বেদনার রঙ নীল পর্ব -০৪

#বেদনার_রঙ_নীল
চতুর্থ পর্ব
লিখা- Sidratul Muntaz

হেলাল সাহেব বাড়িতে আসার পর থেকেই পেছনে হাত গুটিয়ে ক্রমাগত পায়চারী করে যাচ্ছিলেন। চেয়ারম্যান সাহেব বলে দিয়েছেন, তুলি যদি কেইস না তুলে তাহলে তিনি হেলাল সাহেবের দোকান তুলে দিবেন, একঘরে করে রাখবেন এমনকি গ্রাম থেকেও বের করে দিতে পারেন। তিনি ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন।

তুলির প্রতি একগাদা রাগ আর মনে অস্থিরতা নিয়ে হেলাল সাহেব ভাবছেন, কি করবেন তিনি? বিয়ের আসর থেকে মেয়ে পালিয়ে যাওয়া একজন বাবার জন্য যেমন অসম্মানজনক, বাবাহীন মেয়ের মামার জন্য তার চেয়েও বেশি অসম্মানজনক। তার উপর মেয়ে যদি প্রেমিক নিয়ে মামার বিরুদ্ধে মামলা করে তাহলে সেটা আরও বিপজ্জনক। নিজের মেয়ে হলে তিনি না হয় সহ্য করতেন। কিন্তু তুলি তো তার মেয়েও না। প্রচন্ড রাগে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন তিনি। মাঝে মাঝে বুকে ভীষণ চাপ অনুভব করছেন। স্ত্রী রোকেয়া খাতুন এই পর্যন্ত পাঁচবার মাথায় পানি দিয়েছেন। এখন আবারও গেছেন পানি বদলে আনতে। এর মধ্যেই তিনি উঠে আবারও পায়চারি শুরু করেছেন। মনে হচ্ছে এখনই মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। কিন্তু তবুও শান্ত হয়ে বসতে নারাজ।

রোকেয়া পানির বালতি হাতে ভিতরে ঢুকল। স্বামীকে পায়চারী করতে দেখে চোখ তার কপালে উঠে গেল। তুমুল গতিতে হাতের বালতি টেবিলে রেখেই হেলাল সাহেবকে শক্ত করে ধরল সে। অস্থির হয়ে বলতে লাগল,” তুমি আবার উঠতে গেলে কেনো?শরীরের এই অবস্থায় কেউ এইভাবে হাঁটাহাঁটি করে? তোমাকে না শুয়ে থাকতে বললাম!”

হেলাল ঝারি মেরে স্ত্রীকে সরিয়ে দিলেন। কয়েকবার বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,” রাখো তোমার শুয়াশুয়ি। টেনশনে আমার মাথা কাজ করছে না। আর তুমি বলছো শান্ত হয়ে শুয়ে থাকতে? সেই অবস্থা কি রেখেছে তোমার আদরের মেয়ে?”

রোকেয়া মুখ কুচকে বললেন,” আচ্ছা এরকম করলে কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? তুমি এইভাবে নিজের প্রেশার টা বাড়িও না। পরে দেখা যাবে তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি কর‍তে হবে। বিপদের উপর আরও বিপদ।”

হেলাল কোনো উত্তর দিলেন না। বুকে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। নিচের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। রোকেয়াও বিছানা ধরে মাটিতে বসল। স্বামীর হাত-পা মালিশ করে দিতে লাগল।

” আচ্ছা, তুলির সাথে আমি কথা বলবো। ও কেইস তুলবে। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। আমার কথা তুলি কখনও ফেলেনি।”

” আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারব না যতক্ষন পর্যন্ত না মেয়েটা বাসায় ঢুকছে। ওর ঠ্যাং ভেঙে গুঁড়ো করে তারপর সামিরের সাথে বিয়ে দিবো আমি। এর আগে আমার শান্তি নেই। বড্ড বাড় বেড়েছে মেয়ের।”

রোকেয়া হতবাক হয়ে বললেন,” এখনও সামিরের সাথে বিয়ে দিতে চাও? মামলা খেয়েও কি আঁশ মেটেনি তোমার?”

