অন্তর দহন পর্ব -০১

বিয়ে বাড়িতে লোকজন গমগম করছে।বাড়ি ভর্তি লোকজন। চারিদিকে হৈচৈ চেঁচামেচি চলছে।সবার মধ্যে কেমন একটা টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। হঠাৎ করেই সৈয়দ বাড়িতে বিয়ে বলে কেউ কেউ আবার কানাঘুষা ও করছে। আবার আলোচনা সমালোচনা ও চলছে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে।কেউ বলছে এমন কি ঘটলো যে বিয়ে দেওয়ার জন্য এতো তাড়াহুড়ো করতে হলো, আবার কেউ হা হুতাশ করে বলছে মেয়েটার কপাল বুঝি পুড়লো এবার। অনেকেই আবার মজা করছে। নিকটবর্তী আত্মীয়ের মধ্যে আবার শোকের ছায়া দেখা যাচ্ছে।কত সুন্দর একটা ফুলের মতো মেয়ে তার সাথে কিনা একটা মাতাল,বদরাগী ছেলের বিয়ে হচ্ছে।

ভীর ঠেলে কেউ একজন কাঁদতে কাঁদতে এসে বললো,

__চন্দ্র?কেনো রাজি হলি এই বিয়েতে?তোর কপালটাই এবার পুড়লো রে চন্দ্র। নিজের হাতে নিজের কপালেই আ’গুন ধরিয়ে দিলি?

__আহ্ আফরা!চুপ কর তুই। চন্দ্র কে এসব কথা এখন তোর না বললেই নয় নাকি?আর এমন কোনো ক্ষতি হয়নি যে তোকে এভাবে হা হুতাশ করতে হবে আফরা।

__বড় আপা ঠিক বলেছেন মেঝো আপা। তুই এমন করে বলছিস যেনো চন্দ্র কোনো বিপদে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে?

__দেখ ইরু তুই বুঝবি না এসব। চন্দ্র ছোট মানুষ।ভালো খারাপের বোধ হয়নি চন্দ্রের।তাইতো এমন একটা সিদ্ধান্তে রা কাটতে পারেনি মেয়েটা।তাই বলে ওর মেঝো ফুপি হয়ে আমি ওকে ভালো মন্দের বোধ দিবো না? কেমন করে বললি রে তুই ইরু?

__দেখ আফরা অনেক সময় ধরে তোর বকবকানি শুনছি।চুপ করবি নাকি?

__আমি তো ভুল কিছু বলছিনা বড় আপা।

__সঠিক ও কিছু বলছিস না আফরা। এখন যদি ছোট ভাইয়া বা ভাবী চলে আসে ?কি হবে ভেবে দেখেছিস?

__আসলে আসুক। আমি মিথ্যা কিছু বলছি না বড় আপা।

__চুপ করবি এবার?সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে আফরা। ভাইয়া ভাবী শুনলে কত কষ্ট পাবে ভেবেছিস?

__এই দেখো বড় আপা আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেনা তুমি। তুমি বলো স্পন্দনের মতো একটা মাতাল, একরোখা, বদমেজাজি ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে ছোট ভাই ভাবী কিভাবে রাজী হতে পারলো?বলো আমাকে?

__আফরা?

__জ্বী জ্বী বড় ভাইজান।

__এটা একটা বিয়ে বাড়ি আফরা। আশাকরি আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে দাঁড়িয়ে তুমি এমন কোনো কথা বলবে না যাতে এই সৈয়দ বাড়ির মান সম্মান সব ধুলায় মিশে যায়।

__জ্বী আজ্ঞে ভাইজান।

__তাহলে কান খুলে শুনে রাখো আফরা তোমার মুখে দ্বিতীয়বার এই বিয়ে নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। ভুলে যেওনা এই সৈয়দ বংশের মেয়ে তুমি ও।তাই মান সম্মান একটু গেলেও তোমার ও যাবে।

__আমার ভুল হয়ে গেছে বড় ভাইজান।আর এমন ভুল হবেনা।

__আন্জুমান?

__জ্বী বড় ভাইজান।

__ওদিকে গিয়ে দেখো আত্মীয় স্বজনদের যত্নের যেনো কোনো ত্রুটি না হয়। সৈয়দ বাড়ির বড় ছেলে আর ছোট মেয়ের বিয়ে।বিয়েটা যেনো হাসি খুশিতে হয় খেয়াল রেখো।

