গল্পঃ বাক্সবন্দী চিঠি
লেখিকাঃ নিনিকা জামান নূর
পর্বঃ ২৭
কক্সবাজার থেকে ফিরে শুনে অহনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
ইতুর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে। অনু খুশিতে বকবক করেই যাচ্ছে। মেহেদিতে কি পড়বে, হলুদে কি পড়বে।
“জানিস ইতু অহনার বরটা এতো ভালো, অহনা বিয়ে করবে না শুনে বলেছে যখন অহনা রাজি হবে তখনই করবে বিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই অহনা বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলো। উফফ আরেকটা বিয়ে খাবো। এই ইতু আমি তোর পিংক বেনারসিটা পড়বো বিয়েতে।”
“এই থাম তো। কিসের বিয়ে? পাগল হয়ে গেলি? অহনা শ্রাবণ ভাইকে ভালোবাসে। হঠাৎ কি হলো যে বিয়েতে রাজি হয়ে গেলো?”
“কিহহহ? অহনা আর শ্রাবণ ভাই? কেমনে কি? ওরা প্রেম করছিলো? আর আমি জানি না? এইসব কখন হলো? এই ইতু তাহলে অহনা আরেকটা ছেলেকে কেনো বিয়ে করছে?”
অনুর এমন রিয়েক্ট করা দেখে ইতুর মাথায় হাত।
“আস্তে চিল্লা মা। পুরো শহর জানিয়ে দিবি তুই?”
অনু থতমত খেয়ে বললো, “ইয়ে মানে এইসব কবে হলো? আমাকে কিছু বলেনি কেন? তোরা সবাই জানিস?”
“আরে না। আমিও কক্সবাজার যাওয়ার আগে জানতে পেরেছি। ওইদিন রেস্টুরেন্টে শ্রাবণ ভাই এর হাত ধরে বসে ছিলো। পরে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন বলেছে ও ভালোবাসে কিন্তু শ্রাবণ ভাই নাকি এইসব এর মধ্যে নেই। এক তরফা বুঝলি।”
“শালা তোরা সবাই রূপে গুনে এতো এগিয়ে খালি এই ভালোবাসার বেলায় তোদের কেউ পাত্তা দেয় না।”
জোরে একটা চিমটি কাটলো অনুকে।
“আরে ব্যাথা পাচ্ছি তো।”
“বান্ধবি নামে কলঙ্ক তুই। এইভাবে বলতে পারলি?”
“আচ্ছা সরি। এখন বল কি করবি?”
“অহনার সাথে কথা বলতে হবে। কেন এমন করছে যানতে হবে। আমি চাই না ও কষ্ট পাক বা জোর করে একটা সম্পর্কে জড়াক।”
“তাহলে আজ বিকালেই চল। এখন রেস্ট নে কিছুক্ষণ।”
“ঠিক আছে যা। আর তোর ভাইকে বল তো একটু রুমে আসতে।”
“বাহ সবে তো এলি। কয়টা মিনিট ও বুঝি ভাইকে ছাড়া থাকতে পারছিস না?”
অনুর পিঠে কিল দিয়ে বললো,” দরকার ছিলো তাই বলেছি। রোম্যান্স করতে না। যা ভাগ।”
অনু খিলখিলিয়ে হেসে চলে গেলো।
ইতু ফ্রেস হয়ে এসে দেখে আবির বেডে বসে মোবাইল টিপছে।
ইতুকে বের হতে দেখে আবির জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে থাকলো।
ইতুর পরনে কালো থ্রি-পিস। গোসল করায় চোখে মুখে পানির ফোটা লেগে আছে। ইতুকে যেন আরো স্নিগ্ধ লাগছে।
আবির উঠে এসে ইতুকে এক ঝটকায় কাছে টেনে নিলো। প্রথমে কপালে চুমু দিয়ে গালে লেগে থাকা পানি চুষে নিতে লাগলো। আচমকা আক্রমণের শিকার হয়ে প্রতিরোধ করতে ভুলে গেলো। এক রাশ ভালোবাসা ঘিরে ধরলো তাকে। তার পুরুষালি গ্রান যেন তাকে আরো তীব্র ভাবে কাছে টানছে। ইতুর দিকে তাকিয়ে আবিরও যেন একটা ঘোরের মাঝে চলে গেলো। ইতুকে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো। শরীর যেন হাওয়ায় ভাসছে। ইতু নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে আবিরের উপর শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। আবির পরম যত্নে নিজের সাথে তাকে মিশিয়ে ধরে রাখলো। আবির বুঝতে পারছে ইতুর শরীর মৃধু কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবির তাকে আরো গভীর ভাবে স্পর্শ করতে নিলে ইতু তাকে থামিয়ে দিলো। আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার দিকে।
“কি হয়েছে? কনো সমস্যা?”
