#ভালোবাসার_রঙ_কালো 🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব-২
————————————————-
.
আমি পিছনে ফিরে তাকাতেই মিহির ভাইকে ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তাকে দেখে খুব রাগান্বিত মনে হচ্ছে! এক পলক তার দিকে তাকিয়ে আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই তিনি পুনরায় রাগে গর্জে ওঠেন,
” আমার বলার পরও এই কালো শাড়ি পালটাওনি কেন?
তার ধমকে আমি মৃদ্যু কেঁপে উঠে আমতা আমতা করে বললাম,
” আমি এই শাড়িই পরে থাকবো ; এবং আমার যা ইচ্ছা আমি তাই পরবো।
আমার কথায় তিনি আরও ক্ষেপে গেলেন। আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
” তোমার ইচ্ছে! আমার কথার পরে তোমার আর কোনো ইচ্ছে থাকতে পারে না আরজু।
এই কথা শুনে আমি তার মুখে দিকে তাকাতেই ঘাবড়ে যায়। তিনি দাঁত কটমট করে রাগী চোখে আমাকে দেখছেন। আমি তার কথার জবাব দিতে গেলে তিনি হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বললেন,
” বেশি বাড় বেরো না আরজু। আমার কথার উপরে তোমার ইচ্ছের দাম দিতে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে এসো না।
কথাগুলো বলেই তিনি রাগে ফোসফাস করতে করতে হনহন করে ছাদ থেকে নেমে গেলেন। আর আমি হতভম্ব হয়ে ছাদেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর মাগরিবের নামাযের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে হাতের শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে ধীরপায়ে লিফটে ওঠে ছাদ থেকে নেমে এলাম। ঘরে এসে ঢুকতেই মিহির ভাইয়ের মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখেই তিনি চোখমুখ কুঁচকে বিরক্তির সুরে বললেন,
” কী ব্যাপার আরজু, এই কালো শাড়ি পরেছো কেন! তোমার কী আক্কেল বলতে কিছু নেই? এমনিতে তুমি দেখতে কালো। তার উপর কোন বুঝে এমন একটা কালো শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছো? আরে এই ভর সন্ধ্যায় তোমাকে দেখে তো যে কেউ ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে।
আন্টি যে আমাকে অপমান করার জন্যই ইচ্ছে করে কথাগুলো বলছেন সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। তার কথা যেন আমার গায়ে লাগেনি এমন ভঙ্গি করে মুচকি হেসে বললাম,
” অন্যদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো এমন বিরল গায়ের রঙ কয়জনে পায় বলুন তো আন্টি। আমি তো নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে করি এমন একটা দূর্লভ গায়ের রঙ পেয়ে! বলেই মুখের হাসিটাকে আরও প্রসস্থ করলাম। আমি জানি আমার কথায় আন্টির গায়ে এখন আগুন লেগে যাবে এবং হলোও তাই। তিনি তার ছোট ছোট চোখ দুটিকে কুঁচকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন,
” নির্লজ্জের মতো কথাবার্তা বলো কেন তুমি?
আমি অবাক হওয়ার সুরে বললাম,
” নির্লজ্জের মতো কী বললাম আন্টি?
আন্টি আমাকে আর কিছু না বলে গটগট করে তার রুমে গিয়ে ধুম করে বিকট শব্দে দরজা লাগিয়ে দিলেন। এর মাধ্যমে যেন তিনি আমাকে বুঝালেন, বেহায়া মেয়ে অনেক হয়েছে, এবার আমার বাড়িটাকে ছেড়ে যাও আমি আর সহ্য করতে পারছি না তোমাদের। আমি সেখানে আর না দাঁড়িয়ে সোজা আমার রুমে এসে পরনের শাড়ি পালটে সালোয়ার কামিজের সাথে হিজাব পরে মাগরিবের নামায পড়ে নিলাম। তারপর আমার শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করে বিছানার এক পাশে রেখে আব্বা আম্মা আর নোমানের কাপড়গুলো নিয়ে তাদের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। আব্বা আম্মার রুমে এসে দেখি ফ্লোরে জায় নামায বিছিয়ে আম্মা নামাজ পড়ছে। আম্মার আসরের নামায কাজা হয়ে গিয়েছিল বলে হয়তো এখন আদায় করে নিচ্ছে। আমি নিঃশব্দে কাপড়গুলো আলনায় রেখে বেরিয়ে আসতেই দরজায় আব্বার সাথে দেখা হলো। আব্বার চোখমুখ শুকিয়ে আছে। আমাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” ছেলে পক্ষ আর আসবে না বলে দিয়েছে। তোর কথামতো ঘটককে আগে তোর গায়ের রঙ কালো সেটা জানিয়ে দিয়ে তারপর তারা আসতে চাইলে তাদেরকে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। কিন্ত ঘটকের কাছে সব শুনে তারা আর আসবে না বলেছে।
আব্বার চোখ দুটি ছলছল করছে। যেকোনো সময় তাঁর চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল টুপ করে গড়িয়ে পড়বে। আমি স্বান্তনার সুরে বললাম,
” এটা নিয়ে তুমি মন খারাপ কোরো না আব্বা। একদিকে বরং ভালোই তো হয়েছে। ঘটক চাচা যদি তাদেরকে আমার সম্পর্কে না জানিয়েই আমাকে দেখাতে নিয়ে আসতো, তাহলে অযথা তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কতগুলো টাকা অপচয় হতো আমাদের। যেগুলো কোনো কাজেই আসতো না। আমাদের কাছে এখন একটা টাকারও অনেক মূল্য। তাই বলছি যা হয়েছে ভালো হয়েছে। এইসব নিয়ে ভেবে তুমি আর হা-হুতাশ করো না। সম্ভবত আমার যুক্তি আব্বার মনপুত হয়নি। তিনি রাগী সুরে বলেন,
” আমি এখনো এত ফকির হয়ে যায়নি যে আমার মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে তাদের আপ্যায়ন করতে সামান্য আয়োজনও করতে পারবো না!
