#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
|পর্ব ২০|
চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। চোখের পানি কিন্তু তার সঙ্গ দিচ্ছে না, সে নিজের মতো বইছে। এক চাপা রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে সে উঠে গেলো। হঠাৎ খুব জোরে বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। বৃষ্টি থেমে যায়, সে চুপচাপ দাড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে। বৃষ্টির পানি প্রকৃতের সাথে ওর মনের রাগ টাকে ধুয়ে নিলো। সে ভেবে উঠে, ‘আচ্ছা, রাত্রি আপুর কি দোষ? উনি তো এসব করেন নি,তাহলে আমি অযথা কেনো উনাকে দোষারোপ করছি? উনার সাথে তো আমার থেকেও খারাপ ব্যবহার হয়ে আসছে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে তো উনার থেকে অনেক সুখে আছি আমি। আর উনি তো এসে আমার সংসার দখল করেন নি, আমি করেছি। তাহলে তো উনার আমার থেকেও বেশি কষ্ট হয়েছে। মাত্র এক মাস খানেকের সম্পর্কে আমার এমন লাগছে,সেখানে তো উনার বছরের সম্পর্ক। কিন্তু আমার ই বা কি দোষ? আমি তো নিজ থেকে আসি নি। আমার পরিস্থিতি এমন ছিলো যে আমি ক্ষণিকের লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, সবাই তো চায় একটা সুন্দর লাইফ, সেখানে আমার চাওয়া টা কি খুব বেশি দোষের ছিলো? মানলাম অন্যের বশে পড়ে আমি অন্য পথে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কি স্বাভাবিক নয় আমার মতো মেয়েদের জন্য? আমি কি সব জানতাম? তাহলে কী আমার উচিত ছিলো সব চুপচাপ মেনো নেওয়া,কোনো প্রতিবাদ না করা?
‘মেয়েরা প্রতিবাদী হলে মেয়েরাই তাদের দুষমন হয়ে যায়।’
আচ্ছা, আজ থেকে আমি আর আমার কোনো অধিকার চাইবো না আর না উনাদের মাঝে যাবো। সরে যাবো উনাদের জীবন থেকে, সুখে থাকুক। কাল যা হয়েছিলো সেটা কেউ জানবে না, কখনো কেউ জানবে না। মনের মধ্যে দামাচাপা দিয়ে দিলাম সব। আজকের পর আর কেউ জানবে না। ধীরে ধীরে আমি নিজেও সরে যাবো।
আচ্ছা,এসবে আমার দোষ কই? আমি জানতে চাই, কেনো আমার জীবন টা এমন হয়েছে? কেনো?হোয়াই? সব কিছুতেই আমি দোষী?
ইট-সিমেন্টের এই জীবন থেকে হাজারগুন ভালো ছিলো ওই কুড়ে ঘরের জীবন।”
বৃষ্টি ভাবতে ভাবতে এক সময় হাটুগেড়ে বসে পড়ে। কাঁদতে চায় না সে, তবুও চোখ দিয়ে পানি আসছিলো। কি করবে? এ চোখ দুটো যে বড্ড বেহায়া, বড্ড অবাধ্য। ভিজে চুপসে গিয়েছে সে, থরথর করে কাঁপছে, জামা ভিজে শরীরের সাথে মিলে গিয়ে সব স্পষ্ট হয়ে গেছে।
কতক্ষণ এভাবে থাকার পর সে উঠে যায়, চুপচাপ উঠে নিচে নেমে আসলো। ছাদের সিড়ি দিয়ে নামতেই শাশুড়ির সাথে তার দেখা। তার মুখ গম্ভীর, থমথমে। চোখ দুটো ভীষণ ফোলা। মনে হচ্ছে খুব কেঁদেছেন। পুরো মুখে এক রাশ ঘন কালো মেঘ।
–” এমন ভিজে আছো কেনো? এ অসময়ে ছাদে গিয়েছিলে কেনো?”
বৃষ্টি মিনমিন করে কাঁপতে কাঁপতে বলে,–“ছ্ ছাদে ক্ কোনো কাপড় আ্ আছে কি না দ্ দেখতে..!!”
