#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৮|
উচ্ছ্বাসের বাড়ি থেকে কুসুমের যাবার সময় হয়ে এসেছে। রাত হুহু করে বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা ঘুরে নয়টায় এসে থেমেছে। কুসুমের মা এই নিয়ে অনেকবার কল করেছেন। কুসুম এখনো ফিরছে না কেন? মেয়ে আদরের কি না। খানিক চোখ ছাড়া হলেই, দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কুসুমের খালা বোনের এই চিন্তা যেন পাত্তাই দিলেন না। বরং বললেন,
‘ কুসুম কি শুধু তোর মেয়ে, সাহেদা? আমার কিছু না? মনে রাখবি, তোর মেয়ে আমার হাতে বড় হয়েছে। তুই মেয়েকে আমার কাছে রেখে স্কুলে মাস্টারি করতে চলে যেতি। কুসুমকে খাওয়া থেকে শুরু করে ডায়পার অব্দি আমি বদলে দিয়েছি। এখন কুসুমের জীবনে আমার অবদানের কথা ভুলবি, তো আমার সাথে তোর কথা শেষ! ‘
সাহেদা এবার খানিক নিভেন। লম্বা করে বুকে শ্বাস টেনে নিয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন,
‘ আপা, রাগছ কেন? মেয়ে এই প্রথম বাড়ির বাইরে গেছে। মন তো একটু টানবেই। কখন আসবে, একটু জেনে রাখলে শান্তি পাব। ওকে ছাড়া খালি খালি লাগছে ঘর, আপা। ‘
কুসুমের খালা পারুল বোধহয় আজ একটু বেশি উড়ে বেড়াচ্ছেন। তার কারণও আছে বৈকি। কুসুমকে ছেলের বউ করে ঘরে আনবেন তার জন্যেই বোনের কাছে এতদিন তেল মালিশ বিক্রি করেছেন। এটা সেটা বলে বোনকে খুশি করার চেষ্টাও করা হয়েছে অনেক। কিন্তু এখন তো কুসুমকে তিনি নিজের বাড়ির সদস্য করে নিয়েছেন। এখন আর বোনকে পাত্তা দেবার প্রয়োজন বোধ করছেন না। বোনের কাছে এতদিন ভিজে বেড়াল হয়ে থাকলেও, এখন হয়ে গেছেন বাঘ। কুসুমকে পেয়ে তিনি চোখে আর কাউকে দেখছেন না। বোনকে তো একেবারেই নয়। অনেক জ্বালাতন করেছে সাহেদা তাকে। কুসুমকে বিয়ে দেবে না দেবে না করে সারাক্ষণ ঝগড়া করেছে তার সঙ্গে। এখন তিনি বোনকে বুঝাবেন ঝগড়া কাকে বলে!
পারুল কথা বললেন। বেশ ভাব নিয়ে দেমাগ দেখিয়ে,
‘ আসবে, আসবে। উচ্ছ্বাস আজ লাগেজ টাগেজ নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। সেখান থেকে সোজা বিদেশ। যাবার আগে তোর মেয়ে তোর ঘরে রেখে যাবে। এবার আর আমার মাথা খাস না। ফোন রাখ। আর ফোন দিবি না। তোর মেয়েকে আমরা মা-ছেলে মিলে খেয়ে ফেলছি না। ‘
সাহেদা বোনের কথা শুনে বেশ বুঝতে পারছেন, পারুল আপা তাকে জব্দ করতে চাইছে। করুক। তিনিও দেখতে চান, বোন আর কি কি করতে পারে। সাহেদা ফোন কাটার আগেই পারুল ফোন কেটে দিলেন। সাহেদা কি করবেন আর। অগ্যতা ফোন হাতে নিয়েই থম হয়ে রইলেন।