হেলাল গরম গলায় বললেন,” দেখো, তুমি এসব নিয়ে একদম কথা বলবে না৷ এই বিয়ে না হলে চেয়ারম্যান সাহেবকে আমি মুখ দেখাতে পারব না। সারাজীবনের জন্য সম্পর্ক নষ্ট হবে। আর তিনি কি আমায় ছেড়ে দিবে ভেবেছো? তাছাড়া তন্বি আছে৷ তার যদি কোনো ক্ষতি করে?”

” ঠিকই আছে। ক্ষমতাশীল মানুষদের সঙ্গে এজন্যই আত্মীয়তা করতে নিষেধ করেছিলাম৷ তুমি তো লোভে পড়ে গেছিলে। মেয়েটাকে একদম হাত-পা বেঁধে বিয়ে দিতে নিচ্ছিলে। এখন হয়েছে না? আমও গেল ছালাও গেল!”

” সব ওই কলেজের দোষ। তোমাকে পই পই করে বারণ করেছিলাম ঢাকায় পড়তে পাঠিও না ওদের। মেয়ে মানুষ বিগড়ে যাবে। এবার হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছো? মুখে চুন কালি মেখে ভেগে গেল পর পুরুষের সাথে। ”

” তন্বিও তো ঢাকায় পড়তে গিয়েছিল। সে তো বিগড়ে যায়নি!”

” রক্ত বলে একটা ব্যাপার আছে না? আমার রক্ত এতো খারাপ না।”

তন্বি লেবুর শরবত হাতে ভেতরে ঢুকল। মা-বাবার ঝগড়া দেখে কিছু না বলে নিঃশব্দে শরবতের গ্লাস টা টেবিলে রেখে বেরিয়ে যেতে চাইল। এমন সময় কঠিন গলায় হেলাল ডেকে উঠলেন, ” এই তন্বি।”

তন্বি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে খানিকটা এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলল,” কি?”

” কোনোরকম ভণিতা না করে আসল ঘটনা বল। তুলি কোথায় গেছে ওই ছেলের সাথে? ওরা কি বিয়ে করবে?”

” আমি কি করে জানব বাবা? তুলি কি যাওয়ার সময় আমার কানে কানে এসে বলে গিয়েছিল যে, তন্বি আমি পালিয়ে অমুক জায়গায় যাচ্ছি। তুই পারলে মামাকে জানিয়ে দিস!”

হেলাল সাহেব অতিরিক্ত রাগ নিয়ে বললেন,” কথার সোজাসুজি উত্তর দে। বেয়াদবের মতো করবি না। একদম থাপ্পড় মে-রে..”

হেলাল সাহেব উঠতে নিলেই রোকেয়া তড়িঘড়ি করে ধরলেন,” দোহাই লাগে। থামো দয়া করে। এই তন্বি, দেখছিস না বাবা রেগে আছে? তুই ফাজলামি করছিস কেন? যা এখান থেকে!”

তন্বি দরজার কাছে যেতে যেতে শক্ত গলায় বলল,
” ফাজলামো টা বাবাই শুরু করেছে মা। সামির ভাইয়ের সাথে তুলির বিয়ের কথা চিন্তা করাই একটা বড় ফাজলামো।”

হেলাল সাহেব আরও চটলেন। চোখ বড় করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,” সামিরের থেকে ভালো ছেলে এই গ্রামে আর একটাও খুঁজে বের কর‍তে পারবি তুই? ওই অনাথ মেয়ের জন্য সামির তো সোনার হরিণ!”

