#বাসন্তীগন্ধা
|শেষাংশ|
লাবিবা ওয়াহিদ
মেহের লেকের একপাশে বসে আছে। অপেক্ষা করছে সারিমের। সারিম মেহেরের জন্যে আইসক্রিম আনতে গিয়েছে। মেহেরের এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে এজন্য সারিমের সাথে গেলো না। এছাড়াও পায়ে অসহনীয় ব্যথা। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে। মেহের আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছিলো এমন সময় তার সামনে অভি এসে দাঁড়ালো। একদম হুট করে। মেহের চমকে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমতা আমতা করে বললো,
–“আপনি?”
অভি শুকনো হেসে বললো,
–“চমকানোর কিছু নেই। ঘুরতে এসেছি এখানে। তোমাকে দেখতে পেয়েই তোমার কাছে আসলাম!”
মেহেরের অন্তঃস্থল কাঁপছে। ভীষণরকম৷ সারিম যদি একবার অভিকে দেখে ফেলে তাহলে মেহেরের রক্ষা নেই। মেহেরের অন্তরের ভয় চোখেও ভেসে উঠলো। অভি তা দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পেরে হাসলো। হেসে বললো,
–“ভয় পাওয়ার কিছু নেই বোকা মেয়ে। কিছু কথা বলতে এসেছি। বলেই চলে যাবো!”
মেহের সরু চোখে অভির দিকে চেয়ে রইলো। অভি হেসে বলতে লাগলো,
–“সত্যি বলতে আমি দু’জন মেয়ের উপর দুর্বল হয়েছিলাম। তারা পরবর্তীতে আমার মনমতো হয়ে ওঠেনি৷ তাই তাদের সাথে বিচ্ছেদ হয়। তৃতীয়জন হিসেবে তুমি ছিলে। তোমাকে আচমকা পছন্দ করে বসেছিলাম। প্রথম এবং দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ-এর পর এক দারুণ মানুষের সাথে পরিচিত হলাম। দারুণ বলতে একজন চমৎকার প্রেমিক। যে তোমার অপ্রকাশিত একজন প্রেমিক। তার অনুভূতি সম্পর্কে যখন জানতে পারলাম তখন তার কাছে নিজেকে বড়োই তুচ্ছ অনুভব হচ্ছিলো। যাইহোক, আজ অন্য কথা বলতে এসেছি। বলতে পারো, ৩য় এবং শেষবারের জন্যে আসলাম। বিদায় দিতে। আমি ভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়েছি। খুব শীঘ্রই ফরেইন যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, যে তোমার হাত ধরেছে তার হাত আঁকড়ে ধরো। আমি দুঃখিত, হয়তো-বা কারণে অকারণে তোমাকে বিরক্ত করেছি। ক্ষমার সাথে দোয়ায় রেখো। কেমন? আসছি। ভালো থেকো!”
এক দমে কথাগুলো বলেই অভি আবার চলে গেলো। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে এলো আবার ঝড়ের গতিতেই চলে গেলো। মেহের হতবাক, বিমূঢ় হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। বিস্ময় কাটছে না তার। অভির কথাগুলো আবার কানে বাজতেই মেহের নড়েচড়ে উঠলো। সারিম এলো আইসক্রিম নিয়ে। মেহের আইসক্রিম হাতে নিয়ে এক ধ্যানে কতক্ষণ চেয়ে রইলো সারিমের দিকে। সারিম মেহেরের সামনে আচমকা তুড়ি বাজিয়ে বললো,
–“কী হলো? যাবে না?”
মেহের নিজেকে ধাতস্থ করে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
–“হ্যাঁ, চলুন।”
——————-
বেশ কিছুদিন যাবৎ মেহের অস্থিরতায় ভুগছে। অস্থিরতার কারণ অভির বলা কথাগুলো। অভির কথাতে যা বুঝলো তাতে তো অভি সারিমের কথাই বলেছে। কিন্তু সারিম না ধমকিয়ে কী এমন বললো অভিকে? সারিমের অপ্রকাশিত ভালোবাসা? মাথার ওপর দিয়ে গেলো। মেহের ভেবেছিলো সারিম হয়তো-বা টুকটাক পছন্দ করতে শুরু করেছে। তাই বলে এতদিন আগে থেকে? কীভাবে?
