বাক্সবন্দী চিঠি পর্ব -০২

গল্পঃঃ #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখকঃ Ninika Jaman Noor
পবর্ঃ২
বাস থেকে নেমে রিকশা করে তার বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো।এই দুইবছরে শহরের অনেক কিছু বদলে গেছে।শুধু বদলায়নি এই দুটো বাড়ি।আড়চোখে আবিরদের বাড়িটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো ইতুর।বাড়িটা সাজানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে।ইতু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা হাতে দরজার কলিং বিল চাপ দিলো।দুই বছরে তার বাবা তাকে দেখতে গেলেও মা যায় নি।অনেক বেশী অভিমান করেছে মেয়ের উপর।
শারমিন বেগম দরজা খুলে ইতুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো।পরমুহূর্তে সকল রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে ইতুকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো।
ইতুও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না মায়ের সাথে সমান তালে কেঁদে চলছে।
ততক্ষনে ইতুর বাবা তাদের পিছনে এসে দাঁড়ালো।
ইতু এইবার মাকে ছেড়ে বাবাকে ধরে কাঁদতে লাগলো।যে মেয়েটা বাবা মা ছাড়া থাকতো পারতো না সে তাদের থেকে দুটো বছর অন্য শহরে গিয়ে থাকছে।এটা যে কতোটা কষ্টের ইতু বুঝাতে পারবে না।অন্যের অপরাধের শাস্তি সে এইমানুষগুলোকে দিয়ে ফেলেছে।বড্ড ভুল হয়ে গেছে তার।
ইতুর বাবাকে মেয়েকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো,”এতোদিনে ফিরতে হলো তোকে?আর যেতে দিবো না।তুই তো আমাদের একমাত্র রাজকন্যা কিভাবে আমাদের ছেড়ে গেলি?”
ইতু চোখের পানি মুছে বললো,”ভুল হয়ে গেছে।আর যাবো না।এইবারের মতো মাফ করো।”
শারমিন বেগম মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে লাগলেন।ইতু তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,”আমার মেলোড্রামা কুইন আর কেঁদো না।চলে এসেছিতো আর যাবো না তোমাদের ছেড়ে।
এইবার কিছু খেতে তো দাও।কতোদিন তোমার হাতের রান্না খাই না।”
শারমিন বেগম হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,”তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় আমি এক্ষুনি খাবার আনছি।”
“আচ্ছা।আর আমি এসেছি এই খবর কাউকে দিবা না এখন।অনুর জন্য সারপ্রাইজ এটা।”
“ঠিক আছে বলবো না কাউকে।”
ইতু উপরে চলে গেলে শারমিন গেলেন রান্না করতে।আব্দুল কাদের বাজারের ব্যাগ নিয়ে গেলেন বাজারে।আজ তার মেয়ের সব পছন্দ জিনিস কিনবেন।এতোদিন পর মেয়ে ফেরাতে মনের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
ইতু তার রুমে ঢুকে দেখলো রুমটা আগের মতোই আছে।সবকিছু যত্ন করে গুছিয়ে রাখা।
ইতু চলে যাওয়ার পর শারমিন বেগম প্রতিদিনই নিয়ম করে রুমটা পরিষ্কার করেন।এক দুই ঘন্টা রুমটাতে বসে বেরিয়ে আসেন।
ইতুর মনে অপরাধবোধ হচ্ছে।অন্যভুলের জন্য তার বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।
ইতু আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে লাগেজ থেকে কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলে গেলো।
দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করে ফ্রেশ লাগছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো শারমিন বেগম সব জামা কাপড় গুছিয়ে আলমারিতে রাখছে।
ইতু হেসে তার মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,”কেমন আছো আম্মু?আমাকে একবার ও দেখতে যাওনি কেনো? দেখো তো তোমার হাতে খাবার না খেয়ে কেমন শুকিয়ে গেছি।চুল দেখছো অর্ধেক পড়ে গেছে।”
