বিবর্ণ সিঁদুর
পর্ব- ০৫
Taniya Sheikh
সৌমিত্রের গাড়ি বিমলার ভিটেতে এসে থামল। রাত তখন এগারোটার কাটা ছুঁই ছুঁই। গ্রামাঞ্চলে এই সময়টাই মধ্যে রাত সমান। চারিদিকে নিস্তব্ধতা অনেকটাই ম্লান ঝিঁঝি পোকার ডাকে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে ছিল। গাড়ির শব্দে বিমলার ছোট ছেলে পরেশের ঘুম ভেঙে যায়। বিছানার উপর উঠে কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করল বাইরে কী হচ্ছে।
এ বাড়িতে তিনটে ঘর তিনপাশে। মাঝখানে লেপাপোছা ঝকঝকে উঠোন। সৌমিত্রের গাড়ি সেখানেই থামানো। পরেশ বাইরে কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে পরনের ধুতি ঠিক করতে করতে দরজা খুললো। বারান্দার স্বল্প পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতিটির আলোয় সরু চোখে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললো,
” এ যে সৌমিত্র বাবু। ও মা, মা, ওঠো। দেখো কে এসেছে।”
পরেশের হাঁকডাকে বিমলার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেল। আশি কেজির শরীর নাড়িয়ে উঠতেও তার সময় লাগল। পাশে শায়িত মেয়ে কনক। দাদার গলার শব্দে তার ঘুমে কিছুটা ব্যঘাত ঘটল৷ মুখ বিকৃত করে কাথাটা টেনে মুড়ি দিয়ে পাশ ফেরে শোয় কনক। বিমলা সেদিকে দৃষ্টিপাত না করেই কিছুটা বিরক্ত গলায় বললেন,
” কে এসেছে পরেশ?”
পরেশ ছুটে গাড়ির দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কিছুটা হেঁসে বললো,
” সৌমিত্র বাবু এসেছে।”
বিমলা চোখ কুঁচকে ফেললেন৷ পাশে ঘুমানোর চেষ্টা করা কনকের আর ঘুম এলো না। কাঁথা সরিয়ে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে বসল মায়ের পাশে। মা-মেয়ে চোখাচোখি করে বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে এলো দরজা খুলে। ও’পাশের ঘর ছেড়ে বিমলার বড় পুত্র বধূটিও বেরিয়ে এসেছে পরেশের গলা শুনে। মিনুর স্বামী নরেশ থাকে শহরে। রজনীর বিয়ের পরের দিনই ওর চাকরী হয়। পরেশেরও হয়েছে তবে তার জয়েন আরও দু’দিন পর। মিনু এগিয়ে এলো। সৌমিত্র গাড়ি থেকে বেরিয়ে করজোড়ে নমস্কার করল বিমলাকে। গাড়িতে বসা মলিনমুখো রজনীর দিকে বিমলার দৃষ্টি নিবদ্ধ। রজনীকে দেখে খুশি হওয়া তো দূরের কথা একটা কথাও বললো না বিমলা। সৌমিত্রের নমস্কারের জবাব ফ্যাকাসে মুখেই দিলেন তিনি। পরেশ অভ্যর্থনা জানিয়ে বারান্দার বেঞ্চিটাই বসাল সৌমিত্রকে। সৌমিত্রের প্রচন্ড গরম লাগছে। ঘেমে একাকার শরীর। তবুও অস্বস্তির ছিটেফোটা নাই তার চোখে মুখে। পরেশ ঘর থেকে টেবিল ফ্যানটা এনে ছেড়ে দিল। রাশভারি চেহারায় বসে রইল সৌমিত্র। বউকে আর বোনকে ইশারায় আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে মা’কে আড়ালে টেনে আনে পরেশ। অষ্টমঙ্গলার আগে মেয়ে বাড়ি এসেছে, এ যে ভালো কিছুর ইঙ্গিত নয় তা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে তারা। পরেশের মুখে এতোক্ষন ধরে রাখা হাসিটাও ঝড়ে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো দপ করে নিভে মুখমণ্ডলে অন্ধকার নেমে এলো। পরেশ রাগী গলায় চাপা স্বরে মা’কে বললো,
” তোকে বলেছিলাম না তোর এই বোনের মেয়ে সব উগলে দেবে? এখন আমাদের আবার খেয়ে না খেয়ে বাঁচতে হবে। আমি মরে যাব এমন হলে বলে রাখলাম।”
