#বাসন্তীগন্ধা
|১৯|
লাবিবা ওয়াহিদ
আজ মেহেরদের বাড়িতে ইলিরার বাবা-মা এসেছে। ইলিরার সাথে সারিমের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মেয়ের জেদে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তারা এসেছে। বৈঠকঘরে তারা সকলে বসে আছে। ইলিরার বাবার মুখ-ভঙ্গি দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে তার মাঝে জড়তা কাজ করছে। কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছে তার। তাদের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবার কি না শেষমেষ ছেলের বাড়ি আসলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, বিষয়টি মানতেই পারছেন না তিনি। ইলিরার মা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“একপ্রকার বাধ্য হয়েই আপনাদের কাছে এক আর্জি নিগে এসেছি ভাইজান!”
উপর থেকে সবটা দেখছিলো মেহের। চোখ তার অশ্রুতে ছলছল করছে। যখন-ই ইলিরার মায়ের মুখে “আর্জি” শব্দটি শুনলো তখনই তার মনে কু ডাকলো। সারিম, সাইয়ান কেউ-ই বাড়িতে নেই। তারা অফিসে। জানে না ইলিরার বাবা-মায়ের আসার কথা।
মেহের বেশ বুঝতে পেরেছে তারা কী নিয়ে কথা বলতে এসেছে। গতকালই ইলিরা মেহেরকে কল করে উচ্ছ্বাসময় কন্ঠে বলেছিলো,
–“তুমি শীঘ্রই আমার ননদ হতে যাচ্ছো মেহের। আ’ম সোও এক্সাইটেড।”
এরকম কথা শুনে মেহের অর্ধেক রাত কেঁদেছে। যার ফলে তাঁর চোখ-মুখ অত্যন্ত লাল হয়ে গিয়েছিলো। সেই পহেলা বসন্তের পর থেকেই মেহের মন খারাপ করে থাকতো। সারিমকে সে আর কী বলবে? সারিম তো এখনো জানেই না ইলিরার কান্ড৷ সারিমকে নানান ইঙ্গিতে অনেক কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করে ইলিরা। কিন্তু সারিম তাকে এড়িয়ে চলে। এ ব্যাপারটা মেহের ভালোভাবেই লক্ষ্য করেছে। তবে সামান্য এই এড়ানোতে তো আর ভবিষ্যৎ বদলে যাবে না। ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে সেটা একমাত্র উপরওয়ালা জানে। আজকাল সারিমকে হারানোর ভয়টা খুব করে জেঁকে বসেছে।
খুব ইচ্ছে হয় সারিমকে তার মনের কথা জানাতে। কিন্তু সারিম যদি ইলিরার মতো তাকে এড়িয়ে যায়? মেহের তো থাকতে পারবে না। এই অনুভূতি এত যন্ত্রণাদায়ক কেন? এত যন্ত্রণাময় জানলে মেহের কখনোই সারিমের উপর দুর্বল হতো না। ইদানীং কেন যেন সারিমকে নিষিদ্ধ লাগে মেহেরের। হয়তো সারিম ছাড়া মেহেরকে সেভাবে কেউ বোঝে না, তাই বলে তো এই নয় যে সারিম তার জীবনসঙ্গী হবে। এছাড়া মেহেরের জেঠু যতই তাকে ভালোবাসুক, সারিমের বউ হলে হয়তো মেহেরকে মানতে পারবে না। এছাড়া আরও নানান পারিপার্শ্বিক চিন্তা-ভাবনা।
মেহের চোখের জল গড়ানোর আগেই সেটা উলটো পিঠে মুছে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। সে আর পারবে না এতসব চিন্তা-ভাবনা করতে। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তাই মেহের সিদ্ধান্ত নিলো দাদীর সাথেই এর হেস্তনেস্ত করবে। আপাতত দাদী রোকসানাই তার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে।
রোকসানা তখন যোহরের নামাজ শেষ করে সবে বসেছেন। বাইরের অস্পষ্ট কথাবার্তা তার কানে এসেছে, তবে হাঁটু ব্যথার কারণে বিছানা ছেড়ে বাইরে বের হচ্ছেন না। আজকাল হাঁটু ব্যথায় তার নড়তে ইচ্ছে করে না। এমন সময় মেহের প্রবেশ করলো রোকসানার ঘরে। রোকসানা নাতনিকে দেখে মুচকি হাসলো। ইশারায় কাছে ডেকে বললো,
–“কে এসেছে রে মেহের? কী এত আলাপ হচ্ছে!”
