#বিষাদময়_জীবন
#অধরা_ইসলাম
#পর্ব৭
সেদিন আকাশ দের বাড়িতে গিয়ে ছোট্ট বাচ্চা টার সঙ্গে সময় কাটাই। সেখান থেকে ওদের সংস্থাতেও ঘুরে আসি একটুখানি৷ আকাশ জোর করছিলো সেজন্য যাই। সেখানে কতো অসহায় মেয়েদের সাবলম্বী করা হয়। হাতের কাজ করানো সহো আরো কত্তো কি! নিজেরা খেটে নিজেদের রোজগারে চলে কারোর উপর নির্ভরশীল হতে হয় না এদের। ভাবতেই কি ভালো লাগছে। সেখান থেকে একটুখানি ঘুরে বাড়ি ফিরি। বাড়িতে ফিরতেই দেখতে পাই ড্রয়িং রুমের দরজা হা’ট করে খোলা আছে। কলিও এই সময় কোচিং এ থাকে তাহলে এভাবে দরজা খোলা কেনো? হঠাৎই উপরের রুম থেকে কিছু ভা’ঙা’র শব্দ কানে আসতেই ভয়ে শিওরে ওঠে আমার সারা শরীর! আমি তড়িঘড়ি করে উপরে ওঠতেই দেখতে পাই নয়নার সঙ্গে একটা অচেনা পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে! আমাকে দেখেই সে চলে যায় রুম থেকে! নয়না হকচকিয়ে ওঠে আমাকে দেখে।
–“তুমি এখানে? পার্মিশন না নিয়ে অন্যের রুমে আসতে নেই জানো না বুঝি?”
–“না আসলে তুমি যে অন্য পুরুষ ঢোকাও বাড়িতে আমরা কেউ না থাকলে এটা জানতাম কি করে?”
—“মুখ সামলে কথা বলো বলছি।”
নয়নার চোখে আমি স্পষ্ট ভ’য়ের আভাস দেখতে পাচ্ছি। ওর হাত দু’টো পেছনে নেওয়া নিশ্চয়ই হাতে এমন কিছু রেখেছে যা আমাকে দেখতে দিবে না। আমি চুপ করে থেকে হুট করে এক পর্যায়ে ওর হাত টা সামনে এনে দেখি প্রেগন্যান্সি টেস্টের কী”ট ওর হাতে! আর সেটা পজেটিভও আছে! এক মুহুর্তে যেনো মনে হচ্ছে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে! ভাবতেও পারছি না আর কিছু! এরই ভেতর নিরব রুমে ঢুকলো হাত কিছু কাগজ পত্র নিয়ে রুমে ঢুকে বোধহয় আমাকে আর নয়নাকে একসঙ্গে আশা করেনি নিরবের মুখটা কেমন যেনো দু্ঃখী দুঃখী লাগছে!
–“একি মায়া? তুমি এই রুমে কি করছো? তোমার আর কলির জন্য না এক রুম আছে তাহলে আবার এখানে কেনো এসেছো?”
আমি নিরবকে কিছু বললাম না কিন্তু নিরব আমার হাতে থাকা কী”টটা দেখতে পেয়েই একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে! কিন্তু আমি চুপচাপ আছি কিছুই বলছি না। এই দিনটা আসার বোধহয় খুব দরকার ছিলো আজকে। ভাগ্যিস বাড়িতে এসেছি আকাশদের বাড়িতে থাকতে তখন নয়নাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম বিকেলে আসবো কিন্তু আমি যে দুপুরেই চলে এসেছি আকাশ ঘুমিয়ে পড়ার পর সেটা নয়না ই বা কি করে জানতো? ভাগ্যিস এসেছি সেজন্যইতো এই কী”’র্তি ধরতে পেরেছি! আজকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আমি ঠিক কি করবো এখন শুধু কলি আসলে সেটা বাস্তবায়ন করার অপেক্ষা। মেয়েটা অনেক ভালোবাসে আমাকে বড়ো বোনের মতন সম্পর্ক ওর সঙ্গে ওকে এমনি এমনি ছেড়ে দিতে তো পারি না! নিজের ছোটো বোনের মতনই দেখি ওকে আজকে ও আসুক ওরও ব্যবস্থা ভেবে রেখেছি আমি। নিরব এবার আমাকে ছেড়ে নয়নাকে প্রশ্ন করলো এবার অপেক্ষায় আছি নয়না কি উত্তর দিবে নিরবকে। আমার আর কিছু বলার নেই এখন নিরব দর্শকের মতন সবটা দেখে যাবো খালি আমি।
–“নয়না? মায়া তো অলরেডি আট মাসের প্রেগন্যান্ট তাহলে এই প্রেগন্যান্সি পজেটিভ কী”’ট আসলো কোথা থেকে বলো? এটা নিশ্চয়ই তোমার না বলো?”