ইতু নিজেকে ধাতস্থ করে বললো, “আসলে তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা বলার জন্য ডেকে ছিলাম।”
আবির অতুর দিকে তাকিয়ে বুঝলো সিরিয়াস কিছু হয়েছে।
“এনি থিং হ্যাপেন্ড? আর ইউ ওকে?”
“আ’ম ফাইন আবির। কথাটা অহনা আর শ্রাবণ ভাইকে নিয়ে।”
আবিরের ভ্রু আরো কুঁচকে গেলো।
ইতু আবিরকে সব কিছু খুলে বললো।
“আমি চাই আজ অহনার বাসায় গিয়ে ওর সাথে কথা বলতে। কেনো নিজেকে এইভাবে কষ্ট দিতে চাচ্ছে। আর শ্রাবণ ভাই কি করে ওকে ফিরিয়ে দিতে পারে?”
শ্রাবণ এর ব্যাপর নিয়ে ইতুকে খুলে বলতে চেয়েও চুপ করে গেলো। ইতু ব্যাপারটা কিভাবে নিবে সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো। আপাতত এই ব্যাপার নিয়ে চুপ থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।
“কি হলো? কোথায় হারিয়ে গেলে? কিছু বলো।”
“হুম আমার ও মনে হয় তুমি গিয়ে একবার অহনার সাথে কথা বলে দেখ। আমিও শ্রাবণকে বুঝানোর চেষ্টা করবো।”
আবির আরেকটা ব্যাপার ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ে। অহনা কি যানে শ্রাবণ ইতুকে পছন্দ করে?
_____________________________________________
অহনার মা রুমে এসে দেখে অহনা রুম অন্ধকার করে বসে আছে। মিসেস শায়েলার আগমন বুঝেও অহনার কনো হেলদোল নেই। সে কাথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে। তিনি জানালার পর্দা সরিয়ে জানালাগুলো খুলে দিলেন।
অহনার চোখ মুখ কুঁচকে গেলো রুমে আলো দেখে।
“আম্মু প্লিজ এগুলো বন্ধ করো। আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। যাও এখান থেকে।”
“ঠাটিয়ে এক চড় মারবো। অসভ্যের মতো কথা বলছিস কেন? এই দিনের বেলায় রুম অন্ধকার করে ব্যার্থ প্রেমিকা সাজচ্ছো?”
“আম্মু।”
“একদম উঁচু গলায় কথা বলবা না। খুব তো বড় গলায় বলে বেরিয়েছিলে কনো এই বাড়ীতে ফিরবে না। তোমার প্রেমিক তোমাকে নিয়ে যাবে? সেই তো আবার এখানেই আসতে হলো।”
“কেন এসেছি বলে খুশি হও নি? তুমি বললে এখনি চলে যাবো।”
“কোথায় যাবে শুনি? ওই ছেলের মতো আরো অনেকেই আছে বুঝি?”