তন্বি বাঁকা হেসে বলল,” উল্টো বলেছো বাবা। সামির ভাইয়ের জন্য তুলি সোনার হরিণ।”

রোকেয়া কঠিন চোখে তন্বির দিকে তাকালেন,” তন্বি, তুই এখান থেকে যা। একজন পালিয়ে গেছে আরেকজন ওর হয়ে সাফাই গাইছে! তোদর মতো মেয়েকে এতোদিন আদর-যত্নে বড় করেছি কি এইদিন দেখার জন্য? যখন যা চেয়েছিস তাই এনে দিয়েছি। আর আজকে তোরা আমাদের…”

” একই কথা আমিও বলতে পারি মা। তুলি এতো কষ্ট করে ভালো কলেজে পড়ে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছে কি এই দিন দেখার জন্য? ভার্সিটির চৌকাঠ পেরোনোর আগেই তার এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যাবে যে কি-না তিনবার ম্যাট্রিক ফেল করে ঘরে বসে আছে!”

হেলাল গর্জন করে বলে উঠলেন,” রাখ তোর ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট!যে রেজাল্টের বড়াই করে মেয়ে পরিবারের মুখে চুনকালি মেখে পালিয়ে যায়, সেই রেজাল্টের দরকার নেই আমার। তোকেও আর লেখাপড়া করতে হবে না৷ ঘরে বসে আদব-কায়দা শিখবি এখন থেকে। ”

তন্বি গজগজ করে বলল,” যে পরিবার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উঠে-পরে লাগে, সেই পরিবারের মুখে চুনকালি তো পড়বেই বাবা। ”

হেলাল উঠে দাঁড়ালেন এবং পানির বালতি লাথি মেরে ফেলে দিলেন। পুরো ঘর পানিতে ভেসে যেতে লাগল৷ তন্বি দরজা ভিড়িয়ে বাইরে চলে এলো।

খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে উঠানের দিকে গেল সে। কোথায় গিয়ে বসলে মেজাজটা ঠান্ডা হবে সেটাও বুঝতে পারছে না। হঠাৎ সামনে সামিরকে দেখতে পেল। ঘরের দরজা আধখোলা। সেই ঘরে বসে আছে সামির। ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। তার চোখেমুখে খুব অস্থির একটা ভাব। তন্বি জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। বিয়ের সাধ এখনও মেটেনি লোকটার। এতোকিছু হয়ে গেল অথচ সে এখনও বাড়ি যায়নি।

সামির তন্বিকে দেখতে পেয়েই ফোনের লাইনে থাকা মানুষটিকে বলল,” আচ্ছা এখন রাখছি। আর কোনো খোঁজ পেলে আমাকে জানাবেন। ”

তারপর ফোনটা সে পকেটে রেখে তন্বিকে উদ্দেশ্য করে বলল,”কিছু বলবে?”

” কার সাথে কথা বলছিলেন সামির ভাই?”

সামির তন্বির প্রশ্নের উত্তর দিল না। বরং তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, তুলি কি ওই ছেলেটিকে ভালোবাসে? তারা কি বিয়ে করবে?”

সামিরের চোখে তীব্র অসহায়ত্ব। বেচারার জন্য মায়াই লাগছে তন্বির। কবুল বলার আগেই বেচারার বউ পালিয়ে গেল। কত শখ করে বউয়ের জন্য আলমারি সাজিয়েছিল। রং-বেরং এর ফুল নিজে বাছাই করে কিনেছিল বাসর সাজানোর জন্য। স্বর্ণের পায়েল কিনে এনেছিল বাসর রাতের উপহার হিসেবে। কিন্তু সেই শখের বাসর পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই বউ হাওয়া!এই কষ্ট কোথায় রাখবে বেচারা?

তন্বি শ্রান্ত গলায় বলল,” আপনি চিন্তা করবেন না সামির ভাই। তুলি কারো সাথে প্রেম করে না। সে লেখাপড়া করতে চায়। এজন্যই পালিয়ে গেছে। যেদিন ওর লেখাপড়া শেষ হবে, সেদিন দেখবেন আপনার কাছেই ফিরে আসবে।”

সামির সরল মনে কথাটা বিশ্বাস করল। খুশি মাখা কণ্ঠে বলল,” সত্যি বলছো?”