–“আমি জানি না কিছু নিরব বিশ্বাস করো তুমি। আমি কিচ্ছু জানি না এসব তোমার বউ ওই মায়াই করেছে দেখো?”
অনেক হয়েছে এবার নিজের মনকে বুঝ দিলাম। ওদের তর্কাতর্কির ভেতরে আমি আমার পরিচিতো একজন ডাক্তারকে ফোন করলাম বাড়িতে আসার জন্য। ডাক্তারের আমাদের বাড়িতে আসতে দশ মিনিটও লাগে না খুবই কাছে। ওরা তর্ক করার মাঝখানেই ডাক্তার এসে হাজির হলো। নিরব আবারো আমাকে প্রশ্ন করলো
–“তোমাকে বলে কোনো লাভ হতো না তাই ডাক্তারকেই ডেকে এনেছি। আমি বাহিরে গেছিলাম একটুখানি সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসি আর বাড়িতে এসে দেখি নয়নার সঙ্গে একজা লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই লোকটি তাড়াহুড়ো করে চলে যায় আমি যদি খুব সম্ভবত ভুল না করি তাহলে ওই লোকটিই নয়নার বাচ্চার বাবা। তুমি যেমন ঠ”কি’য়েছো আমাকে? তেমনি নয়নাও ঠ”কি’য়েছে তোমাকে একই ভাবে। নয়না ওই লোকটির সঙ্গে পর’কী’য়া ছিলো। যাকে তুমি ভালোবাসতে যার প্রেমে অ”ন্ধ হয়ে আমার বা আমার বাচ্চার কথা ভাবোনি। এবার আমার কথার প্রমান করতে হলে এই যে ডাক্তার সাহেব আছে? উনি নয়নাকে চেকআপ করলেই বুঝে যাবেন।”
আমার কথানুযায়ী নয়নাকে চেক আপ করলো ডাক্তার। নিরব ডাক্তারের মুখ থেকে সবটা শুনে ধ’প করে মাটিতে বসে রইলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতোটা পাচ্ছে ও। নয়না আবারো নিরবকে বলতে লাগলো
–“ভুল কেনো বুঝছো তুমি? এই সন্তান তোমার নিরব।”
নিরব এবার নয়নাকে ক’ষে দুটো থা”প্প”ড় দিলো! তাল সামলাতে না পেরে নয়না মাটিতে পড়ে গেলো। নিরবের চোখ মুখ দেখে বেশ রা’গী মনে হচ্ছে।
–“ব্যস অনেক সহ্য করেছি আমি! আর না আর সহ্য করতে পারছি না আমি! ভুলে গেছো নয়না? বিগতো তিন মাস ধরে আমি তোমার সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ রাখিনি যাতে তুমি মা হবে! হ্যাঁ হয়তো কয়েকবার দেখা করেছি কিন্তু এসব কখনো হয়নি তো তুমি আমার বাচ্চার মা কি করে হবে! এতো বড়ো একটা ধো’কা কি করে দিতে পারলে আমাকে নয়না! মনে আছে যখন মায়া তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা জেনে ছিলো আমি দূরে সরে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি মানসিকভাবে বুঝিয়ে আমাকে আবারো এনেছিলে তোমার কাছে। সেসব কেনো করেছিলে তুমি? কেনো এসব করেছো? সত্যি কথা বলো আজকে! তোমার জন্য আমি আমার বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে অন্যায় করেছি। কষ্ট দিয়েছি ওকে শুধু ওকেই নয় আমার বাচ্চাকেও! আর সেই তুমিই কিনা এসব করলে আমার সঙ্গে?”
–“হ্যাঁ বেশি করেছি! যা করেছি বেশ করেছি আমি। কি কনবো বলো? ছোটো থেকে অভাবে বড়ো হয়েছি ভালোবেসেছিলাম তোমারই মতন সূর্য নামক ছেলেকে ওর খুব টাকার প্রয়োজন ছিলো আর প্রয়োজন পূরন করতেই তোমার কাছে আসা আমার। কিন্তু কি করবো বলো? যার জন্য এতোকিছু করলাম সেই তো রইলো না আর আমার কাছে দিনশেষে! হ্যাঁ আমার পরিকল্পনা ছিলো তোমার বাড়িতে এসে তোমাকে নিয়ে সব রকম সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া। পারিনি আমি সেসব করতে আর বোধহয় করতেও হবে না কারন বললাম না যার জন্য এসব করলাম সেই নেই বোধহয় আর! মায়া সূর্যকেই দেখেছিলো আমার গর্ভে ওরই সন্তান রয়েছে কিন্তু ও মেনে নেয়নি মি”থ্যা অ”জু’হাত দিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে সারাজীবনের মতন!”
আমি এতোক্ষণ ধরে নয়না আর নিরব দু’জনেই কথা শুনেছি এখন মনে হচ্ছে প্রকৃতিই যেনো ওদের দু’জনকে শাস্তি দিয়ে দিয়েছে। যে ঠ”কায় সে নিজেও ঠ”কে একদিন না একদিন! তবে সেটা সময়ের অপেক্ষা। আর আজেকই সেই সময়। এবার বুঝুক নিরব কি রকম লাগে!
