# বিচ্ছেদ ১৭
আশিক গরম কফিতে চুমুক দিলো।
সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায় ওর, দিনের শেষ কফিতে চুমুক দিলেই।
অদ্ভুত এক প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়ে ওর মনে।
বিয়ের পর পরই রিয়া জানতে পেরেছিল আশিকের এই অভ্যাসের কথা।
স্ট্রং ব্লাক কফির প্রতি ওর দূর্বলতার কথা।
রিয়া বুদ্ধিমতি মেয়ে।
খুব জলদি সে আশিকের পছন্দের স্ট্রং ব্লাক কফি বানানো শিখে নিয়েছিল।
সকালে এবং রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে রিয়ার হাতের কফিতে মারাত্মক অভ্যস্হ হয়ে পড়েছিল আশিক।
ডিভোর্সের পর খুব কষ্ট হত আশিকের।
কফিতে কোন স্বাদ পেতো না।
রিয়ারও কি কষ্ট হতো আশিকের জন্য ?
ওরা প্রায়ই রাতে বের হয়ে যেতো শুধু কফি খাওয়ার জন্য। ঢাকা শহরের ভাল ভাল কফিশপ গুলো খুঁজে খুঁজে বের করতো আশিক।
কফি খেতে খেতে গল্প করতো।
রিয়ার ছোট ছোট সপ্নের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতো আশিক।
রিয়ার হাতে হাত রেখে বলতো,
তোমার সপ্নপূরণে আমাকে সবসময় তোমার পাশে পাবে।
আশিকের থাকা হয়নি রিয়ার পাশে।
রিয়া কি আজও সেই সপ্নগুলো দেখে ?
নাকি সম্মানজনক ভাবে বাঁচার জন্য লড়তে লড়তে ক্লান্ত রিয়া ?
কষ্ট হয় আশিকের।
কেন নিজের কথা রাখতে পারলো না ?
রিয়া খুব ভাল আবৃতি করতো।
কত যে কবিতা ওর মুখস্হ থাকতো !
কথায় কথায় কবিতার লাইন আওড়াতো।
রিয়া কথাও বলতো খুব মিষ্টি করে।
কবিতার চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তুলতো আবৃতির অপূর্ব মূর্ছনায়…
আশিক অসম্ভব কবিতা ভালবাসতো।
এখনো বাসে। কবিতা পড়া এবং শোনা আশিকের প্রিয় অভ্যাস।
তাই রিয়ার সাথে তার কবিতার প্রেম চলতো.. অহর্নিশি। কি মায়াময় ছিল সেসব দিন !
মানুষ জানতে পারেনা তার ভবিষ্যৎ কি ?
তাই এত এত পরিকল্পনা করে, সপ্ন দেখে।
ওদের সপ্ন আর পরিকল্পনার মাঝখানে.. ইগো আর জেদ চলে এসেছিল।
রিয়া সাজতে খুব ভালবাসতো।
তবে খুব পরিপাটি করে সাজতো।
একটা স্নিগ্ধ ভাব ফুটে উঠতো রিয়ার সমস্ত অবয়বে। আশিক রিয়ার এই পরিপাটি সাজ খুব পছন্দ করতো। রিয়া এখনো আগের মতই খুব পরিপাটি সাজে। তবে কোথাও একটা কিছু কম আছে, আশিক সেটা ধরতে পারেনি।
কেবলই মনে হয়েছে, কোথাও কিছু মিসিং !
রিয়া কি আবার কোনদিন সেই আগের মত করে শুধু আশিকের জন্যেই সাজবে ?
জানে না আশিক।
একবার আশিক অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপে খুব ব্যস্ত ছিল অফিসের কাজ নিয়েই। রিয়ার দিকে ভাল করে তাকানোর সুযোগই পায়নি সেদিন।
রিয়া ঐদিন শাড়ী পরেছিল।
তারপরও সবই ঠিক ছিল।
রাতে খাবার টেবিলে গিয়ে আশিক বুঝতে পারলো রিয়া ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে,কথা বলছেনা।
কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও ঠিকমত উত্তর পেলো না,আবার রিয়ার মনের মেঘও কাটছিলো না। রাতে ঘুমোতে এসে আশিক টের পেয়েছিল রিয়া কাঁদছে।
বিচলিত হয়ে আবারও জানতে চেয়েছিল আশিক, কি হয়েছে ?
অনেক কথা বার্তার পর আশিক বুঝতে পেরেছিল অভিমানের কারণ।
সন্ধ্যা থেকেই শিখার সাথে ফোনে বার বার কথা বলতে হচ্ছিলো। শিখা আশিকের ক্লাসমেট। ওরা একসাথে বুয়েটে পড়েছে।ওরা একই ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করতো,পোস্টিং আলাদা জায়গায় ছিল। পেশাগত বিষয় নিয়েই সেদিন বার বার শিখার সাথে কথা বলতে হচ্ছিল।কথা বলার সময় বার বার রুমে এসে ল্যাপটপের সামনে বসতে হচ্ছিল,জরুরী তথ্যের জন্য।
রিয়া ভেবেছে আশিক আলাদা করে কাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে যে, একবারও ভাল করে তার দিকে তাকাতে পারলো না ?
আশিক বুঝতে পেরে হো হো করে হেসেছিল ঘর ফাটিয়ে। যদিও রিয়ার মান ভাঙাতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
বেলী ফুলের মালা, রাত জেগে গল্প করা, এরকম আরো কত কি করে ওর মান ভাঙ্গিয়েছিল। বেলী ফুলের মালা হাতে নিয়ে রিয়া বলেছিল,তোমার পাশে কাউকে সহৃ করতে পারবো না।
আশিক হেসে বলেছিল,দূর ! শিখা তো আমার ক্লাসমেট। তুমি তো না বুঝেই অভিমান করে বসে আছো। আর আমার পাশে অন্য কাউকে সহৃ করতে হবে কেন ?
