#বিবর্ণ_সিঁদুর
পর্ব- ০৮
#Taniya_Sheikh
রজনী সন্ধ্যার পর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল ঐ কম্পিউটারে কোচিং করা মেয়েটার সাথে। রুনার বাড়ির পরের বাড়িটাতেই সপরিবারে ভাড়া থাকে ওরা। নাম নূপুর সুলতানা। কালো গাত্রবর্ণ,বয়স বাইশের আশেপাশে। রুনাই বলে এসেছিল রজনীকে মেয়েটির সাথেই ফিরতে। যদিও ভাড়ার টাকা ওর কাছে আছে, তবুও নূপুরের সাথে হেঁটেই এলো। ঐ জনবহুল বাজার সংলগ্ন রাস্তা ছাড়া বাকি পথ হাঁটতে রজনীর তেমন কোনো সমস্যাই হয়নি। পুরো রাস্তা ওরা কথা বলতে বলতে এসেছে। তবে তা অতো বেশিও নয়। রজনী হিন্দু হয়ে মুসলিম পরিবারে কেন থাকছে? ওর পরিবারে কে কে আছে? ওর স্কুল কোথায়? এইসব জিজ্ঞেস করেছে নূপুর। রজনী নিজের বিয়ের কথা বলে নি। যেখানে সৌমিত্র তাকে স্বীকার করতেই চাইনা, সেখানে বিবাহিতা পরিচয় দিতে তার মন চাইল না। সত্য প্রকাশে হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে। রজনী পারবে না আর সেসবের মুখোমুখি হতে। তার সে শক্তি ক্ষয়ে গেছে। নিরুপায় হয়ে তাই সত্য – মিথ্যে মিলিয়ে বলে-সে অনাথা, তার তিনকুলে কেউ নেই। শহরে কাজের খোঁজে এসে এখানে রুনা আপার বাড়িতে আশ্রিতা। তবে আশ্রিতা সে ভাবলেও রুনা আপা তাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করে। সেই স্নেহের কারনেই আজ রজনী পড়ছে। নূপুর সব শুনে দুঃখ প্রকাশ করে। আহা! আহা! করে রজনীর কাঁধে হাত রেখে সমবেদনা জানায়। সে সমবেদনা তীরের ফলা হয়ে বুকে বেঁধে রজনীর। নিজেকে সত্যিই বড় অসহায় প্রানী বলে ভেবে নেয় আজ আবার। রুনার বাসার সামনে এসে থামে ওরা৷ রজনীকে বিদায় জানিয়ে নিজের বাসার দিকে হাঁটে নূপুর। রজনী একপলক সেদিকে তাকিয়ে দোতলার সিঁড়ি ধরে উঠতে থাকে। তাকে এখন দেখলে যে কেউ ভাববে সিঁড়ি গুনে গুনে হাঁটছে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ফের রজনী। সৌমিত্রের উপর এখন ঘৃণা নয় অভিমান জন্মেছে। কী ক্ষতি হতো যদি দাসী করে ফেলে রাখত তাকে চরণ তলে সৌমিত্র! তার চাওয়া তো খুব বেশি ছিল না। হলো না হয় সে ধনীপুত্র,উচ্চশিক্ষিত! রজনীর মতো মেয়ে তার সাথে যায় না। তাই বলে এমন করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে তাকে? হ্যাঁ সেও না হয় চেয়েছিল একটু সম্মানের জীবন। সবাই তো চায়। তাই বা ক’জন পায়। সেও না হয় পেত না। দিবারাত্র স্বামীর চরণ তলে পড়ে থাকত তবুও তো থাকত সেখানে। সধবা হয়ে সধবা’ই থাকত। এমন করে,,” রজনী সিঁড়ির রেলিং আঁচড়ে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না গিলে প্রবল অভিমানে কন্ঠরোধ হয়ে আসে। আরও দু’টো সিঁড়ি বেয়ে ওঠে টালমাটাল পায়ে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যা হোক! সে সৌমিত্রের কাছে ফিরে যাবে না। কোনোদিন না। দরকার পড়লে গলায় কলসি দেবে অথবা গলায় রশি দিয়ে ঝুলে পড়বে। রজনীর বুকটা হু হু করে ওঠে। অপমান, লাঞ্ছনায় বিদীর্ণ তার হৃদয় তিলে তিলে। দু’হাত সম্মুখে মেলে শূন্য কব্জি দেখতেই কী এক শূন্যতা তাকে গ্রাস করে সহসা। উপরে কারো পায়ের আওয়াজ পেয়ে চকিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। একফাঁকে চোখের জল মুছে আগত লোকটার পাশ কাটিয়ে উঠে যায় দোতলায়। রজনী খেয়াল করলে দেখত, তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ছেলেটা তাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে।
বাসার দরজা খোলা পেয়ে রজনী ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রুনা বসার ঘরের টেবিল মুছছিল। টেবিলের এককোনে এঁটো চা-য়ের কাপ, নাস্তার পিরিচ। রজনী ভাবল, হয়ত কেউ বাসায় এসেছিল। রজনী ব্যাগটা রেখে রুনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রুনা মিষ্টি হেঁসে কাপ, পিরিচ ট্রে তে উঠাতে উঠাতে আড়চোখে রজনীর দিকে তাকিয়ে বললো,
” ক্লাস কেমন হলো?”