মেহেরের মাথা কাজ করছে না। সে বসে না থেকে দ্রুত ফোন হাতে তুললো। এই বিষয়ে একমাত্র সোহাই তাকে সাহায্য করতে পারবে। মেয়েটা যেন প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে এক্সট্রা ডিগ্রী নিয়ে বসে আছে। সোহাকে কল দিয়েই মেহের না থেমে সব খুলে বললো। সোহা সব শুনে হাসতে হাসতে বললো,
–“বোকা রাণী আমার। আমি তো যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। এখন তোকে বুঝতে হলে সব সারিম ভাইয়ার মুখ থেকে শুনতে হবে!”
মেহের নখ কামড়ে বললো,
–“আমি জিজ্ঞেস করবো?”
–“তা নয়তো কী? কিছু কথা থাকে, যেগুলো প্রিয় মানুষের মুখেই শুনতে ভালো লাগে। আমি বুঝালে তুই নাও বুঝতে পারিস। এছাড়াও সারিম ভাইয়ার মনে কী চলছে সেটা একমাত্র উনি-ই ভালো জানে। যদি তোর প্রতি অনুভূতি না থাকতো, তবে তুই বিয়ের কথা বললেই কেন তেঁতে উঠতো? পয়েন্ট আছে বন্ধু, অনেক পয়েন্ট আছে। পয়েন্ট গুলো আগে ধরো, তারপর নাহয় সারিম ভাইকে জিজ্ঞেস করিও!”
–“সব বুঝলাম। আমায় ধমকাতো কেন?”
–“শাসনের মধ্যে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। যত্ন থাকে। এই যেমন দেখ, বাবা-মা আমাদের বকাবকি করে, শাসন করে। তাই বলে কী ওনারা আমাদের ভালোবাসে না? বাসে। তবে হয়তো-বা সারিম ভাইয়া নিজের অনুভূতি লুকাতে তোকে শাসন করতে পারে! জানি না, দুটোর একটা হতে পারে।”
মেহের কল কেটে দিলো। শুরু থেকে সব মনে করার চেষ্টা করলো।
রাতে সারিম বাড়ী ফিরতেই দেখলো তার রুম অন্ধকার। সারিমের ভ্রু কুচকে গেলো। হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে অন্ধকারেই ডাকলো মেহেরকে। মেহের মৃদু স্বরে শুধু হুঁ বলেই নীরব রইলো। সারিমের কপালে ভাঁজ। তাও সে লাইট না জ্বালিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে এলো। বিছানায় বসে দেখলো মেহের গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছে। সারিম মেহেরের গালে হাত দিয়ে কিছু একটা বলতে নিবে ওমনি হাত কেমন গরম হয়ে এলো। সারিম ভীষণ অবাক হলো। মেহেরের গায়ে যে অসম্ভব জ্বর। সারিম হাত না সরিয়ে মেহেরকে ডাকলো। মেহের জড়ানো কন্ঠে বললো,
–“কিছু বলবেন?”
–“এত জ্বর আসলো কী করে? দুপুরেও তো ঠিকভাবে কথা বলে ছিলি৷”
মেহের বিড়বিড়ালো,
–“আপনাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে জ্বর এসে পরেছে।”
–“কী বললি?”
মেহের এবার খুব আদুরে গলায় বললো,
–“আমাকে আগলে নিন না আপনার বক্ষে!”
সারিম এমন আদুরে আবদারে “না” করতে পারলো না। দ্রুত শুয়ে পরলো৷ মেহের সারিমের বুকে মাথা রাখতেই তার চোখ আবেশে বুজে এলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেললো। সারিম মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
–“কিছু খেয়েছিস? ডিনার করবি চল, ওষুধও নিতে হবে। কেন যে এত রোগ বাঁধাস! একটু সাবধানে চললে কী হয়?”