__জ্বী ভাইজান।

সৈয়দ মির্জার কথা শুনে আফরার মুখে কুলুপ এঁটে গেলো।শাড়িটা একটা ঝাড়া দিয়ে গটগট করে হেঁটে বেড়িয়ে গেলেন আফরা।আন্জুমান চোখ দিয়ে ইরুকে ইশারা করলেন চন্দ্রের কাছে যেতে।ইরু সায় দিতেই উনিও চলে গেলেন অন্দরে।ইরু গিয়ে চন্দ্রের পাশে বসে হাতে হাত রেখে বললো,

__চন্দ্র?

__জ্বী ছোট ফুপি।

__মেঝো আপার কথায় মন খারাপ করিস না মা। জানিসই তো মেঝো আপা বরাবরই কেমন টেরা। সোজা কথা কখনো বলতেই পারেন না।

__আমি কিছু মনে করিনি ছোট ফুপি।

__এই বিয়েতে তুই খুশি তো চন্দ্র?

__আমি আব্বুর বাধ্য সন্তান ছোট ফুপি। আব্বু যখন যা বলেছেন আমি তখন তাই করেছি। আব্বু চেয়েছেন আমি যেনো বিয়েটা করি। আমি আব্বুর সিদ্ধান্ত চুপচাপ মেনে নিয়েছি ফুপি।

ইরুর বুকটা কেঁপে উঠলো। তারমানে বিয়েতে চন্দ্রর মত নেই। শুধু মাত্র ছোট ভাইয়ের কথায় এই বিয়েতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এখন তো আর সময় ও নেই এই বিয়ে আটকানোর।যাই হোক আল্লাহ আল্লাহ করে ভালো কিছুই হোক।শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো চন্দ্রের আড়ালে বসে। বললেন,

__আম্মু ! বড়রা সব সময়ই ছোটদের ভালো চান। তোমার ও ভালো চেয়েছেন।এই নিয়ে মনে আর কোনো ক্ষোভ বা অভিমান অভিযোগ রেখো না চন্দ্র।

চন্দ্র শুকনো মুখে হাসি দিয়ে বললো,

__খুব বেশি ভালো চেয়েছেন ফুপি।এতো ভালো না চেয়ে আমাকে মে’রে ফেললেই তো পারতো আব্বু।

__চন্দ্র? আম্মু এমন কথা মুখে আনতে নেই।সব ভালো হবে আম্মু।

চন্দ্র চুপচাপ বসে রইল।নিরা আর মিতু এলো এমন সময়। চন্দ্রের মেঝো চাচার মেয়ে নিরা আর বড় ফুপির মেয়ে মিতু। চন্দ্র ওদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসলো। ওদের দুজনের চোখে জল ছলছল করছে।কোনো রকম সেটা আটকে মিতু বললো,

__চন্দ্র বর দেখে আসলাম।বর বেশে স্পন্দন ভাইয়াকে একদমই রাজপুত্র লাগছে।কিরে নিরা বল তুই কিছু?

__হু হুম চন্দ্র।মিতু ঠিকই বলেছে। ছোট্ট বেলায় দাদির মুখে মুখে যেমন রাজপুত্রের গল্প শুনতাম।ঐ যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে আসতো। ঠিক তেমনি দেখতে লাগছে ভাইয়াকে।

__সান্তনা দিতে এসেছো তোমরা আপু?

মুখটা কালো হয়ে গেলেও বহুকষ্টে আবার হাসি হাসি মুখে মিতু বললো,

__সত্যি বলছি চন্দ্র। আমি তোর বড় আপু। আমার উপর বিশ্বাস নেই?

__বিশ্বাস তো আব্বুর উপর ও ছিলো মিতুপু। আব্বু কেনো আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো?বলতে পারো এই চন্দ্র আজ পর্যন্ত এই বাড়ির কারো কথা শুনে নি এমন হয়েছে?বলো হয়েছে কখনো?তাহলে কেনো আমাকে সবাই হাত পা বেঁধে বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে আপু?