______________________
পারুল উচ্ছ্বাসের লাগেজ তৈরি করছেন। ছেলে সেই যে খেয়েদেয়ে বের হয়েছে, আর ঘরে আসেনি। হতচ্ছাড়া হয়েছে। কাল যাবার কথা ছিল। সেখানে আজ চলে যাচ্ছে। একদিন ছেলের কাছে সময় চেয়েছিলেন। সেটাও মিলেনি। পিঠে দুই ঘা দিতে পারলে শান্তি লাগত। কিন্তু বড় হয়েছে ছেলে। এখন বললেই তো আর ছোটবেলার ন্যায় উদোম করে পিঠে পরপর কিল বসাতে পারেন না। আর না পারেন ধরে বাসায় বেধে রাখতে। পারুল লাগেজে একে একে উচ্ছ্বাসের প্রয়োজনীয় কাপড় ঢুকাচ্ছেন। কুসুম পাশেই বসে আছে। পারুল আলমারি থেকে কাপড় বের করছেন আর উচ্ছ্বাসের নামে কুসুমের কানে এত এত অভিযোগ ঢেলে দিচ্ছেন। কুসুম বোকার মত মায়ের মুখে ছেলের অভিযোগ শুনেই যাচ্ছে। মৃদু হাসছে বারবার। পারুল বললেন,
‘ দেখ তো কুসুম, এই ম্যারুন রঙের শার্ট দেব ভরে? উচ্ছ্বাসের জন্যে নতুন কিনেছি কাল। পছন্দ হবে কি না বুঝতে পারছি না। পছন্দ না হলে পরবেও না। অযথা শার্ট ফেলে রাখবে আলমারির কোণায়। কি বলিস তুই, এটা কি লাগেজে ভরব? ‘
কুসুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল শার্টটি। ম্যারুণ রঙের শার্টটা বেশ সুন্দর, চোখে পরার মত। কুসুম বলল,
‘ দিয়ে দাও। সুন্দর কিন্তু শার্টটা। ‘
পারুল এ কথা শুনে একদম গদগদ হয়ে গেলেন। চোখে হেসে শার্ট ভাঁজ করে লাগেজে ভরে দিলেন। কুসুমকে বলেন,
‘ এদিকে আয় তো। তুই নিজে দেখে দেখে শার্ট প্যান্ট লাগেজে ঢুকা। আমি আসছি একটু। চুলোয় পায়েস চড়িয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সন্ধ্যার নাস্তায় দেব। হতচ্ছাড়া ছেলে, এলোই না এখনো ঘরে? তুই দেখ না মা এদিকটা। আমি রান্নাঘর থেকে ঘুরে আসছি। ‘
কুসুমকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পারুল বেরিয়ে গেলেন উচ্ছ্বাসের ঘর থেকে। কুসুম পরল মহা ফ্যাসাদে। সে কি ছেলেদের কাপড় চোপড় ভালো করে চেনে? তার পছন্দ করা কাপড় উচ্ছ্বাসের পছন্দ না হলে? পরবে না একটাও। কুসুম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল খালার আসার জন্যে। কিন্তু খালামনি এলেন না। অগ্যতা কুসুম আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। আলমারি ভর্তি এত্ত এত্ত কাপড় দেখে কুসুমের টাশকি খাবার জোগাড়। ছেলে মানুষ হয়ে এত কাপড় পরেন? কুসুম মেয়ে হয়েও তার এত কাপড় চোপড় নেই। কুসুম আলমারি বেছে বেছে শার্ট প্যান্ট আর টিশার্ট বের করল। কয়েকটা জ্যাকেট আর শীতের কাপড়ও লাগেজে ভরল। আলমারির এক কোণায় একটা ব্যাগ রাখা। কাপড়ের দোকান থেকে আনা হয়েছে। বোধহয় উচ্ছ্বাস ভাই কিনে এনেছেন বিদেশ নিয়ে যাবার জন্য। কুসুম ব্যাগ খুলে দেখল। সঙ্গেসঙ্গে দু কদম পিছিয়ে গেল সে। ব্যাগে কয়েকটা আন্ডারওয়্যার আর সেন্ডো গেঞ্জি রাখা। কুসুমের লজ্জায় মরিমরি অবস্থা। এসব কি হচ্ছে তার সঙ্গে? এসব গুছাবে সে? উফ। খালামনির উপর রাগ লাগছে কুসুমের। তাকেই পেল উচ্ছ্বাস ভাইয়ের লাগেজ গুছানোর জন্য? কুসুম কি আর করবে। চোখ বন্ধ করে আলগোছে সেসব জিনিস রেখে দিল লাগেজে। সব রেখে দিয়ে মনে করে দেখল, আর কিছু বাকি আছে কি না। না, নেই। কিছু বাকি নেই দেখে কুসুম লাগেজের চেইন বন্ধ করে লাগেজ কষ্ট করে টেনে নিয়ে মাটিতে এক কোণায় রেখে দিল। হাত ঝাড়া দিয়ে ব্যথায় মুখ কুঁচকে নিল। ইশ, এত ভারি লাগেজ!