” ভালো!” বিষন্ন মুখে জবাব দিল রজনী।
ট্রে’টা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল রুনা। পিছু পিছু রজনীও গেল। বেসিনে সব রেখে রুনা বললো,
” স্যার টা একটু বেশিই কড়া তাই না?”
রজনী জবাব না দিয়ে চুপ করে রয়। রুনা একবার রজনীর মুখের দিকে তাকাল। চোখ সরিয়ে ঠোঁট দু’টো চেপে কাপ, পিরিচ ধুবে বলে হাত বেসিনে রাখতেই রজনী মুখ আরও নামিয়ে বললো,
” আপা, আমি ধুয়ে দেই?”
রজনীর কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হলো রুনা। দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর ভেজা হাত মৃদু ঝেড়ে পিছিয়ে গিয়ে বললো,
” আচ্ছা।”
রজনীর মুখটায় হাসির রেখা ফুটে ওঠে। রুনা পাশে দাঁড়িয়ে রজনীর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
” নূপুর মেয়েটা কিছু জিজ্ঞেস করেছিল তোকে?”
মাথা নাড়িয়ে সব বললো রজনী। নূপুরকে সে মিথ্যে বলেছে, একথা রুনার সামনে প্রকাশ করে লজ্জায় মুখ নুয়ে রইল। রুনা এক হাত রজনীর বাজুতে রেখে বললো,
” পরিস্থিতি মানুষকে কতো সংকটেই না ফেলে। যা বলেছিস মিথ্যে হলেও এটাই হয়ত ঠিক। সত্যিটা তোর কষ্ট বাড়াত। যা হোক, এসব মনে আনিস না। পড়ালেখায় মনোযোগ দে।”
প্রত্যুত্তর না করে মৃদু ঘাড় নাড়িয়ে কাপ-পিরিচ ধুতে থাকে রজনী। মনটা বিষাদ হয়ে গেছে ওর। কোনোকিছুতেই আগের মতো ভালোলাগা নেই। রুনা চুলায় ভাত চড়িয়ে আবার রজনীর পাশে এসে দাঁড়াল। দুজনের আরও বেশকিছুক্ষন কথা বলে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। কথাগুলো ছিল কোচিং ক্লাসের নিয়ম নীতি এবং পড়াশোনা নিয়ে। রুনার একবার ইচ্ছা করল সৌমিত্র সম্পর্কে রজনীর মনে কী চলছে সেটা জানার,পরক্ষনেই সেই ইচ্ছা ত্যাগ করে রান্নাঘর ছেড়ে রুমে চলে গেল।
মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত। অচেনা মানুষও চেনা হয়ে যায় আবার চেনা হয়ে যায় অচেনা। রজনী ফ্রেশ হয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়। একাকী থাকলেই ভাবনাগুলো উত্তাল হয় সৌমিত্র আর ওর সম্পর্ককে ঘিরেই । রুনার পরিবার ওকে আজ আশ্রয় না দিলে কী হতো সে ভাবনাও ভাবায় খুব। রুনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে সে। এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে অসময়েই ঘুম নেমে আসে দু’চোখে।
রাত দশটার পর ঘুম ভাঙে। রুনায় ডেকে তোলে খাবারের জন্য। রজনীর শরীর বেজায় দূর্বল। মুখ, চোখ শুকিয়ে কেমন নিস্প্রভ হয়েছে। রুনার বড্ড খারাপ লাগে মেয়েটার অসহায় মুখটা দেখলে। মায়ের কষ্টের দিনগুলো স্মরণ করে চোখ ছলছল হয়। রজনী হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে। প্রতিদিনকার মতোই যৎসামান্য খেল। পাশে রুনা মরিচ ডলে ভাত মাখাতে মাখাতে বললো,
” এখন কী আবার ঘুমাবি?”