মেহের কোনো উত্তর না দাদীর সামনে বসলো। অতঃপর কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
–“আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো দাদী। তার আগে বলো, এটা বললে আমাকে তুমি অস*ভ্য বা খারাপ ভাববে না তো?”
রোকসানা অবাক হলো মেহেরের কথায়। মেহেরের চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। রোকসানা বুঝতে পারলো ঘটনা গুরুতর। রোকসানা বেগম ব্যস্ত হয়ে বললো,
–“কী হয়েছে? এভাবে বলছিস কেন? তুই খারাপ হতে পারিস মেহের? রোকসানার নাতি-নাতনিদের সে নিজে পেলেছে। ছোটো থেকে বড়ো করেছে। তারা একেকজন আমার কলিজা, বুঝছিস?”
এবার মেহেরের চোখের বাঁধ ভেঙে গাল গড়িয়ে অশ্রু পরতে লাগলো। ভাঙা গলায় আওয়ালো,
–“দাদী….”
———————–
আইঁয়ুব সাহেব আলতো হেসে ইলিরার বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
–“হ্যাঁ বলুন ভাবী। কী আর্জি?”
ইলিরার মা-বাবা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছেন। তাদের ভীষণ অস্থির এবং অদ্ভুত লাগছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে আইঁয়ুব সাহেব আবার বললেন,
–“ভয়ের কিছু নেই। আপনারা বলুন, আমি শুনছি।”
এর মাঝে জ্যুতি অর্থাৎ মেহেরের মা চা-নাশতা নিয়ে আসলেন। তার অধরেও হাসি ঝুলছে। আইঁয়ুব সাহেবের কথা শুনে ইলিরার বাবা ইতঃস্তত হয়ে বলতে লাগলো,
–“আসলে, হয়েছে কী ভাই.. আমরা আপনাদের ছেলে সারিমের সাথে ইলিরার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমার মেয়েটা আপনার ছেলেকে ভালোবাসে।”
এরকম একটা কথা শুনে আইঁয়ুব সাহেব এবং জ্যুতি কিছুটা থমকালেন। দু’জনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরকম কথার জন্যে কেউ-ই প্রস্তুত ছিলো না। আইয়ুঁব সাহেব অস্ফুট স্বরে বললো,
–“বিয়ে!”
ইলিরার বাবা মাথা নিচু করে ফেললো। অতঃপর আবার বললো,
–“হ্যাঁ ভাই। মেয়েটা বড্ড পাগল হয়ে আছে। বয়স বেড়েছে। বিয়ের জন্যে বললে বলে সারিমকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আপনি তো দেখেছেন-ই ইলিরাকে। মেয়ে আমার মাহ-শা-আল্লাহ্ বেশ সুন্দরী। আশা রাখছি দু’জনকে মানাবে।”
আইঁয়ুব সাহেব দুশ্চিন্তায় পরলেন। এরকম একটা প্রস্তাব, তার উপর সারিমের বান্ধুবী ইলিরা। চাইলেও মুখের উপর ‘না’ করে দিতে পারছে না। তার উপর সারিমেরও তো সম্মতি নেওয়া বাকি। এমনও তো হতে পারে সারিম এবং ইলিরার মাঝে কোনো সম্পর্কে আছে? কিন্তু,, সারিম তো তার ওরকম ছেলে না। সে বড্ড গম্ভীর স্বভাবের। এরকম ছেলে নিশ্চয়ই প্রেম করবে না। করলেও আইঁয়ুব সাহেব ঠিকই জানতে পারতো।
ইলিরার বাবা আবার বললেন,
–“ভাই, আপনার মতামত কী? সম্মতি ধরে নিবো?”
