বাদলা দিনের কৃষ্ণচূড়া পর্ব -০৭

#বাদলা_দিনের_কৃষ্ণচূড়া❤️
#লেখনীতে:সারা মেহেক

সুহানা ও বাচ্চাগুলো আম কুড়ানোয় মশগুল। তাদেরই এ কাজটি অতি আশ্চর্যের সহিত পর্যবেক্ষণ করছে নাজ। দৃশ্যটি অন্যরকম এবং দেখতেও ভীষণ ভালো লাগছে। জন্ম হতে শহরে বেড়ে উঠা নাজ আজই প্রথম আম কুড়ানোর দৃশ্য সচক্ষে দেখছে। এর পূর্বে ‘আম কুড়ানো’ শব্দজুগলের সাথে মাত্র বইয়ের পাতাতেই পরিচয় হয়েছে তার।
বৃষ্টির গতি পূর্বের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। এদিকে তুমুল বর্ষণের ফলে ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে সুহানা ও নাজ। সুহানার পরনের সালোয়ার কামিজ তার শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। ফলে তার শরীরের ভাঁজ অস্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে এ মুহূর্তে মনের সুখে আম কুড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু তার এ ফিনফিনে পোশাকের দিকে অজান্তেই নাজের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো। মুহূর্তেই সে নিজেকে সংযত করলো। অজান্তে হওয়া এ কাজে দু চোখ বুজে সে নিজেই নিজেকে বেশ করে বকাঝকা করলো।

খানিক বাদে নাজ তার পরনের ভিজে জবজবে পোশাকের ফলে শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো। কটকট করে তার দাঁতের সাথে দাঁত বাড়ি খেতে লাগলো এবং এ বাড়ি যেনো গুণিতক হারে বাড়লো। তার এ ঠকঠক, কটকট শব্দে সুহানা খানিক বিরক্ত হলো। আম কুড়ানোর মাঝে নাজের দিকে বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বললো,
” এভাবে কার্টুনের মতো কাঁপছেন কেনো?”

নাজ কোনো রকমে দাঁতের বাড়ি কিছুটা থামিয়ে বললো,
” শশ-শীত করছে। খু-খুব শীত করছে।”

নাজের হেন কথার ধরণে সুহানা ও বাচ্চাগুলো একযোগে হেসে উঠলো। তন্মধ্যে দশ/ বারো বছরের একটি ছেলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো,
” বৃষ্টিত ভিজছেন ক্যান ভাইজান? আপনারে দেইখা তো মনে হইতাছে শহুরে পোলা আপনে। নিশ্চিত এবার জ্বর আইবো।”

ছেলেটার কথায় কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলো নাজ। সে যে অসুখ নামক শব্দটিকে ভীষণ ভয় পায় এটি এদের বুঝিয়ে বলবে কে! সে নিশ্চিত, এই জ্বরের বিষয়টা নিয়ে সে কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখালেই সে সকলের হাসির পাত্রে পরিণত হবে, যা সে কিছুতেই চায় না। কিন্তু সুহানা ঠিকই তার ঘাবড়ে যাওয়া মুখশ্রীর রূপরেখা ধরে ফেলেছে। সেই সুবাদেই সুহানা নাজকে টিপ্পনী কেটে বললো,
” জ্বরকে এতো ভয় পান!”

নাজ কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো। তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে বললো,
” মোটেও না৷ ভয় পাওয়ার কি আছে?”