পাঁচ বছর পর,,,,,,
সেদিনের ওই ঘটনার পর নয়না চলে যায় ওই বাড়ি থেকে সে আত্ন’হ”ত্যা করে সূর্য তাকে মেনে নেয়নি সেই অপ’মা’ন আর তার অনাগতো বাচ্চাকে কি অধিকার দিবে সেসব ভেবে, আর নিরব? তার বিরুদ্ধে আমি নারী নি’র্যা”তনে”র কে’স করি। যদিও সে কিছু বছর পর ছাড়া পেয়ে যায়। নিরব ছাড়া পেয়েই আমার আর আমার মেয়ের কাছে ফিরতে চেয়েছিলো। হ্যাঁ আমার মেয়ে হয়েছে! সেদিনের সেই ঘটনার পর নিরব শুধরে যায় পুরোপুরি ভাবে। ও আমার প্রতি যে অ’ন্যা”য় করেছিলো প্রকৃতিই নিরবে তাকে তার শাস্তি দিয়ে দিছে আমার কিছু করা লাগেনি! জে’ল থেকে বেরিয়ে এসে ফিরতে চেয়েছিলো আমি রাখিনি তারপর থেকে নাকি নিরব অনুশোচনায় দ”গ্ধ হয়ে একসময় পাগল হয়ে যায়! শুনেছি এখন নাকি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি নিরব। পা”পে’র শা”স্তি এভাবেই পেয়েছে, প্রকৃতিই দিয়েছে ওকে ওর কৃতকর্মের ফল আমার কিছুই করতে হয়নি। কলি প্রথম কয়েক বছর নিরবের দেখাশোনা করলেও কলির ও বিয়ে হয়ে যায় ওর সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার মেয়েটা বেশ সুখেই আছে। এখন সময় পেরিয়ে গেছে সেদিনের থেকে পাঁচ বছর। আমি ওই দিনের পর থেকে নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারি। বাপের বাড়ি যাইনি ফিরে। আকাশ নামক ছোট্ট বাচ্চার হাত ধরে আমি রয়ে যাই ওই সংস্থাতে। বাকি মেয়েদের মতন আমিও এখন নিজে উপার্জন করে নিজে চলি। শুধু তাই নয় সেদিন নিরুপায় হয়ে যখন আকাশের সঙ্গে শেষবারের মতন দেখা করতে যাই আকাশ নামক ছোট্ট বাচ্চাটি আমাকে আশ্রয় দেয়। ওর দাদীমা আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ওই সংস্থায় কাজ দিয়ে। আমার মেয়ে হবার ছয় মাসের ভেতন আমি নিজের উর্পাজনের টাকায় একটা বাসা নিই যদিওবা সেখানে সংস্থার আরো তিনটে মেয়ে থাকতো। আকাশ এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে আর আমার মেয়ে তো সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো ওই পরিবারটার কাছে যারা আমাকে জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। ওনারা ছিলেন বলেই আমাকে কোথাও মুখ থুবড়ে পড়তে হয়নি! তখন নিরবের সঙ্গে থাকতে পারতাম ওই বাড়িতে কিন্তু রুচিতে আর কুলোয়নি তখনো সন্তানের কথা ভেবেই থেকে গেছিলাম। ভেবেছিলাম ও পৃথিবীতে আসলে চলে যাবো কিন্তু ওইযে বললাম না? আকাশের সঙ্গে একবার দেখা করতে যাই আর তারপর থেকেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়৷ অবশ্য ভালোই আছি আমি এখন। নিজের কাজ করে বাকিটুকু সময় মেয়ের খেয়াল রাখি মাঝেমধ্যে আকাশের কাছেও যাই। উনারা খুব ভালো মানুষ আমাকে বলেছিলো থাকতে কিন্তু আমি থাকিনি। আমার বিপদে আশ্রয় দিয়ে যে বড়ো উপকার করেছে তার ঋনই তো শোধ করতে পারবো না আমি। তাছাড়া এখনতো নিজেই উপার্জন করতে পারি। কষ্ট হয় না আর কোনো কিছু নিয়ে খুব ভালো আছি। অতীতের সব স্মৃতি ভুলে গেছি পুরোপুরি ভাবে। আমার জীবন এখন আমার মেয়েকে নিয়েই। আর দরকার নেই জীবনে আমার কাউকে আমি আমার ছোট্ট মেয়ে আর আকাশের মিষ্টি আন্টি হয়েই পারি দিতে পারবো বাকিটা জীবন। আমার এই বিষাদময় জীবনের বিষাদ সেদিনের পর থেকে ঘুচে গিয়ে আলো করে এসেছে আমার মেয়ে আর আকাশ।
#সমাপ্ত