রজনী বললো,
” না!”
রুনা একগাল ভাত মুখে নিয়ে চিবাতে চিবাতে বলে,
” যতোক্ষণ ঘুম না আসে বই নিয়ে পড়। তুই তো আর্টসে, তাহলে কোচিং-এ শুধু ম্যাথ,ইংলিশ পড়াবে। ওগুলো সহ বাকিগুলোও ঠিকমত বাসায় পড়িস। সমস্যা হলে আমাকে বলবি। বলবি তো নাকি?”
” হ্যাঁ বলব।”
” লক্ষী মেয়ে। যা রুমে যা।”
রজনী সামনের এঁটো প্লেট উঠাতে গেলেই রুনা বাধা দেয়। রজনী কাতর কন্ঠে অনুরোধ করতেই রুনা বলে,
” আচ্ছা যা। কিন্তু আগে পড়াশোনা। মনে থাকবে তো?”
রজনী এক চিলতে হেঁসে হ্যাঁ বলে। রুনার সামনের বাটিটা নিতেই রুনার প্লেটে চোখ পড়ে ওর। শুকনো ভাতে মরিচ মেখে লাল করে খাচ্ছে রুনা। ঝালে মুখ লাল তবুও যেন খাওয়ার ইচ্ছা দমছে না। রজনী ভ্রু তুলে বিমর্ষ স্বরে বললো,
” এতো তরকারি থাকতে শুধু ঝাল দিয়ে কেন খাচ্ছ?”
রুনা একঢোক পানি খেয়ে বললো,
” আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। শুধু ঝাল,টক ছাড়া। আচার তো নেই তাই এটাই এখন অবলম্বন।”
” আমি যদি তোমার জন্য আচার বানাই তুমি খাবে?” কথাটা না ভেবেই বলে ফেলে রজনী। রুনা ওর অপ্রস্তুত হওয়া মুখটা দেখে স্বাভাবিক গলায় বলে,
” আরে তুই কেন কষ্ট করবি? আমার এটাতেই চলবে। চিন্তা করিস না এ নিয়ে।”
রুনার গলার স্বর বড়ো মিষ্টি। পর পর ভাবটা কেটে যায় গলাটা শুনলে। যে রজনীর জন্য এতো কিছু করছে, তাকে সামান্য আচার বানিয়ে খাওয়াতে কিসের কষ্ট। রজনী ঠাঁই দাঁড়িয়েই বললো,
” চিন্তা করতে হয় না, এসে যায়। বলো না, আমার তৈরি আচার তুমি খাবে?”
রুনা চোখ তুলে রজনীর মুখের দিকে তাকায়। মৃগনয়না, ঘন পাপড়িওয়ালা চোখদুটো ছলছল করছে। যেন সামান্য নাড়া দিলেই জল গড়িয়ে পড়বে চোখের কোনা বেয়ে। রুনা তার চিরাচরিত হাসিটি আবার হাসল। বললো,
” তোর যখন যা ইচ্ছা হবে করিস। আমি শুধু চাই তুই আপন ভেবে এখানে থাক। থাকবি তো নাকি?”
” হ্যাঁ।” ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হেঁসে রজনী রান্নাঘরে চলে আসে এঁটো প্লেট নিয়ে। শুধু সেগুলোই ধোয় না। রান্নাঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে,মুছে তবেই বের হয়। এসে দেখে রুনা টেবিল পরিষ্কার করে রুমে গেছে। রজনী ধীর পায়ে রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
” আপা আসব?”
” আয়।”
রুনা বসে বসে ছোট কাঁথা সেলাই করছিল। হাতের ইশারা করে বসতে বললে-রজনী রুনার রুমে গিয়ে বিছানার উপর বসল। রুনা কাঁথায় ফোঁড় দিতে দিতে বললো,
” ঘুম আসছে না বুঝলি, তোর ভাইয়াও আজ আসবে না। তাই ভাবলাম বসে বসে ছোট কাঁথা সেলাই করি। কেমন হচ্ছে দেখত?”