শাহিনুর অতি গম্ভীর গলায় বলেন,–“তাড়াতাড়ি গিয়ে বদলে ফেলো এসব। ঠান্ডা লেগে যাবে।”
বৃষ্টি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,–“হু!” এটুকু বলে সে চলে যেতে লাগলো, শাহিনুর পেছন থেকে তাকে বলে,–” শুনো।”
–“জ্ জ্বি!”
–“আমার রুমে একবার এসো, কিছু কথা ছিলো..!!”
বৃষ্টি আবারো মাথা ঝাঁকালো। চুপচাপ রুমে ডুকলো, আগে একবার চেক করে নিয়েছে, কেউ আছে কি না? কাউকে না দেখে সে শব্দহীন ভাবে ডুকে। দ্রুত একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। মাথা মুছতে মুছতে বের হতেই দেখলো সাগর খুব গম্ভীর হয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। চেহারা আঁধার হয়ে আছে। হয়তো কিছু ভাবছে। গভীর কিছু ভাবছে, না হলে বৃষ্টির উপস্থিতি ওর চোখে পড়লো না কেনো?
বৃষ্টি চুপচাপ বের হয়ে গেলো শাশুড়ির রুমের উদ্দেশ্য। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর শাশুড়ি বলে, –” বৃষ্টি, কিছু কথা বলবো। কিছু মনে করবে না তো?”
বৃষ্টি মাথা ঝাঁকালো, সে বলে–“না,কিছু কেনো মনে করবো?”
শাহিনুর অনেক্ষণ চেষ্টা করেও বলতে পারছিলো না। অবশেষে খুব দ্বিধা নিয়ে বলে,
–“সাগর আর তোমার মধ্যে কি কিছু হয়েছিলো?”
বৃষ্টি কিছু টা লজ্জা পায়, তবুও সে কঠোর কন্ঠে বলে –” না, কিছুই হয় নি। আর না কখনো হবে।”
শাহিনুর খুব জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তার তপ্ত শ্বাস বৃষ্টির মুখে এসে লাগলো। বুক থেকে খুব বড় একটা পাথর নেমে গেলো। অনেক টা শান্তি লাগছে তার। বৃষ্টিকে আর কিছু বলেন নি তিনি, তাকে সম্মতি দিয়ে দিলেন চলে যাওয়ার জন্য। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বলে, –” সন্ধ্যায় সবাই বসার রুমে যেনো বসে। আমি খুব জরুরী কিছু কথা বলবো।”
বৃষ্টি হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে কিছু টা। সে চুপচাপ বের হয়ে গেলো। রাতে সাগর আসার পর সে সব দেখেছে আর শুনেছেও।মা কে কত কি বলেছে সে সব আড়াল থেকে দেখেছে। বৃষ্টির ধারনা শাহিনুর এখন বলবে, সে যেনো চলে যায়। তার ছেলের সুখের জন্য রাত্রিকে উনি আবার ওর সাথে মিলিয়ে দিবেন।
সাগর ড্রাংক ছিলো,সেটা বৃষ্টির বুঝতে একটু কষ্ট হয় নি। আর সে অনেকবার বলেছে, সে মদ খায় নি,বিয়ার খেয়েছে!
বৃষ্টি অনেকবার তাকে বাঁধা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার সাথে পেরে উঠে নি। তার মনে কোথাও না কোথাও সাগরকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো। তাই সে হাল ছেড়ে দেয়।
আশেপাশে ঘুর ঘুর করে রুমে আসে বৃষ্টি। সাগর এখনো আগের মতো দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই সাগরের কাছে গিয়ে দাড়ালো। সাগর কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকালো।
বৃষ্টি মাথা নিচু করে চুপচাপ বলে উঠে,–” আপনাকে সন্ধ্যায় রুমে থাকতে বলেছে আপনার মা। উনি কিছু জরুরী বিষয় আলোচনা করবেন।”
সাগর চুপ করে রইলো। বৃষ্টি চলে যাচ্ছিলো সাগর তার হাত ধরে ফেলে। বৃষ্টি পেছনে ঘুরে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হয়। বৃষ্টির ঠোঁটজোড়া মৃদ্যু কম্পমান। সে বলতে চাইছে,–“কি?কিছু বলবেন?হাত ধরে আছেন কেনো?”
