বেটারহাফ পর্ব ৩

#বেটারহাফ
writer: #Nishat_Tasnim_Nishi
#পার্ট_০৩

বৃষ্টি হাসলো,তাচ্ছিল্যের হাসি। সে অনুভব করলো সাগরের এত মারার পরেও সে এত কষ্ট পায় নি যতটা মায়ের বলা কথাগুলোতে পেয়েছে। সাগর তো রক্তাক্ত করেছে তার শরীর আর তার মা তো রক্তাক্ত করেছে তার মনকে। ডাক্তারের দেওয়া ঔষধে তো শরীরের দাগ গুলো চলে যাবে কিন্তু মনের ক্ষতগুলো?সেগুলো কীভাবে যাবে?

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে বৃষ্টি! এত কষ্ট কেনো হচ্ছে? এটা তো তার জীবনের সবে শুরু তাহলে নিশ্চয় পরে এর থেকেও খারাপ কিছু হবে তখন তো আরো কষ্ট হবে। তখন সে কীভাবে এত কষ্ট সহ্য করবে?

বৃষ্টিরর মা আবারো বললেন, –“বৃষ্টি ভুলেও চেষ্টা করো না সব ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার। তুমি দেখেছো তো ,কী কী সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। তোমার চোখের সামনেই তো সব হতো। সেদিন মনে নেই বাড়ীওয়ালা আঙ্কেল আমাকে কী বলেছিলো? কত বাজে প্রস্তাব দিয়েছিলো। তোমার বাবা বেঁচে থাকা স্বত্তেও কত পুরুষের বাজে নজর আর প্রস্তাবের শিকার হয়েছি আমি? ঘরেই নিরাপদ নয় মেয়েরা সেখানে বাহিরে তো আরো খারাপ অবস্থা। দুনিয়া টা এত সহজ নয়, যতটা আমরা ভাবি! জানো,আমারও ইচ্ছা করতো সব ছেড়ে চলে যাওয়ার। পারতাম না শুধু মাত্র তোমাদের জন্য।
তোমার বাবা অসুস্থ হওয়ার পর পরেই তো দেখা দিয়েছিলো সংসারের অভাব অনটন আর সব ঝামেলা। একটা মেয়ে বাহিরে কাজ করে টাকা রোজগার করা কোনো সহজ কাজ নয়।আমি বাহির থেকে রোজকার করে এনে সংসার চালাতাম। তোমাকে সবসময় ঘরের মধ্যে রাখতাম তার কারণ হলো তোমার সৌন্দর্য। কত শকুনের নজর ছিলো তোমার উপর, কত বার বাসা বদলিয়েছি তা তো জানোই!
সেখানে স্বামী ছাড়া এ সমাজে বাস করা কী এতই সহজ? সবাই তোমার দিকেই আঙ্গুল তুলবে। এর বেশি বললাম না, আশা করি বাকিটুকু তুমি বুঝবে!”

বৃষ্টি মাথা নাড়ালো। সে কতটুকু আর কী বুঝলো সেই ভালো জানে। মায়ের কথা বিষের মতো ঠেকছে তার কাছে। চুপচাপ শুনে যাচ্ছে কোনে রিয়েক্ট করছে না! তার মা কী বুঝতেছে না এভাবে আর দুদিন এ সংসারে থাকলে তো সে মরে যাবে!

অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে মা-মেয়ের আলাপনের। হঠাৎ বৃষ্টি ভাবলেশহীন হয়ে বললো,
–“ঠিক আছে আমি সব মেনে নিবো!”

লতা বেগমের মুখ খুশিতে টগবগিয়ে উঠলো মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে। মেয়েকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বললো,–“মা,আমি জানতাম আমার মেয়ে ঠিক বুঝবে। সে কখনোই তার পরিবারের কথা বাদ দিয়ে নিজের স্বার্থ চিন্তা করবে না। ”

তিনি আরো নানান কথা বলতে লাগলেন,বৃষ্টি শুনেও শুনলো না। সে অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছে।

—“বিনিময়ে আমার একটা কথা রাখতে হবে?”

—“একটা কেনো তুই বল আমি কথা দিলাম আমি সব রাখবো!”

বৃষ্টি হাসলো, তার মা এত খুশি হবে সে ভাবেই নি। একবার ও কী তার কথা ভাবলো না? তার মরা বাঁচা মায়ের উপর কোনো ইফেক্ট ই করে না। তবুও সে বললো, –” মা,আমি বুঝেছি যে আমি এমন জায়গায় আছি যেখানে আজ হোক আর কাল হোক আমার মরণ নিশ্চিত। উনারা যে আমাকে বাঁচতে দিবে না তা আমি বুঝে গিয়েছি। তাই আমার অনুরোধ কাল যদি আমি মরেও যাই আমার লাশ ও যেনো তোমার ছায়া না দেখে। জানি তো আমার মরা-বাঁচা তোমার কাছে কিছুই না তাও বললাম!মনে করবে যে আমি মরে গিয়েছি,বৃষ্টি নামে তোমার কোনো মেয়েই ছিলো না।”