” জ্বী সামির ভাই।”

” কিন্তু ওর লেখাপড়া কবে শেষ হবে? মানে আমাকে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?”

তন্বি মৃদু হেসে বলল,” খুব বেশি না। তেরোতম মাসের বত্রিশতম তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। তুলি ফিরে আসবে।”

এই কথা বলে তন্বি চলে গেল। সামির ক্যালেন্ডারের কাছে গেল। সে তেরোতম মাসের বত্রিশতম তারিখটা চিহ্নিত করে রাখতে চায়।

দু’জন কনস্টেবল আর একজন জুনিয়র অফিসার প্রণয়-তুলিকে গাড়িতে করে ঢাকায় পৌঁছে দিচ্ছেন। মাইক্রোর পেছনের আসনে প্রণয় আর তুলি বসেছে। সামনে ড্রাইভার, অফিসার আর কন্সটেবলস। তুলি আর প্রণয় পুরো গোটা পথটা গল্প করেই কাটাল। তবে প্রণয় নিজের সম্পর্কে খুব কম বলল। সে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ডিপার্টমেন্ট সিএসসি। তার একটা বড়বোন আর ছোটভাই আছে। এর বেশি কিছু প্রণয় বলল না। আর তুলি নিজের ছোটবেলার ঘটনা থেকে শুরু করে সবকিছু বলতে লাগল,

” জানেন, তন্বি আমার মামাতো বোন। ছোটবেলায় আমার মামা খুব ভালো ছিলেন। তন্বি আর আমাকে কখনও আলাদা মনে করেননি। বাবা-মাকে তো আমি কখনও দেখিনি। মামা-মামীই ছিল আমার সব। কিন্তু তারা যে এভাবে বিট্রে করবে…. আচ্ছা এসব দুঃখের কথা ছাড়ুন৷ আপনাকে আমি সুখের কথা বলি। এখন আমি যার বাড়িতে যাচ্ছি সে আমার বেস্টফ্রেন্ড রাইফা। শুধু আমার না, সে কিন্তু তন্বিরও বেস্টফ্রেন্ড। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পর আমরা ঢাকার কলেজে এপ্লাই করেছিলাম। আমার ভিকারুননিসায় পড়ার খুব শখ। আর আমার যে নাম্বার, তাতে শিউর চান্স হয়ে যেতো। কিন্তু তন্বির রেজাল্ট খুব একটা ভালো ছিল না। সে ভিকারুননিসায় চান্স পেতো না। এখন সে যদি ঢাকায় না যায় তাহলে তো আমারও যাওয়া হবে না। এই ভেবে খুব মনখারাপ হচ্ছিল আমার। তখন তন্বি কি করল জানেন? সে সাইন্স বাদ দিয়ে আর্সের জন্য এপ্লাই করল। ব্যস, দু’জনেই চান্স পেয়ে গেলাম৷ তারপর আমরা ঢাকায় হোস্টেলে থাকা শুরু করেছি৷ রাইফার সাথে এভাবেই পরিচয়। সে আমাদের লাইফে না এলে জীবনের মজা অর্ধেক মিস করে ফেলতাম। সে যে কত্ত চমৎকার একটা মেয়ে আপনি জানেন না। আই জাস্ট লভ হার।”

প্রণয় মনোযোগ দিয়ে সব শুনছিল। যদিও কথাগুলো এতো আগ্রহপূর্ণ না। কিন্তু তুলি খুব সুন্দর করে বলছিল। হঠাৎ সে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,” আচ্ছা একটা প্রশ্ন করব?”

” কি?”

” ওসি সাহেব কি আপনার পূর্ব পরিচিত? মানে তিনি আপনার কেইসটা যেভাবে নিলেন তাতে মনে হলো তিনি আপনার পূর্ব পরিচিত!”

