#বাগান_বিলাস
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ অন্তিম পর্ব
“স্মৃতির বিয়ে হওয়ার আগে কেন, আমার মরণ হলো না?
তুই হয়তো বলবি এতটাও কেউ ভালোবাসতে পারে?
আমি বলবো পারে, আমার ছেলে পারে। শৌখিন পারে ঠিক এমন গভীরভাবে ভালোবাসতে। যা অন্যরা পারে না তাই শৌখিন পারে। ”
স্মৃতি নিরবে সব শুনতে লাগল। কথাগুলো তার খুব মনে ধরেছে সত্যিই শৌখিন তাকে এত ভালোবাসে? কিন্তু সে কি শৌখিনের যোগ্য?
শৌখিনের এমন গভীরতম ভালোবাসার দাম কি সে দিতে পারবে?
–” আন্টি আমি তো বিধবা, আমি কি শৌখিনের যোগ্য?”
–” মা জগতে অনেক কিছু ঘটে, ভালো মন্দ সব কিছুই ঘটে আমাদের সাথে। তোর জীবনে ও তার ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি, তোর এই জীবনের জন্য তোর তো দোষ নেই এটা তোর ভাগ্যে লেখা ছিল। কিছু কিছু জিনিস থাকে যা আমাদের ভাগ্যে লেখা থাকে তা একদমই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হয়ে যায়। এই যে শৌখিন আর তোর বিষয়টা দেখ!
আজ শৌখিনের সঙ্গে তোর সম্পর্কটা ঠিক হলো ঠিকই কিন্তু অনেক পরে। এটা বিধাতার লেখন!”
–” জানিস আমার না অনেক শখ ছিল তোকেই যেন আমার ছেলের বউ করে আনতে পারি। আমি চাইতাম ও সব সময় কিন্তু হঠাৎ এমন কিছু হয়েযাবে আমি ভাবতে পারিনি রে মা। আমার কাছে এখনও কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে আমার ছেলেটা তাহলে তার ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েই গেল?”
স্মৃতি নিজেও খানিকটা অবাক হয়েগেল এতটা সহজ ভাবে জীবনে সব কিছু পাওয়া যায়?
স্মৃতির সঙ্গে কথা বলে স্মৃতিকে নিয়ে শৌখিনের সামনে বসিয়ে দিলেন সুরাইয়া বেগম। স্মৃতির চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখল শৌখিন ও তারদিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা লজ্জায় পরে সে মাথাটা নিচু করে ফেলল।
শৌখিন বর্ষাকে নিয়ে বসে রয়েছে তার ও কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছে আজ সঙ্গে ভালোলাগা ও বটে। স্মৃতির মা খুশি মনেই সব মেনে নিয়েছেন, তার মেয়েটা সুখে থাকুক তিনি তাই চাইছেন আজ। ছেলের জন্ম কোথায়, কি হয়েছে এসব জেনে কি করবেন তিনি? ছেলেটার জন্মের হয়তো ঠিক নেই কিন্তু ছেলেটা তো ভালো। যে পরিবারে বড় হয়েছে সেই পরিভারে মানুষরা তো ভালো। স্মৃতির মা সবটা জেনেশুনে খুশী মনেই মেয়ের বিয়েতে রাজি হয়েছেন। শেষ চাওয়া মেয়েটা যেন সুখেই থাকুক একটু খানি!
সন্ধ্যে বেলায় সুপ্তির বাবা সুপ্তির মামার সঙ্গে ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত, সুপ্তির কানাডা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েগেছে।
এইতো মেয়েটা সেদিন এইচএসসি দিয়ে বের হলো রেজাল্ট ও বের হয়েগেছে আর আজই কিনা তার শুনতে হলো তাকে দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভূইয়ে পাড়ি দিতে হবে।
সুপ্তি বাবার দিকে করুণ চোখে চেয়ে আছে। বাবার কাছ থেকে আজ একমাস ধরে শুনে আসছে সে তাকে দেশ ছেড়ে চলেযেতে হবে। অতটা সিরিয়াস ভাবে ভাবেনি সুপ্তি কারন তার মনে হয়েছিল বাবা তার সঙ্গে এমনি বলছে।
কিন্তু আজ বাবা নিজেই তাকে ডেকে বললেন –
–” মামানি, তোমার কানাডা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েগেছে।
তোমার আশফাক মামা বলেছেন সবঠিক হয়েগেছে তোমার থাকার ব্যবস্থা সে করেছে।”
–” থাকার ব্যবস্থা মানি? ভিসা? আমার যাবতীয় কাগজ পত্র?”