ললাটে কথা আটকে আছে, মুখ দিয়ে সে সেটা বের করতে পারছে না। বৃষ্টি হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে, সাগর তাকে টেনে সোজা দাড় করিয়ে বলে,–“কিছু কথা ছিলো।”
বৃষ্টি কম্পমান ঠোঁটে বলে,–” ক্ কি বলবেন?”
সাগর খুব ছোট মুখ করে বলে,–” রাতে আমাদের মধ্যে কিছু হয়েছিলো তাই না? ”
বৃষ্টি হাত টা ছাড়িয়ে নিলো। সে সরাসরি খুব কড়া গলায় বলে,–” না। কিছুই হয় নি। আপনি মদের নেশায় টাল ছিলেন, বারবার রাত্রি আপু বলছিলেন আমাকে। আমার সাথে অনেকবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কিছু হয় নি।”
সাগর প্রাণভরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দম বন্ধকর পরিস্থিতি হচ্ছিলে এতক্ষণ। কিছুক্ষণ যা হয়েছিলো সেটা ভাবতেই তার মাথা ঘুরে আসছে।
রাত্রি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আর বলে যে সে কাল রাতে তাকে রুমে দিয়ে চলে গিয়েছিলো। সে যা ভাবছে এমন কিছুই তাদের মধ্যে হয় নি। তারপরেই সে ধাক্কা খায়। মাথায় হাত দিয়ে কতক্ষণ বসে বসে ভাবতেই তার মনে পড়লো, বৃষ্টি তাকে ধাক্কা দিয়েছিলো। এর আগে মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছেন। সে কী খুব খারাপ কিছু করেছিলো মায়ের সাথে?
মানে দু দিকের টেনশন মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠছিলো। তাই সে বৃষ্টিকে সরাসরি প্রশ্ন করলো যদিও তার মনে হচ্ছে বৃষ্টি মিথ্যা বলছে।
সে বৃষ্টিকে বলে,–” সত্যি তো কিছু হয়নি! ”
বৃষ্টি কিছুটা হেসে বলে,–“হলেও কি হতো? পাপ হয়ে যেতো বুঝি? ”
কথা টা বলে সে চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে আসে সেখান থেকে। সাগর বারবার পেছন থেকে ওকে ডাকতেছিলো কিন্তু সে ফিরে তাকায় নি। চুপচাপ বের হয়ে গেলো।
***
—“কিন্তু স্যার এখন কীভাবে সম্ভব?”
—” আমি জানি না। তুমি কীভবে ম্যানেজ করবে তোমার ব্যাপার।”
—“স্যার আজ তো শুক্রবার। অফ ডে তারপরেও স্কুলে আসতে হবে?”
—” দরকার না পড়লে তো তোমাকে বলতাম না স্যার। কিন্তু কি করবো পরিদর্শক নিজে আমাকে ফোন দিয়েছেন। উনি নাকি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে আসবেন, বিশেষ করে তোমার সাথে দেখা করতে।”
—” আমার সাথে? কিন্তু কেনো?”
—” আর, উনার একটা নাতি আছে না? শাফি। ও নাকি তোমাকে দেখতে চায়, বাবাকে প্রচন্ড ভয় পায়। তাই সে তোমার সাথে দেখা করার জন্য দাদুকে বলেছে।”
–“কিন্তু স্যার?”
–” রাত্রি প্লিজ। কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলে হাজির হও। ”
রাত্রি ঠিক আছে স্যার বলে ফোন কেটে দেয়। সে ভীষণ উদ্বিগ্ন আর চিন্তিত। এ বাচ্চা তো কারো সাথেই কথা বলে না, সারাক্ষণ বাঘের মতো থাকে। তাহলে আবার আমার সাথে কেনো দেখা করতে চায়। কাহিনী কি?