উচ্ছ্বাস এসেছে রাত তখন সাড়ে দশটা। এসেই তাড়াহুড়ো করা শুরু করে দিয়েছে। এদিকে গিয়ে এটা ব্যাগে রাখে তো ওদিকে গিয়ে ওটা ঠিক করে। সে এক ঝড়! এসেই মাকে ডেকে উঠে,
‘ আম্মা, আমার লাগেজ গুছিয়েছ? দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার। ‘
পারুল হাতে করে পায়েসের বাটি নিয়ে ছেলেকে দেন। পায়েস দেখে উচ্ছ্বাস অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘ সময় নেই, আম্মা। এখনি বেরুতে হবে। ‘
পারুল রাগ দেখিয়ে পায়েসের বাটি টেবিলের উপর রেখে দেন। যেতে যেতে বলেন,
‘ সবগুলো পারে না আমাকে খাটিয়ে মারতে। একটা দিন চাইলাম তার কাছে, এই এক দিন আমায় দিতে পারল না? এমন হতচ্ছাড়া ছেলে জন্ম দিয়ে কি লাভ হল। জ্বা*লিয়ে মারল সবকটা। ‘
উচ্ছ্বাস ঘর থেকে মায়ের গাঁদা গাঁদা অভিযোগ শুনে। মা রাগ করবে দেখে কোনো উপায় না পেয়ে দ্রুত পায়েস নিয়ে খেতে শুরু করে। ঝড়ের গতিতে সবটুকু পায়েস খেয়ে এক গ্লাস পানি খায়। লাগেজ টেনে নিজের ঘরের দিকে একবার চেয়েই বেরিয়ে পরে। নিচে যেতে যেতে ডাক দেয়,
‘ কুসুম, দ্রুত আসো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘
দেখা গেল, কুসুম শিউলির ঘর থেকে পার্স নিয়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে আসছে। খালামনির থেকে বিদায় নেয়। পারুল ছেলের কাছে যান। এতক্ষণ কান্না আটকে রাখলেও এবার আর পারেন না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন ছেলেকে জড়িয়ে। মায়ের কান্না দেখে উচ্ছ্বাসের চোখেও কিছুটা জল জমে। কিন্তু সে বরাবরই শক্ত মনের মানুষ। তাই নিজের কান্না সংবরণ করে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝায়,
‘ আমি তো একেবারেই যাচ্ছি না আম্মা। এইতো বছর পরেই চলে আসব। কেঁদো না আম্মা। দেখো, তুমি কাদলে তো আমায় বাংলাদেশেই থেকে যেতে হবে। তোমাকে কান্না করিয়ে আমি বিদেশ গিয়ে শান্তি পাব? আমার ডিগ্রির কি হবে তখন? কান্না বন্ধ করো আম্মা। ‘
ছেলের অনেক বুঝানোর পর পারুল কান্না থামান। পারুল কান্না থামালেও উচ্ছ্বাসের বোনরা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। কান্না থামার নামগন্ধ নেই। মানহাকে কোলে নিয়ে আদর করে উচ্ছ্বাস। অতঃপর বাবা, ফুপু, বোন, আম্মা, মানহা সবার থেকে বিদায় নিয়ে কুসুমকে নিয়ে বেরিয়ে যায় উচ্ছ্বাস। কুসুমের চোখ ছলছল করছে। এদের কান্নার মাতম দেখে যেকোনো মুহূর্তেই সে কেঁদে দেবে। উচ্ছ্বাস কুসুমের ছলছল চোখ দেখে কাতর কণ্ঠে বলল,
‘ এবার তুমিও শুরু করে দিও না প্লিজ। একবারেই যাচ্ছি না। তোমরা এমন ভান করছ, যেন কখনোই দেশে ফিরে আসব না। ‘