নাজের এ সাধারণত কথাও এখন বাচ্চাদের নিকট হাসির খোরাকে পরিণত হলো। তাদের সাথে হাসলো সুহানাও। বৃষ্টির স্বচ্ছ, নির্মল ছোঁয়ায় সুহানার সুন্দর মায়াবী মুখশ্রী পূর্বের তুলনায় আরোও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ সে অপরূপ মুখশ্রীতে খিলখিল করা হাসিটা মানাচ্ছে দারুণ। নাজ অপলক সুহানার সে হাসির দিকে চেয়ে রইলো৷ সে যেনো এ মুহূর্তে অন্য এক সুহানাকে দেখছে, যে তার গাম্ভীর্যের কৃত্রিম মুখোশ হতে বেরিয়ে প্রাণখোলা হাসির মাধ্যমে বাতাবরণে সতেজতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে কারোর হৃদয়ে অস্থির করা এক অনুভূতি। ছড়িয়ে দিচ্ছে হৃদয়ে জাগ্রত হওয়া সদ্য নব্য অনুভূতি, যেটি ভালোবাসার প্রারম্ভিকতার প্রতিক।

কামিজের সম্মুখ অংশের খানিক জায়গা জুড়ে কুড়িয়ে নেওয়া আমগুলো রেখেছে সুহানা। ফলে কিঞ্চিৎ উঁচু হয়ে থাকা কামিজের জন্য সে ঈষৎ ঝুঁকে আছে৷ অবিরাম হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার জোগাড় হয়ে এলে সে থেমে যায়। তার কিয়ৎ বাদে থেমে যায় সেই বাচ্চাগুলোও। অকস্মাৎ সুহানার নজর গিয়ে পড়লো বাচ্চাগুলোর হাতের ব্যাগের উপর। তারা বাড়ি হতেই ব্যাগ নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে আম কুড়াতে এসেছে৷ সুহানা একটি বাচ্চা ছেলেকে বললো,
” ইমন, আমাকে তোর ব্যাগটা দে। এভাবে আম রাখতে পারছি না৷ তুই রাজুর ব্যাগে আমগুলো নে।”

ইমন নামের ছেলেটি তৎক্ষনাৎ ভেঙচি কেটে বললো,
” পারমু না রাজুর ব্যাগে রাখতে। ওয় আমারে খেলবার নেয় না৷ ওর সাথে কথা কই না। ”

ইমনের হেন কথায় সুহানা ঠোঁট কামড়ে ক্ষীণ রাগত স্বরে বললো,
” বাচ্চাকালে এতো ঝগড়া কিসের হুম? মিলেমিশে থাকতে পারিস না? আজ তুই রাজুর ব্যাগেই আম রাখবি। আর পরে বাড়িতে গিয়ে নিজের ভাগ নিয়ে নিবি। চাচির কাছে শুনবো তো তোরা আবার ঝগড়া করেছিস কি না৷ যদি শুনি তোরা ঝগড়া করেছিস, আমার উল্টো হাতের মার খাবি বলে দিলাম। ”
এই বলে সুহানা ইমনের হাত হতে জোর করে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিলো৷ অতঃপর নিজের কুড়ানো আমগুলো মাটিতে একত্রে রেখে ইমনের ব্যাগের আমগুলো রাজুর ব্যাগে রেখে দিলো। এরপর একে একে নিজের ভাগের আমগুলো সেই ব্যাগে পুরলো।

বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গিয়েছে। চারপাশে শুধু গা হিম করা হিমেল হাওয়া বইছে। হাওয়ার সাথে ভেসে আসছে প্রকৃতি সতেজ করা এক ঘ্রাণ৷ ভেসে আসছে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ৷ বর্ষণ পরবর্তী পরিবেশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো নাজ। ঈষৎ ধূসর রঙে রাঙায়িত মেঘপুঞ্জরা ধীরেধীরে ছুটছে। জমিনের বিশাল বিশাল বৃক্ষগুলোর মগডাল সুতীব্রভাবে দুলছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি তারা নিজেদের স্থান হতে ছি’ন্ন’ভিন্ন হয়ে যাবে। প্রতিটি বৃক্ষের পত্ররাজি তাদের বাস্তবিক রঙ ফিরে পেয়েছে। গাঢ় সবুজ বর্ণে ছেয়ে উঠেছে প্রকৃতি। এক এক করে পাখিরা ক্ষণিকের জন্য নেওয়া আশ্রয়স্থল হতে বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতির এ নজরকাড়া অদ্ভুত সুন্দর রূপ দেখে নাজ মুগ্ধ কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললো,
” মারভেলাস। অতুলনীয় যাকে বলে। ”