তুমি ছাড়া এখানে অন্য কারো এন্ট্রি হবেনা,বুঝেছো বোকা মেয়ে ?
সময়ের সাথে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।
ওরা ছিটকে পড়লো জীবনের আলাদা পথে।
আশিকের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও রিয়ার কি কষ্ট হয়েছিল নীলার কথা জানার পর ?
খুব জানতে ইচ্ছে করে আশিকের।
রিয়াকে বলেছিলো যদিও কারো এন্ট্রি হবেনা,তবুও নীলার আগমন ঘটেছিল জীবনে। ক্ষমা করো রিয়া,মনে মনে বললো আশিক।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বাবা-মাকে দেখে অবাক হয়ে গেল রিয়া।
বাবা-মা এসেছেন ওর বাসায়। রায়না খুব খুশী নানাভাই-নানুকে পেয়ে। মা ওকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর রায়না টিভিতে কার্টুন দেখছে।
বিকেল চারটায় রায়নার গানের ক্লাস আছে। রহিমা খালা নিয়ে যাবে।
আজ রায়নার গানের ক্লাসেও যেতে ইচ্ছে করছেনা একটুও।
নানাভাই – নানু এসেছে তাদের বাসায়।
তাদেরকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা।
রিয়া খুশী খুশী গলায় বাবাকে বললো, কি ব্যাপার বাবা, হট্যৎ চলে এলে যে ?
বাবা হাসলেন, খুব দেখতে ইচ্ছে করলো তোদের । সেদিন গিয়ে তো বেশীক্ষণ থাকলিও না। তাই আমরাই চলে এলাম।
খুব ভাল করেছো বাবা। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি। একসাথে খাব, বলতে বলতে রিয়া তার বেডরুমের দিকে চলে গেল।
বাবা-মায়ের সাথে খেতে বসেছে রিয়া। মা হটপট ভর্তি করে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছেন। রিয়ার এবং রায়নার সব পছন্দের খাবার। চিংড়ি মাছ দিয়ে কাঁচ কলার মোচার
ঘন্ট,শুটকি, গরুর মাংস, হাঁসের মাংস এবং গলদা চিংড়ীর মালাইকারি। মালাইকারিটা বিশেষভাবে রায়নার জন্য।
মা বললেন, সব খাবারই অল্প অল্প করে খেয়ে দ্যাখ।
রিয়া আঁতকে উঠে বললো, কি বলো মা ! এত খাবার একসাথে খাওয়া যায় নাকি ?
পরে খাব। এখন আমি মোচার ঘন্ট আর শুটকি দিয়ে ভাত খাব। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাইনি বলো তো মা ?
মা হাসলেন।
ওরা গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করলো।
মা রায়নাকে নিয়ে পাশের রুমে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করছেন। রায়না গল্প শুনতে খুব ভালবাসে।
বাবা টিভিতে ডিসকাভারি চ্যানেল দেখছেন।
রিয়া চা নিয়ে বাবার পাশে এসে বসলো।
ইন্ডিয়ান সেনা অফিসারদের কমান্ডো ট্রেনিং দেখচ্ছে। কত কঠিন কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয় টগবগে তরুণ অফিসারদের না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
ঠান্ডা গভীর জলে পা দু’টো বেঁধে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা খুব কঠিন একটা প্রশিক্ষণ।
সবাই সারভাইভ করতে পারেনা। দু’জন অফিসার মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারলো না,অসুস্হ হয়ে পড়লে তাদেরকে দ্রুত এমার্জেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হলো।
আবার কয়েকজন অফিসার কঠিন মনোবলের সাথে প্রশিক্ষণ শেষ করলো।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে রিয়া বললো, কত কঠিন ট্রেনিং দেখেছো, বাবা ?
বাবা মাথা ঝাঁকালেন।
রহিমা খালা বিকেলের নাস্তার জন্য ডালের পিয়াজু আর ঝাল মুড়ি মাখানোর জন্য সবকিছু গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,আমি রায়না বাবুর কেলাস থ্যাইকা আইসা নাস্তা বানাইয়া দিমু সগলরে।
রিয়া হাসলো, ঠিক আছে।
পৌনে চারটায় রায়না গানের ক্লাসের জন্য বের হয়ে গেল রহিমা খালার হাত ধরে। গেটের বাইরে গিয়েই রিক্সা নিয়ে নেবে।
রিয়া বাবা মাকে নিয়ে ওর বেডরুমে বসে গল্প করছে। বাবা বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। মা বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসেছেন। রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে রায়নায় যাওয়া দেখলো।
বড় কামিনী গাছটার আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত রিয়া দাড়িয়ে থাকে।
এই গাছ টা অনেক পুরনো আর বড়। রাতের বেলা যখন ফুল ফোটে তখন রিয়ার ঘরেও সেই ফুলের সুবাস ছুটে আসে।
রিয়ার মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায় কামিনীর সুগন্ধে।
রিয়া ঘরে এসে বিছানার আরেক পাশে বসলো। টুকটাক কথা-বার্তার পর মা বললেন,তুই কি সিদ্ধান্ত নিলি ?