অহনা স্তব্ধ হ্যে গেলো তার মায়ের কথা শুনে। মা কি করে এমন কথা বলতে পারে। তার মায়ের এমন কথায় যেন মন শত টুকরো ভেঙে গেলো। শ্রাবণের দেয়া কষ্ট কি কম ছিলো এখন আবার এইসব শুনতে হচ্ছে তাকে।
চোখের জল ও শুকিয়ে এসেছে। কান্নাগুলো গলায় এসে আটকে গেছে। অহনা খুব করে চাচ্ছে চোখের জল ফেলে এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু নিষ্ঠুর চোখ দুটো ও আজ তার সাথে প্রতারণা করছে।
অহনার গলায় জোর নেই আর। কোন রকম ধীর গলায় বললো, “আমি আর নিতে পারছি না আম্মু প্লিজ চুপ করো।”
“তোমার আগে ভাবা উচিত ছিলো। এই কয়দিন তোমার কম তামাশা সহ্য করিনি। কি কমতি রেখেছিলাম? তাও দুই দিনের ছেলের জন্য এইভাবে সবার সামনে অপমান করে বেরিয়ে গেলে? তোমাকে যে এই বাসায় ডুকতে দিয়েছি এটাই তোমার জন্য অনেক। পেটে ধরেছি ফেলে তো দিতে পারি না। এমন অমানুষ এর মা যখন হয়েছি দ্বায়িত্ব পালন করতেই হবে। দয়া করে আর আমাদের মাথা নত করাবে না।”
মিসেস শায়েলা দপদপ পা ফেলে চলে গেলেন৷ রেখে গেলেন মনে মনে নিজের মৃত্যু কামনা করা অহনাকে।
বিকেলে ইতু আর অনু এলো অহনার সাথে দেখা করতে। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা খুললো না সে। অহনার মা এসে বকাবকি করে দরজার খুলতে বাধ্য করলো। মিসেস শায়েলা তাদের একা কথা বলতে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
“এমন করছিস কেন? কি হয়েছে তোর?”
ইতুর কথা কানে না তুলে অহনা অনুকে বললো, “প্লিজ চলে যা। এই ব্যাপারে কনো কথাই বলতি চাচ্ছি না। আমকে একা ছেড়ে দে তোরা।”
ইতু অহনার ইগনোর করাটা বুঝতে পারলেও তেমন কিছু ভাবলো না। অহনার হাত ধরে বললো,”কি হয়েছে আমাদের বল। আমরা সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করব।”
অহনা রেগে ইতুর হাত সরিয়ে দিলো। এতোক্ষণে জমিয়ে রাখা রাগ থেকে বললো,” কি সমাধান করবি তুই? আমার সমস্যাটাই হচ্ছিস তুই। তোর জন্য আজা শ্রাবণ আমাকে মেনে নিচ্ছে।”
ইতু আর অনু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে অহনার দিকে।
ইতু বুঝে উঠতে পারছে না এখানে সে জড়ালো কিভাবে? অবিশ্বাসের সাথে বললো, “আমি? আমি কি করেছি? শ্রাবণ এর না করার সাথে আমার কি সম্পর্ক? ”
“একদম ন্যাকা সাজবি না। সব সময় শ্রাবণ এর সাথে কথা বলে তার সাথে মিষ্টি মিষ্টি করে নিজের দিকে টেনেছিস। শ্রাবণ তোকে ভালোবাসে দেখে আমার ভালোবাসা গ্রহণ করতে পারছে না। সব কিছু হয়েছে শুধু তোর জন্য। তুই তো আবির ভাইকে ভালোবাসতি তাহলে কেন আমার শ্রাবণকে নিয়ে পড়ে ছিলি?”