নাজের কথা শুনতে পেলো সুহানা। মৃদু হাসলো সে। খানিক সময় সেও প্রকৃতির এ সৌন্দর্যে বিচরণ করলো। রোজকার দেখা প্রকৃতি মনের মাধুরি মিশিয়ে আবারো নতুন করে দেখলো সে। অকস্মাৎ দূর হতে মেঘের গর্জনে ধ্যান ভাঙলো তার। ধ্যান ভাঙলো নাজেরও। সুহানা বললো,
” চলুন, যে যার মতো বাড়ি ফিরে যাই৷ অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।”

নাজ প্রত্যুত্তর করলো না৷ এক নজর সুহানার দিকে চাইলো। তার পরনে পাতলা সাদা টিশার্ট ও তার উপরে চেক শার্ট ছিলো। সুহানার ভেজা পোশাক দেখে সে উপরের চেক শার্টটা খুলে সুহানার দিকে ধরে বললো,
” এটা গায়ে জড়িয়ে নাও। ভেজা কাপড়ে ভালো দেখাচ্ছে না তোমাকে। ”

সুহানার যেনো এতোক্ষণে হুঁশ ফিরলো। সে কিয়ৎক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। তব্দা খেয়ে নাজের দিকে চেয়ে রইলো ক্ষণিক সময়। অতঃপর চট করে মাথা নিচু করে ফেললো। একটি ছেলের সামনে এমন বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় পড়তে হবে তা সুহানা কল্পনাও করেনি। ভেজা পোশাকের ফলে এখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড় হলো তার। সে আমের ব্যাগটা কোনোরকমে ধরে চওড়া ওড়না দিয়ে উরু পর্যন্ত নিজেকে আবৃত করে নিলো। সুহানার নিজেকে ঢাকার এ প্রচেষ্টা দেখে নাজ বললো,
” এখনও পুরোপুরি ঢাকতে পারোনি নিজেকে। শার্টটা গায়ের উপর দিয়ে রাখো। তাহলে অতোটা বুঝা যাবে না। ”

সুহানা আর কথা বাড়ালো না। কোনো প্রকার বাছবিচার ব্যতিতই নাজের নিকট হতে শার্টটা নিলো। নাজ তার হতে আমের ব্যাগটা নিতেই সে পিঠের উপর দিয়ে শার্টটা নিয়ে শরীরের সম্মুখভাগে জাপটে ধরলো। নাজের সামনে এ লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়ে সে আর কোনো কথাই বলতে পারলো না। বরং নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। নাজ তাকে বললো,
” জানি না কতটুকু রাস্তা আছে। তবে আমার মনে হয় ভ্যানে যাওয়াই বেটার হবে। রাস্তা পর্যন্ত চলো, দেখি ভ্যান পাই কি না৷ ”

সুহানা নীরবে ঈষৎ মাথা দুলালো। অতঃপর সে ও নাজ সে জায়গা পেরিয়ে রাস্তায় চলে এলো। বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় কোনো ভ্যানের দেখা মিললো না৷ প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি ভ্যান দেখা গেলো। নাজ হাতের ইশারায় সেটি থামালো। সুহানাকে বললো ভ্যানওয়ালা চাচাকে নিজেদের বাড়ির ঠিকানা বলতে। সুহানা ঈষৎ মাথা উঁচিয়ে তাদের বাড়ির ঠিকানা বললো। বাড়ির ঠিকানা শুনেই ভ্যানওয়ালা চাচা ক্ষীণ অপ্রসন্ন সরু দৃষ্টিতে নাজ ও সুহানার পানে চাইলো। তার এ দৃষ্টি চোখে পড়লো না সুহানার। তবে নাজের চোখে পড়লেও সে বিষয়টাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সুহানাকে ভ্যানে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লো।
®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here