ভাগ্য পর্ব-০৬

#ভাগ্য ৬ পর্ব

পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ আছে, কেউ ভালো কেউ খারাপ।
খারাপ মানুষের সংখ্যাই বেশী, ভালোর সংখ্যা হাতে গোনা, তবে আমার সৌভাগ্য তেমন একজন মানুষের দেখা পেয়েছি। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি।
ঘুম ভেঙে দেখি সকাল সাতটা, উঠে কিচেনে গেলাম রান্না করতে, হাসিব এখনো ঘুমাচ্ছে।
আমি রুটি ভাজি করে হাসিবকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।
হাসিব আমাকে বলল, শুনেন ইসরাত আমি আগে তুহিনের সঙ্গে কথা বলে আসি পরে নাস্তা করব।
জানতে চাইলাম কি কথা বলবেন তুহিনের সঙ্গে,

তার মত মানুষের সাথে একই ফ্ল্যাটে থাকা আমি নিরাপদ মনে করিনা, তাকে জিজ্ঞাস করে দেখি এই ফ্ল্যাটে সে থাকবে, না কি আমি থাকব, যদি সে থাকতে চায় তাহলে আমি আপনাকে নিয়ে অন্য কোন ফ্ল্যাটে উঠব।

হাসিব তুহিনের সঙ্গে কথা বলে এসে আমাকে বলল,
আমি আজ ভার্সিটিতে যাবো না, নাস্তা খেয়ে বের হচ্ছি ফ্ল্যাট ভাড়া খুঁজতে। আপনি দরজা লক করে থাকবেন আমি যতক্ষণ পর্যন্ত বাসায় না ফিরি।
এই তুহিন অমানুষটার সঙ্গে থাকার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।

নাস্তা খেয়ে হাসিব বের হয়ে গেল, তুহিন এখনো শুয়ে আছে। হাসিব যাবার সময় আমাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছে সে না আসা পর্যন্ত যেন আমি রুমের বাহিরে না বের হই।
আমি নাস্তা করে রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
হাসিবের ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর তিনটা বাজে।
দুপুরে তো রান্না করা হয়নি, আমার খুব ক্ষিদে লাগছে, দরজা খুলে রুম থেকে বের হয়ে দেখি হাসিবের হাতে খাবারের প্যাকেট।
আমাকে বলল,

আসেন খেয়ে নেয়া যাক, ফ্ল্যাট ভাড়া পেয়েছি, ফ্ল্যাটের মালিক কিছু টাকা অগ্রীম চাচ্ছে, আমার কাছে তত টাকা নেই।
তাই বাংলাদেশে ভাইয়ার কাছে ফোন করে টকা চাইলাম, ভাইয়া প্রথমে রাজী হয়নি এত টাকা দিতে, অনেক বুঝিয়ে রাজী করলাম।

সব ঝামেলা আমার জন্য, না হলে তো আপনি আর তুহিন একসঙ্গে ভালোই ছিলেন।
হাসিব রেগে গেলো,

কিসের ঝামেলা বলছেন আপনি, আমার কাছে আপনি ঝামেলা না, আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারছি এটাই আমার বড় পাওয়া, কয়জনের এমন সুযোগ হয় অপরের সাহায্য করার।
কি আর বলব, আমার চোখে পানি চলে আসছে হাসিবের কথা শুনে, তার মত মানুষের সাথে দেখা না আজ আমি কোথায় কোন নরপশুর ভোগের সামগ্রী হতাম কে জানে।

নতুন ফ্ল্যাটে আসছি কয়েকদিন ধরে, এখন আর তুহিন জানোয়ারের জন্য ভয় নেই, ফ্ল্যাটে দুইটা বেডরুম আমি থাকি একটায় হাসিব থাকে অন্যটায়।
এখন আমার অপেক্ষার পালা কবে বাংলাদেশে যেতে পারব, সেই আশায় দিন গুনছি, দুইবছর পর হাসিবের স্টাডি কমপ্লিট হবে, তখনি হয়তো আমাকে নিয়ে সে বাংলাদেশে যাবে।

কিছু শারীরিক প্রব্লেম হচ্ছে দুইদিন ধরে, ভাত খাইলে বমি বমি লাগে, মাথা চক্কর দেয়, আমার মনে সন্দেহ জাগল, এই মাসে পিরিয়ড ও হয়নি, তাহলে কি আমি প্রেগন্যান্ট।
আমি হাসিবকে বললাম আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে, সে জানতে চাইলো আমার কি হয়েছে,
বললাম, শরীর ভালো না।
সন্ধ্যায় হাসিব আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, ডাক্তার চেকাপ করে জানাল, আমি প্রেগন্যান্ট।
শুনে আমার মাথাটা ঘুরে গেল, কি করব আমি এখন, এই বাচ্চা আমি কি করব, তাকে তো পারব না এই পৃথিবীতে জন্ম দিতে, চোখ দিয়ে অঝোরে কান্না আসছে।

দেখেন আপনি কোন চিন্তা করবেন, আমি আছি আপনার পাশে, আপনি যদি চান এই বাচ্চাকে আপনি পৃথিবীতে আনতে পারেন।
হাসিবের কথার প্রতি উত্তরে বললাম, আপনি আমার জন্য যতটুকু করছেন সেটাই অনেক বেশী, আমি চাইনা এই বাচ্চাকে জন্ম দিতে।
কি পরিচয় দেবো মানুষের কাছে, কে এই বাচ্চার বাবা, আদিব কখনো এই বাচ্চাকে সন্তানের স্বীকৃতি দিবে না।
সে তো আমাকেই স্ত্রী মনে করেনি কখনো আর আমার সন্তানকে নিজের সন্তান বলে স্বীকার করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছুনা।