বৃষ্টির কথা শুনে লতা বেগমের বুক ধক করে উঠলো! কী বললো তার মেয়ে? সে কীভাবে তার মা কে এত খারাপ ভাবতে পারলো?
আঁচল মুখে দিয়ে কান্না করতে করতে তিনি দৌড়ে বের হয়ে গেলেন।

আর বৃষ্টি অন্যদিকে ফিরে কাঁদতে লাগলো। এমন কেনো হলো তার সাথে? সে তো কত খুশি ছিলো কত বড় ঘরে তার বিয়ে হয়েছিলো।কত ভালো সংসার করছিলো। চোখের পলকেই সব কিছু মিথ্যা হয়ে গেলো!

৫. মাত্রই বাড়ী এসে পৌঁছিয়েছে সাগর। এসেই দৌড়ে গেলো রাত্রির কক্ষে। ভয়ে তার বুক কাঁপছে,মা কিছু করেন নি তো রাত্রির সাথে? মা মেরে ফেললেও মেয়েটা যে এক ফোটা শব্দও করবে না খুব ভালোই জানে। কত বকে সে এমন স্বভাবের জন্য, তবুও সে সব চুপচাপ শুনে।

বাড়ীর কোথাও রাত্রিকে খুঁজে পেলো না সে। সে পাগলের মতো রাত্রিকে ডাকতে লাগলো,কোথাও কোনো সাড়া শব্দ পেলো না। বাধ্য হয়ে তার মা কে ও ডাকলো।তারপরেও কোনো খবর পেলো না। ঘরের প্রতিটা কোণা চেক করলো সে।

হঠাৎ দক্ষিনের রুমের জানালার বাহিরে চোখ পড়তেই সে থমকে গেলো।সে দেখলো রাত্রি বারবার পুকুরে ডুব দিচ্ছে আর উঠছে। পাড়েই দাড়িয়ে আছে তার মা। সে দ্বিগুণ গতিতে দৌড়ে যেতে লাগলো পুকুর পাড়ের দিকে।

.
—“কী হলো চাবি পেয়েছো?”

রাত্রি হাপাতে হাপাতে বললো সে পায় নি। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্বিগুণ গতিতে চলছে। দুবার নাক-মুখে দিয়ে পানিও গিলে ফেলেছে সে।

শাহিনুর বেগম তাড়া দিয়ে বললো–“তাড়াতাড়ি বের করো!”

রাত্রি আবার ডুব দিলো পুকুরে। হাত-পা দুটো দিয়েই চাবি খুঁজছে সে। তার খুব কান্না আসছে, সে ভালো করেই জানে এখানে চাবি হারিয়ে যায় নি। তার শাশুড়ি ইচ্ছে করেই হয়তো ফেলে দিয়েছেন। সাগরের শাস্তি ই তাকে দিচ্ছেন তিনি।

সাগরকে দৌড়ে আসতে দেখে শাহিনুর বেগম হাসলেন। তিনি ভাবমূর্তি এমন করলেন যেনো সত্যিই উনার কিছু হারিয়েছে। সাগর এসেই বললো,–” মা, কী হয়েছে রাত্রি পানিতে বারবার ডুব দিচ্ছে কেনো?”

শাহিনুর বেগম বললেন,–” আমার চাবির গুচ্ছ হারিয়ে গিয়েছে পানিতে। ও সেটা খুঁজে দিচ্ছে, আমি কতবার বারণ করেছি তবুও সে শুনলো না। নেমে গিয়েছে পানিতে। ”

সাগর মায়ের দিকে তাকালো, সে বুঝতে পারছে তার মা মিথ্যা বলছে। তার শাস্তি যে রাত্রিকে দিচ্ছে সে বুঝতে পারছে।

(বিদ্র: পানিতে চাবির ঘটনা টি আমার খুব কাছের আত্নীয়ের সাথে ঘটেছে।উনার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক!)

রাত্রিকে ধমকে পানি থেকে তুললো সাগর। চেঞ্জ করার জন্য বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলো।এরপর নিজেই খুঁজতে লাগলো চাবি, ইচ্ছা করেই সে নাকমুখ চুবিয়ে পানি খেতে লাগলো। খুক খুক করে বারবার কাশতে লাগলো। সাগরের অবস্থা দেখে শাহিনুর বেগম হকচকিয়ে গেলেন। তিনি বারবার বলতে লাগলেন তাকে উঠে আসার জন্য, সাগরের হেলদোল না দেখে নিচের সিড়িতে নেমে গেলেন তিনি।