মেহের সারিমকে থামিয়ে দিয়ে চোখ বুজেই বললো,
–“বিরক্ত করবেন না। খাবার পালাচ্ছে না। এভাবেই একটু থাকতে দিন। শান্তি লাগছে!”
সারিম কিছু বললো না। মেহেরের গায়ের তাপে সারিম ঘেমে যাচ্ছে। এসিটাও অন করতে পারছে না। সিলিং ফ্যান ঘুরছে উপরে। অদ্ভুত শব্দে।
মিনিট পাঁচেক নীরব থাকার পর মেহের হঠাৎ বললো,
–“আপনি আমায় কবে থেকে ভালোবাসেন?”
মেহের না তাকিয়েও বুঝলো সারিম মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। অবাক চোখে। অথবা মেহেরের অনুমান। সারিম উত্তর দিতে দেরী করলো না। বললো,
–“নবীন বরণে যেদিন প্রথম শাড়ি পরেছিলি সেদিন!”
মেহের চমকে যায় সারিমের কথা শুনে। সারিম বলতে শুরু করে।
–“যেদিন প্রথম শাড়ি পরলি, সেদিন তোকে দেখে অদ্ভুত অনুভূতি দেহ নাড়িয়ে তুলেছিলো। বুকের বা পাশে চিনচিন করতো। হৃদপিন্ড দ্রুত গতিতে ওঠা-নামা করতো, ঢিপঢিপ শব্দ করতো। চোখের নজর কেমন মুগ্ধতায় ছেয়ে গিয়েছিলো৷ মায়ের মৃ* ত্যুর পর সেভাবে প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে অনুভূতি কাজ করতো না। অথবা সেসবে ধ্যান দেওয়ার সময় হয়নি। বোনসহ পরিবারকে নিয়েই সময় চলে যেত। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার নজর তোর উপর গিয়ে ঠেকবে। এক মুহূর্তে ভালোবাসা যায় না। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তাই হয়ে গেলো। নিজেকে খুব বুঝ দিতাম। তুই আমার বোন, তোকে নিয়ে অন্য অনুভূতি সম্ভব না। আরও নানান বাস্তবমুখী ব্যাপার নিয়ে আমার বিবেক আমাকে বাঁধা দিতো। কিন্তু ভুলবশত এই ভালোবাসা আমায় নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো। বদ্ধ পাগল হয়ে গেলাম তোর জন্যে। শেষমেষ টিকতে না পেরে আমি প্রায় চৌদ্দদিনের ট্যুর দিলাম। মনে আছে, হঠাৎ-ই যে দুই সপ্তাহের ট্যুর দিয়েছিলাম?”
মেহেরের মনে পরলো। এজন্যে সেই অবস্থাতেই ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে সারিমকে নীরব উত্তর দিলো। সারিম আবার বলতে শুরু করলো,
–“নিজের কাছে বড্ড অপরাধী হয়ে থাকতাম। কেন সাইয়ান ভাইয়ের মতো তোকে বোন ভাবতে পারিনি? সামিরার মতো কেন তোকে বোনেয় জায়গায় বসাতে পারিনি? কেন অন্য নজরে দেখলাম, এই ব্যাপারগুলো বড্ড পোড়াতো আমাকে। অনুশোচনায় দিন কাটতো। এজন্য ভেবেছিলাম ট্যুর দিলে হয়তো মাথার ভূত নেমে যাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? সেই দুই সপ্তাহের ট্যুরে অনুভব করলাম, তুই ছাড়া কাউকে ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোকে দূরে ঠেলে দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব না। সঙ্গে এও সিদ্ধান্ত নিলাম তোর পড়াশোনা শেষ হওয়া অবধি তোর অপেক্ষায় থাকবো। এরপর বাবাকে তোর কথা জানাবো। সবার মতেই আমাদের বিয়ে হবে। ততদিন অবধি তুই আমার চোখের সামনে থাকবি, এটাই আমার জন্যে দারুণ স্বস্তির!”