রিয়া আচমকা মায়ের এই প্রশ্নে একটু বিব্রত হলো। কিছু বললো না। চুপ করে থাকলো।
মা তখন বললেন, সেদিন তোর ছোট খালা এসেছিল। আশিক দেশে এসেছিল শুনে জানতে চাইলো, সে কি তোদের ফিরিয়ে নিতে এসেছিল কিনা। আমি হ্যাঁ বলেছি।
রিয়া মার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
কিছু বললোনা।
সত্যিই তো আশিক তাদের ফিরিয়ে নিতেই তো চাইছে। মা তো এক অর্থে ঠিকই বলেছেন। মার জন্য রিয়ার কষ্ট হলো।
রিয়ার এমন একাকী জীবন মা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না মনে মনে।
কতবার রিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে, রিয়ার নতুন করে শুরু করা উচিৎ।
ছোট খালা,মেঝো খালা আগে কত প্রস্তাব নিয়ে আসতো রিয়ার জন্য। বাচ্চা সহই ছেলে পক্ষ রাজী আছে… এরকম কত কথা।
রিয়া রাজী হয়নি।
কেন হয়নি কাউকে বলতে পারতো না।
আশিককে এত ভালবেসেছিল, সেই আশিকের সাথেই তো ঘর করা হলোনা।
তাই অন্য কারো কথা ভাবতে ইচ্ছে হয়নি রিয়ার। আশিকের জন্যেই কি কোথাও কোন পিছুটান ছিল রিয়ার ?
রিয়া জানে না।
আশিক শান্ত স্বভাবের হলেও খুব রোমান্টিক ছিল। একবার ওরা আশিকের দেশের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। আশিক রাতের বেলা রিয়াকে নিয়ে নৌকায় ঘুরতে বেরিয়েছিল। চাঁদনী রাত ছিল।
নদীর দু’পাড়ে কত নাম না জানা গাছ। সেবারই প্রথম রিয়া হিজল গাছ দেখেছিল।
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা রিয়ার মনে এক রিদম সৃষ্টি করেছিল।
আশিক রিয়ার হাত ধরে বসেছিল।
রিয়া মুগ্ধ চোখে আশিককে দেখছিল।
ওর মনে হয়েছিল,জীবনে সব পেয়ে গেলাম।আর কি চাইবার আছে !
সেই ‘সব পাওয়া’ রিয়ার জীবনটা হট্যৎ না পাওয়ায় ছেয়ে গেল।
বাবার কথায় রিয়া বাস্তবে ফিরলো।
বাবা বললেন, কিছু কি ভেবেছিস মা ?
তবে আশিকের সাথে আবার নতুন করে সম্পর্ক টা করতে চাইলে কিছু ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে। তুই সেসব ব্যাপারে কতটা জানিস আমার জানা নেই। তাই,সেটা ভেবেই আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাই তোর সাথে।
রিয়ার মনে পড়লো এরকম কিছু কথা ভিপি ম্যাডাম সেদিন রিয়াকে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,রিয়া একবার ডির্ভোস হয়ে যাওয়ার পর আবার যদি নতুন করে পুরনো সম্পর্কে ফিরে যেতে চাও তাহলে কিছু বিষয়
ভাল ভাবে জানতে বুঝতে হবে তোমাকে। এবং সেটায় ভাল হবে তোমার জন্য।
কিন্তু কি বিষয় সেটা আর বলার সুযোগ পাননি ম্যাডাম। তার আগেই জরুরী ফোন এলো এবং তারপর ম্যাডাম প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিসে চলে গেলেন।
রিয়াও ব্যস্ত হয়ে ছিল নিজের কাজ নিয়ে,তাই আর কথা বলা হয়নি এটা নিয়ে।
রিয়া একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলো, কি ব্যাপার বাবা ?
বাবা নরম গলায় বললেন,’কিছু নিয়ম-কানুন আছেরে মা !
তুই বরং নিজেই পড়ে দেখিস।’
বাবা রিয়ার হাতে পবিত্র কোনআন শরীফ এর একটি বাংলা অনুবাদ দিলেন এবং বললেন, ‘এখানে সূরা আল-বাকারার ২২৬ থেকে ২৩০ আয়াত পর্যন্ত তালাক এবং তালাক পরবর্তী বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আল্লাহ্ তায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশনাও দেয়া আছে। আমার মনে হয় তোর জানা দরকার।’
রিয়া মাথা ঝাঁকালো পড়বে বলো।
রিয়ার ভেতরটা কেঁপে উঠলো কেন জানি।
রহিমা খালা সন্ধ্যার পর পর সবাইকে গরম গরম পিয়াজু আর মুড়ি মাখা দিয়ে নাস্তা দিলো। ওরা হৈ চৈ করে খেলো।
রিয়ার বাবা এধরনের খাবার পছন্দ করেন।
চা খেতে খেতে কত গল্প করলো ওরা।
মা রিয়ার ছোট বেলার গল্প করলেন।
রায়না খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছিলো সেই গল্প।
তখন রিয়া অনেক ছোট,স্কুলে পড়তো।
শরৎকালের এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে মা দেখলেন রিয়া ঘরে নেই।
অত সকালে একা একা বাড়ীর বাইরে যাওয়ার মত বড়ও তখন হয়নি।
মা পাগলের মত বাসার ভেতরে খুঁজলেন,
কোথাও নেই। ছাদেও নেই।
ততক্ষণে বাড়ীর সবাই উঠে পড়েছে।
ছোট রিয়া কোথায় যেতে পারে ভেবে যখন সবাই অস্হির, তখন সে ফ্রকের সামনেটা দুই হাতে উঁচু করে ধরে গুটি গুটি পায়ে বাসায় ঢুকছে।
মা রাগে কাঁপছিলেন।
বাবা অবাক হয়ে বলেছিলেন,জামার ভিতরে কি ওগুলো,মা ?
