বিকেল বেলার রোদ পর্ব ৬

#গল্পঃবিকেল বেলার রোদ
#পর্বঃ০৬
#লেখাঃনুসরাত মাহিন

বাড়ির গেইটের বাহিরে দূরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছি মা – বাবাকে এক নজর দেখার জন্য। কত মাস হয়েছে মা- বাবকে দেখি না। আজ ফরম ফিলাপের লাস্ট ডেট ছিল। আমাদের কলেজের ইংলিশের টিচার রায়হান স্যার আমাকে অনেক পছন্দ করে। ফোন কেনার পরে স্যারের সাথে সাথে প্রায়ি যোগাযোগ করি। স্যারের কাছ থেকে বাবা- মায়ের খোঁজ খবর নেই। স্যার ফরম ফিলাপের সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল আমি গোপনে কলেজে এসে স্বাক্ষর করে টাকা দিয়ে চলে এসেছি।

মাঝে মাঝে পর ও আপন হয়ে যায় আজ লোকমান চাচা যদি টাকা না দিত তাহলে হয়তো আমার ফরম ফিলাপ করা হতো না। চাচা প্রতি মাসে ওনার মেয়ের জন্য কিছু টাকা জামা রাখেনে সেখান থেকে টাকা উঠিয়ে আমাকে দিয়েছেন।

বাবা মাকে দেখে আমার বুক বুমরে মুচরে যাচ্ছে। মা আগের থেকে শুকিয়ে গেছে আর বাবার চেহারা কেমন যেন মলিন হয়ে গেছে।

রাতের বাসে ঢাকা চলে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু রায়হান স্যার জোড় করে ওনার বাসায় নিয়ে এসেছে।

মানুষের কাছাকাছি না গেলে বোঝা যায় না সে কতটা সুখি, কতটা দুঃখী। স্যার কে দেখলে মনে হয় কত সুখি একটা মানুষ কিন্তু বাস্তব জীবনে সে অনেক কষ্টের মধ্যে আছে।

যে সকল পুরুষ ঘরজামাই থাকে শ্বশুর বাড়ির মানেষের কাছে তাদের কোন মূল্যায়ন থাকে না।

বেকার মানুষ ঘর জামাই থাকে সেটা আলাদা বিষয় কিন্তু কর্মজীবী হয়েও যদি শ্বশুর বাড়ি থাকে লজ্জার বিষয়। এই সব মানুষ পুরুষের মধ্যে পরে না।

স্যার বিয়ের পর থেকেই শ্বশুর বাড়ি থাকে। আজকে বাসায় ঢোকার সাথে সাথে স্যারের শ্বশুরের কাছে খেল একটা ঝারি। এখন স্যারের বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। জিজ্ঞেস না করে কেন আমাকে বাসায় এনেছে । ইচ্ছে করেছিল চলে যাই শুধু স্যার কষ্ট পাবে এই জন্য যাইনি।

স্যারের স্টাডি রুমে বসে আছি। আমাকে থাকার জন্য স্টাডি রুমে ফ্লোরমেট করে দিয়েছে। এ বাড়ির কাজের লোকের কথায় যা বুঝলাম। স্যারের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কখন ও স্যারের সাথে ভালো ব্যবহার করে না এমন কী স্যারের সঙ্গে এক সাথে খেতেও বসে না গরিবের ছেলে এই জন্য। বাড়ির সবাই খাবার খাওয়ার পরে স্যার খাবার খায়।

— স্যার একটা কথা বলি..??

— কী কথা..?

— আপনি ঘর জানাই থাকেন কেন..??

— ঘরে যে জামাই থাকে তাকে ঘর জামাই বলে। জামাইরা তো সব ঘরেরই থাকে সব জামাইরা ঘর জামাই কেউ পর জামাই না।

— স্যার নিজের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ি থাকা কী এক বিষয় হলো। আত্নসম্মান থাকলে কেউ কী বউয়ের বাবার বাড়ি থাকে..?।