রজনী একপলক রুনার শুকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে কাঁথায় চোখ রেখে মৃদু হেঁসে বললো,
” সুন্দর হয়েছে।”
রুনা বললো,
” তুই সেলাই করতে পারিস?”
” হ্যাঁ। আমার কনক’দিও পারে। আমি আর কনক’দি মিলে পাল্লা লাগতাম কার কাঁথা কতো সুন্দর হয়।”
রজনীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল অতীতের স্মৃতি চারণ করে। রুনার দিকে চোখ পড়তেই চুপ করে গেল। রুনা সেটা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে বললো,
” কে জিততো? তুই না তোর কনক’দি।”
” মাঝে মাঝে আমি আবার মাঝে মাঝে দিও।” নিচু গলায় জবাব দিল রজনী।
” ক’টা সেলাই করেছিস এ পর্যন্ত?”
” তিনটে ছোট আর একটা বড়।”
” বাহ! আমি কিন্তু এসব পারি না বুঝলি। পাশের বাসার এক ভাবির কাছ থেকে শিখে এটা করছি। এই দ্যাখ লাইনগুলো কেমন ত্যাড়াব্যাড়া।”
কাঁথাটা মেলে ধরে হাসতে লাগল রুনা। যেন কী বোকামিটাই না সে করছে। রজনী কাঁথায় হাত বুলিয়ে বললো,
” ফোঁড়ের মাঝে মাঝে লাল,সবুজ সুতার ফুল দিলে খুব ভালো দেখাবে।”
” ফুল! আরে কী বলিস? ফোঁড়ই দিতে পারি না আর তুই নকশী করতে বলছিস।”
” আমি করে দেই?”
” এঃ সব আমি করে দেই। এতো করে দেই, করে দেই করলে পড়বি কখন শুনি?”
” সারাদিন একটানা পড়া যায়? বিকেলে তো পড়তে ইচ্ছা করবে না তখন করব।”
” আমাকে শিখিয়ে যদি দিস তাহলে ওকে নয়ত,,”
” দেব শিখিয়ে। এখনই দেই।” কথাটা শেষ করেই ছুটে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। একটু পর একটা পেন্সিল আর রুলার দিয়ে দৌড়ে আসে। রুনা ভ্রু কুঁচকে বলে,
” এটা দিয়ে কী হবে?”
” তোমার ফোঁড়ের লাইন সোজা হবে।” বলেই ফিক করে হেঁসে বসে পড়ে রুনার মুখোমুখি। কোনোদিক না তাকিয়ে কাঁথাটা বিছানায় বিছিয়ে ঝুঁকে দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপ দিয়ে কাঁথায় দাগ টানতে থাকে সোজাসুজি, আড়াআড়ি। মাঝে ছোট ছোট ঘর রাখে সুতার ফুল বানাবে বলে। রুনা একনিবিষ্টে চেয়ে আছে রজনীর দিকে। কতো ভাল মেয়েটা। মনটা সরল আর পবিত্র। সৌমিত্রের উপর খুব রাগ হলো রুনার। মনে মনে প্রার্থনা করল একদিন যেন এই রজনীকেই সে চোখে হারায়। সে রাতের একতৃতীয়াংশ ওদের এসব করেই কাটল। পরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙল রজনীর। গ্রামে থাকলে কোনোদিন বেলা হয়নি, কিন্তু শহরে এসে জীবনটাই পাল্টে গেছে আর এতো অভ্যাস! পূজো করাও হয়নি অনেকদিন। এদিকে মন্দির কোথায় তাও জানে না৷