তাহলে আপনি কি চান এই বাচ্চাকে নষ্ট করে দিতে।
হাসিবের এমন প্রশ্নে আমি হকচকিয়ে গেলাম, বুকের ভিতর মুচড়ে উঠলো।
তাকে বললাম, স্বপ্ন ছিল আমি একদিন মা হবো, আমার সন্তানকে অনেক আদর ভালোবাসা দেবো, জানেন সব মেয়েরই স্বপ্ন থাকে তার প্রথম সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে, আমার ভাগ্যে হয়তো নেই।

হাসিব ডাক্তারকে বলল, আপনি ওষুধপত্র লিখে দেন যাতে করে মা আর বাচ্চা দুজনেই সুস্থ থাকে।
ডাক্তার হাসিবকে বললেন, ঠিকমত খেয়াল রাখতে, আর নিয়মিত খাবার খাওয়াতে।
আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি হাসিবের কান্ড দেখে, সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে আমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে।
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, সে না হয় বাচ্চার দায়িত্ব নিলো, যখন সবাই জানতে চাইবে বাচ্চার বাবা কে, তখন আমি লোকের কাছে কি জবাব দেবো।

শুনেন যা হবার হবে আগে এতকিছু ভেবে লাভ নেই, সবকিছুর সমাধান আল্লাহর হাতে, তিনি যা করবেন ভালোই করবেন, এখন চিন্তা বাদ দিয়ে অনাগত সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুব সেটাই বেটার হবে।

কি আর করব সব চিন্তা বাদ দিলাম, হাসিম আমার অনেক কেয়ার করে, সময় মত খাবার খেলাম কি না, মেডিসিন খেলাম কি না টাইম টু টাইম খেয়াল রাখে।
যখন বাসায় না থাকে ফোন করে আমাকে মনে করিয়ে দেয় খাবার ও মেডিসিন খেতে।

আস্তে আস্তে সময় চলতে লাগল, এখন আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
হাসিব আল্ট্রাসনোগ্রাফী করার জন্য পাগল হয়ে গেছে, বারবার বলছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে আমাকে।
আমি বললাম, যা হয় হবে, অযথা টাকা খরচা করার কি দরকার, সে এক প্রকার জোর করে আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
আল্ট্রাসনোগ্রাফ রিপোর্ট আসলো মেয়ে হবে।
মেয়ে হবে শুনে হাসিব অনেক খুশী, আমার মুখ মলিন দেখে হাসিব জানতে চাইলো আমি খুশী হয়েছি কি না।

কি করে খুশী হবো, আমি তো অনেক লাঞ্চিত অত্যাচারিত নিপিড়ীত, আমার মেয়ে যে অত্যাচারিত নিপিড়ীত হবেনা তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে।
আর যদি আমার মেয়ে আমার মত কালো বর্ণের হয় তাহলে তো তার ভাগ্যেও আমার মত অবহেলা ছাড়া আর কিছুই জুটবে না।

এতো চিন্তা করতে হবে না, আপনাকে একদিন বলছি না, আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে, তিনিই সবকিছু ঠিক করে দিবে, দেখবেন আপনি সুখী হবেন, শুধু আল্লাহর রহমতের উপর বিশ্বাস রাখুন।
হাসিবের কথা গুলো শুনে মনটা এমনি ভালো হয়ে যায়, আল্লাহর প্রতি তার অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস দেখে খুব ভালো লাগে।

আর তিনদিন পর খ্রিস্টানদের বড়দিন তাই লন্ডন শহর জুড়ে সাজ সাজ রব।
ফ্ল্যাটের মালিক হাসিবকে ইনভাইট কার্ড দিয়ে গেছে তার বাসায় বড়দিনের পার্টিতে যাওয়ার জন্য।
হাসিব ভার্সিটি থেকে এসে আমাকে বলছে,

ইসরাত রেডি হয়ে নেন ক্রিকেট খেলে দেখতে যাবো, আজ বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের টি-টুয়ান্টি ম্যাচ, আমি দুইটা টিকিট নিয়ে আসছি।
ভাবলাম আপনাকে নিয়ে খেলা দেখব, আপনার তো ক্রিকেট খেলা অনেক প্রিয়।

আমি হাসিবকে না করে দিলাম, বললাম আমি অনেকক্ষণ বসে থেকে খেলা দেখতে পারব না, আমার কষ্ট হবে।
সে আর জোর করেনি, আমি ইচ্ছা করেই তার সাথে গেলাম না। যখন হাসিব আমাকে সঙ্গে নিতে চাইল, তখন আদিবের বলা কথা গুলো মনে পড়ে গেল।
আদিব বলেছিল, আমি তার সাথে গেলে লোকে হাসাহাসি করবে বলবে, এমন ছেলের কালো বউ।
হাসিবও তো সুন্দর ফর্সা তার সাথে আমি গেলে মানুষে যদি হাসাহাসি করে, আমি চাইনা আমার জন্য হাসিব কারো কাছে ছোট হোক।
যত দিন যাচ্ছে মানুষটার প্রতি অনেক শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে চলছে।

আমি টিভি অন করে খেলা দেখতে বসলাম।
ইংল্যান্ড ব্যাটিং করছে,এই মুহূর্তে ইংল্যান্ডের রান এক উইকেটে নব্বই, নয় ওভারে। মুস্তাফিজের বলে একজন আউট হলো, কিন্তু পরক্ষণেই আবার চার ছক্কা।
খেলা দেখতে আর ভালো লাগছে না, বাংলাদেশ তো হারবেই এটা নিশ্চিত, টিভি অফ করে রান্না করতে গেলাম।

চলবে,,,

সাদমান হাসিব সাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here