ইতু নিজের কানকে ও বিশ্বাস করতে পারছে না। অহনার এমন ব্যবহার আর শ্রাবণ তাকে ভালোবাসে জেনে ইতুর লজ্জায় অপমানে শরীর কেঁপে যাচ্ছে।
“পাগলের মতো কথা বলসি না অহনা। তুই ইতুর সাথে এইভাবে কথা বলছিস কেন? তুই যানিস না ইতু শুধু ভাইকে ভালোবাসে। শ্রাবণ ভাই ওকে ভালোবাসলে এখানে ওর দোষ কোথায়? আমারা সবাই শ্রাবণ ভাইর সাথে কথা বলতাম ইতু একা না। তুই ও কম মিষ্টি কথা বলতি না। সব থেকে বেশি তুই বলতি। তাহলে শ্রাবণ ভাই তোকে ভালো না বেসে ইতুকে কেনো বাসলো? কার কখন কাকে ভালো লেগে যায় সেটা তো আমারা বলতে পারি না। সেখানে কারোর হাত নেই। শ্রাবণ ভাই ওকে ভালোবেসে থাকে সেখানে তো ইতুর দোষ নেই। ওর সাথে এইভাবে কথা বলার মানেই হয় না।”
অহনা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ইতুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
“আ’ম সরি ইতু। আমার মাথা ঠিক নেই। আমি সত্যি এইসব বলতে চাইনি। শ্রাবণের প্রত্যাখ্যান, আব্বু- আম্মুর এমন ব্যবহার আমি আর নিতে পারছিলাম না। কেউ আমাকে বুঝতেই পারছে না। তারা কি করে আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে ঠিক করলো। একবার জিজ্ঞেস করলো না আমাকে আমি কি চাই। শ্রাবণ ও বুঝলো না আমাকে। সবার কাছে আমি এতোই মূল্যহীন? কেন এতো কষ্ট হচ্ছে ইতু। আমি শ্রাবণ ছাড়া অন্য কাউকে কি করে মেনে নিবো। সে স্কুল থেকে আমি তাকে পছন্দ করে এসেছি। তার পর সেটা কিভাবে যেন ভালোবাসায় রূপ নিয়ে নিলো। তাকে মনের কথা জানাতে বড্ড দেরি করে ফেলছি। তার মনের কোথাও আমি জায়গা করে নিতে পারিনি। আমি আর এইভাবে বাঁচতে পারবো না ইতু। সে আমার হবে না ভাবলেই যে আমার দম ফুরিয়ে আসে। আবার কি নতুন করে ভালোবাসা যায় না বল?”
ইতু কি বলে শান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। অহনার এমন কান্না দেখে দুইজনের চোখে পানি চলে এসেছে।
অনু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। আমারা তোর বাবা মা কে বুঝাবো। শ্রাবণ ভাইর সাথেও কথা বলবো।”
ইতু বললো, দরকার পড়লে শ্রাবণ ভাইকে কিডন্যাপ করে তোর কাছে নিয়ে আসবো তাও এইভাবে কাদিস না।”
অহনার কষ্ট হচ্ছে তাও ইতুর বলা কথায় হেসে উঠলো।
“এইভাবে হাসবি। দেখবি সব ঠিক করে দিবো আমরা।”
সব ঠিক হবে কিনা যানে না কিন্তু ইতুর কথা মনে একটু আশা জাগলো অহনার।
“অনু তুই ওর পাশে বস আমি আন্টির সাথে কিথা বলে আসি।”
“যা আছি আমি।”
অহনার ইতুর হাত ধররে বললো, “পারবি তো?”
“চেষ্টা যে করতেই হবে।”
চলবে।গল্পঃ বাক্সবন্দী চিঠি
লেখিকাঃ নিনিকা জামান নূর
পর্বঃ ২৮