সে বিরবির করে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলো এমন সময় তার মুখোমুখি হয়ে দাড়ায় বৃষ্টি। দুজনের একসাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। খুব গভীর চাহনী দুজনের! একে অপরের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
| পর্ব ২১-২২ |
দুজনে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিষ্পাপ সেই চাহনী! মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে মনে অনেক কথা জমা হয়ে আছে দুজনের জন্য। চুপচাপ তাকিয়ে আছে দুজন। কয়েক মুহূর্ত নিরবতা বিরাজ করে রইলো। এ যেনো চোখ দিয়ে কথা চলছে। রাত্রির ফোন টা বেজে উঠতেই দুজনের সম্মতি ফিরে আসলো। সে ফোন টা দরতে যাবে তার আগে কাটা যায়, পরক্ষণেই টেক্সট আসে,–” আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা ছিলো। আপনি কি এখন স্কুলে আসতে পারবেন?”
রাত্রি অবাক হয়ে মেসেজ টা দুবার রিপিট করলো। আননোন নাম্বার। কার হতে পারে?
বৃষ্টি কিছুু টা অস্বস্তি নিয়ে বলে,–“কি হয়েছে?কিছু সমস্যা আ্ আপু?”
রাত্রি ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকালো। বৃষ্টি যে গাবড়ে গেছে তা সে বুঝলো। সে মৃদ্যু হেসে বলে,–” না, তেমন কিছু না। আসলে অপরিচিত নাম্বার থেকে টেক্সট এসেছে এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য আমার ধারনা হয়তো স্কুলের কোনো টিচার নাহলে কোনো বাচ্চার বাবা-মা প্রাইভেটের জন্য কিছু বলবেন।”
জবাবে বৃষ্টি কিছু টা খুশি হলো। কারন সে ভেবেছে হয়তো তাকে বকাঝকা করবে। বা অন্যকিছু।
সম্মতি জানিয়ে সে বলে,–“ওহ,আচ্ছা আপু।”
রাত্রিও মাথা নাড়ালো,এরপর সে ফোন টা হাত থেকে সরিয়ে বলে,–” তুমি কি কিছু বলবা?”
বৃষ্টি মনে পড়া ভঙ্গিতে বলে,–“ও,হ্যা। মা বলেছেন সন্ধ্যায় সবাই একসাথে বসতে উনি কিছু কথা বলবেন।”
রাত্রি ভ্রু কুচকে তাকালো তার দিকে। মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলছে, ‘কি বলবে সে?’
মুখে প্রশ্ন করবে কি করবে না ভাবছে।
বৃষ্টির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,–” তোমাকে কি কিছু বলেছে কি বলবে?”
বৃষ্টি মাথা নাড়িয়ে বলে,–“না, আপু। কিছু বলে নি তবে হ্যা আমাকে এ কথা বলার আগে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন।”
রাত্রি কপাল কুচকে বলে,–“কি বলেছে? আমার ব্যাপারে কিছু?”
বৃষ্টি মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলে,–” না আপমার ব্যাপারে কিছু না। আমাকে শুধু প্রশ্ন করেছেন যে আমারা ইন্টিমেট হয়েছি কি না?”
রাত্রি হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তার কথায়। চোখমুখে অস্বস্তি ফুটে উঠলো। সে হালকা হেসে বলে,–” আচ্ছা, আমি যাবো। এখন স্কুলে যেতে হবে, মা কে একটু বলে দিও। আমার টাইম নেই স্যার যেতে বলেছেন, একটা বাচ্চার ব্যাপারে কিছু কথা বলবেন।”
বৃষ্টি হালকা হাসলো। হাসিমুখে বলে,–” আচ্ছা আপু,আমি বলে দিবো।”
রাত্রি বৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বৃষ্টি আনমনে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। এ জল খুশির কি না তার জানা নেই তা। তবে অন্তর টা খুব হালকা লাগছে তার।
***
খুব দ্রুত পা ফেলেই স্কুলে এসে পৌঁছায় রাত্রি। প্রিন্সিপাল রতন তখন পায়চারী করছে ঘরময়(অফিস)। চেয়ারেই বসে আছে শাওন আর তার ছেলে। দুজনেই গম্ভীর আর চুপচাপ বসে আছে।
রাত্রি সালাম দিয়ে বলে,–” আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আমাকে ডেকেছিলেন?”