শারমিন বেগম বিছানায় ইতুকে বললেন,”আয় আমার কোলে মাথা রাখ।”
ইতু মুচকি হেসে তার মায়ের কোলে মাথা রাখলো।
“জানিস তুই যেদিন চলে গেলি সেদিন এই বাড়িটা যেনো অন্ধকার পুরি হয়ে গেছিলো।আমি আর তোর বাবা কেউই ঠিক করে খেতে পারছিলাম না ঘুমাতে পারছিলাম।আমি তো তাও তোর রুমটাতে বসে কেঁদে নিজের মনটাকে হালকা করতাম।কিন্তু তোর বাবা পুরুষ মানুষ কাঁদতে পারতো না।আমার সামনে শক্ত থাকলেও রাতে বিছানায় শুয়ে যে তোর জন্য চোখের পানি ফেলতো আমি বুঝতে পারতাম।এইসব দেখে তোর উপর অভিমান হয়েছিলো।কেনো গেলি আমাদের ফেলে?তোকে দেখতে ইচ্ছা করতো কিন্তু তোর কাছে গেলে তোকে সাথে করে নিয়ে আসতে পারবো না সেই কষ্ট আমার সহ্য হতো না।তাই বুকের মধ্যে পাথর রেখে দাঁতে দাঁত চেপে এই দুটো বছর কাটিয়েছি।নামাজে বসে কতোবার আল্লাহর কাছে বলেছি আমাদের মেয়েটাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।
অবশেষে আল্লাহ তার বান্দার দোয়া কবুল করেছে।”
ইতু নিরবে তার মায়ের কথা শুনে চোখের জল ফেলছে।নিজের রাগ,জিদ,অভিমান বড় করে দেখতে গিয়ে এই মানুষ দুটোর ভালোবাসা চোখেই পড়েনি।ছোটবেলা থেকে যারা তার সকল আবদার পূরণ করে আসছে সে তাদের একটা আবদার পূরণ করতে পারলো না?উল্টো তাদের এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেললো?
ইতু তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বললো,
“স্যরি আম্মু।খুব ভুল হয়ে গেছে।এইবার থেকে তোমাদের সব কথা মেনে চলবো।আর কখনো কষ্ট দিবো না।”
শারমিন বেগম হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
সারা বিকাল ইতু তার বাবা মায়ের সাথে কাটালো।দুই বছরের জমানো কথাগুলো বললো।
সন্ধ্যা নাগাদ ইতুর মা,বাবা মেহেদির অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হয়ে গেলো।যদিও মেহেদির অনুষ্ঠান ছাদে ছোট করে হচ্ছে তাও ডেকোরেশনের কমতি রাখেনি।ইতু তার রুম থেকেই দেখতে পাচ্ছে।মনে একঅজানা অনুভূতি কাজ করে বাড়িটার দিকে তাকালে।
ইতুর মা ডাকতে এলে সে বলে দিলো আরেকটু পরে যাবে।
___________________
অনু মুখ ভার করে মেহেদি লাগাচ্ছে।আশেপাশের এতো হইচই তার ভালোলাগছে না।অনুর মা কয়েকবার বলে গেলো এইভাবে মুখ ফুলিয়ে না রাখতে তাও অনুর কোনো হোলদোল নেই।আবির তার বোনের মুখ ভারের কারণ বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।গত দুই বছর ধরে অনুকে খুব কম হাসতে দেখেছে সে।
আবির অনুর পাশে বসে বললো,”কিরে আজকের দিনেও মুখ ফুলিয়ে রাখবি?যার জন্য মুখ ফুলিয়ে রেখছিস সে তো এলোই না।দেখে ইতুর বাবা মা কতো আগে এসে বসে আছে।”
অনু কিছু বললো না।আবিরের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না অনু।তার ভুলের জন্যই আজ এতো সমস্যা।
অনুকে চুপ থাকতে দেখে আবির উঠে তার বন্ধুদের সাথে বসলো।
হঠাত্‍ পুরোবাড়িতে লোডশেডিং।সবাই চেঁচামেচি শুরু করলো।
আবির ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে উঠে যেতে নিলে একটা কন্ঠ শুনে থমকে দাড়ালো।পুরো বাড়ি আবার জ্বলমল করছে।
একটা মেয়ে মাইক্রোফোন হাতে দাড়িয়ে গান ধরলো,
“তু যো রুঠা তো কন হাছেগা
তু যো ছুটা তো কন রাহেগা।
তু চুপ হে তো ইয়ে ডার লাগতা হে
আপানা মুঝকো আব কন কাহেগা।
তো হে ওয়াজা
তেরে বিনা বেওয়াজাহ
বেকার হু মেয়।
তেরা ইয়ার হু মেয়..
তেরা ইয়ার হু মেয়।”
অনু ছলছল চোখে ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে।বাড়ির সবাই স্তব্ধ ইতুকে দেখে।
ইতু হেসে বললো,”কিরে বিয়ে কনে একটা হাগ তো দিবি নাকি?”