বিমলা ছেলেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেও পারলেন না। রাগে ক্ষোভে পরেশ মাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে বাড়ির বাইরে চলে গেল। সৌমিত্র এদের মধ্যেকার উত্তেজনা বুঝল কী না কে জানে! পরেশের ওমন গম্ভীর মুখ দেখে উঠে দাঁড়াল সে। আড়াল থেকে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়েছিল বিমলা। মুখটাতে তার বৈদ্যুতিক আলো পড়লেও আধার কমলো না। নিদারুন কষ্ট ভেসে উঠল চেহারায়। সৌমিত্র এগিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।
ডান পার্শ্বের ছাপরা রান্নাঘরের চুলায় আগুন জ্বলছে। ওরা শশব্যস্ত হয়ে পড়েছে জ্বামাই আদর আপ্যায়নে। যদিও ঘরে পর্যাপ্ত জিনিস নেই, তবুও যা আছে তাতেই কাজ চালাতে ব্যস্ত কনক এবং পরেশের বউ রত্না। সৌমিত্রকে সামনে আসতে দেখে বিমলা হাসার চেষ্টা করে বললো,
” আপনি বসেন বাবা। আমি দেখি খাওয়া দাওয়া কতদূর হলো। আসার আগে একটা খবর দিলে ভালো হতো।”
সৌমিত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিমলার দিকে তাকাতেই বিমলা একপ্রস্থ হাসল। বিমলা দেখতে বিকট, কুৎসিত চেহারার। একটা বাচ্চা শিশু ভয় পাবে তাকে হঠাৎ দেখামাত্র। কিন্তু তার ছেলে কিংবা মেয়ে পুরোপুরি মায়ের উল্টো। পাশাপাশি দাঁড়ালেও মায়ের সাথে তাদের মিল পাওয়া ভার। সৌমিত্র বুঝল বিমলা আর সবার মতো স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবতী নন। তার চেহারার কুৎসিত ভাবটাও একটা রোগ। এটা একধরনের হরমোনাল সমস্যা। জন্মের পর থেকেই এরা এমন হয়ে থাকে। অনেকে চিকিৎসায় সুস্থও হয় তবে বিমলার হওয়ার কথা না। তিনি হতদরিদ্র মহিলা। দিনরাতের আহার জোগাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ব্যয়বহুল চিকিৎসা নেহাত কল্পনায় বটে। সৌমিত্র একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
” আপনার সাথে কিছু কথা ছিল আমার।”
” হ্যাঁ। হ্যাঁ। বলেন না বাবা।” বিমলা বিগলিত গলায় বললো,
” একটু একান্তে বলতে পারলে সুবিধা হতো আমার।”
বিমলার দু’পাশের ঠোঁট শক্ত হয়ে উঠল। মনে মনে যে শঙ্কা ছিল সেটাও বেড়ে গেল। তবুও সেসব গোপন করে স্বাভাবিক হয়ে বললো,
” আপনাকে কোন ঘরে যে বসতে দেই। ঘর তো মোটে তিনখানা। সবাই ঘুমাচ্ছিলাম। গরিব মানুষ আমরা, বৈঠক খানা নেই। ওমন অগোছালো ঘরে আপনাকে কী করে নেই যে। একটু বসুন। ঘরটা গুছিয়ে তারপর আসছি।”
বিমলা চলে যেতে উদ্যত হতেই সৌমিত্র বললো,
” সমস্যা নেই। আপনি সেখানেই নিয়ে চলেন।”
বিমলা ইতস্তত করল কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
” চলেন।”
বিমলার ঘরখানার অবস্থা অন্য দুই ঘরের চেয়ে করুন। উপরে জং ধরা পুরোনো টিন। বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়ে ভিজে যায় ঘরের ভেতরের অনেখানি। ঝড় হলে তো ভগবানের নাম নিয়েই রাত কাটাতে হয়। ঝড়ের কবলে পড়ে দু’তিন বার টিন খুলেও গিয়েছিল প্রায়। ঘরের চারপাশে বাঁশের চটার বেড়া। তাতেও বড় বড় ছিদ্র। সেগুলো ঢাকার জন্য খবরের কাগজে মাড় লাগিয়ে এঁটে দেওয়া হয়েছে। এ বুদ্ধিটা অবশ্য রজনীর ছিল।
মাথা নুয়ে নড়বড়ে, ঘুনে খাওয়া দুই পাল্লার দরজা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল সৌমিত্র। গুমোট গন্ধ নাকে লাগতেই নাক কুঁচকে গেল তার। বিমলা তাকানোর আগেই মুখটা স্বাভাবিক করে সে। বৈদ্যুতিক বাল্বটি বোধহয় বহু পুরানো। ঘরের অন্ধাকারাচ্ছন্নতা সম্পূর্ণ কাটছে না তাই। একটি চৌকি আর দু’টো পুরোনো মিটসেফ ছাড়া তেমন কিছুই নেই এ ঘরে। এককোনে তাক সদৃশ্য বস্তুটির উপর কয়েকটি দেবদেবীর ছবি এবং মূর্তিও রয়েছে। পূজার কিছু সামগ্রীও আছে সেটার সামনে। রাধা কৃষ্ণের ছবিটিই চোখে পড়ল সৌমিত্রের। এইসব পুরোনো জিনিসপত্রের মধ্যে কেবল এই ছবিটাই নতুন। হয়ত কিনেছে কিছুদিন আগে। সৌমিত্র ছবিটির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বিমলার দিকে তাকাল। অগোছালো বিছানা গুছাচ্ছেন তিনি। বিছানা কিছুটা বসার উপযোগী করে লজ্জিত মুখে বললেন,