— সবাই ভাবে আমি মনে হয় সম্পত্তি লোভে শ্বশুরের বাড়ি থাকি পরে আছি। আমি এখানে ইচ্ছা করে থাকি না বাধ্য হয়ে থাকি। সাদিয়া বাবার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকবে না। এই বিষয় নিয়ে প্রায়ি ঝগড়া হয় সাদিয়ার এক কথা মা বাবাকে ছাড়া এক দিনও থাকতে পারবে না। ভেবেছিলাম বাবা মায়ের একটা একা থাকতে পারবে না তাই জোড় করিনি বাচ্ছা কাচ্চা হলে ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু না সাদিয়ার কোন পরিবর্ত হয়নি এখন আরো বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে আমার কোন কথাই শোনে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই শুধু সন্তানে মায়ায় পরে আছি। এমনিতে নাচোনের বুড়ি তার উপরে দেয় ঢোলের বারি। সাদিকে কিছু বললে আমার শ্বশুরে বাড়ির লোকেরা হট্টোগোল শুরু করে দেয়।

— সহধর্মিণী মানে সারাজীবনের সঙ্গী সুখে দুঃখে এক সাথে থাকা। ভাবি কী চোখে দেখে না এ বাড়ির সবাই প্রতিনিয়ত আপনাকে অপমান অপদস্থ করছে। স্ত্রী সম্মান রক্ষা করা যেমন স্বামীর দ্বায়িত্ব ঠিক তেমনি স্বামীকে সম্মান ধরে রাখা স্ত্রীর দ্বায়িত্ব। একটা কথাবলি কিছু মনে করবে না স্যার একজন ভালো স্ত্রীর হবার জন্য যে সকল গুনাবলী থাকা দরকার তা ভাবির মধ্যে নেই।

— কী মনে করবো এটাই আমার প্রপ্য ছিল। আল্লাহ আমার বিচার করছে এটা আমার পাপের শাস্তি। আমি যেমন আমার বাবা মাকে অপমান করেছি। আল্লাহ আমাকে মানুষের দ্বারা প্রতিনিয়ত অপমানিত করাচ্ছে।

সকাল বেলা স্যারের কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকায় চলে আসলাম।

***

দুই’দিন ধরে জুনায়েদের কোন খোঁজ পাচ্ছি না। প্রতিদিন রিকসা নিয়ে ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
কেন জানি চিন্তা হচ্ছে কোন সমস্যা হয়নি তো। এই কয় মাস ধরে ওর রিকসায় যাওয়া আসা করি অথচ বোকার মতো ঠিকানাটা নেওয়া হলো না। শুধু একদিন আমার বন্ধুবি নিগার কে দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে ছিলাম। বাসায় এসে দেখি দিপা আন্টি মুখ ভার করে বসে আছে।

— দিপা আন্টি তোমার কী মন খারাপ…??

— হুম

— কী হয়ছে কোন সমস্যা..??

— কীভাবে বলি নিজের মা বলতে লজ্জা লাগে। দিন দিন ভাবির উপরে মায়ের অত্যাচার বেরেই চলেছে। ভাবির জন্য আমার খুব খারাপ লাগে মাকে এত করে বলি কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। এদিকে বিন্দু আমার ভাইয়ের মেয়ে অনেক অসুস্থ। মা ভাবিকে দিয়ে বাসার সব কাজ করায় ঠিক মতো খাবার ও সময় পায় না। তাছাড়া ভাবিকে ঠিক মতো খাবারটাও খেতে দেয় না।
অসুস্থ মেয়েটার দেখাশোনা করবে সেই সময়টাও ভাবি পায় না।

নিজের সন্তানের বেলায় ষোল আনা বোঝে অন্যের সন্তানের বেলায় এক আনাও না। মায়ের কাজ কারবার দেখলে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যায় রাগ হয়ে বাড়িতে যাই না। বাসায় বসে আমরা সবাই যখন খেতে বসি মা তার নিজের সন্তানের প্লেটে বড় বড় মাছ, বাটি ভরা গোস্ত তুলে দেবে। ছেলের বউদের প্লেটে সব থেকে ছোট টুকরা টা দেবে আর গোস্ত দুই এক টুকরার বেশি না। ভাবিদের বেলায় মায়ের একটাই ডায়লগ মাইয়া মাইষের বেশি খাইতে হয় না। এটা কেমন বিচার তুই বল । এই সব নিয়ে মায়ের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম পাঁচ মাস হয়েছে বাড়িতে যাই না।

— তোমার ভাইয়া ও কী তোমার মায়ের মতো..?