মিতু আর নিজেকে সামলাতে না পেরে চন্দ্র কে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো। চন্দ্র কাঁদছেনা।ও যেনো পাথর হয়ে গেছে। শক্ত আবরণ নিয়ে বসে থাকলে ও ভেতরে ভেতরে উথাল পাতাল ঝড় চলছে চন্দ্রের। কেউ সেটা বুঝতে পারছেনা।

দুপুরের দিকে ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়েই গেছে। এবার কনে বিদায়ের পালা। চন্দ্র কে জড়িয়ে ধরে ওর আম্মু অনেক সময় ধরে কাঁদলেও চন্দ্র কাঁদলো না।সবার থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কারো দিকে ফিরেও তাকিয়ে দেখলো না। আব্বুর হাতটা ধরে বললো,

__নিজের যত্ন নিও আব্বু। এখন আর তোমার চন্দ্র থাকবে না যে সময় মতো তোমার সবকিছুই খেয়াল করে রাখবে। আম্মুকে দেখে রেখো।আসছি আব্বু।

সৈয়দ আশরাফ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। চন্দ্র পেছনে ফিরে আবার একবার বাড়িটাকে চোখ বুলিয়ে দেখলো। এরপর গাড়িতে স্পন্দনের পাশে গিয়ে বসলো।স্পন্দন ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে।যেনো বিয়েতে তার কিছুই আসে যায় না। চন্দ্র একবার ও তাকালো না স্পন্দনের দিকে।সিটে হেলান দিয়ে বসে ভাবতে লাগলো,

সেই ছোট্ট বেলার থেকে এই বাড়িতে বড় হয়েছে।এই বাড়ির প্রতিটি ইট বালি সিমেন্টের কোনায় কোনায় তার পদচারণায় মুখরিত হয়ে থাকতো এক সময়। আজকে সেই বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হচ্ছে।এটা তার জন্য হৃদয় বিদারক। তবুও কেনো আজকে তার কান্না পাচ্ছে না?কেনো হাউমাউ করে কেঁদে নিজেকে হালকা করতে পারছেনা?কি একটা যেনো গলায় চাপা দিয়ে আছে শুধু।মনে হচ্ছে কথাগুলো আটকে আছে সেখানে। শুধু নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে আছে আজকে চন্দ্র।

বড় আব্বুর বাড়িতে পৌঁছে গেছে এর মধ্যেই। এখন তো বড় আব্বুর বাড়ি নয় শ্বশুর বাড়ি বলতে হবে।মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো চন্দ্র।দেখে বড় আম্মু বরণডালা হাতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।চোখে চোখ পড়তেই চন্দ্র ও একটা শুকনো হাসি দিলো।স্পন্দন নেমে গিয়ে চন্দ্রের পাশের দরজা খুলে দিল। চন্দ্র একটু অবাক হলো।এতটা স্বাভাবিক কিভাবে আছে স্পন্দন?সাত পাঁচ না ভেবে নেমে পড়লো চন্দ্র।বড় আম্মু এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,

__আমার চন্দ্র। কেমন আছিস আম্মু?

__ভালো আছি। তুমি কেমন আছো,,

__বড় আম্মুকে কি বলবি তাই ভেবে পাচ্ছিস না?

চন্দ্র মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যি তো তাই ইতস্তত করছে।এর মধ্যেই আফরা এসে বললো,

__কেনো বড় ভাবী? তোমাকে আম্মা বলেই ডাকবে চন্দ্র এখন থেকে। এখন আর পুরনো সম্পর্ক নেই। এখন তুমি শ্বাশুড়ি আম্মা চন্দ্রের।

__তুমি ও না আফরা? আমি আজীবন চন্দ্রের বড় আম্মু।সেটা বলেই ডাকবে ও।

__কি জানি বাপু? তোমাদের যে কখন কি মনে চায় কে জানে?

বলেই আফরা চলে গেলো।

__আফরার কথায় কিছু মনে করিস না আম্মু।চল ভেতরে চল।

রাতে বাসর ঘর সাজাতে গিয়ে ভাই বোনেরা খুব মজা করছে।আর স্পন্দন ছাদে একা দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলছে,

__চৈত্রের দহন যদি তোমাকে পোড়াতেই না পারে?
তাহলে তুমি আর প্রেমিক হতে পারলে কোথায়?
শুষ্ক মরুর বুকে তোমার এক ফোঁটা বর্ষণ যদি প্রাণ দিতে না পারে?
তবে তুমি ছলনায়ীর মায়ায় পরেছিলে, প্রেমিক হতে পারো নি!

#অন্তর_দহন
#সূচনা_পর্ব
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

#চলবে,,,,,,,,

লেখিকার লেখায় ভুল ত্রুটি থাকলে তা মার্জনা করবেন।লিখতে না পারলেও চেষ্টা করেছি। আশাকরি সবার ভালো লাগবে।সবার সাথে থাকবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here