আকাশের লাল নীল কালিমা ছড়িয়ে পড়তেই রাস্তার ধারে একে একে সোডিয়ামের আলো জ্বলে উঠলো। ব্যস্ত শরের সবাই নিজেতেই মত্ত। ছোট ছোট পথ শিশুরা দল বেধে বোধ হয় নিজ ঠিকানায় ফিরছে। দুজন কপোত-কপোতী তাদের কোলে বাচ্চা নিয়ে হেটে চললো। কুহু এক দৃষ্টিতে বাইরের জগতেই হারিয়ে যাচ্ছে। ভাবতে লাগলো তার জীবন নিয়ে। সাজানো গুছানো একটা সংসার হতে পারতো। এইভাবে তার বাচ্চা নিয়ে হেসে খেলে জীবন পার করে দিতে পারতো। নিজের হাতেই সব নষ্ট করেছে। আবির যখন তার জন্য পাগল ছিল তখন তার থেকেও বড় ঘর এর প্রস্তাব আসে। টাকার লোভে আবিরকে মিথ্যা বলে দূরে সরে আসে। সেদিন আবির কত আকুতি মিনতি করেছিলো সে কানে তুলে নি। অথচ এই মুহুর্তে আবিরকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া তার গতি নেই। ইতু সংসার ভেঙে তার সংসার গড়তে হবে। তার অনাগত সন্তানকে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দিতে হবে। আর সেটা আবির ছাড়া আর কেউ পারবে না।
মাঝে মাঝে তার নিজের কপাল দেখে হাসি পায়। কি ছিলো না তার? কখনো অভাবের মুখ দেখে নি। স্কুল কলেজেও ছিলো ড্রিম গার্ল। আর এখন সবার কাঁধে বোঝা সে। সময় কিভাবে যেন সব পাল্টে দেয়। অতিতের কাজগুলো বড্ড ভাবায় তাকে।
কারো গলার আওয়াজে কুহুর ধ্যান ভাঙ্গে। আদিত্য বসে আছে তার সামনে। এই ছেলেটাও অদ্ভুত লাগে তার৷ একদিন হঠাৎ করে তার সাথে কাজ করতে বললো। তার লাভ সে ইতুকে পাবে আর কুহু আবিরকে। এতে করে সে ইতুকে কষ্ট দিতেও রাজি।মানুষ যতই মুখে ভালোবাসি ভালোবাসি বলুক দিন শেষে নিজের ভালো থাকাটাই মূখ্য। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না। সবাই নিজের স্বার্থেই বিপরীত মানুষটাকে চায়। ভালোবাসার পেছনে স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। নিজে ভালো থাকার স্বার্থ।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো কুহুর দিকে।
“এই যে মিস? কোথায় হারিয়ে গেলেন? আসার পর থেকেই দেখছি ধ্যানে বসেছেন মনে হয়।?”
কুহু হাসলো। যে হাসি কিছু সেকেন্ডই মুখে থাকলো তার। আবার গম্ভীর মুখে বললো,” যা বলতে এসেছেন তাই বলুন কাজের কথা ছাড়া আপনার সাথে বাড়তি কথা বলতে ইচ্ছুক নই।”
আদিত্য গা ছাড়া দিয়ে বসলো। তাচ্ছিল্য ভাবে হাসি দিয়ে বললো,”এই এটিটিউড কাকে দেখাচ্ছো বলোত? তুমি কি ভেবেছো তোমার ব্যাপারে খোঁজ না নিয়ে ডিল করেছি? সবই জানি আমি। তোমার অতিত একবারেই বলে দিতে পারবো আমি। তাই আমার সামনে একদম সতি সাজতে এসো না। টাকা ফেললে যে কারোরই কোলে চড়ে যাবে সেটা খুব ভালো করেই জানা আছে আমার।”
কুহুর অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেলো।
“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট আদিত্য। তুমি কি ভাবো আমি রাস্তার মেয়ে? টাকা দিলেই আমার যার তার কাছে চলে যাবো?”