কুসুম কি আর বলবে? কান্না আসলে কি কান্না থামানো যায়? উহু। কুসুম চিন্তা করল, সে আর উচ্ছ্বাস ভাইকে তার কান্না দেখাবে না। দূর্বল হবে না তার সামনে। তাই কুসুম গাড়ির জানালার দিকে চেয়ে বসে থাকল সারাটাপথ।
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |৯|
তীব্র গরমে ক্লাস শেষ করে ক্লান্ত কুসুম। ক্লান্তি যেন মাথায় চড়ে বসেছে। গা অত্যন্ত ম্যাজম্যাজ করছে। কুসুম দু কাঁধে দু বেনুনি দুলিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। সঙ্গে কুসুমের বান্ধুবি সেঁজুতি। কুসুম সেঁজুতির সঙ্গে আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে বাসার দিকে এগুচ্ছিল। হঠাৎ কুসুমকে পেছন থেকে ডাক দেয় শুভ। কুসুম ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকায়। শুভ কুসুমের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। বেশ কদিন ধরে সে কুসুমের পেছনে পরে আছে। কুসুমের সঙ্গে প্রেম করাই যেন গর ধর্ম হয়ে গেছে। কুসুমকে চিঠিপত্র, ফুল এসব দিয়ে ভুলানোর চেষ্টাও করা হয়েছে কয়েকবার। তবে কুসুম বরাবরই তাকে এড়িয়ে গেছে। কুসুম এবারেও এড়িয়ে যেতে চাইল। তবে শুভ ততক্ষণে কুসুমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেঁজুতি শুভকে একপল দেখে কুসুমের কানে কানে বলল,
‘ যখন বিরিয়ানির মধ্যে এলাচি কা*মড়ে পরে, তখন আমরা কি করি কুমকুম? ‘
কুসুম বোকার মত ফিসফিস করে বলে, ‘ কি? ‘
সেঁজুতি বিরক্ত হল। ধাম করে কুসুমের মাথায় ভয়াবহ চাপড় দিয়ে বলল, ‘ গাধার বাচ্চা। আমরা এলাচি ছুঁড়ে ফেলে দেই। এটাও জানিস না? ‘
কুসুম মাথায় হাত ঘষে বিড়বিড় করে, ‘ হ্যাঁ,তাইতো। ‘
সেঁজুতি আবারও ফিসফিস করে বলে, ‘ এবার দেখ এই অশুভকে কি করি আমি। চোখ মেলে থাকবি। পলক ফেলবি না। এখন মজাদার নাটক হবে। খলনায়িকা হব আমি। জাস্ট সি। ‘
কুসুম সত্য সত্য চোখে মেলে বড়বড় চোখে সেঁজুতির কাজ দেখে যায়। শুভ এগিয়ে আসতে চায় কুসুমের দিকে। সেঁজুতি পথ আটকে দাড়ায়। শুভ কাতর কণ্ঠে বলে,
‘ দেখ সুজি, কুসুমের সঙ্গে আমার অনেক দরকারি কথা আছে। সরে দাঁড়া। ‘
সেঁজুতি তার স্কুল ইউনিফর্ম এর কলার ঝাঁকায়। দম্ভ নিয়ে বলে,
‘ কুমকুম এখন ব্যস্ত। পরে কথা বলবে। ফুট এখন। ‘
শুভ তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে। সেঁজুতিকে পাশ কাটিয়ে কুসুমের দিকে চেয়ে বলে, ‘ আই লাভ ইউ কুসুম। দেখ, তোর জন্যে আমি আমার হাত কে*টে ফেলেছি। এই দেখ, দেখ। হাতে এখনো র*ক্তের দাগ আছে। ‘
শুভ তার স্কুল ড্রেসের হাতা উঠিয়ে বাম হাতের কব্জি কুসুমকে দেখায়। কুসুম আঁ*তকে উঠে। সত্য সত্য কা*টা শুভর হাত। ব্যান্ডেজের উপর র*ক্তের দাগ। কুসুমকে কথা বলতে না দিয়েই সেঁজুতি বলে,