দুপুরে রুনার সাথে থেকে ঘরের কাজ শেষ করে পড়তে বসল। যা পড়া দিয়েছে তার অর্ধেক গতকাল রাতেই পড়েছে রুনা আপার রুমে বসে। বাকি অর্ধেক শেষ করে লিখতে বসল। লেখা শেষ হতেই ঘুম চলে এলো চোখে। আবার একটা ঘুম দিয়ে উঠল একেবারে বিকেলে। তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছিল, তখনই বসার ঘরে নূপুরের গলার স্বর শুনতে পেয়ে উঁকি দিল। সত্যিই নূপুর এসেছে। রজনী ভেবেছিল হয়ত ওর অসহায়ত্বের গল্প শুনে আর ওর সাথে মিশবে না। কিন্তু ওর ধারনা ভুল প্রমাণিত করে নূপুর এসেছে। দু’জনে একসাথে বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে নূপুর ওকে বললো, সে এখন থেকে নিয়মিত তার সাথে যাবে। নিজের মুঠোফোনের নাম্বার দিয়ে দিল যেন, বের হওয়ার পূর্বে তাকে জানায়। রজনী মনে মনে খুশিই হলো। আজ যেতে যেতে নূপুর নিজের সম্পর্কে বললো। ওরা এক ভাই এক বোন৷ ওর ভাই বড়। বিয়ের পর আলাদা থাকে বউ নিয়ে। নূপুরের বাবা সরকারি চাকরি করে। দু’বছর পর অবসরে যাবে। নূপুর অনার্স শেষ করেছে। বিয়ের কথাবার্তা চলছে বাসায়। তবে সে চায় বিয়ের আগে একটা ভালো জব নিতে। সেই জন্যেই কোচিংএ ভর্তি হয়েছে। নূপুরের কথা শুনে রজনী ভাবল সেও পড়াশোনা শেষ করে জব করবে। তারপর একা একাই জীবন পার করে দেবে৷ মনে আশার বীজ বোনে নূপুরকে দেখে।
ওরা কোচিং-এ পৌঁছে গেল। নূপুর নিজের ক্লাসে চলে গেল আর রজনী নিজের ক্লাসে। ক্লাস শুরু হতে তখনও পাঁচ মিনিট বাকি। আজ গল্প করতে করতে কখন পথ শেষ হয়েছে রজনীর খেয়ালই ছিল না। কোচিং ক্লাসের কয়েকটা মেয়ে ওকে দেখে ব্যঙ্গ করে হাসল। রজনী সেদিকে না তাকিয়ে বই খুলে পড়া রিভাইজ করছে। কয়েকটা ছেলে পরিচিত হতে এসেছিল,রজনী কথা বলেনি। ছেলেগুলো সেজন্য খেঁপিয়েছে ক্লাসের ঐ মেয়েগুলোর সাথে বসে। গতকালের পাশে বসা মেয়েটি ঢুকতেই হাসাহাসি কিছুটা থামিয়ে দিল। মেয়েটা রজনীর পাশে এসে বললো,
” ভেতরে চাপো নয়ত সাইড দাও।”
রজনী ভেতরে চেপে যেতেই মেয়েটি বললো,
” ভেতরে চাপার দরকার নেই তুমি সাইড দাও আমি ভেতরে বসব।”
রজনী কোনো কিছু না বলে সাইড দিল। মেয়েটা গিয়ে বসল ভেতরে দেয়াল ঘেঁষে। রজনী আড়চোখে তাকাতেই ঠোঁট চেপে হাসল। হাত বাড়িয়ে বললো,
” হাই, আমি অম্বিকা পাল মিতুল।”
” আমি রজনীকান্তা বিশ্বাস।” রজনী ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে দেয়। মিতুল লম্বায় রজনীর চেয়ে পাঁচ ইঞ্চি বেশি। ছিপছিপে গড়ন, ফর্সা গাত্রবর্ণ। গায়ের চকলেট কালার টপসটা যেন ওর জন্যেই তৈরি। রজনী অপলক তাকিয়ে দেখল। প্রতিমার মতোই সুন্দর মুখশ্রী মিতুলের। হাসলে ঠোঁটের একপাশে টোল পড়ে। রজনী ইংলিশ পড়ছে দেখে হাসল মিতুল। বললো,
” আজ তন্ময় স্যারে ক্লাস সবার শেষে। প্রথমে আকাশ স্যারের তারপর একাউন্টিং রাইসা ম্যামের।”
” আমি তো আর্টসে।”
” ও তুমি মানবিক বিভাগের? সমস্যা নাই। দ্বিতীয় ক্লাসের সময় এখানে বসে থাকতে পারো অথবা ওয়েটিং রুমেও যেতে পারো।”
” ওয়েটিং রুম!” রজনীর মুখ চুপসে গেল। কারন সে চেনেই না কোথায় সেটা। মিতুল রজনীর মুখের ভাব বুঝে বললো,