প্রণয় হেসে উঠে বলল,” আসলে তিনি আমার বাবার বন্ধু হোন।”

তুলি বেশ অবাক হয়ে বলল,” ও তাই? এজন্যই তো আমি বলি। ওসি সাহেব কিন্তু খুব ভালোমানুষ তাই না?”

” হুম।” প্রণয় সম্মতি প্রকাশ করল। যদিও সে তুলিকে মিথ্যা বলেছে। ওসি সাহেব প্রণয়ের বাবার বন্ধু না।

ভোরের দিকে চোখ লেগে এলো তুলির। চোখের ঘুম নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কখন যেন গাড়িতে মাথা ঠেঁকিয়ে ঘুমিয়ে গেল সে! কিন্তু গাড়ি অনেক ঝাঁকি খাচ্ছিল। তুলিও বসেছে জানালার পাশে। যেকোনো মুহূর্তে মাথায় বারি খেতে পারে। তাই প্রণয় আলগোছে তুলির মাথা নিজের কাঁধে নিল। তুলির লম্বা চুলের ঝাপটা বার-বার প্রণয়ের চোখেমুখে এসে লাগলেও ধৈর্য্য ধরে সরিয়ে নিল সে। মেয়েটার চুলের খুব অন্যরকম সুবাস। ব্যাপারটা কি প্রণয়কে টানছিল? সে পুরো রাস্তা ঘুমন্ত তুলির মাথা কাঁধে নিয়েই বসে ছিল। মাঝে মাঝে তুলির চোখ থেকে চুলগুলো সরিয়েও দিচ্ছিল। যেন তার ঘুমে ব্যঘাত না ঘটে। তুলি হয়তো ঘুমের মাঝে এসব টের পাচ্ছে না। আহারে, ঘুমন্ত এই মেয়েটি কখনও জানবে না তাকে প্রায় চারঘণ্টার সম্পূর্ণ পথে কেউ খুব যত্নে আগলে রেখেছিল!

ধীরে ধীরে চলে এলো বিদায়বেলা। সকাল সাতটা বেজে বারো মিনিট তখন। রাইফাদের বাড়ির মেইন গেইটের সামনে গাড়ি থামাতে বলল প্রণয়। একুশ নম্বর বাড়ির গোলাপী রঙের গেইট। গেইটের পাশে কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। সবকিছুই বর্ণনার সাথে মিলে গেছে। প্রণয় বিশ্বাস করতে পারছে না, এতোবড় কাকতালীয় ব্যাপার কিভাবে ঘটল? কারণ পাশের গলিতেই তার নিজের বাড়ি৷ এই কথা অবশ্য তুলিকে জানানো হয়নি।

” মিস তুলনা, ওয়েইক আপ। আমরা চলে এসেছি।”

প্রণয়ের ধাক্কায় ঘুমের জগৎ ছিন্ন করে জেগে উঠলো তুলি। প্রণয়ের কাঁধ থেকে মাথা উঠিয়ে চোখ পিটপিট করে দেখতে লাগল আশপাশ টা। এলোমেলো চুলগুলো গোছাতে গোছাতে প্রণয়ের দিকে ভ্রু কুচকে একবার তাকাল। প্রণয় বলল,” এটাই আপনার ফ্রেন্ডের বাড়ি। তাই না?”

তুলি বাইরে তাকাল। তার ঠোঁটে ফুটল বিশ্বজয়ের হাসি। সেই হাসি প্রথমবার খুব সুন্দর লাগল প্রণয়ের। যেন ভেতরটা শান্তিতে ভরে গেল।তুলি তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামল। প্রণয়ও তুলির সাথে নামল। দরজাটা বন্ধ করে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে।
তুলি গেইটের সামনে গিয়ে পুরো বাড়িটা একনজর দেখে নিয়ে আবার প্রণয়ের কাছে ফিরে এলো। চোখমুখ উজ্জ্বল করে খুব আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য ছাড়া কখনোই এতোদূর আসতে পারতাম না আমি। আপনি অনেক উপকার করেছেন। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”

এইভাবে ধন্যবাদ দেওয়ার ব্যাপারটা প্রণয়ের ভালো লাগল না। তার মনে পড়ে গেল, তুলি একটা অচেনা-অজানা মেয়ে। তার সাথে প্রণয়ের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ এতোক্ষণ প্রণয়ের মনে হচ্ছিল তুলি তার একান্ত কেউ যাকে দেখে-শুনে রাখাটাই প্রণয়ের ব্যক্তিগত দায়িত্ব!