‘ এটা ছাগলের র*ক্ত। বোকা পাইসিস আমাদের? ‘
শুভ এবার যেন আরো অসহায় হয়ে পরে। গতকাল রাতে সে বুক ভর্তি সাহস সঞ্চয় করে চোখ বুজে কব্জিতে ছু*রি দিয়ে এক টান দিয়েছে। ফিনকি দিয়ে র*ক্তও পরেছে। ব্য*থায় এখনো কব্জি জায়গাটা টনটন করছে। আর তারা বলে কি না, এটা ছাগলের রক্ত? এত ব্যথা তাহলে কার জন্যে সহ্য করল শুভ? পা*ষাণ মেয়ে। শুভ ছলছল চোখে বলে,
‘ এটা আমারই র*ক্ত। আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস না হলে আমার মায়েরে জিজ্ঞেস করতে পারিস। ‘
সেঁজুতি ধমকে উঠে, ‘ আরে রাখ ব্যাটা তোর আবেগের কথা। কুসুম তোর সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না। কুসুমের হাত পা বাঁধা। ‘
শুভ অবাক হয়ে কুসুমের হাতের দিকে চায়। বোকার মত বলে,
‘ হাত পা তো খোলাই আছে। ‘
সেঁজুতি এবার যেন রেগে যায়। কটমট করে বলে,
‘ ওই ব্যাটা বে*য়াক্কলের বাচ্চা। কুসুমের হাত পা বাঁধা মানে সেই বাঁধা না। সম্পর্কের দড়ি দিয়ে বাঁধা। সোজা বাংলায় কুসুমের বিয়ে হয়ে গেছে। তোর মত পুচকু ছেলের জন্যে কুসুম বসে থাকবে নাকি? তার বিয়ে হয়েছে ডাক্তার বাবুর সাথে। বুঝসস? এখন ফুটে যা। কুইক। ‘
শুভর মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠে। কুসুম দাঁত দিয়ে ঠোঁট কেটে আহম্মকের মত দাঁড়িয়ে থাকে। সে এই বিয়ের কথা এতদিন লুকিয়ে এসেছে। কাউকে জানতে দেয়নি। আর আজ এই মুখ পাতলা সুজির বাচ্চা শুভকে জানিয়ে দিয়েছে। এখন সবাই জেনে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট। কুসুম সেঁজুতির পিঠে ঘু*ষি দিয়ে বলে,
‘ সুজির বাচ্চা, সব ফাঁস করছিস কেন? ‘
সেঁজুতি হাত দিয়ে ইশারা করে কুসুমকে চুপ থাকতে বলে। শুভ সেঁজুতির কথা বিশ্বাস করে না। মাথা কাত করে কুসুমকে জিজ্ঞেস করে, ‘ সত্যি কুসুম? তোমার বিয়ে হয়ে গেছে? ‘
কুসুম কি আর বলবে? মিথ্যা তো আর বলতে পারবে না। তাই অগ্যতা কুসুম মাথা হেলায়, ‘ হ্যাঁ। ‘
শুভর বুকে যেন কেউ খা*মচি দিয়ে ধরে রাখে। সে টালমাটাল কণ্ঠে বলে, ‘ কবে হয়েছে বিয়ে? ‘
কুসুম মিনমিন করে উত্তর দেয়, ‘ এক সপ্তাহ আগে। ‘
শুভ বলে,’ এত ছোট বয়সে বিয়ে করে ফেললে? পরে যদি এই বিয়ে নিয়ে আফসোস কর? ‘
কুসুমের বুক ধড়ফড় করে উঠে। কুসুম কথা বলে না। হাঁসফাঁস করে অন্যদিকে চেয়ে বসে। শুভ আর কি বলবে? কুসুমের দিকে একপল অসহায় চোখে চেয়েও চলে আসে সেখান থেকে। সেঁজুতি এবার কুসুমের দিকে চেয়ে দম্ভ করে বলে,
‘ কেমন দিলাম, কুমকুম? ‘
কুসুম কথা বলে না। চুপচাপ হাটা শুরু করে। সেঁজুতি পথ পেরিয়ে আচমকা বলে,