রিয়া উজ্জ্বল মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল,বাবা.. দ্যাখো কত ফুল !
ফ্রকের দু’কোনা ছেড়ে দিতেই টুপ টুপ করে ঝরে পড়েছিল অজস্র শিউলি ফুল।
ভোরের শিশিরে ভেজা শিউলি !
দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।
সেদিনও বাড়ীর সবার মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। মা আর বকুনী দিতে পারেনি বাবার কারণে।
বাসার কাছেই ছিল বড় একটা শিউলী গাছ। ভোর বেলা আশে পাশের মেয়েরা শিউলী ফুল তুলতে আসতো।
প্রতিদিন বারান্দায় দাড়িয়ে রিয়া ওদের ফুল কুড়োন দেখতো। তার ভারী ইচ্ছে করতো ওদের মত ফুল কুড়োতে।
সেদিনও ঘুম ভেঙে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছিল। মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে মেয়েগুলোর ফুল কুড়োন দেখতে দেখতে নিজেও টুক করে দরজা খোলা পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
রায়না মায়ের ছোটবেলার গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনলো। রিয়াকে বললো,মা আমিও একদিন শিউলী ফুল কুড়োতে যাব !
রিয়া হাসলো,আচ্ছা মা যাব একদিন।
মাত্র তো শিউলি ফোটা শুরু হয়েছে।
জানো তো রায়না, এটা শরৎকাল, শিউলী ফোটে শরৎকালে।
নভেম্বরের মাস।
স্কুলে এখন পরীক্ষার মৌসুম। প্রচুর ব্যস্ততা।
রিয়ার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।
রায়নার পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
নভেম্বরের ১ তারিখে জেএসসি শুরু হয়েছিল,এরপর পিএসসি। এখন সাধারণ ছাত্রীদের ফাইনাল শুরু হয়েছে।
এবার কি ঢাকায় ঠান্ডা পড়বে সেভাবে ?
এখন আর ঢাকায় শীত পড়েনা বললেই চলে।
হালকা পাতলা শীতের কাপড় পরলেই হয়।
ভারী কিছু পরার মত শীত গত কয়েক বছরে অন্তত পড়েনি।
এবার মনে হচ্ছে একটু বেশীই পড়বে শীতটা।
আজ খুব ভোরে স্কুলে চলে এসেছে রিয়া।
জরুরী কিছু কাজ আছে। একটু নিরিবিলি বসে করে নেবে।
এত সকালে সাধারণ; টিচাররা আসেন না। সাতটার পর থেকে আসা শুরু হয়।
রিয়া সাতটার আগেই চলে এসেছে।
টিচার্স রুমে ব্যাগ, জরুরী খাতা-পত্র রেখে বারান্দায় এসে দাড়ালো।
টিচার্স রুমের আয়া পারুল নিজেই আগ্রহ করে রিয়ার জন্য ক্যান্টিন থেকে গরম চা আনতে গেছে।
সকালের মৃদু বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। মাঠের পূর্বদিকে বিশাল বড় বট গাছটার দিকে তাকিয়ে রিয়ার একটু শীত শীত করতে লাগলো। রিয়ার ভাল লাগলো শীতের এই অনুভূতি টুকু।
এবার রিয়ার চোখ পড়লো গাছের নীচে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের উপর। অডিটোরিয়ামের পাশেই শিউলি গাছটা। গাছটার নীচে ফুল পড়ে পড়ে সাদা ফুলের বিছানা হয়ে আছে।
রিয়া বারান্দা থেকে নেমে এলো।
সেই ছোট্টবেলার মত নিজেকো ধরে রাখতে পারলো না।শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে শিউলি গাছের নীচে এসে দাড়ালো।
আহ্… কি সুন্দর ফুল !
সাদা ফুলের নীচে হালকা কমলা রঙের ছোঁয়া। কি সুন্দর দৃশ্য।
সাদা ফুল গুলোর উপর টুপ্ টাপ্ করে ঝরে
পড়েছে শিশির। সকালের নরম রোদে চিক্ চিক্ করছে ঝরে পড়া শিউলি গুলো।
রিয়া মুগ্ধ হয়ে গেল।
নীচু হয়ে দু’হাত ভরে তুলে নিল মুঠো মুঠো শিউলি…চোখ বন্ধ করে ফেললো রিয়া।
শিউলির সুবাস নিতে নিতে বিড় বিড় করলো রিয়া, তোমাকে আরো একবার মুঠো মুঠো শিউলির দিতে চাই, আশিক !
তুমি কি নেবে ???
(চলবে..)
Mashawfi Amin
Dhaka Cantonment.
13.11.2017#বিচ্ছেদ – ১৮
আশিক স্হির চোখে তাকিয়ে আছে, ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে।
এত গভীর আনন্দ কতদিন আগে তাকে ছুঁয়ে গেছে, মনে করতে পারছেনা।
“হয়তো আরো একবার তোমার সাথে, গোটা শহর ঘুরে ঘুরে খুঁজে বের করতে পারি একটা শিউলি গাছ…কুয়াশা ভোরে ধোয়া ওঠা কফির মগে দিতে পারি আয়েশি চুমুক…গভীর আনন্দে ঘুরতে পারি একুশের বইমেলায়… সেই পুরনো দিনের মতো।”
আশিক গভীর মনোযোগ দিয়ে আবার পড়লো মেইলটা।
রিয়া লিখেছে তাকে।
বিশ্বাস হতে চাইছে না।
যদিও রিয়াকে মেইল পাঠাবার পর থেকেই প্রতি মূহুর্ত্যে রিয়ার কাছ থেকে এরকম একটা মেইল পাবার আশা নিয়ে অপেক্ষা করেছে আশিক।
মেইলটা রিয়াই করেছে।
এটা রিয়ার স্টাইল। এভাবেই লিখতো ও।
একবার আশিকের জন্মদিনে লিখেছিল,
“মায়ের জন্য আজ আমার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা রইল….কারণ এরকম একটি দিনে তিনি তোমাকে জন্ম দিয়েছিলেন।”
একটু আলাদা অন্যদের থেকে।
বিয়ের পর রিয়া ভোর বেলা শিউলি কুড়োবে বলে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। আশিকদের বাসার আশে-পাশে কোন শিউলি গাছ ছিলনা।
ওরা ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে শিউলি গাছ খুঁজে বের করেছিল। রিয়া কি যে খুশী হয়েছিল সেদিন !