প্রণয় প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিতে বলল,” আচ্ছা, আপনার বান্ধবি কি নিচে আসবে? নাকি আপনিই যাবেন?”

“ও নিশ্চয়ই এখন ঘুমাচ্ছে। কষ্ট করে নিচে আনাবো না ওকে। আমিই যাবো।”

প্রণয় পকেটে হাত গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,” ওকে! তাহলে এবার আমার যাওয়ার পালা।”

কথাটা শুনে মুখ গোমরা হয়ে গেল তুলির। কিছু একটা ভেবে বলে উঠল,” আমার নিজের বাসা হলে আপনাকে কফি অফার করতাম। কিন্তু ফ্রেন্ডের বাসা তাই….”

প্রণয় হেসে দিয়ে বলল, ” নো ইটস ওকে। আমার এমনিতেও খুব দেরি হয়ে গেছে। সো, বাই।”

প্রণয় হাত নাড়ল। তুলিও হাত নেড়ে বিদায় জানাল। প্রণয় গাড়িতে উঠে বসা পর্যন্ত সে তাকিয়েই থাকল। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই গাড়িটা চলে গেল তার দৃষ্টির আড়ালে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেইটের ভেতরে ঢুকে পড়ল তুলি।

রাইফা দরজা খুলে তুলিকে দেখেই জোরে একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেল। তুলি খানিকটা চমকাল। কারণ সে তখনও প্রণয়ের ব্যাপারেই চিন্তা করছিল। একটা আচ্ছন্নে ডুবে ছিল। হঠাৎ রাইফা দরজা খুলে শব্দ করায় তার ঘোর কেটেছে।

রাইফা হাসি থামিয়ে তুলির হাত ধরে টেনে বলল,” ভেতরে আয়। আম্মু ঘুমিয়ে আছে এখনও। জলদি জামা-কাপড় চেঞ্জ করে ফেল। নাহলে তোকে এইভাবে দেখলে আম্মু বুঝে যাবে তুই বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছিস। এটা কিন্তু আম্মুকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।”

তুলি বিরস কণ্ঠে বলল,” আমার সাথে কি কি হয়েছে জানিস রাফু?”

” সব শুনবো। অর্ধেক তন্বির থেকে শুনে নিয়েছি।বাকি কথা তুই বলবি।”

” তন্বি তোকে কখন ফোন করেছিল?”

” ভোররাতে। তোর মামার নাকি অবস্থা ভালো না। প্রেশার টেশার ফল করে বেহুশ হয়ে গেছিল। মাথায় পানি ঢালা হয়েছে। আচ্ছা, আগে তুই ফ্রেশ হো। তারপর ব্রেকফাস্ট করতে করতে সব বলবো।”

তুলি গোসল শেষ করে আয়নায় দাঁড়ালো৷ চুল মুছতে মুছতে সে বাথরুমে বসে যে কথা ভাবছিল৷ এখনও সেই কথা ভাবতে লাগল। ছেলেটার নাম ছাড়া আর কিছুই জানে না সে। আবার কি কখনও দেখা হবে তাদের? এতোবড় শহর, এতো এতো মানুষ। শুধু নাম দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যদি কখনও তুলির প্রয়োজন হয় তাহলে সে প্রণয়কে কিভাবে খুঁজে পাবে? এই কথা চিন্তা করে তুলির মনটা অকারণেই খুব অস্থির হয়ে উঠল। একটা সম্পূর্ণ অচেনা ছেলের জন্য এমন অস্থির হওয়া কি মানায়?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here