‘ এই কুমকুম, কাল না তোর জন্মদিন গেল? ডাক্তার বাবু কি দিল গিফট? ‘
কুসুম বেজায় মন খারাপ করে। জন্মদিন উপলক্ষে কুসুম আর কিছুই চায়নি। শুধু চেয়েছিল, উচ্ছ্বাস ভাই একবার কল করবে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা না জানাক, একবার ‘ ভালো আছো, কুসুম? ‘
জিজ্ঞেস করবে! না, সে কিছুই করেনি। না একটা ফোনকল, না একটা শুভেচ্ছা বার্তা, আর নাইবা কোনো গিফট। সে তো বিদেশ যাবার পর একবারও কুসুমের খোঁজ নেয়নি। হয়তো এত এত বিদেশি নারীর কারণে কুসুমের মত ছোট্ট নারীকে ভুলেই বসেছে। কে জানে তার মনে কি চলছে? সেঁজুতি কুসুমের কথা বলার অপেক্ষা করে না। বরং নিজের মত করেই বলতে থাকে,
‘ জানিস, সজীব আমাকে আমার লাস্ট জন্মদিনে একটা ইয়া বড় টেডি বিয়ার গিফট করেছে। পুতুলটা কি মোলায়েম জানিস? হাত দিলেই যেন হাত দেবে যায়। আমি তো রোজ এটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। ‘
কুসুমের মন এবার আরো খারাপ হতে শুরু করে। এই বিয়ে সে কেন করল? কেন বয়সের আনন্দ বোঝার আগেই বিয়ে নামক জঞ্জালে জড়িয়ে পরল? মা কেন কুসুমকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে এতবড় দায়িত্ত্ব কাঁধে চাপিয়ে দিল? সবাই কেন কুসুমকে বোঝার চেষ্টা করল না? সবাই সবার মত চলছে। অথচ কুসুমের মনের তুফান কেউ বুঝতে চাইল না। কেউই না। এমনকি উচ্ছ্বাস ভাইও না।
_______________________
সারাপথ কুসুম কান্না আটকে বসে থাকলেও বাসায় এসেই আর কান্না দমাতে পারেনি। রান্নাঘরে মায়ের কাছে এসেই মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সাহেদা মেয়ের আচমকা কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে যান। চুলোর আগুন দ্রুত নিভিয়ে মেয়ের দিকে ফেরেন। কুসুমের ঘামে ভেজা কান্নামাখা মুখ বড্ড আদুরে লাগছে। সাহেদা মেয়ের মাথা দুহাতে তুলে কণ্ঠে আদর ঢেলে বলেন,
‘ কুসুম, কাঁদছিস কেন মা? স্কুলে কেউ কিছু বলেছে? কি হয়েছে? মাকে বল। ‘
কুসুম মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মিশে যায়। কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দেয়,
‘ আমাকে এত ছোট বয়সে কেন বিয়ে দিলে মা? আমার এই বিয়ে ভালো লাগছে না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না, মা। কিচ্ছু না। ‘
সাহেদা আঁতকে উঠেন মেয়ের কথায়। বিয়ের অল্পদিনেই মেয়ে এসব কি বলছে? উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কি ঝামেলা হয়েছে? সাহেদার মা’সুলভ বুকের ভেতরটা কেউ যেন খা*মচে ধরে রাখে। মেয়ের কান্নায় ভয় জমে যায় মনের ভেতর। তবে কি বোনের কথায় অল্প বয়সে মেয়ে বিয়ে দিয়ে ভুল কিছু করে বসলেন তিনি?
#চলবে