রিয়া কি সত্যিই ফিরবে তার জীবনে ?
নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো আশিক।
রায়নার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে দু’দিন হলো। প্রথম দিন ইংলিশ ছিল।
ওর প্রিপারেশন খুবই ভাল।
রায়না সব বিষয়েই ভাল নম্বর পায়। রিয়া মহা ব্যস্ত থাকে বছরের এই সময়টাতে।
স্কুলের পরীক্ষার আগে থেকে শুরু হয় প্রশ্নপত্র তৈরী করার মধ্য দিয়ে ওর ব্যস্ততা।
এরপর পরীক্ষা, খাতা দেখা, রেজাল্ট শীট তৈরী করা। নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকেনা। তার মধ্য রায়নার পরীক্ষা।
ওকেও তো একটু পড়াতে হয়।
প্রথম পরীক্ষার দিন সকালে আশিক ফোন করেছিল, মেয়েকে উইশ করার জন্য।
পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে অবশ্য প্রতিদিনই সকালে ফোন করছে রায়নার সাথে কথা বলার জন্য।
মেয়েকে উইশ করে,সেদিন জানতে চেয়েছে রিয়া কেমন আছে।
রিয়া আশিককে মেইল করেছে।
কিন্ত এখন পর্যন্ত কথা হয়নি। স্কুলের ঝামেলা শেষ হলে দেখা যাবে।
আশিক ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট্ট একটা মেইল পাঠিয়েছে।
আজ পরীক্ষার হলে একটি মেয়ে হট্যৎ অসুস্হ হয়ে পড়েছিল ।
ক্লাস নাইনে পড়ে মেয়েটি।
সকালে ঠিকমত খায়নি, তার উপর পরীক্ষার টেনশনে মাথা ঘুরে উঠেছিল।
তাড়াতাড়ি তাকে ধরে সিক রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ভিপি ম্যাডাম দেখতে এসে একটু রাগ করলেন, ‘এতটুকুন সব মেয়েরা, এখনই ডায়েটিং করে…ঠিকমত খায়না…কি করে এত ধকল সহৃ হবে শরীরে ?’
রিয়া হেসে ফেললো ম্যাডামের কথা শুনে।
ম্যাডাম বললেন, ‘হেসো না রিয়া । এটাই করে ওরা। দাড়াও আগামী বছরের শুরুতে প্যারেন্টস মিটিং এ এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে প্যারেন্সদের সঙ্গে।
ডায়েটিং করতে গিয়ে অসুস্হ হয়ে যাবে মেয়েরা ! আমরা তো এমন ছিলাম না ? এখনকার মেয়েরা এমন কেন বলো তো ?’
এদিকে আবার অসুস্হ মেয়েটিকে তিনি আদর করে গ্লুকোজ পানি খাওয়ালেন নিজ হাতে। তারপর একটু সুস্হ হয়ে উঠলে আবার পরীক্ষার হলে পাঠাবার ব্যবস্হা করলেন।
রিয়া ভিপি ম্যাডামকে যত দেখে তত মুগ্ধ হয়।ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি এই স্কুলের সকলের মা।
তিনি না থাকলে এই স্কুল মা-হারা হয়ে যাবে।
রাতে ঘুমুতে যেতে দেরী হচ্ছে রিয়ার গত ক’দিন যাবৎ। পরীক্ষার খাতা চেক্ করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়।
ডিসেম্বরেই তো রেজাল্ট দেয়া হয়। কাজেই যেসব পরীক্ষা হয়ে গেছে, সেগুলোর খাতা দেখাও শুরু করে দিয়েছে ওরা।
সাধারণত ; ডিসেম্বরের বিশ তারিখের মধ্যেই রেজাল্ট হয়ে যায় ওদের স্কুলে।
এবার ছুটিতে রায়নাকে নিয়ে কোথাও একটা বেড়াতে যেতে হবে।
গ্রামের দিকে গেলে কেমন হয় ?
ভালই হবে মনে হয়।
গ্রামের শীত একটু অন্যরকম।
সকালের নরম রোদে পিঠ লাগিয়ে বসে রোদ পোহানো আর গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাটাই আলাদা।
গাছ থেকে সতেজ শাক্-সবজি তুলে রান্না করে খেতে দারুণ লাগে।
নদীর পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি…
এই আনন্দগুলো অবশ্যই রায়নাকে দিতে হবে। রিয়া পাতলা কম্বলটা গায়ে টেনে নিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিল।
আজ রায়নার রেজাল্ট দিয়েছে।
সব বিষয়েই খুব ভাল নম্বর পেয়েছে।
সে খুব খুশী। বাবাকে রেজাল্ট জানানোর জন্য অস্হির হয়ে আছে।
এক নম্বরের জন্য প্রথম হতে পরেনি।
ক্লাসে ২য় হয়েছে। রিয়া বলেছে,তাতে কি হয়েছে ? পাঁচটা শাখা মিলে ২য় হয়েছে, এটা কম কি ?