” বসেন বাবা। আপনাকে ভালো জায়গায় বসতে দেব এমন অবস্থা এই গরিব মাসির নেই।”
” আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না প্লীজ। আমি এখানে আদর আপ্যায়ন গ্রহণ করব বলে আসি নাই।”
সৌমিত্রের এমন রসহীন কথায় বিমলার মুখের অনিচ্ছাকৃত হাসিটুকুও নিভু নিভু। সৌমিত্র পকেটে হাত রেখে বললো,
” আপনারা নিশ্চয়ই চিন্তায় পড়ে গেছেন অসময়ে আমাদের দেখে। পড়ারই কথা বটে। সে যাহোক। ভনিতা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। শুনুন বিমলা দেবী, আপনার ভাগ্নিকে আজ ফেরত দিয়ে যাচ্ছি আমি।”
ঝড় উঠবে জানার পরও হঠাৎ বিজলির গর্জনে মানুষ যেভাবে চমকে ওঠে। বিমলা সেই ভাবেই চমকাল। নির্বাক হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল সৌমিত্রের কঠিন মুখের দিকে। সৌমিত্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” আপনারা ঠিক করেন নি। অর্থের সামনে মানুষকে পণ্য বানাতে আপনাদের বিবেকে বাঁধল না? রক্তের সম্পর্ক এতোটাই দূর্বল আপনাদের? বর্বর, নিষ্ঠুরকেও হার মানিয়েছেন দেখলাম।”
” বাবা!”
বিমলার কথা শেষ করতে দিল না সৌমিত্র। সেই রাতটা মনে পড়াতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। বললো,
” কথা শেষ করতে দিন আমাকে। আপনি এবং আমার পরিবারের লোক যাই করেছেন তার হিসেব আজ নিতে আসি নাই। তবে এই যে ওকে রেখে যাচ্ছি এরপরের সব হিসাব আমি কড়াই গণ্ডায় বুঝে নেব।” সৌমিত্র থামল নিজের রাগ সংবরণ করে। বিমলা জবাব দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পেল না। মাথা ঘুরে উঠল। সৌমিত্র দরজার দিকে দু’পা এগিয়ে রজনীকে ডাকতে বললে বিমলা লজ্জিত মুখে সেই মুহূর্তে কিছুই বললো না। শুধুমাত্র জামাতা হলে কিছু বলা যেত কিন্তু সৌমিত্র তার চেয়েও বেশি কিছু। সৌমিত্রকে রাগানো কিছুতেই উচিত না ভেবে চুপচাপ বেরিয়ে এলো ঘর ছেড়ে।
রজনী আসার পর থেকে নিঃশ্চুপ। বউদিদের, দিদির একটা প্রশ্নের জবাবও সে দিল না। তার কষ্ট, অশ্রু সব যেন জমে আছে বুকের ভেতর। অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে এই মুহূর্তে আপনজনের প্রশ্ন বাণে বিদ্ধ হয়ে। বিমলা পাণ্ডুর মুখে রজনীর পাশে এসে বসলেন। রজনীর দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সজোরে চড় মেরে বসলেন। রজনী তবুও টু শব্দ করল না। বিমলা আর্দ্র গলায় বললেন,
” আসার আগে গাড়ির তলে পড়ে মরলি না কেন রে অভাগী? আমি এখন কী করব বল আমায়? দু’টো দিন স্বামীর ঘরে টিকতে পারলি না কপালপুড়ি।”
রজনীর অবিচল মুখটা দেখে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদলেন বিমলা। রজনীর চোখে ব্যথা হচ্ছে। এ ক’দিনে সে এতো কেঁদেছে কান্নাও আসছে না। এতোক্ষনে পাশে দাঁড়ান বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা কী ঘটেছে বুঝে নিল। তাদের আর চিন্তার শেষ থাকল না রজনীর একেবারে ফিরে আসায়। রজনী ফিরে আসার অর্থ তাদের জীবনও আগের মতো হয়ে যাওয়া। দুর্বিষহ!