–“ওগুলো সব আমি তৈরী করেছি মা!”
–” তুমি এতকিছু কখন তৈরী করেছো বাবা?”
–” দেখ সুপ্তি তুমি আমাদের একমাত্র মেয়ে তোমার ভালো মন্দ সবকিছু আমাদের যাচাই করা আমাদের উচিৎ। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে কানাডায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দেব। তাই আগেই সব ঘুছিয়ে রেখেছি। ”
–” বাবা, তুমি আমাকে না জানিয়ে সব করলে? আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলে না?”
–” সব কথা জানানোর প্রয়োজন বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া তোমার বয়সটা ও কম, আমি যা ভেবেছি তাই তোমার জন্য মঙ্গল!”
সুপ্তি ছলছল চোখ নিয়ে বাবার সামনে থেকে সরেগেল। এই জিনিসটা অন্তত সে বাবার কাছ থেকে আশা করেনি সে। রুমের ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে বসে পরল সে খুব কষ্ট হচ্ছে তার নিশ্বাস নিতে। শৌখিনকে ছাড়া সে কিভাবে থাকবে? তার যে মনে অনেক কথা জমে আছে।ঐ কথাগুলো কিভাবে তাকে বলবে সে? তার যে বলা হলো না শৌখিন ভাই আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি!
খুব অভিমান হলো বাবার উপর এমনটা না করলেও পারতো বাবা, কেন তাকে না জানিয়ে এমন সিদ্বান্ত নিল?”
_____________________________________
–“আপা একটা কথা শুনছেননি?”
–” কি কথা ময়না?”
–” শৌখিন ভাই আছে না? শৌখিন ভাই বিয়া করছে!”
–” শৌখিন বিয়ে করেছে? কখন?”
–” কালকে রাতে বিয়া পরাইয়া দিছে, সাদিক সাবের মাইয়া কি জানি নাম স্মৃতি ওর সঙ্গে বিয়া হইছে।”
সুপ্তির মা হঠাৎ এই কথা শুনবেন কল্পনা ও করেননি। তিনি তো চেয়েছিলেন সুপ্তিকে কোনভাবে কানাডায় পাঠিয়ে দিতে। আর আজ কিনা এইভাবে শৌখিনের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েটাকে তিনি কিভাবে সামলাবেন?
সুপ্তির হঠাৎ কানাডা যাওয়া তারপর আবার ভালোবাসার মানুষের বিয়ে দেখা যে তাদের জন্য ও কষ্টের।
ভাবতে ভাবতেই দেখলেন সুপ্তি তার পিছনে দাড়িয়ে আছে মুখটা কেমন মলিন হয়েগেছে। চোখ জোড়ায় পানিগুলো টলটল করছে। ভিষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে তার তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন।
কি জবাব দিবেন? কি বা বলবেন?
সেদিন সুপ্তি শৌখিনের কাছে শেষবার দেখা করতে গিয়েছিল। দেখেছিল এক উজ্জলতা হারানো প্রেমিক পুরুষের মুখে জ্বলজ্বল করা হাসি। ভালোবাসার মানুষকে চিরদিনের জন্য কাছে পাওয়ার যে আনন্দ সেই আনন্দটা শৌখিনের মুখে দেখা যাচ্ছে। সুপ্তি স্মৃতির দিকে একবার তাকালো কি ভাগ্য তার! বিয়ে হয়েছে সংসার করল, সেই সংসারে তার স্বামী ও মারা গেল আবার কাক তালীয় ভাবে প্রাক্তনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে ও গেল। এমন সৌভাগ্য কজনের হয়? সুপ্তির মনে একটু হিংসে লাগল পরক্ষনেই হিংসেটাকে আর জ্বলতে দিল না সে। শৌখিনের কাছে গিয়ে দাড়ালো বলল-.
–” না জানিয়ে বিয়ে করে নিলেন, এটা ঠিক করলেন না ভাইয়া!”