আশিক ফোন করেছে।
প্রচন্ড উৎফুল্ল হয়ে কথা বলছে বাপ-মেয়ে।
আশিক খুব খুশী মেয়ের রেজাল্টে।
স্পিকার অন করে কথা বলছে রায়না।
আশিক বলছে,তোমার মাকে আমার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ। তোমার জন্য তোমার মা এত কষ্ট করেছেন বলেই তুমি এত ভাল রেজাল্ট করেছো।
রায়না কল কল করে কথা বলে যাচ্ছে তার বাবার সাথে। রিয়া চায়ের মগ আর পেপার নিয়ে শোবার ঘরের বারান্দায় চলে এলো।
আজ থেকে স্কুল ছুটি।
ছুটির কয়টা দিন গ্রামে যাবে ঠিক করলো।
বিকেলে বাবা এসে রায়নাকে নিয়ে যাবে ও বাসায়। রিয়া কাল সকালে রহিমা খালাকে নিয়ে একবারে যাবে। রিয়ার বড় বোনও আসবে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে।
তারপর ওরা সবাই মিলে একসাথে রিয়ার দাদা বাড়ী যাবো।
আজ রাতে কোনআন শরীফের অনুবাদ নিয়ে বসতে হবে। এ ক’দিন যা ঝামেলা গেল যে এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাববারও সময় পায়নি রিয়া।
আশিকের সাথে কথা বলতেও হবে।
বিকেলে রায়না তার নানাভাই এর সাথে চলে গেল নানার বাসায়। খুব খুশী সে, বহুদিন পর নানাু-নানুর সাথে একা সময় কাটাতে যাচ্ছে।
যদিও আগামীকালই মা চলে আসবে।
তবুও আজ সে একা যাচ্ছে।
মা তাকে একটু বড় ভাবছে তাহলে !
নানুবাসায় যাওয়ার পথে নার্সারী আছে একটা। সেখানে রিক্সা থামিয়ে ২/৩ গাছের চারা কিনলো। আজ নানু বাসায় গিয়ে ছাদে গাছ লাগাবে। রায়না খুব খুশী আজ।
সারাদিন খুব আনন্দে কাটছে তার।
আগামীকাল চিটাগং থেকে নেহা আপুরা আসবে। কি মজা ! বড় খালামনি কত্তো আদর করে ওকে। নেহা আপু, নেহাল ভাইয়া সবাই আসবে। ওরা একসাথে গ্রামে বোড়াতে যাবে। এবার গ্রামে গেলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা শিখবে রায়না।
নেহাল ভাইয়া বলেছে,রায়না তোকে এবার মাছ ধরা শিখিয়ে দেবো।
রায়না খুব দুঃচিন্তায় আছে। কারণ, তার তো কোন বড়শী নেই !
তবে নানাভাই বলেছেন,ওখানে সব ব্যবস্হা করা আছে।
রায়না পুরোটা বিকেল ছাঁদে গাছ লাগিয়ে কাটালো। বুয়া সাহায্য করেছে। এমনকি নানা ভাইও সাথে সাথে থেকেছেন।
রায়নার ভীষণ ভাল লাগছে নিজ হাতে গাছ লাগাতে পেরে।
সন্ধ্যার আগে আগে সে সদ্য লাগানো গাছ গুলোতে পানি দিল।
রিয়া আছরের নামাজ শেষ করে কোরআন শরীফের অনুবাদ নিয়ে বসলো।
২য় পারা, সুরা বাকারার ২২৬ নম্বর আয়াত থেকে পড়তে শুরু করলো,” যারা স্ত্রীর সাথে সংগত না হওয়ার শপথ করে,তারা চার মাস অপেক্ষা করবে।অতঃপর যদি তারা মিলে যায়,তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
(২২৭) আর যদি তারা তালাক দেয়ার সংকল্প করে তবে আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।”
রিয়া পড়তে লাগলো… “(২৩০)অতঃপর সে যদি তালাক দেয় তবে অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী তার জন্য বৈধ হবে না;অতপর সে (২য় স্বামী) যদি তালাক দেয় আর উভয়ে মনে করে যে, আল্লাহ্ র নির্দেশিত পথে চলতে পারবে তবে তাদের পূর্ণমিলনে কোন দোষ হবে না। এগুলো আল্লাহ র সীমারেখা। জ্ঞানী লোকদের জন্য তিনি এগুলো স্পষ্ট বর্ণনা করেন।”
রিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে।
মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো।
রিয়া কোনআন শরীফ বন্ধ করে উঠে পড়লো।
মূল বিষয়টা বুঝতে পারলেও পুরোপুরি স্পষ্ট হলোনা রিয়ার কাছে।
পূর্ণমিলন সহজ কোন ব্যাপার নয় এটুকু বুঝতে পারছে।
এক কাপ চা খেলো।
অস্হির লাগছে রিয়ার। বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
রিয়া গুগলে এ তালাক লিখে সার্চ দিলো।
অনেকক্ষণ ধরে এটার উপরে যাবতীয় সঠিক তথ্য এবং সেই তথ্যের ব্যাখা জানার চেষ্টা করলো।
রিয়া বোখারী শরীফের ২য় খন্ডের ৭৯১ পৃষ্ঠায় কোনআন শরীফে দেয়া তালাকের ব্যাখাটা পেয়ে গেল।
রিয়া ব্যাখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়লো,