কনক মুখে ওড়না গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেল। রত্নাও গেল ওর পিছু পিছু৷ বিমলা উঠবে বলে নড়তেই গিঁট আর কোমরের ব্যথাটা টনটন করে ওঠে । বিলাপ করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। রজনীকে সাথে করে এলেন নিজের ঘরে সৌমিত্রের সামনে। এবার ওদের সাথে মিনুও এলো। সৌমিত্র বিনাবাক্য ব্যয়ে রজনীর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অবনত মুখে দাঁড়ানো রজনীর শাড়ির আঁচলটা ধরে সিঁথির সিঁদুর মুছতেই বিমলা চমকে বলে,
” এ কি করছেন বাবা?”
” চুপ থাকুন আপনি।” ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল সৌমিত্র। এরপর কেউ আর কথা বললো না।
মিনু বড় বড় চোখে তাকিয়ে এই অঘটন দেখতে লাগল। রজনী জোর করে কান্না দমিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরবে। সৌমিত্র সিঁদুর যতোটুকু পারল মুছে রজনীর হাতের শাখা পলা খুলে নিল। দু’কদম পিছিয়ে একপলক দেখল সিঁথির দিকে। এখনও অবশিষ্ট সেখানে সামান্য সিঁদুর। তবে আগের মতো জ্বলজ্বলে নেই আর। বিবর্ণ হয়ে গেছে সিঁদুরের রঙ। সৌমিত্র শাখা পলাগুলো পকেটে পুরে বললো,
” ওর সকল খরচ সময়মতো পেয়ে যাবেন৷ এক ফোঁটা আঁচর যদি দেন তো রেহায় পাবেন না কেউ আপনারা।”
বিমলা তখনই একটা কান্ড করে বসল। একপ্রকার কাঁদতে কাঁদতে সৌমিত্রের পায়ে পড়বে বলে ঝুঁকতেই ধরে ফেলল সৌমিত্র। লজ্জিত আর বিব্রত হয়ে বললো,
” করছেন কী আপনি?”
” বাবা, আপনার পায়ে পড়ি এমন কথা কাজ করবেন না। অষ্টমঙ্গলার আগে মেয়ে বাড়ি ফিরেছে এ খবর লোকে শুনলে বদনাম রটাবে। আমার ঘরে এখনও একটা অবিবাহিতা মেয়ে। তার যে কপালে সিঁদুর উঠবে না গো বাবা। আমার রজনী মা লক্ষী। ওরে এভাবে ফেলে যাবেন না আপনি। ওর যে গলায় কলসি বেঁধে গাঙে ডুব দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না আর। আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। আপনি ওরে দাসী বানিয়ে রাখেন তবুও কাছে রাখেন৷ আমার যে ওকে রাখার সাধ্যি নাই।”
বিমলার ভারী শরীর ধরে বিছানায় বসাতে বেশ কষ্ট হলো সৌমিত্রের। মিনু রজনীকে ধরে নিরবে কাঁদছে এককোনে। রজনীর দিকে চেয়ে বিমলা আহাজারি করে কাঁদতে কাঁদতে ফের বললো,
” এ আপনি কী করলেন বাবা? ওর কপাল থেকে সিঁদুর মুছে নিলেন? ও বেচারীর এখন কী মূল্য থাকল সমাজে? ওর দূর্গতির সীমা থাকবে না যে। এই দরিদ্র, অনাথ মেয়েটিকে এভাবে শাস্তি দেবেন না বাবা। ভুল আমি করেছি। ওর কী অপরাধ?”