—“ওহ,রাত্রি!এসেছো তুমি? এদিকে আসো।”
রাত্রি হালকা অবাক হয়ে ভেতরে ডুকলো। তার মন আর মষ্তিষ্কে চলছে, ‘কী হয়েছে? ‘
রাত্রি কে দেখে শাফি খুব গম্ভীর হয়ে গেলো। সে নিচু হয়ে হেটে এসে রাত্রির শাড়ীর কুচি টান দিতে লাগলো। রাত্রি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকালো, ঝুঁকে বলে,–” কি হয়েছে? কিছু লাগবে?”
শাফি গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” হাগ মি!” (জড়িয়ে ধরো)
রাত্রি ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিচু হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। সে অবাক নয়নে স্যারের দিকে তাকালো। রতন, চোখ দিয়ে ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে। রাত্রি তাকে উঠিয়ে কোলে নিতেই সে চুপচাপ তার ঘাড়ে মাথা রাখলো। রাত্রি বিষ্ময়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। শাওন চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাত্রি কিছুটা ইতস্ত গলায় বলে,–“কি হয়েছে?ও এমন করছে কেনো?”
শাওন তাকে চেয়ার টা ঠেলে দিলো বসার জন্য, রাত্রি তাকে সহ বসে পড়লো।
শাফির ব্যাগ থেকে একটা চিত্র বের করে তার সামনে ধরলো শাওন। রাত্রি চোখ বড় করে ভালো করে চিত্র টা দেখতে লাগলো। ছবিটা তার নিজের! আচ্ছা সে ভুল দেখছে না তো? কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে? বিস্ময়ে মুখেরর হা টা ইয়া বড় হয়ে গেলো।
ছবিটায় দেখা যাচ্ছে, রাত্রি অসহায় মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর শাফি দাঁত বের করে হালকা হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ওদের থেকে হালকা দূরেই পুরুষ অবয়ব দাড়িয়ে আছে। রাত্রি ধরে নিলো ও শাওন।
সে বলে,–” চমৎকার! এটা কে একেঁছে?”
শাওন হালকা স্বরে বলে,–” শাফি একেঁছে। ”
রাত্রি অবিশ্বাসের স্বরে বলে,–” Unbelievable!কিভাবে সম্ভব? ”
শাওন আরো অনেকগুলো ছবি বের করে দেখালো তাকে। প্রত্যেক টা ছবি দেখতে জীবন্ত! রাত্রি সবগুলো ছবি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।
শাওন গম্ভীর কন্ঠে বলে,–” ও আমেরিকার আর্ট স্কুলে পড়েছে। ওখানে দুবার চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম ও তৃতীয় হয়েছে। ও মন থেকে একবার যা চায় তা আঁকতে পারে। নাহলে অন্যসময় কিছুই পারে না। তাই এটা স্বাভাবিক। ”
রাত্রি অবাক হয়ে শুনছে সব। এটুকু বাচ্চার কত গুন। রাত্রিকে নানান জিনিস দেখালো সে। দেখানো ফাঁকে রাত্রি প্রশ্ন করলো,–” আচ্ছা,ও কথা বলে না কেনো? না মানে ও খুব কম কথা বলে।”
শাওন উঠে দাড়ালো, দু কদম হেঁটে গম্ভীর কন্ঠে বলে,–“ও এবনরমাল বাচ্চা। ওর অনেক কিছু স্বাভাবিক আবার অনেক কিছু খুব অস্বাভাবিক! ”
রাত্রি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো। শাফি তখনও ওর কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সে হাত উঠিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
— আপনি হয়তো ভাবছেন? আপনাকে কেনো ডেকেছি আমি?”