“যখন কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে দেয়,তখন তার স্ত্রী তার জন্য হারাম হয়ে যায়। সে তখন তার স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে নিতে পারেনা স্ত্রী হিসেবে। ইদ্দত পালনের সময়েও না, শেষেও না।
তবে সে তার স্ত্রীর সাথে আবার পুণর্বিবাহ করতে পারবে,যদি তার স্ত্রীর অন্য একজন ব্যক্তির সাথে বিবাহ হয় এবং ২য় স্বামীর সাথে (সহবাস সহ) বসবাস করে।
তারপর, ২য় স্বামী যদি তাকে স্ব-ইচ্ছায় এবং সঙ্গত কোন কারনে তালাক দিয়ে দেয় বা ২য় স্বামীর মৃত্যু ঘটে, তাহলে এই নারী তার প্রথম স্বামীর সাথে পুণর্বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। তা না হলে নয়।
শুধুমাত্র একটি চুক্তির মাধ্যমে কাউকে বিবাহ করে (সহবাস সহ/ছাড়া) ২য় স্বামীর থেকে তালাক নিয়ে, প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়া যাবেনা।
এটাকে ইসলাম সমর্থন করে না।”
রিয়ার অবসন্ন লাগতে লাগলো।
বুকের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর।
এমন কঠিন অবস্হার সম্মুখিন হতে হবে কোনদিন ভাবেনি।
রিয়া কি করবে কিছুই বুঝতে পারলো না।
সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে ঘরে।
রিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।
আকাশ-পাতাল ভাবছে।
কোন কূল-কিনারা খুঁজে পেলো না।
এত অদ্ভুত, এত কঠিন নিয়ম কেন, এটা নিয়েই ভাবছে রিয়া।
কত কিছুই জানিনা আমরা, না জেনেই কত কি করে বসে থাকি, ভাবলো রিয়া।
নিজের উপর রাগ হলো ওর।
যখন আশিকের সাথে ডিভোর্স হয়েছিল, তখন তো উচিৎ ছিল, ডিভোর্স সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়টা নিয়ে খোঁজ -খবর করা, এই বিষয়ে ভালমত জানার চেষ্টা করা।
তারপর ডিভোর্সের মত এত কঠিন সিদ্ধান্তটা নেয়া। রিয়া সেটা করেনি।
তখন তো রাগ, জেদ,অভিমান এগুলো নিয়েই বেশী ভেবেছে রিয়া।
আর তখন আশে পাশের আত্মীয় পরিজন অনেকেই ওর সিদ্ধান্তকেই সাপোর্ট করেছিল, বাবা-মা ছাড়া।
আজ রিয়া ভাল করে বুঝতে পারছে, বাবা-মা কেন এতবার বলেছিলেন, আশিকের কাছে ফিরে যেতে।
আচ্ছা, আশিকও কি তার মতই কোন কিছু না জেনেই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ?
নাকি সব জেনেই করেছিল ?
রিয়ার ধারনা, আশিকও রাগের মাথায় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বেশীর ভাগ মানুষই তাই করে।
কিন্তু করা একেবারেই উচিৎ নয়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কোন ছেলে-খেলার জিনিস নয়।
পবিত্র একটা সম্পর্ক এটা।
এই সম্পর্ককে অনেক যত্নের সাথে পরিচর্যা করতে হয়। রক্তের সম্পর্কগুলো মাঝে যা কিছুই ঘটুক.. ফিরে ফিরে আসে বেশীর ভাগ সময়ই।
কিন্তু যে সম্পর্কের ভিত্ কলমা বা মন্ত্র পড়ে, কাগজে সই করে সৃষ্টি হয়,তারপর দু’জন মানুষের শরীর এবং মনের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কের ভিতকে আরো শক্ত করতে হয়, সেই সম্পর্ককে যত্ন আর পরিচর্যা ছাড়া কি ধরে রাখা যায় ?
রিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
এতটা বোঝার ক্ষমতা বা মন তার কেন ছিলনা এগারো বছর আগে ?
রায়নার মুখ মনে পড়লো !
বাবা-মা দু’জনকেই পাশে চায় মেয়েটা।
একজন সন্তানের পক্ষে খুব ন্যায্য চাওয়া।
বাবা-মায়ের কোন অধিকার নেই সন্তানকে এভাবে বঞ্চিত করা।
তবুও,অপরিনামদর্শি বাবা-মায়েরা শুধু নিজেদের কথা ভেবেই আলাদা হয়ে যায়।
রিয়া-আশিক যেমন করেছিল।
রায়নার একটু সুখের জন্য কত কিছুই না করার চেষ্টা করে রিয়া।
অথচ,সেদিন একবারও ভাবেনি, যেভাবে আজ ভাবছে।
কিন্তু আসলেই কি চাইলেই সব করা যায় ?
রিয়া কতটুকু করতে পারে ?
রিয়া মেয়েকে সুখী সুন্দর একটা জীবন দিতে চায়। কিন্তু নিজেকে এতটা অসম্মানিত করে কি চায় ?
অসম্মানই বটে।
আশিকের সাথে নতুন করে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে চাওয়ার জন্য, রিয়া কি এমন কিছু করবে, যা তার জন্য মর্যাদা হানিকর ? একেবারেই অনভিপ্রেত ?