আইঁয়ুব সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। কিছু বলতে নিবেন ওমনি রোকসানা বেগম তাদের মধ্যে উপস্থিত হলেন। রোকসানাকে দেখে ইলিরার বাবা-মা দু’জনেই সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রোকসানা বেগম সালামের উত্তর নিয়ে তাদের বসতে বলে নিজেও বসলেন। রোকসানাকে দেখে ইলিরার বাবা-মা আরও বেশি লজ্জিত অনুভব করলেন। রোকসানা তাদের বড়ো। মেয়ের জন্যে ছেলের বাড়ি প্রস্তাব নিয়ে আসার খবরটি শুনলে তিনি কী মনে করবেন? রোকসানা তাদের নেতিয়ে যাওয়া মুখ দেখে সব বুঝে নিলো। তাই নিজেই বললো,
–“লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমি কিছু মনে করিনি। তবে সমস্যা হচ্ছে আমার নাতির বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তাই ইলিরার সাথে আমার নাতির বিয়ে সম্ভব না।”
রোকসানার কথা শুনে সকলে স্তব্ধ। বিশেষ করে আইঁয়ুব সাহেব। তার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অথচ সে নিজেই জানে না? ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না তার। তাও মুখ খুললো না। একজন নীরব রইলো। জ্যুতিও শ্বাশুড়িকে কিছু বলার সাহস পেলো না। সে নীরবে সবকিছু দেখতে লাগলো।
——————————-
–“সোহা, আজ আমার তরফ থেকে তোর জন্যে ট্রীট। কোন রেস্টুরেন্টে যাবি বল!”
মেহেরের এমন কথায় সোহা কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বললো,
–“প্রথম পরীক্ষা দিয়েই কী মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?”
মেহের মুচকি হেসে বললো,
–“হয়নি খারাপ। তুই যাবি নাকি বল? তুই না গেলে প্রব্লেম নেই। তোর জায়গায় রাস্তা থেকে একজনকে ধরে নিয়ে যাবো নাহয় রেস্টুরেন্টে।”
মেহের যেতে নিলে সোহা মেহেরের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“সমস্যা কী? এমন করছিস কেন?”
–“কেন? ট্রীট দেওয়াটা সমস্যা?”
–“অবশ্যই। বিনা কারণে ট্রীট দেওয়াটা আমার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক। প্লিজ বল না কী হয়েছে? হঠাৎ ট্রীট কেন দিতে চাচ্ছিস? তোর বিয়ে-টিয়ে হয়ে গেলো নাকি?”
মেহের হেসে বললো,
–“নাহ। তবে একজনের হবে। যেতে যেতে বলছি!”
সোহা কৌতুহলী হয়ে মেহেরের পাশে হাঁটতে লাগলো। তারা ভার্সিটির কাছাকাছি এক কফিশপে ঢুকলো। সেখানে নিজেদের পছন্দানুযায়ী এক টেবিলে বসে মেহের বলতে লাগলো,
–“ইলিরা আপুর বাবা-মা এসেছিলো সারিম ভাইয়ের সাথে ওনার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”
সোহা বিস্ময়ভরা চাহনিতে চাইলো মেহেরের দিকে। কৌতুহলী কন্ঠে বললো,
–“তারপর?”
–“বিয়ে ভেঙে গেছে। এখন ইলিরা আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে অন্য কোথাও। আমার এত শান্তি লাগছে সোহা।”
সোহা আরও অবাক হয়ে বললো,
–“এর মানে কী তুই সারিম ভাইয়ের মেরু হয়ে গেছিস?”
মেহের লাজুক হাসলো। এতেই সোহা যা বোঝার বুঝে গেলো। হুট করে তালি দিয়ে উঠলো সোহা। মেহের সোহাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
–“কী করছিস?”
–“তুই এভাবে ফাঁদে পরবি বইন, আমি ভাবতে পারিনি। তুই আসলেই কোনো ভোলা-ভালা মেয়ে না। তা বিয়ে কবে হচ্ছে?”
মেহের লাজুক হেসে বললো,
–“আমিও তো ভাবতে পারিনি। যার বকা খেয়ে সকাল শুরু হতো তাকে এভাবে পছন্দ করে বসবো। সব তোর উস্কানির দোষ। সারিম ভাইয়ার বউ দেখা হলো না আমার!”
সোহা মজা নিয়ে কথায় টান দিয়ে বললো,
–“ও, আ~~আচ্ছা। তা~~ই নাকি মেরু?”
মেহের হেসে বললো,
–“খবরদার ‘মেরু’ ডাকবি না আমায়। ‘মেরু’ ডাকার অধিকার একমাত্র আমার গোমড়ামুখো সারিম ভাইয়ের।”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।