” দেখুন ওকে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যা খরচ লাগে বলেন আমি দেব। দরকার হলে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন।” অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো সৌমিত্র। বিমলা সৌমিত্রের হাতে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
” এ’কথা বলবেন না গো বাবা। ওর সিঁদুরে যে আপনার নাম লেখা হয়ে গেছে। এভাবে মুছলেই কী মুছবে তা? এতো সহজ না। ওর জীবনের সব কিছু এখন আপনার হাতে। রাখলে রাখেন নয়ত বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেন। আমি ওকে রাখতে পারব না। এই গরিবের কষ্ট বোঝেন বাবা। এতোবড় অসম্মানের বোঝা বইতে আমি পারব না। আমাকে ক্ষমা করেন।”
সৌমিত্র মহাঝামেলায় পড়ল। ভেবেছিল রজনীর যাবতীয় খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখে যাবে কিন্তু তা হলো না। এই মেয়েকে কাছে রাখতে পারবে না সৌমিত্র। তার অগোছালো জীবনে জেনেশুনে মেয়েটাকে রাখা চরম ভুলই হবে। সংসারধর্মের উপর তার বিন্দুমাত্র মোহ,আকর্ষণ নেই। জোর করে সেটাকে গ্রহণ করার অর্থই অপরপক্ষকে কষ্ট দেওয়া। সৌমিত্র আর যা করুক এই মেয়ের সত্যিটা জানার পরও এমন কিছু করবে না। তবে করবে টা কী? মহা বিরক্ত সে। বিমলা, মিনু করজোড়ে অনুরোধ করল সকাল হওয়ার পূর্বেই যেন রজনীকে নিয়ে চলে যায় সৌমিত্র। এক রজনীর জন্য তাদের সমাজে বদনাম হবে। বহু চেষ্টার পর কনকের বিয়ে ঠিক হয়েছে৷ এখন যদি এসব জানাজানি হয় বিয়েটা ভাঙবে নিশ্চিত। সৌমিত্রের মন নরম হলো এদের কান্নাকাটিতে। কিছুটা রাগও হলো রজনীকে তারা গ্রহণ করল না বলে। ঐ অবস্থায় রজনীকে নিয়ে তাকে এ বাড়িও ছাড়তে হলো শেষমেশ।
সৌমিত্র এসব ঝামেলায় পড়তে চাচ্ছিল না। মেয়েটাকে নিয়ে এতোদূর আসাতেও তার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মায়ের সাথে বাক বিতন্ড হওয়ার পর আসতে বাধ্য হয়। তার মা বলে দিয়েছে স্ত্রী মানলেই রজনী তাদের বাড়ি থাকবে নয়ত না। স্ত্রী মানার প্রশ্নই ওঠে না। রজনীকে তো নয়ই। এই মেয়ের সাথে তার কিছুতেই মিলবে না। তারা দুইজন শুধু বয়স নয় শিক্ষা, দীক্ষা, আচার,সংস্কারেও অসম। অসমতায় সম্পর্ক গড়ার ইচ্ছা সৌমিত্রের নেই। বিয়ের পূর্বে যদি এই বিষয়গুলো ঘুর্ণাক্ষরেও জানত তবে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। সব হয়েছে তার মায়ের কারনে। ভেবেছে কী তার মা! সৌমিত্র এই মেয়েকে নিয়ে সংসার করবে? ইম্পসিবল! হাজার ঝামেলায় ফেললেও সৌমিত্র নিজেকে বদলাবে না আর। যে দাগ মায়া দিয়েছে তার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সে। বাকি জীবনে আর এসব বিরহ, ব্যথা চায় না তার।
মূর্তির মতো একমনে বসে থাকা রজনীর দিকে চোখ পড়ল। মেয়েটার একটা ব্যবস্থা না করেও শান্তি হচ্ছে না। সৌমিত্রের মেজাজ প্রচন্ড খারাপ এই মুহূর্তে। পেছনে বসা রজনীকে তাই অসহ্য, উপদ্রব মনে হলো। এই মেয়ে নিজে থেকে কোথাও চলে গেলেও বোধহয় ঝামেলামুক্ত হতো সৌমিত্র। কিন্তু সে এই ক’টা দিনে বুঝে গেছে এই মেয়ে তেমন ধরনের নয়। মাথা ধরেছে খুব সৌমিত্রের। একটা কিছু সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে আজ। পুরোরাত ড্রাইভ করতে করতে ভাবল কী করবে। পথিমধ্যে কিছু খেয়েছিল সে। রজনীকেও দিয়েছে খাবার কিনে কিন্তু খাওয়া তো দূরের কথা প্যাকেটটাও খুলে দেখে নি। দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত রাখল সৌমিত্র। ঢাকায় পৌঁছে বন্ধু জামিলের সাথেও কথা হলো ওর। জামিল বুঝাল তাকে। ভাগ্য বলে মেনে নিতে বললো কিন্তু সৌমিত্র একগুঁয়ে কিসিমের। একবার যা বলবে,ভাববে তাকে সেখান থেকে টলানো সম্ভব নয়। শেষে জামিলই বুদ্ধি দিল রজনীকে লেডিস হোস্টেলে রাখার,,,
চলবে,,,