রাত্রি কিঞ্চিৎ চমকে তাকালো। আসলে সে এটা এতক্ষণ ভাবছিলো,কিন্তু এখন সেটা ওর মাথা থেকে চলে গিয়েছিলো। সে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে বলে, –“জ্বি, দয়া করে বললে উপকৃত হতাম। আসলে আমাকে একটু দ্রুত বাড়ীতে যেতে হবে।”
শাওন চুপ করে রইলো, এরপর মোবাইল টা নিয়ে একটা ভিডিও প্লে করে ওর সামনে রাখলো। রাত্রি হরিণের মতো চোখ করে ভিডিওর দিকে তাকালো।
ভিডিও তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, শাফি পুরো রুম তচনছ করছে। সব ভেঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। ফুলদানি, খেলনা গাড়ী, খেলনা পিস্তল আরো নানান জিনিস। রাত্রি চমকে উঠলো, সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ শাফির আঙ্গুলে ছোট কাচের টুকরো আটকে যায়, সে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাতরাচ্ছে। দরজার অপাশ থেকে দরজা খোলার জন্য মানুষ চেঁচামেচি করছে।
একটু পর দেখা গেলো, পঞ্চাশোর্ধ এক লোক জানালা দিয়ে ইশারায় কিছু বলতেই সে চুপচাপ গিয়ে দরজা খুলে দিলো। এটুকুই ছিলো ভিডিও তে। টান টান উত্তেজনা নিয়ে এতক্ষণ রাত্রি ভিডিও টা দেখছিলো। দম বন্ধকর অবস্থা ছিলো। ভিডিও শেষ হওয়ার সাথে সাথে শাওন বলে, –” আমি জানি, আপনি কি প্রশ্ন করবেন! আপনাকে বলতে হবে না। আমিই বলছি, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন যে শাফি এমন করছে কেনো?’
রাত্রি মাথা নাড়ালো, শাওন মুখ টা ছোট করে বলে,–” ওর এমন এবনরমাল আচরণ করার কারণ হলো ও আপনার কাছে আসতে চাইছিলো,আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিলো। ওর দাদু এবং আমি বুঝিয়েছি যে আজ শুক্রবার আজ আসা যাবে না। কিন্তু ও মানতে নারাজ, এর পরিবর্তে কি করলো সেটা তো দেখলেন ই। বাবা রাজি হওয়ার পর ও থেমেছে। তাই আপনাকে এ সময় এখানে এনেছি।”
রাত্রি কথা শোনার ফাঁকে ফাঁকে শাফির হাত তুলে দেখলো। আঙ্গুল টা ব্যান্ডেজ করা। ইশশ কতখানি ব্যাথা পেয়েছে! রাত্রি মুখ টা ছোট করে দেখলো,এরপর কাঁটা জায়গায় চুমু দিয়ে দিলো।
শাওন চুপ করে বসে রইলো। রতন স্যার ও চুপচাপ সব শুনতে ও দেখতে লাগলেন। রাত্রি কিছু বলার আগে তিনি উৎসুক হয়ে বলে,–” কিন্তু ওর সাথে দেখা করতে কেনো চাইছিলো আপনার ছেলে? একদিনে এত টা মায়া তো সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ রাত্রির সাথে দেখা করার জন্য গম্ভীর শান্তশিষ্ট বাচ্চা টা এতটা ভায়োলেট কেনো হলো?”
শাওন চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার মাথায় কী চলছে? কে জানে!
রাত্রি নিজেও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়।
শাওন নিরলসভাবে বলে,–” কারণ ও মনে করে মিস রাত্রি ওর মা!”
শাওনের সহজ-সরল জবাব শুনে দুজনেই চমকে তাকালো।
–“কিহহ? কিন্তু কেনো?”