— আমার ভাই হচ্ছে হৈমন্তী গল্পে অপু। আমি ভাবতাম অপুদের মতো পুরুষেরা গল্পেই থাকে কিন্তু বাস্তবেও যে অপুর দেখা পাব কল্পনাও করিনি। এসব মেরুদণ্ডহীন পুরুষদের কে বিয়ে না করে সারাজীবন একা থাকা উচিৎ। জানিস নাবিলা আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে আমার পরিবারের মানুষগুলোকে গাছের সাথে বেঁধে পিটাতে পারতাম। আমার ভাবিটা অনেক ভালো একটা মানুষ। ভালো মানুষের কপালে আল্লাহ কেন যে এত কষ্ট লেখে।

— দিপা আন্টির কথা শুনে আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমার আপুর উপরেও তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এর থেকেও বেশি অত্যাচার করেছিল।

আজ এইচ এস সি ফাইনাল কোচিংনের প্রথম ক্লাশ নিতে গিয়ে অবাকের চূরান্ত সীমানায় পৌছিয়ে গিয়েছি। জুনাদেয় ক্লাশের প্রথম ব্যাঞ্চে বসে আছে তারমানে ও রিকশা চালানোর পাশাপাশি পড়াশুনা করে। সেই প্রথমদিন বাসে বসে যে ড্রেস পরা দেখেছিলাম আজ সেই পোশাক পরা শুধু পার্থক্য অগের থেকে গায়ের রংটা মলিন হয়ে গেছে । জুনায়েদকে দেখে মনে হয় না কোন গরিব ঘরের সন্তান। ওর রিকশা চালানোর পিছনে নিশ্চোই কোন কাহিনী আছে।

ক্লাসের সব স্টুডেন্টদের সাথে পরিচিত হলাম।

জুনায়েদ আমাকে চিনতে পারিনি আর পারবেইবা কী করে ও তো আমার চেহারা কখন দেখেনি। ভার্সিটি ক্লাস রুম আর কোচিং ছাড়া আমি বাহিরে কখন মুখ খুলে চলা ফেরা করি না। মামা ঢাকায় আসার সময় বলে দিয়েছিলো বাহিরে মুখ খুলে চলাফেরা যেন না করি। কবির আমাকে খোঁজার জন্য ঢাকা আসবেই । মামার কথা ঠিকি সত্যি হয়েছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির এডমিশন পরীক্ষার দিন কবিরকে আমি ইউনিভার্সিটির সামনে দেখেছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে আমি সব সময় বোরখা পরে যাই। কোচিং এ থ্রিপিজ পরে হিজাব পরে যাই । জুনায়েদ ইউনিভার্সিটির আমাকে আর কোচিংনের আমাকে কখন এক করতে পারবে না।

দিন দিন জুনায়েদকে আমি যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি ছেলেটা অনেক জিনিয়াস শুধু হিসাব বিজ্ঞানে একটু কাচা।

ক্লাস শেষ করিয়ে কোচিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি জুনায়েদ জন্য অপেক্ষা করছি।

— জুনায়েদ ভাইয়া

— জি আপু কিছু বলবেন..??

— হ্যাঁ একটু কথা ছিল

— জি বলেন

— ভাইয়া আপনি কোচিং শেষ হবার পর কী করেন..??

— তেমন কিছু করিনা

— ব্যস্ত থাকেন নাকি ফ্রি থাকেন..??

— ফ্রি থাকি। কেন বলেন তো..??

— আপনি অন্য সব সাবজেক্ট তো অনেক ভাল। হিসাব বিজ্ঞানে অনেক উইক। এই একটা বিষয়ের কারনে এ প্লাস মিস হয়ে যাবে তাই বলছিলাম আপনি যদি চান তাহলে কোচিং শেষ হবার পরে আমি আপনাকে আধাঘণ্টা হিসাব বিজ্ঞানটা দেখিয়ে দিতে পারি।

— ধন্যবাদ আপু যদি হেল্পটা করেন আমার অনেক উপকার হতো। আসলে আমি নিজে থেকে আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আপু আপনি খুব সহজে বুঝাতে পারেন অন্য কার কাছে পড়ে আমি এত সহজে বুঝিনি।

— ওকে আগামিকাল থেকে আপনাকে আমি পড়ানো শুরু করব।

এই জুনায়েদ ছেলেটাকে দেখলে আমি নিজেকে কন্টোল করতে পারি না।ইচ্ছে করে সারাক্ষন জুনায়েদের দিকে চেয়ে থাকি। আমি জানি না কী করব জুনায়েদের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পরেছি ।
জুনায়েদের সাথে কোন মেয়েকে কথা বলতে দেখলে আমার খুব হিংসা হয়।

জুনায়েদ কে কী আমি ভালবাসি..??

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here