সারিম বুকে ভেঁজা অনুভব করলো। মেহের কাঁদছে? সারিম মেহেরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“এই! কাঁদছিস কেন?”
মেহের নাক টেনে বললো,
–“এর মানে যার-তার হাতে শাড়ি পাঠাতেন আপনি?”
সারিম হালকা হাসলো। মেহেরের মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
–“বুদ্ধিমতী হয়ে গেছিস তাহলে!”
–“কই? আমি তো আন্দাজে ঢিল মেরেছিলাম!”
সারিম আবারও হাসলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“বিশ্বাসই হয় না, এই পিচ্চিটা আমার অপেক্ষার দুই বছরের মাথায় আমার হয়ে গেছে। জানিস, তোকে বুকে আগলে নিলে কত শান্তি লাগে? মনে হয় মরুভূমির বুকে পানির বাস। তুই আমার জীবনের বসন্ত, বসন্তের ঘ্রাণ রে মেরু। তোকে আগলে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই!”
মেহের অনুভব করলো সে থরথর করে কাঁপছে। অসংখ্য অনুভূতি তার সর্বাঙ্গ জুড়ে দুলে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ নীরব রইলো দুজনে। মেহের অনুভব করলো, ধীরে ধীরে জ্বরটা সেরে আসছে। মেহেরের অধরে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। মিনমিন করে বললো,
–“আমার অনুভূতি জানতে চাইবেন না?”
–“উঁহু। তোমাকে অনুভব করেই তোমার অনুভূতি অনুভব করেছি। মুখে ঘটা করে বলার প্রয়োজন নেই!”
আহ্। অসংখ্য প্রাপ্তি, শান্তি, সুখ। মেহের এত সুখের কল্পনা তো কোনদিন করেনি। সারিম এত ভালো কেন? সারিম তাকে ভালোবাসে বলে? মেহেরের বলতে ইচ্ছে করলো,
–“ভালোবাসা সুন্দর। খুব সুন্দর!”
মেহের সারিমকে অভির কথা আর জিজ্ঞেস করবে না। মেহের যে তার উত্তর পেয়ে গিয়েছে।
——————–
সামিরা এবং আশিফের বিয়ে হয়েছে প্রায় এক মাসের বেশি। রোজা রুমে বসে ভাবছে সাইয়ানের কথা। সাইয়ান কিছুদিন আগেই রোজার বাবা এবং রুবেলকে পুলিশে দিয়েছে। সঙ্গে খুব জোরালো কেস ঠুকে দিয়েছে। সহজে বের হওয়া সম্ভব নয়। এই সবকিছুই রোজার জন্যেই। রোজা সাইয়ানকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। ছেলেটা রোজার জন্যে কী করেনি? সাইয়ান যেন রোজার জীবনে ফেরেশতা স্বরূপ।
মেহের বই-খাতা নিয়ে রোজার রুমে প্রবেশ করলো। রোজা তখনো বিছানায় বসে একমনে জানালা ভেদ করে বাইরে চেয়ে আছে। মেহের মুখে শব্দ করতেই রোজা বাস্তবে ফিরে এলো। মেহেরকে দেখে মুচকি হেসে বললো,
“এসো। বসো!”
মেহের বসতে বসতে বললো,
–“পড়াশোনা আর ভালো লাগে না ভাবী।”
রোজা আলতো হাসলো। মেহের এবং মাহিমকে পড়ানোর ডিউটি এখন সারিম থেকে রোজার কাছে ট্রান্সফার হয়েছে৷ সারিম এখন পড়ানোর জন্যে আলাদা সময় পায় না। এজন্য রোজাই ভরসা। মেহের পড়তে পড়তে হঠাৎ রোজার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো রোজার মুখশ্রী আগের চাইতে বেশ শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল, ফোলা গাল কেমন নেতিয়ে গেছে, শুষ্ক অধর, চোখও যেন গর্তে চলে যাচ্ছে। চোখ-মুখে একরাশ ক্লান্তিও লক্ষণীয়। মেহের রোজাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে বললো,
–“ব্যাপার কী ভাবী? নিজের এরকম হাল করেছো কেন? ইদানীং দেখছি ঠিকমতো খাও না, খেলেও বমি করে দাও। তুমি কী অসুস্থ?”