অনু দৌড়ে এসে ইতুকে ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো।ইতুও হেসে চোখের কোন থেকে জল মুছে ফেললো।একে একে ইতুর সব বান্ধবী কাজিন এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
আবির আর ওর বন্ধুরা এখনো অবাক চোখে ইতুকে দেখে।সব থেকে বেশী অবাক হয়েছে আবির।আবির ইতুকে প্রথমে চিনতেই পারেনি।অয়ন ও হা করে তাকিয়ে আছে।শ্রাবণ শুধু মুচকি হাসছে।
অয়ন আবিরকে গুঁতো দিয়ে বললো,”দোস্ত এটা সেই মোটা ফ্রেম ওয়ালা,চুলে তেল দিয়ে দুই বেনী করে রাখা ইতু?আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।এই মেয়ে এতোটা পাল্টে গেলো? কি সুন্দর সবুজ একটা লেহেঙ্গা পড়েছে দেখ।এই মেয়ের চুল এতো লম্বা আর এতো সুন্দর! মেকাপ ও তো করেছে।হ্যাঁরে ভাই ইতু কোনোদিন মেকাপ করতো?আমার তো মাথা ঘুরছে।মেয়েটা এতো সুন্দর ছিলো আমাদের সামনেই ছিলো অথচ খেয়ালই করলাম না?
আবিরের বুকে ধুকপুক করছে।ইতুকে দেখে তো আগে কখনো এমন হয়নি।আবির ভালো করে ইতুকে পর্যবেক্ষণ করছে।ইতুকে এইভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয়।
ইতু সবার সাথে হাসি মঝা করছে কিন্তু আবিরের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।আবির না চাইতেও ইতুকে দেখে যাচ্ছে।অয়ন ও ইতুকে নিয়ে এটা সেটা বলে যাচ্ছে। আবিরের শুনতে একদম ভালো লাগছে না।বার বার মন খারাপ হচ্ছে।কেনো এমন হচ্ছে সে নিজেই বুঝতে পারছেনা।আবির মন প্রাণ দিয়ে চাইছে ইতু যেন একটিবার ওর দিকে ফিরে তাকায়।
শ্রাবণ এগিয়ে গিয়ে ইতুর পিছনে দাড়িয়ে বললো, “ইতু।”
শ্রাবণকে দেখে ইতু অবাক চোখে,”আরে শ্রাবণ ভাই কি অবস্থা?”
“চলছে।”
“ও মাই গড শ্রাবণ ভাই আপনি তো আরও হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন।কয়টা মেয়ে পটিয়েছেন?”
শ্রাবণ মাথা চুলকে মুচকি হেসে বললো,”একটা ও না।”
“তার মানে আমার চান্স আছে?”
কথাটা বলে ইতু চোখ টিপলো।
আবির আর অয়ন ওদের সব কথাই শুনতে পারছে।আবির ত বিশ্বাস করতে পারছেনা এইসব কথা ইতু বলছে।যে ইতু আবির ছাড়া কনো ছেলের সাথেই কথা বলতো না সেই ইতু এইসব বলছে!
অয়ন আবিরের হাত চেপে বললো, “মামা এটা আমাদের ইতু না। ওর জমজ বোন টোন হবে।এইসব কথা ইতু জীবনেও বলতে পারে না।তার ওপর মেয়েটা এখনো পর্যন্ত একবার ও তোর দিকে তাকিয়ে দেখলো না।ইতু হলে এতোক্ষণে তোর সাথে চিপকে থাকত।
মানুষ যখন কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন সে নিয়মটার পরিবর্তন ঘটলে মানুষ সহজে তা মেনে নিতে পারেনা।
আবির ও ইতুর এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না।
ইতুকে ওদের দিকে আসতে দেখে আবির সোজা হয়ে চুল ঠিক করতে লাগলো।ইতু ওদের পাশ কাটিয়ে আবিরের মায়ের কাছে চলে যেতে দেখে আবিরের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। ইতুর আচরণে অপমানিত বোধহয়।ঠোঁট কামড়ে লাল চোখে ইতুকে দেখতে থাকে।
” খুব ভাব হয়েছে না? আমাকে পাত্তাই দিলো না?দেখবো কতক্ষন কথা না বলে থাকতে পারিস।জানিতো একটু পারে ঠিক ছুটে আসবি।”
আবির মনে মনে কথাগুলো বলে বাকা হাসলো।
চলবে।।
(গল্প সম্পর্কে মতামত জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here