–” এ আর কি বিয়ে! বিয়ের অনুষ্ঠান এখনও বাকী! ও কি মানে? যা ঘাড় বাকাঁ ছেলে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান পরে করবে আগে বিয়ে পরিয়ে স্মৃতিকে সে ঘরে তুলবে।
সামনের মাসে এক তারিখে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে বড় করে।”
সুপ্তি শৌখিনের মা সুরাইয়া বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন একটা হাসি দিল।
–” তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান মনে হয় আমার দেখা হবে না,”
–” কেন?” শৌখিন প্রশ্ন করে উঠল।
–” আমি কানাডা চলে যাচ্ছি,”
–” মানি?”
–” কানাডায় বাবা আমাকে পড়াশুনার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন, এই মাসের বিশ তারিখ আমার ফ্লাইট!”
–” কিন্তু আমাদের তো কিছু বললি না কখন কি হলো।”
–” আমি নিজেও জানিনা, প্রথমে বাবার উপর রাগ হয়েছিল খুব, এখন বিষয়টা আমার কাছে আর রাগ লাগছে না। এই কাজটাও বাবা আমার জন্য খুব ভালো করেছেন। ”
সুরাইয়া বেগম বা শৌখিন কেউই বুঝতে পারল না সুপ্তির কথাটা। সুপ্তি তাদের সঙ্গে দেখা করে চলে এলো।
শৌখিন আর স্মৃতি বসেছে বিছানার উপর। শৌখিন বর্ষার সঙ্গে দুষ্টুমি করতে ব্যস্ত। এর মাঝেই স্মৃতির দিকে একবার তাকিয়ে বলল-
–” বর্ষা নামটা বেশ দারুন!”
–” হুম, বর্ষণের নামে মিলিয়ে রেখেছে।”
–” ওহ, হুম খুব সুন্দর নাম!”
কথার মাঝেই সুরাইয়া বেগম এসে বর্ষাকে ডেকে বললেন
–” বর্ষা দাদুমনি আসোতো আমার কাছে, আজ তুমি আর আমি গল্প করবো কেমন!” বর্ষা দুটো জুটি ঝুলিয়ে হেলেদুলে চলেগেল তার সাথে।
শৌখিন দরজাটা লাগিয়ে খাটের উপর বসলো। স্মৃতি আবারও মাথাটা নিচু করে রইল। কিছুক্ষণ নিরবতার পর স্মৃতি বলল-
–” শৌখিন একটা কথা বলবো?”
–” কি?”
–” আমার মত বিধবা মেয়েকে বিয়ে করার খুব কি প্রয়োজন ছিল? আমি বর্ষণের মৃত্যর জন্য দায়ী, বর্ষণ ও জানো খুব ভালোবাসতো। ভালোবাসতো বলেই তো ও দূরে চলেগেল খুব তাড়াতাড়ি। তুমি না কখনও আমাকে এত ভালোবেসোনা! আমার এত ভালোবাসা ভালো লাগে না।
খুব করে চাই তোমাকে, আমি বড্ড একা শৌখিন। বড্ড একা, বর্ষণের সঙ্গে বিয়ের পর আমার জীবনটা বেশ কিছুদিন রঙ্গবিহীন থাকলে ও মানুষটা খুব রঙ্গিন ছিল।
তুমি আমার উপর রেগে নেই তো শৌখিন? আমি তোমার কথা রাখতে পারিনি বলে, বাবার কথামতো বিয়ে করে নেওয়ায়?”
–” না, এতে তোমার কোন দোষ নেই স্মৃতি, আমাদের ভাগ্যেই লেখা ছিল। দেখো না আজ এত বছর পর আবার আমাদের মিলন হলো!”
শৌখিন স্মৃতির হাত জোড়ায় চুমু দিয়ে বলে উঠলো –
–” ভিষণ ভালোবাসি তোমাকে, সব সময় এভাবে কাছে থেকো প্রিয়তমা!” স্মৃতি শৌখিনের বুকে মাথা রাখল ঝড় উঠা বুকটায় অনেকদিন পর যেন শান্ত হলো তার।
বুকের ভিতর জ্বলে উঠা আগুনটা নিভে গেলো একদম!
মিলন দুজন ভালোবাসার মানুষের!
এয়ারপোর্টে দাড়িয়ে আছে সুপ্তি । সঙ্গে তার বাবা আর মা, সুপ্তির মায়ের চোখ দিয়ে পানি পরছে। সুপ্তির বাবা ও কাদছেন সুপ্তি হেসে বলল-
–” কাদছো কেন বাবা?”