“আমি কিছুই বলছি না তুমিই বলছো।”
“শাট আপ আদিত্য। একদম বাজে কথা বলবে না। কোন সাহসে তুমি আমাকে অপমান করছো? ভুলে যেও না আমি তোমার কাছে যাইনি তুমি আমার কাছে এসেছো। নিজেকে কি ভাবো? তুমি মহান? ইতুর বিরুদ্ধে প্ল্যান করে তাকে পেতে চাচ্ছো তার জন্য যাই ইচ্ছা তাই করবে৷ তাকে কষ্ট দিতে বিন্দু মাত্র চিন্তা করবে না। সেখানে একবার নিজের দিকে তাকাও তারপর অন্যের গায়ে কাদা ছিটাতে এসো।
আদিত্য সোজা হয়ে বসে বললো, ” কুল ডাউন মিস কুহু। এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো? আরে আমি তো এমনিতেই বলে ফেলেছি। একটু মেজাজ চটে ছিলো তাই ”
কুহু কাঠ কাঠ গলায় বললো,”ইউ ব্যাটার সে সরি টু মি।”
আদিত্যর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।
“মিস কুহু একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”
“বেশি তো আপনি করেছেন। আমাকে আজেবাজে কথা বলার আগে ভাবা উচিত ছিলো।”
আদিত্য বুঝলো এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কুহুকে তার প্রয়োজন এখন। তার এক মাত্র হোপ সে। কুহু হাত ছাড়া হয়ে গেলে ইতুও হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
আদিত্য নিজেকে বুঝিয়ে থেমে থেমে বললো, “স..রি।”
কুহু মনে মনে হাসলেও আর কথা বাড়ালো না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে। অয়নটাও আজ কাল কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। কিছু সন্দেহ করেছে কিনা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।
আদিত্য কুহুর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো।
কুহু ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্যাকেটার দিকে। কাগজের ছোট একটা প্যাকেট।
আদিত্য কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললো,” ইতু আজ তার বান্ধবির বাসায় গেছে। ফিরতেও দেরি হবে এই সময়ের মধ্যে তোমাকে কাজ সারতে হবে।”
“কাজ সারতে হবে মানে? আজই করতে হবে?”
আদিত্য বিরক্তি নিয়ে বললো” আমি আর দেরি করতে চাচ্ছি না। ইতু আজ বাসায় নেই এমন চান্স আমরা আর পাবো না।”
কুহু ভাবনায় পড়ে গেলো। একটু নার্ভাসও লাগছে। সব কিছু তার কাজের উপরই নির্ভর করছে।
“প্যাকেটা নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়। ”
কুহু দীর্ঘঃশ্বাস নিয়ে উঠে দাড়ালো। আদিত্য চোখ টিপে বললো,” বেস্ট অফ লাক।”
কুহুর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। ভালোয় ভালোয় কাজ হয়ে গেলে এই ছেলের ছায়াও মাড়াবে না।
।।
ইতু অহনার মায়ের সাথে কিচেনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। “আন্টি আপনি কি অহনার কষ্ট টা দেখতে পারছেন না? মেয়েটা একা একা যন্ত্রণা সহ্য করছে। আপনি তো মা আপনি কিভাবে পারছেন ওর কষ্ট দেখে যেতে? ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে ও কখনোই সুখে থাকতে পারবে না। আপনি মা হয়ে আপনার মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে পারবেন? আপনি আংকেল কে কেনো বুঝাচ্ছেন না?”
মিসেস শায়েলা নুডুলস ভাজতে ভাজতে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে৷ ইতু অনেক্ষন ধরে বুঝিয়ে চুপ করে গেলো। মিসেস শায়েলার মুখ দেখে কিছুই বুঝতে পারছে না। এক ধ্যানে কাজে ব্যাস্ত তিনি যেন কিছুই শুনতে পাননি।
ইতু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে চাইলো। অহনার কান্না মাখা মুখ চোখে ভেসে ওঠায় আবার কিছু বলতে নিলে মিসেস শায়েলা ইতুর দিকে তাকান।