দুজনেই একসাথে চেঁচিয়ে বলে উঠে। একসাথে বলে উঠায় শাওন থতমত খেয়ে যায়। কিন্তু উনাদের কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। উনারা দুজন একসাথে উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
শাওন ফোনের স্ক্রিন কিছুক্ষণ স্ক্রল করে একটা ফটো বের করে ওদের সামনে রাখলো। দুজনেই ছবি টির দিকে কিছুক্ষণ হতভম্ভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ছবিটায় শাওন আর একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে,মেয়েটির কোলে শাফি। তিনজন ই হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। শাফিকে দেখে মনে হচ্ছে ও খিলখিল জরে হাসছে। ছবিটার মেয়েটার সাথে রাত্রির চেহারায় প্রায় হুবহু মিল। হালকা কিছু জিনিসের বৈশাদৃশ্য থাকলেও অনেকটাই মিল। এ যেমন রাত্রির প্রশস্ত ললাট,মেয়েটার হুবহু তেমন! রাত্রির চোখদুটো গাঢ় বাদামি,মেয়েটার ও তেমন। শুধু রাত্রির গায়ের রং হালকা চাপা কিন্তু ওই মেয়েটার একদম ধবধবে সাদা। রাত্রির চুল লম্বা, ঘন কালো। আর মেয়েটার চুল কাঁধ অবধি, চুলের রং টা বার্গেন্ডি। কেউ যদি ভালো করে খেয়াল না করে তাহলে হয়তো বলবে দুজনেই এক!
রাত্রি, চোখমুখে হাজারও প্রশ্ন আর কৌতূহল নিয়ে শাওনের দিকে তাকিয়ে আছে। শাওনের চোহারায় কোনো চমক নেই। যেনো সে জানতো ওরা এমনই রিয়েক্ট করবে।
রাত্রি অস্থির হয়ে বলে,–” ও কে? আমার মতো দেখতে? আমি তো, আমি তো,,,”
শাওন গম্ভীর কন্ঠে বলে,–“রিলেক্স! এই নেন,পানি খান!”
শাওন পানির গ্লাস টা ওকে এগিয়ে দিলো। রাত্রি একহাত দিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। পানিটুকু খেয়েই শাফিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। অন্য হাত দিয়ে ওর পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।
শাওন রাত্রির দিকে এক পলক তাকালো। পরক্ষণেই সে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। এরপর সে বলে,–” রুহি আমার স্ত্রী। ওর সাথে আমেরিকায় আমার দেখা হয়। সেখানেই প্রেম, আর সেই প্রেম থেকেই বিয়ে। ওর বাবা ছিলো বাংলাদেশি আর ওর মা ছিলো সেখানকার বাসিন্দা। রুহির বাবা ওখানে সেটেল হওয়ার জন্যই তার মাকে বিয়ে করেছিলেন। রুহি বাবার মতো দেখতে হলেও স্বভাব টা পুরো মায়ের মতো ছিলো। ও খুব মিশুক আর ভীষণ হেল্প ফুল ছিলো। আমাকে ট্রেনিং এর সময় অনেক হেল্প করতো সে। ওখানেই আমরা একে অপরের উপর দূর্বল হয়ে পড়ি।
তো আমি আমার বাবাকে ওর কথা বললাম, বাবা তখন পারমিশন দিলেন ওকে বিয়ে করে নিয়ে আসার জন্য। খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় আমাদের, বিয়ের এক বছর না হতেই শাফি হয়ে যায়। কারন এর আগেই আমরা ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়িয়ে ছিলাম।আর এ কারণেই দ্রুত বিয়ে করতে হয় আমাদের। ভালোই চলছিলো আমাদের জীবন। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড় এসে এলোমেলো করে দেয় আমাদের জীবন। সুখে শান্তিতে থাকা ছোট্ট নীড় ধ্বংস হয়ে যায় এক ঝলকেই। আট অক্টোবর
গ্যাস লিক হয়ে বড় ব্লাস্ট হয়ে মারা যায় রুহি।সাথে ওর বাবা-মা ও।”
এটুকু বলতেই শাওনের কথার স্বর আটকে যায়। ওর নিঃশ্বাস খুব অস্বাভাবিক হতে লাগলো। চোখ দুটো চিকচিক করছে, চোখের সামনে সেদিনের সেই ভয়ানক দৃশ্য ভেসে উঠলো। সে কোনেরকম নিজেকে সামলালো।
