“আমাকে এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন রায়ায ভাই?”

উত্তর দিল না রায়ায। টানতে টানতে বেলাকে সদর দরজার সামনে এনে দাঁড় করালো। ভয়ের মাত্রা যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল বেলার। ভিতীগ্রস্ত চোখে রায়াযের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-“এত রাতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

কোন প্রত্যুত্তর না করে বেলাকে নিয়ে বাহিরে বের হয়ে এলো রায়ায। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে বেলাকে ইশারা করল উঠে বসতে। উঠলো না বেলা। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এবার রেগে তাকে ধমকে উঠলো রায়ায,

-” সমস্যা কী? উঠছিস না কেন? তাড়াতাড়ি উঠে বস। আরো অনেক কাজ বাকি।”

অবাক হলো বেলা। জিজ্ঞেস করল,

-“এতো রাতে আপনার আবার কিসের কাজ? আর আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কোথাও যাবো না আমি।”

রাগে ফেটে পড়ল রায়ায। টানতে টানতে বেলাকে নিয়ে ধাক্কা মেরে গাড়ির ভিতর ফেলে দিল। নিজে গিয়ে দ্রুত ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। ছটফট করতে লাগলো বেলা। আতঙ্কিত কন্ঠে বারংবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো,

-“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন রায়ায ভাই? প্লিজ গাড়ি থামান। আমার খুব ভয় লাগছে।”

গাড়ি ড্রাইভ করা থামিয়ে গভীর চোখে এবার বেলার দিকে তাকালো রায়ায। রাজভারি কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“আমার উপর বিশ্বাস নেই তোর? বিশ্বাস করিস না আমাকে?”

রায়াযের সেই গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে বেলা উত্তর দিল,

-“অনেক বেশি বিশ্বাস করি আমি আপনাকে। নিজের থেকেও বেশি।”

-“তাহলে আর একটাও প্রশ্ন না করে চুপচাপ বসে থাক।”

পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করে সত্বর ফোন করলো কাউকে রায়ায। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই ভারী কন্ঠে বলল,

-“আমাদের এলাকার কাজী অফিসের সত্তর চাচা আছে না..ওই যে বিয়ে পড়ায়?”

ওই পাশ থেকে কি বললো শোনা গেল না। পরমুহুর্তে রায়ায আবার বলল,

-“উনাকে দ্রুত তুলে নিয়ে আয় ওনার কাজী অফিসে।”

কথাটা শেষ করেই মোবাইল পকেটে রেখে আবারো ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিল সে। শঙ্কিত হলো বেলার চিত্ত। জিজ্ঞেস করল,

-“কাজী অফিসে আমরা কেন যাচ্ছি রায়ায ভাই?”

এবার বেশ রাগ হলো রায়াযের। এই মেয়েটার খালি অহেতুক প্রশ্ন! রাগান্বিত কন্ঠে জবাব দিল,

-“কেন তুই কি ফিডার খাস? জানিস না মানুষ কী করতে কাজী অফিসে যায়?

ভয়ে এবার কেঁদে দিল বেলা। ক্রন্দনরত স্বরে বলল,

-“প্লিজ রায়ায ভাই না। এমনটা করবেন না। আমি কোথাও যাবো না, আমাকে বাড়ি দিয়ে আসুন।”

বেলার কথাকে তেমন পাত্তা দিল না রায়ায। নিজ মনে ড্রাইভ করতে লাগলো সে। কাজী অফিসের সামনে গাড়ি থামতে বেলাকে ভিতর থেকে টেনে হিচড়ে বের করে আনলো। রাগী স্বরে বেলার উদ্দেশ্যে বলল,

-“চুপচাপ ভিতরে যাবি। কোন প্রকার সিনক্রেট করার চেষ্টা করবি না। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ আর কেউই হবেনা !”

রায়াযের ধমকিতে দমে গেল না বেলা। পূর্বের ন্যায় থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল আগের জায়গায়। রাগ যেন তিরতির করে বাড়তে লাগল রায়াযের। কোনো দিক বিচার বিবেচনা না করে বেলাকে একটানে নিজের কাঁধে তুলে নিল। চিৎকার দিয়ে উঠলো বেলা। কাজি অফিসের ভিতরে গিয়ে তৎক্ষণাৎ তাকে নিচে নামিয়ে দিল রায়ায। টেনে নিয়ে গিয়ে বসালো। সকল ফর্মালিটি শেষ হলে কাজী বেলার উদ্দেশ্যে বললেন,

-” ** লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া, জহির রওশনের একমাত্র পুত্র রায়ায রওশন সহিত তোমার বিবাহ ধার্য করা হয়েছে।আপনি যদি এই বিবাহে রাজি থাকিয়া থাকেন,, তাহলে বলুন মা কবুল….।”

থম মেরে বসে রইলো বেলা। টু শব্দটিও করল না।
কাজী বেশ কয়েকবার তাড়া দিল। তবে সকলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো বেলা। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো এবার রায়াযের। এক টানে বেলাকে দাঁড় করিয়ে হিরহির করে টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে এলো। হুঙ্কার ছাড়লো,

-“সমস্যা কি? মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিস কেন?”