রোজা হাসার চেষ্টা করে বললো,
–“আরে সেরকম কিছু না। একটু দুর্বল!”
–“আমার মনে হচ্ছে তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত!”
রোজা হেসে বলে,
–“মা সকালেই হসপিটাল নিয়ে গেছিলো। কিছু টেস্ট করিয়েছি। কালকের মধ্যে বোধহয় রিপোর্ট দিয়ে দিবে!”
মেহের আর কথা না বাড়িয়ে পড়ায় মনোযোগ দিলো।
পরের দিন সকালে সাইয়ান চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ী এলো। ছুটির দিন হওয়ায় আজ সবাই বাড়ীতে। সাইয়ানের গলা শুনে সকলে একসাথে জড়ো হলো। আইঁয়ুব সাহেব বললেন,
–“কী হলো? এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”
সাইয়ানের অধরে তখনো বিশ্বজয়ের হাসি। চোখে-মুখে চিকচিক ভাব ফুটিয়ে বললো,
–“আমি বাবা হতে চলেছি বাবা। এটা কী চেঁচানোর মতো খবর নয়?”
সাইয়ানের এই কথায় রোকসানা সর্বপ্রথম চেঁচিয়ে আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। পরপর সকলে খুশিতে গুঞ্জন করে উঠলো। সকলের মুখে হাসি, গলায় আনন্দের সুর উঠলেও রোজা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে। যেন নিজের কানকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আইঁয়ুব এবং মেহেরের বাবা নিজেদের জড়িয়ে ধরে খুশি বিনিময় করে একজন ছুটলো মিষ্টি কিনতে আরেকজন ফোন হাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো আত্নীয়দের সুসংবাদ জানাতে। রোজা চোখের কোণ ভিজিয়ে নিজের অজান্তেই পেটে হাত রাখলো। তার দেহে আরেকজনের অস্তিত্ব, সাইয়ানের অংশ বেড়ে উঠছে। মেহের ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রোজাকে। উচ্ছ্বাসিত হয়ে অভিনন্দন জানালো। এবার রোজার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো। মেহের এভাবে রোজার গায়ে হামলে পরায় জ্যুতি চেঁচালো। ধমক দিয়ে বললো,
–“দুইটা চড় খাবি অসভ্য! এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে? ব্যথা পাবে তো। সরে আয় বলছি!”
সাইয়ান রুমে এসে রোজাকে জড়িয়ে ধরলো। রোজার তখন আবেশে চোখ বুজে এলো। সাইয়ান শক্ত করে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“তুমি জানো না রোজা, তুমি আমায় কী খুশি উপহার দিয়েছো। আমি বাবা হবো, ছোটো ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে, আধো বুলিতে আমার সন্তান আমাকে বাবা বলে ডাকবে। তার ছোটো ছোটো হাত-পা আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবো। উফ! আমি আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না বউ। আমি যে এসব বছর দুয়েক আগেও কল্পনা করিনি। ধন্যবাদ রোজা, আমার জীবনে আলো হয়ে আসার জন্যে!”
রোজা অধরে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বললো,
–“এই ধন্যবাদ যে আপনার প্রাপ্য সাইয়ান। আপনি আমার রঙহীন জীবনকে রঙিন করে দিয়েছেন। আপনার ভূমিকা আমার জীবনে তীক্ষ্ণ আলোর মতোই। আপনি এবং আমার ভেতরের আরেক প্রাণ আমার জীবনকে আরও রঙিন করে দিলো যে। আপনারা সম্পূর্ণ করেছেন এই প্রাণহীন রোজাকে।”
সাইয়ান জড়ানো কন্ঠে বললো,
–“ভালোবাসি!”