” অহনা ছিলো প্রিমেচিউর বেবি। ও হওয়ার পর আমাদের সব মনোযোগ ওর দিকে চলে যায়। আমার আরো একটা বেবি ছিলো। আমার পাঁচ বছরের রনক। প্রিমেচিউর বেবি বলে অহনাকে খুব সর্তক্তার সাথে লালন পালন করেছি। অহনার বাবা আর আমার একটাই চিন্তা ছিলো তখন কিভাবে অহনাকে সুস্থ করে তোলা যায়। এতো চিন্তার মধ্যে আমার ছোট্ট ছেলেটার কথা খেয়ালই থাকতো না। আমার কাছে একটু আদর যত্ন চাইতো। আমি তাকে অবহেলা করতাম। ওর খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর দিতে পারতাম না। অহনাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতাম। আমার ছেলেটা একা একা দিন কাটাতো। শেষ যখন দেখেছিলাম বুকে হাড্ডি সব দেখা যাচ্ছিলো। কেমন শুকিয়ে গিয়েছিলো। আগে কখনো খেয়াল করিনি।
সেদিন হঠাৎ অহনার খিচুনি উঠে৷ আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। অহনার বাবাও বাসায় ছিলো না। এদিকে রনক বার বার জ্বালিয়ে যাচ্ছিলো তার ভালো লাগছিলো না বলে৷ অহনার খিচুনি আর রনকের কান্নায় আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।
আমার পাঁচ বছরের ছোট রনকে চ/ড় মে/রে বলেছিলাম আমার একটু শান্তি দিতে৷ ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো সামনে থেকে। আমি অহনাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলাম। ছেলেটাকে একা বাসায় রেখে।
ফিরে এসে দেখি রনকের কোনো সাড়াশব্দ নেই। খুঁজতে গিয়ে দেখি একটা রুমে চুপটি করে ঘুমিয়ে আছে। সে ঘুম আর কোনোদিন ভাঙ্গেনি। ছেলেটার ম্যালেরিয়া হয়ে ম/রে গেলো আমার চোখের সামনে। আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। মা হিসেবে আমি ব্যার্থ হয়েছিলাম।”
ইতু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অহনার একটা ভাই ছিলো সেটা যানতো না কোনদিন। তার চোখেও পানি টলমল করছে রনকের কথা ভেবে। পাঁচ বছরের ছোট বাচ্চা বাবা মায়ের আদর ছাড়াই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো।
মিসেস শায়েলা মুখে আঁচল চেপে কেঁদে যাচ্ছেন।
ইতু কি বলে শান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। মিসেস শায়েলা সময় নিয়ে আবার বললেন,” সেদিন সবাই এই তকমা দিয়ে যায় ব্যার্থ মা আমি। কেউ কিন্তু কোনো দিন বলেনি অহনার বাবা একজন ব্যার্থ বাবা। অহনার বাবা চাইলে পারতেন রনকের প্রতি খেয়াল রাখতে। কিন্তু কেউ তাকে কিছুই বলেনি। একদিকে সন্তান হারানো যন্ত্রণা অন্য দিকে অসুস্থ সন্তান। সব একা একা ভুগতে লাগলাম। মানসিকভাবে ভাঙে পড়লাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম সব অহনার দোষ। এই মেয়েটা না আসলে আমার রনকটা অকালে আমাকে ছেড়ে যেতো না। কতবার ওকেও গলা টি/পে মা/র/তে চেয়েছি তার হিসেব নেই। অহনার বাবার চোখে পড়ে যেতো মাঝে মাঝে মায়ের টান থেকে পারতাম না। আমার উপর নজর রাখার জন্য গ্রাম থেকে শ্বাশুড়ি এসে থাকতে শুরু করলো।
আমার পাগলামি দেখে অহনার বাবা ঠিক করলেন আমাকে তিনি ছেড়ে দিবেন। শ্বাশুড়ি তার ভাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করলেন। তিনিও রাজি ছিলেন। পাগল বউ নিয়ে তিনি তো আর সারাজীবন সংসার করতে পারবেন না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বাবার বাড়ীতেও যে আমার ঠাই হবে না। সে সময় ছাড়াছাড়ি ব্যাপারটা ছিলো খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। সমাজে সে মেয়েকে অন্যচোখে দেখতো সবাই।
যে করেই হোক এই সংসারের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে।
আমি শুরু করলাম স্বামীর মন জয় করার যুদ্ধ। তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম। একটা সুযোগ দিয়ে ছিলেন তিনি। তার পর থেকে তার প্রতিটি কথা আমার জন্য শেষ কথা।
আজ এতো বছর পরও সংসার হারানোর ভয়ে বেঁচে আছি। সাথে কোথাও না কোথাও রনকে হারানোর দোষটাও অহনার প্রতি অবহেলা করতাম।
মেয়েটা এইভাবে কষ্ট পাচ্ছে দেখে নিজের বিবেকে প্রশ্ন করি আমি কি আধো মা হতে পেরেছি? বহুকাল আগে দে তকমাটা আমি পেয়েছিলাম সেটা কি সত্যি নয়?”