রাতে মা ফোন করে জানতে চাইলেন, সকালে কখন আসবে রিয়া।
কাল নয়,পরশুদিন মার ওখানে যাবে রিয়া,মাকে জানিয়ে দিলো।
রিয়ার এই মুহুর্ত্যে যা মানসিক অবস্হা,তাতে সবার সাথে হৈ চৈ করার মত অবস্হায় নেই।
রাতে ভিপি ম্যাডামকে ফোন করে সকালে দেখা করতে চাইলো।
ম্যাডাম সকালে যেতে বললেন তার বাসায়।
সারারাত ঠিক মত ঘুমোতে পারলো না রিয়া।
এপাশ-ওপাশ করলো।
ঘুরে-ফিরে রায়না আর আশিকের মুখ মনে পড়তে লাগলো।
রাতটা খুব দীর্ঘ মনে হলো।
আশিক গভীর মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে পুরো বিষয়টা। ওর চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিনে।
গতকাল রাতে নিউইয়র্কে বসবাসরত সব স্কুল-বন্ধুদের গেট-টুগেদার ছিল।
তুমুল আড্ডার সময় বন্ধুরা আশিককে খোঁচাখুঁচি শুরু করেছিল আর কতকাল এরকম একা থাকবে বলে।
বন্ধুদের এই কথার জবাবে আশিক স্বানন্দে জানিয়েছিল, তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া আনন্দকে নতুন করে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনার কথাটা।
সবাই খুব খুশী হয়েছিল শুনে।
তবে শামীম বলছিল,নতুন করে শুরু করতে কিছু নিয়ম মানতে হবে এবং সেই নিয়ম নাকি যথেষ্ট কঠোর।
আশিক কিছুটা জানে। তবে আজ ভালভাবে জানার চেষ্টা করছে।
রিয়াকে ফিরে পেতে চেয়েছে, কিন্ত এই দিকগুলোর কথা ভাবেনি একেবারেই।
কিন্তু ভাবতে হবে অবশ্যই।
আশিকের মধ্য ধর্ম নিয়ে কোন ধরনের গোঁড়ামী নেই, তবে আশিক ধর্মীয় নিয়মগুলো ভাল ভাবে মেনে চলে।
তাই আশিক জেনে বা না জেনেও কোন ধরনের ভুল কাজ করতে চায়না।
তালাকের উপরে কোনআন শরীফে পরিষ্কার নির্দেশনা আছে।
এতক্ষণ,সেটায় পড়ছিল সে।
অস্হির বোধ করছে আশিক।
জানার মধ্যেও এতকিছু অজানা ছিল ?
ফিরে পাওয়ার আনন্দে আচ্ছন্ন আশিকের মন বিষর্ন্ন হয়ে উঠলো।
কি হবে এখন ?
রিয়াকে ছেড়ে নতুন করে যখন শুরু করেছিল নীলার সাথে,তখন রিয়ার কষ্ট হয়েছিল নিঃসন্দেহে। আজ খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে আশিক।
রিয়াকে ফিরে পেতে গেলে যা করতে হবে সেটা কি মেনে নিতে পারবে সে ?
প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে আশিকের।
আজ এতদিন বাদে আশিকের মনে হচ্ছে, দাম্পত্য জীবনে যত ঝামেলায় আসুক না কেন,খুব ভেবে চিন্তে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ সকল দম্পতির।
যদি এমন হয়, আর কোন ভাবেই একসাথে থাকা যাচ্ছে না এবং আবার কোনদিন ভুল ভেঙে ফিরে আসার কোন সম্ভবনাও নেই, তবেই শুধুমাত্র ডিভোর্স দেয়া উচিৎ একে অপরকে।
কারণ, ইসলামে তালাককে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জায়েজ কাজ হিসেবে ধরা হয়।
নিকৃষ্টতম জায়েজ এজন্য বলা হয়, কারণ স্বামী-স্ত্রীর সামান্য ভুলে,রাগে বা দোষের পরিপ্রেক্ষিতে তালাকের মত ঘটনা ঘটে।
তারপর, কোন এক সময় কোন কোন দম্পতির ভুল ভাঙে এবং তারা আবার পূর্ব সম্পর্কে ফিরতে চায়।
এই ফিরে আসাটা তখন আর খুব সহজ হয়না।
কারণ, একজন নারীর পক্ষে অন্য কাউকে বিয়ে করে (সহবাস সহ), আবার ২য় স্বামীর থেকে তালাক নিয়ে ১ম স্বামীর কাছে ফিরে আসাটা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হলো আশিকের।
তবে কোন নারী যদি প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই নতুন ভাবে শুরু করার উদ্দেশ্যে ২য় বিবাহ করে, এবং কোন কারণে ২য় বিবাহও ডিভোর্স হয়ে যায়, তখন প্রথম স্বামীর সাথে পুণর্বিবাহ করতে কোন সমস্যা হয় না।
কিন্তু, কেউ যদি শুধুমাত্র চুক্তির মাধ্যমে ২য় বিবাহ করে (সহবাস ছাড়া) এবং ২য় স্বামীর কাছ থেকে কোন কারণ ছাড়াই তালাক নিয়ে ১ম স্বামীর কাছে ফিরে যায়,সেটা জায়েয হবেনা।
কারণ,ইসলাম এটাকে সমর্থন করেনা।
আশিক নিজেকে ধিক্কার দিলো মনে মনে, তাদেরও কি অদৌ এমন পরিস্হিতি তৈরী হয়েছিল ? এভাবে আলাদা হওয়ার মত ?
শুধুমাত্র রাগ আর জেদের বসে সম্পর্কটাকে তিক্ত করে তুলেছিল ওরা।
আজকের দিনের কথা একবারও মাথায় আসেনি।
রায়নার জন্মের পরই তো তাদের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। তখন কেন রায়নার কথাটা একবারও ভাবেনি ওরা ??
আজ যেমন ভাবছে ???
(চলবে.. )
মাশাওফি আমিন।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।
১২/১২/২০১৭.