–” মা আমাকে ক্ষমা করে দে!”
–” ছি! ছি! বাবা এই কথা বলো না, তোমাদের কারোর উপর আমি রেগে নেই। তোমরা যা করেছো আমার মঙ্গলের স্বার্থে করেছো। আমি রেগে নেই, আমার জীবনটা তোমরা রাঙ্গাতেই চেষ্টা করেছো। ”
–” মা তুই কষ্ট পাবি না তো? তুই সেই কথাগুলো মনে রাখবি না। সব ভুলে যা মা। তোর জীবনটাকে ঘুছিয়ে নে মা।” সুপ্তি মাকে জড়িয়ে ধরে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
–” তোমাদের উপর আমার কোন রাগ নেই বাবা। ”
ফ্লাইট এনাউন্স হচ্ছে সুপ্তির, যাবার সময় হয়ে এলো তার। যাওয়ার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কয়েকবার বাহিরে এলোমেলো তাকিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরে চলেগেলো সে।
কেটেগেল চারটি বছর। স্মৃতির আর শৌখিনের সংসার আজ সুখেই কাটছে। একটি মেয়ের পর আবার তাদের সংসারে আরেকটি মেয়ে হয়েছে। বর্ষার নামের সাথে মিলিয়ে মেঘলা রেখেছে। সুখেই আছে দুজনে বেশ দুই মেয়ে নিয়ে।
_____________________________
ভালোবাসা কি জানো?
– তোমার দেওয়া একটি শুভ্র গোলাপফুল ছিল!
যা আমি আজও লুকিয়ে রেখেছি
ডায়েরির পাতায় শুকনো অবস্থায়!
ভালোবাসা কি জানো?
– তোমার কন্ঠের যাদুকরী সেই সুর
যে সুর একমুহূর্ত না শুনলে আমার হৃদয়
যেন আকুল হয়ে রয়, সেই কন্ঠ শুনবে বলে!
ভালোবাসা কি জানো?
– তোমার দেওয়া একমুঠো চুড়ি,
যা আজও আমি লুকিয়ে রেখেছি সবার থেকে,
যেন কেউ না ভেঙ্গে ফেলে তোমার স্মৃতি!
ভালোবাসা কি জানো?
– তোমায় আমি এতটাই ভালোবাসি
যে তোমায় হারানোর ভয়ে
হৃদয় আমার এখনও অবধি কেপেঁ উঠে!
ভালোবাসা কি জানো?
-তোমার হাসি মুখখানা একবার না দেখলেই
আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ যেন
আরও বেশি বেড়ে যায়!
ভালোবাসা কি জানো?
-জীবন বাতির সব তেল যখন ফুরিয়ে যায়,
সেই মুহূর্তে ও একবার প্রাণপ্রিয়ের
মুখটা যেন দেখতে পাই!
ভালোবাসা কি জানো?[কবিতা]
~তামান্না~
ডায়েরীর পাতায় আবেগ আর স্মৃতির সঙ্গে মিশিয়ে রাতের আধারে লেখছে মেয়েটি! ঐ চাদ সাক্ষী, সাক্ষী নিরব নিস্তব্ধ রাত্রী! সাক্ষী ঐ বাগান বিলাস গাছ যে গাছের থেকে শুরু হয়েছে প্রথম অনূভুতি!কেউ দেখেনি মেয়েটির গড়িয়ে পরা চোখের জল। সময় পেরিয়ে যায়, দিন থেকে মাস, বছর গড়িয়ে যায় সময়ের কাটা ও ফুরিয়ে যায়। ফুরায় না ব্যার্থ প্রেমিকার চোখের জল। আজও রাতের আধারে ব্যার্থ প্রমিকার চোখের জলে ডায়েরি ভিজে উঠে পাতায় পাতায়। চোখের পানিগুলোকে মুছে একপলক বাইরে তাকালো সুপ্তি। তীব্র শীতের রাত! তুষারে ছেয়েগেছে পুরো শহর। সুপ্তি চোখের পানি মুছে বলল-
–” আবারো হবে বসন্তের আগমণ, আবারো সূচনা হবে নব প্রেমের জাগরণ কিন্তু বসন্তের সেই #বাগান_বিলাস ময় প্রেম আর হবে না!
____________ সমাপ্ত_____________