খানিকটা দম নিয়ে, বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে সে আবারো বলে,– “আমি তখন অফিসে ছিলাম, শাফি ছিলো আর্ট টিচারের বাড়ী। যার ফলে আমরা দুজন শরীরে বেঁচে যাই,কিন্তু মনে নয়। সেদিন হারিয়ে গিয়েছিলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ। বদলে গিয়েছিলো নানান জিনিস। শাফি হয়ে গিয়েছিলো একগুঁয়ে। না কারো সাথে কথা বলে আর না কারো সাথে মিশে। আমার কথা বাদ ই দিলাম। ”
কথাগুলো বলার পর পরিবেশ বেশ খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ রইলো। কেউ কিছু বলছে না। শাওন গম্ভীর হয়ে বসে রইলো, রাত্রির চোখের কোণ দিয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রতন স্যার ও বেশ ইমোশনাল হয়ে গিয়েছেন।
অনেক্ষণ কর শাওন আবারো বলে, –” বাবার কারণে দেশে ফিরে আসলাম আমি। বাবা অনেক দূর্বল হয়ে গিয়েছেন, মা মারা যাওয়ার পর থেকেই তো বাবা একা। তিনি শাফিকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে পড়েছিলেন। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসি। সেদিন স্কুলে আসার পর যখন প্রথম আপনাকে দেখেছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। আপনি তখন নিজের কাজে ব্যস্ত। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আপনার মুখপানে।
আমি কয়েক মিনিট নিজের সাথে হিসেব মিলিয়ে ব্যর্থ হয়ে পড়লাম। এরপর সেদিন ই আমি আপনার সম্পর্কে সম্পূর্ণ খোঁজ নেই। আমার সেক্রেটারি রাফির কাছ থেকে জানতে পারি আপনার বাবা আর রুহির বাবা ভাই ছিলেন। আপনি আর রুহি কাজিন, যার ফলে আপনাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল। এরপর আমি যা করেছিলাম সেটা আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। আমি শাফিকে আপনার কথা বললাম।ওকে বলি যে ওর মায়ের মতো কাউকে আমি দেখেছি। এ কথা শুনে তো ও পাগল হয়ে গিয়েছে। আমাকে পাগল করে দিয়েছিলো আপনার সাথে দেখা করিয়ে দেই। বিনিময়ে আমি ওকে প্রমিস করিয়ে নেই যে আপনাকে যেনো এসব কিছুই না বলে, শুধু যেনো চুপচাপ দেখে। ও রাজি হয়ে যায়। এরপর তো আপনি দেখেছেন ই। আপনি জানেন আপনার খবর জানার পর ও কীভাবে যেনো ভোর ৪টা ৫টায় উঠে যায়। আজ সাড়ে তিনটায় উঠে রেডী হয়ে গিয়েছে আসার জন্য। ওকে অনেক বুঝালাম যে আজ শুক্রবার,কিন্তু ও মানে নি। তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে ডেকে নিয়ে এসেছি।”
শাওন এতটুকু বলেই চুপ করে গেলো। বোতল থেকে হাতে অল্প পানি নিয়ে মুখে ছিটকাঁতে লাগলো। মাথায় ও হালকা পানি দিয়ে দিলো। রাত্রি নির্বাক হয়ে বসে আছে। নিজেকে তার অনুভূতি শূন্য লাগছে। শাফি হালকা নড়ে উঠতেই সে দু হাতে শক্ত জড়িয়ে ধরলো তাকে। তার মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না, এমন অদ্ভুত অনুভূতি কেনো হচ্ছে তার?
চলবে!
[ আপু কাল গল্প দেন নি কেনো? শুধু গল্পের জন্য ১২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। কেনো দেন নি?
উত্তরঃ আপু কাল আমার আর মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ একসাথে ডাউন হয়ে যায়। দুজনেই একসাথে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তাই আজ দু পর্ব একসাথে দিয়ে দিয়েছি তাও অনেক আগে।
**গল্প টা আশা করি এবার বুঝবেন। কেনো শাফি আর শাওনকে এনেছি? গল্প কেমন লাগছে মন্তব্য করে জানালে খুশি হবো।]
চলবে!
[রিচেক করা হয় নি।কমেন্টে কাউকে আঘাতমূলক কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। সে হোক অন্য কেউ বা আমি। সবার ভালো লাগবে এই আশায় তো লিখি না। ভালো না লাগলে কি করি আমরা? যেটা করি সেটা করুন।]