” আচ্ছা এখানেই থেকো।” মিতুল হাসতেই রজনী বোকা বোকা হাসল। তা দেখে আরও হাসি পেল মিতুলের। ঠোঁটে টিপে হাসি থামিয়ে রজনীকে ম্যাথ কী কী করাবে দেখিয়ে দিল। গত ক্লাস গুলোতে কী কী হয়েছে সেটাও বলল মিতুল। মিতুলের সাথের আরও দু’জন ছেলে মেয়ে এলো পরিচয় হতে। এবার মিতুলই পরিচয় করে দিল। সামনের ব্যঙ্গ করা ছেলে মেয়েগুলো তাই দেখে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়। রজনীর মনের ব্যথা, বেদনা এই মুহূর্তে বিন্দুমাত্র রইল না। ম্যাথ ক্লাস শুরু হলো। আকাশ স্যার হাস্যরসিক একটা মানুষ। রজনীর এই ক্লাস করতে ভালো লাগল। বীজ গনিতের সূত্র ভুলে গিয়েছিল রজনী। আকাশ স্যার ওকে বকে নি। সুন্দর করে হেঁসে বলেছে,
” আবার পড়ো।”
সুন্দর সময় দ্রুত চলে যায়। রজনীর মনে হলো চোখের পলকে চলে গেল আকাশ স্যারের ক্লাস। এরপর রাইসা ম্যাম এলো। মিতুল ফিসফিস করে বললো, ম্যামটা নাকি খুব অহংকারী । রজনীর পরিচয় জেনে মুখ সিটকে ফেলল। আর্টসে পড়ে শুনে তাচ্ছিল্য করে বললো,
” ওহ! আর্টস। ঢাকার স্টুডেন্ট বেশিরভাগই কমার্স নয়ত সাইন্স বুঝছ। এখানে আর্টস কেউ নিতে চায় না। আর্টসের দামই বা কী?”
সামনের মেয়েগুলো তাল মিলিয়ে কটাক্ষ করল। আধোমুখে নীরবে দাঁড়িয়ে শুনল রজনী। মিতুল কিছু বলতে চেয়েও বলেনি। রজনীর তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। সাইন্স, আর্টস,কমার্স আবার কী! মানুষের মতো মানুষ হতে পারলেই তার দাম৷ সে সাইন্স থেকে হোক কিংবা আর্টস।
রাইসা ক্লাস শেষ হওয়ার পরও বের হলো না। তন্ময় ঢুকতেই এমন একটা ভাব নিল যেন সে সময়ের খেয়াল রাখে নি। কিছুটা ঢং করে সরি বলে পাশ কাটাবে বলে এগোয়। তন্ময় নির্বিকার ভঙ্গিতে সাইড দিতেই মুখের রঙ পাল্টে গেল রাইসার। এই তন্ময়ের পেছনে বছরের পর বছর ঘুরছে তবুও ফিরে দেখে না একবার। রাগে মুখ লাল করে বেরিয়ে গেল ক্লাস ছেড়ে। মিতুল হেঁসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললো,
” আর্টসের দাম নেই। আবার নিজেই সেই আর্টসের স্টুডেন্টের পেছনে ঘুরঘুর করে। পাত্তা পায় না তবুও আবার ভাব দেখায় অন্যের সামনে।”
রজনী কথা শুনেও তাকাল না মিতুলের দিকে। বিচলিত মনে বসে আছে তন্ময়কে ঢুকতে দেখেই৷ রাইসা ম্যাম ক্লাসে থাকতে সামনের স্টুডেন্ট গুলো খুব চাটুকারিতা করছিল। আর এখন চোরের মতো মুখ করে বসে আছে সব। তন্ময় ঢুকেই দরজা চেপে বোর্ডে কী যেন লিখতে শুরু করে। সবাই গলা উঁচু করে দেখছে দেখে রজনীও তাই করল। টেন্সের গঠন এবং সেনটেন্সএর প্রকারভেদ। এর নিচে গতকালের দেওয়া নিয়মগুলো উপর ভিত্তি করে পাঁচটা ন্যারেশন৷ সেগুলো ডাইরেক্ট আছে ইনডাইরেক্ট ন্যারেশনে পরিবর্তন করতে হবে। তন্ময় ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই রজনীর গলা শুকিয়ে এলো। কী পড়েছিল আর কী লিখেছিল সবই ভুলে গেল সে তন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে,,,,
চলবে,,,