কান্নারত কন্ঠে বেলা জবাব দিল,

-“আমি এটা করতে পারবো না রায়ায ভাই।”

রাগের মাত্রা আরো বেড়ে গেল রায়াযের। বাজখাঁই কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“তাহলে তুই চাইছিস টা কি? ওই ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস?”

এহেন ঝাঁঝালো কন্ঠে কেঁপে উঠল সে। ক্রন্দনরত কন্ঠে উত্তর দিল,

-“না।”

-“তাহলে কাজী যখন কবুল বলতে বলল, বলিস নি কেন? সমস্যাটা ঠিক কোথায় তোর বলবি আমায়?”

চুপ করে রইল বেলা। কোন জবাব দিল না। রাগান্বিত কন্ঠে এবার রায়ায বলল,

-“ঠিক আছে করতে হবে না তোর বিয়ে। যার সাথে ছোটমা তোর বিয়ে ঠিক করেছে তাকে গিয়েই বিয়ে কর।”

ঠোট ভেঙ্গে কেঁদে উঠলো বেলা । দুহাতে জাপটে ধরল রায়াযকে। কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল,

-“না আমি কিছুতেই ওই ছেলেকে বিয়ে করব না।”

কয়েক পল বেলার মুখপানে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে রায়ায বলল,

-“তাহলে আমাকে বিয়ে করে নে।”

নাকোচ করলো বেলা।শত চেষ্টা করেও কোনভাবেই বেলাকে মানাতে পারল না রায়ায। রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ সে। চিৎকার করে বলে উঠলো,

-“ঠিক আছে করতে হবে তাকে বিয়ে।”

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে লাইটারের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে তা মুখে পড়ে নিল। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে তার।সুজয় নামক ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রায়ায বলল,

-“আচ্ছা আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে আছে না? কী যেন নাম?”

তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলল সুজয়। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো,

-“সোনিয়া! সোনিয়ার কথা বলছেন ভাই?”

-“তাই হবে হয়তো।”

-“ভাই মেয়েটা যা পাগল ছিল আপনার জন্য।”

সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে বাতাসে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে রায়ায জবাব দিল,

-“হ্যাঁ শুনেছি মেয়েটা নাকি আমার জন্য খুব পাগল। মরতে ও নাকি গিয়েছিল কতবার ( বেলার দিকে তাকিয়ে )
তাই ভাবছি ওই মেয়েটাকে এখন এই মুহূর্তে বিয়ে করে নিব। বিশেষজ্ঞদের কথা মতে,, যাকে তুমি ভালোবাসো? তাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে না বেছে..যে তোমাকে ভালোবাসে! তাকে জীবন সঙ্গী হিসাবে নিজের করে নাও। তাই ভাবছি
মেয়েটা যেহেতু আমার জন্য এতই পাগল ছিল! মেয়েটাকে এবার একটা চান্স দেওয়া দরকার কি বলিস?”

দাঁত কেলিয়ে সুজয় মাথা নেড়ে সায় জানালো। আঁতকে উঠলো বেলা। রায়াযের কাছে এসে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-“এসব আপনি কি বলছেন রায়ায ভাই? আপনি কেন ওই মেয়েকে বিয়ে করতে যাবেন?”

ভাবলেশহীন কন্ঠে রায়াযের উত্তর,

-“বারে তুই আমাকে বিয়ে করবি না তো কি হয়েছে তাই বলে কি আমার জন্য মেয়ের অভাব পড়বে? তাছাড়া এখন আমার বিয়ে করার মুড জেগেছে,, তাই যেইষ করেই হোক আজ রাতের মধ্যে আমি বিয়ে করে বউ নিয়েই বাড়িতে ফিরবো।”

অস্থির কন্ঠে বেলা বলল,

-“আপনার কাউকে বিয়ে করতে হবে না!”

ভ্রু কুঁচকে রায়ায জিজ্ঞেস করল,

-“তাহলে তুই আমাকে বিয়ে করছিস?”

মাথা নেড়ে সায় জানালো বেলা। তৎক্ষণাৎ রায়াযের ওষ্ঠ কোণে ফুটে উঠলো বিশ্বজয়ের হাসি!
.
.
.
চলবে কী…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here