মেহের সারিমকে খোঁচালো। সারিম কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
–“কিছু বলবে?”
মেহের নজর নামিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,
–“আমারও বাবু চাই!”
সারিম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো মেহেরের দিকে। সারিম কড়া গলায় বললো,
–“নিজেই একটা বাচ্চা আবার সে নাকি বাবু চায়। থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপ করে থাক। পড়াশোনা শেষ না করা অবধি এসব ভূত ভুলেও মাথায় আনবি না।”
মেহের ঠোঁট উলটালো। বললো,
–“এভাবে ধমক দিতে পারলেন? আপনার কী বাবু পছন্দ না?”
সারিম মেহেরের কথায় না গলে বললো,
–“এখন যে আসছে তাকে আরও কয়েকটা বছর দেখতে থাক। এরপর তোরও কোল জুড়ে এক ফুল আসবে!”
মেহের চোখ-মুখ চিকচিক করে বললো,
–“অপেক্ষা করতে বলছেন?”
সারিম হঠাৎ মেহেরের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
–“হুম। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়।”
দূর্ভাগ্যবশত মেহের এবং সারিমের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত মাহিম দেখে ফেলে। মাহিম নাক ফুলিয়ে বললো,
–“যেখানেই যাই সেখানেই কাপল। এদিকে আমাকে দেখো, আমি-ই সিঙ্গেল থেকে গেলাম! বলি আমার কী বিয়ের বয়স হয় নাই? কুড়ি হয়েও মেহের বিয়ে করে ফেললো। সামিরা আপুও করলো, আমি কী দোষ করলাম?”
সারিম মাহিমের দিকে তাকালো। আর মেহের লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। লজ্জা পাওয়ার কারণ সে বুঝতে পেরেছে মাহিম তাদের দেখে নিয়েছে। মেহেরের ইচ্ছে করছে মাহিমের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। আর কোনো সময় পেলো না আসার?
মাহিমের উত্তরে সারিম হাই তুলে বললো,
–“আমার বয়সী হ, তারপর বউয়ের মুখ দেখিস। এতদিন অবধি চালিয়ে যা তোর ফ্লার্টগিরি!”
মাহিমের মুখ তখন দেখার মতো। ম্লান কন্ঠে বললো,
–“ফ্লার্ট করতেও আজকাল ভালো লাগে না ভাইয়া। মন সারাদিন বউ বউ করে!”
সারিম এবার চোখ রাঙিয়ে বললো,
–“এখান থেকে যাবি তুই?”
মাহিম নাক কুঁচকালো। উলটো পথে হাঁটা দিয়ে মিনমিন করে বললো,
–“আল্লাহ্’র কাছে বিচার দিলাম। আমাকে এভাবে সিঙ্গেল রাখার জন্য!”
~[সমাপ্ত]
বিঃদ্রঃ আলহামদুলিল্লাহ। প্রায় চার মাস পর বাসন্তীগন্ধা শেষ হলো। গল্পটা মনমতো সাজাতে পারিনি। এ নিয়ে আমি হতাশ। অনেক ভুলত্রুটি ছিলো, লেখাতেও অসংখ্য ভুল। এই প্রথম গল্প শেষ করেও শান্তি পাচ্ছি না। খুঁতখুঁত করছে মন। আপনাদের মন্তব্য কী গল্পটি নিয়ে? অবশ্যই জানাবেন প্লিজ। শেষবারের মতো আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়া জানানোর অনুরোধ। আমি অপেক্ষা করব আপনাদের মন্তব্য দেখার জন্যে।
অবশেষে অবশ্যই ভালোবাসা এবং ধন্যবাদ, এই গল্পটাকে ভালোবাসা দেওয়ার জন্যে। এতটা ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য। আর হ্যাঁ, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকার কারণে “হৃদয়ের মেঘগলি” আপাতত স্থগিত রাখছি। ওটা গুছিয়ে লেখা হচ্ছে না। ইন-শা-আল্লাহ্ নতুন গল্প নিয়ে ফিরবো। কিন্তু কবে, জানা নেই।