ছেলেকে পানি থেকে তুলার জন্য তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। সাগর উঠছে না দেখে নিজেই নেমে গেলেন পানিতে। সাগরকে বারবার বলেও উঠাতে পারলেন না তিনি, সে বলেছে চাবি না পাওয়া পর্যন্ত সে উঠবে না। কথাটা শুনে শাহিনুর বেগম নিজেও চাবি খুঁজতে লাগলেন।আশ্চর্যের বিষয় তিনি একবারেই চাবি পেয়ে গেলেন। সেটা দেখে সাগর হাসলো, সে স্পষ্ট দেখেছে তার মা আঁচলের দিক থেকে চাবি বের করেছিলো।

৬. সাগর রুমে এসেই দেখলো রাত্রি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঠান্ডায় তার শরীর কাপছে। রাত্রির হাত-পা সব বরফের ন্যায় ঠান্ডা। প্রচন্ড পরিমাণ শীত করছে রাত্রির। কাঁপছে আর কাঁদছে সে। চোখ দুটো হলুদ হয়ে আছে। মিনিট খানিকের মধ্যেই শরীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে লাগলো তার শরীরে।
সে চুপচাপ রাত্রিকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। রাত্রির শরীরে আরেকটা কম্বল দিয়ে সে বের হয়ে গেলো মায়ের রুমের উদ্দেশ্যে।

কিছুক্ষণ আগে শাহিনুর বেগম হসপিটাল থেকে ফোন দিয়ে জেনে নিয়েছেন বৃষ্টির খবর।
ফোন টা টেবিলে রাখতেই দরজায় কড়া নাড়ে সাগর। তিনি ইশারায় আসতে বললেন তাকে।

রুমে এসেই সে প্রশ্ন করলো,–” মা আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন আপনি রাত্রির সাথে এক চুল পরিমাণ দুর্ব্যবহার করবেন না।তাহলে আজ কেনো রাত্রির সাথে এমন করলেন। মিথ্যা বলবেন না আমি নিজে সব দেখেছি।”

সাগর খুব রেগে আছে। শাহিনুর বেগম প্রথমে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।

এরপর তিনি অত্যন্ত রাগী কন্ঠে বললেন,–“আর তুমি কী করছো?”

সাগর জবাব দিলো না। আগের মতোই বসে রইলো।

–“কি হলে জবাব দিচ্ছো না কেনো? আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিলো সেটা ভুলে গেছো?”

সাগর মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো “না সে ভুলে নি।”

—“তাহলে আজ বৃষ্টির সাথে এমন কেনো করেছো? আর বৃষ্টির সাথে তোমার কেনো বিয়ে দিয়েছি সেটা কী ভুলে গেছো?কথা কে বরখেলাপ করছে আমি না তুমি?”

গম্ভীর কন্ঠে বললো,—” আমি ভুলি নি কিছু, আমার কিছু সময় প্রয়োজন। আর আমার সকাল মেজাজ ঠিক ছিলো না।”

–“আর কত সময় প্রয়োজন?আর কী এমন হয়েছিলো যে তোমার মেজাজ ঠিক ছিলো না?”

সাগর চুপ করে গেলো। সে কীভাবে বলবে যে সকালে কী হয়েছিলে তার সাথে। কত বড় ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিলো।

ফ্ল্যাশব্যাক
সকালবেলা রাত্রির রুমের পাশ দিয়ে নিচে যাচ্ছিলো সাগর। কান্নার আওয়াজ পেয়ে রুমে উঁকি মারতেই দেখেছিলো রাত্রি ব্লেড দিয়ে হাত কাটছে।সে এক টান দিয়েও দিয়েছিলো। দৃশ্য টা দেখে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। দ্রুত গিয়ে রাত্রিকে আটকালো। রাত্রি পাগলামি করছিলো, সে বারবার বলছিলো তাকে ছেড়ে দিতে। রাত্রির সাথে না পেরে সাগর তাকে এক চড় মেরে বসিয়ে দিলো।

রাত্রি রেগে বললো,–“ছুঁবেন না আমাকে। আমি তো আপনার বোন তাহলে আমাকে কেনো স্পর্শ করছেন?”

সাগর অবাক হয়ে বললো,–” বোন মানে?”

রাত্রি চুপ করে গেলো। সে জানে সাগর জানে না তাকে যে তাকে(রাত্রিকে) বোন বলে বৃষ্টির কাছে পরিচয় করানো হয়েছে। শাশুড়ি মা তাকে বলেছে যে সাগরকে জেনো এসব জানানো না হয় তাই সে চুপ করে গেলো। এরপর সাগরের পিড়াপীড়িতে সব বললো। সব শুনে তো সাগর রেগে যায় ভয়ানক রেগে যায়। তারউপর আবার বৃষ্টি তাকে আর রাত্রিকে উল্টাপাল্টা কথা বলছিলো তাই সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওমন কিছু করে বসেছে। সে অনুতপ্ত তার ব্যবহারের প্রতি আর এজন্য সে মনেমনে ঠিক করেছে অবশ্যই সে ক্ষমা চাইবে বৃষ্টির কাছে। বিনিময়ে বৃষ্টি যদি শাস্তিও দিতে চায় সে মেনে নিবে।

.
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here