.
সময় গুলো খুব উষ্কখুষ্ক ভাবে কেটে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে কেমন যেন অদ্ভূত একটা যন্ত্রণা হয়। কিন্তু কিসের জন্য হয় সেটাই বুঝতে পারি না। আমার অস্তিত্ব জুরে শুধু শূন্যতা বিরাজ করে! আমি সহেলি নূর আরজু। এতটুকু কী আমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট না? বিয়ে সংসার এসব ব্যতীত বুঝি একটি মেয়ের নিজস্ব কোনো সত্তা থাকে না! রাতের আকাশ ভরা তারা জ্বলজ্বল করছে। শত শত তারার মাঝে চাঁদ সুন্দরী মিটিমিটি হেসে তার চাঁদনী বিলাচ্ছে। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রাতের আকাশ দেখছি মন ভরে। রাতের আকাশ আর আমার মধ্যে একটা মিল রয়েছে। আমরা দুটোই দেখতে কালো। তবে পার্থক্য হলো ; রাতের আকাশের কালো ঘুচাতে চাঁদ আছে। চাঁদ নিজের আলো দিয়ে আকাশের কালোকে চাঁদনীর আড়ালে লুকিয়ে ফেলে রাতের অভিশাপকে মূর্ছনায় মুড়িয়ে দেয়! কিন্তু আমার জীবনে চাঁদের মতো আলো ছড়ানোর মতো কেউ নেই। কেউ আসেনি; হয়তো কখনো আসবেও না!
হঠাৎ করে দরজায় টোকা পড়তেই চমকে উঠলাম। চিন্তার ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,
” কে?
” আরজু আফা আমি শিলা। দরজাটা একটু খুলেন।
আমার চুলগুলো পিঠে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিল। দুই হাতে সেগুলো হাত খোঁপা করে ওড়নাটা ভালো করে মাথা আর শরীরে জড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে দিতেই শিলার ঘুমে জড়ানো দুটি চোখ সামনে দেখতে পেলাম। চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছোট মেয়েটা সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ক্লান্তিতে দুই চোখে ভীর জমানো ঘুমকে তাড়ানোর চেষ্টায় রত।
” কিরে কী হয়েছে?
” বড় ভাই আপনারে এখনি ছাদে যাইতে কইছে।
শিলার কথা শুনেই আমার বুকের ভেতরে ধক করে ওঠল। বড় ভাই মানে তো মিহির ভাই! মিহির ভাই এই রাতের বেলা আমাকে ছাদে যেতে খবর পাঠিয়েছেন কেন? তার কোনো বাজে উদ্দেশ্য নেই তো! কোনো কুমতলবে ডাকেননি তো আমাকে!
আমাকে চিন্তায় ডুবে যেতে দেখে শিলা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে তাড়া দিয়ে বলল,
” জলদি চলেন আফা। আমারে আপনার সাথে ছাদে যাইতে হইবো। বড় ভাইয়ের কথা বলা শেষ হইলে আপনারে আবার রুমে পৌঁছায় দিয়া তারপরে আমি ঘুমাইতে যাইতে পারমু।
আমি শিলাকে আর কিছু না বলে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। শিলাও নিঃশব্দে আমার পিছনে চলতে লাগল।
.
এই অ্যাপার্টমেন্টটা যেমন বিশাল এর ছাদটাও তেমন বিশাল। ছাদের প্রায় পুরোটা জুরেই ফুলের বাগান করা হয়েছে। বাগানের মাঝখানে বসার জন্য কাঠের ছোট ছোট টুল পেতে রাখা আছে। যে কেউ চাইলেই যেন আরাম করে বসে এই বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে তার জন্যই এই ব্যবস্থা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ছাদের এক কোণে তাকাতেই দেখি উত্তরে ডালিয়া গাছের পাশে ছোট টুলে মিহির ভাই পায়ের উপরে পা তুলে বসে আছেন। এই রাতের বেলা লিফটে করে ছাদে আসতে গেলে কারোর চোখে পড়লে নানান রকমের গুঞ্জন শুরু হবে। তাই অনেক কষ্ট করে আট তালা সিঁড়ি বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছাদে এসে পৌঁছেছি। শিলাও আমার সাথে হাঁপাচ্ছে। বেচারি সারাদিন এত পরিশ্রম করে রাতের বেলা এখন ঘুমানোর সময় সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। হুট করেই রাগে আমার সারা শরীর জ্বলতে লাগল। মনে মনে মিহির ভাইকে কঠিন কিছু কথা বলার পণ করে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তার কাছে যেতেই আচমকা তিনি নরম সুরে বলে ওঠলেন,
” লিফট দিয়ে ছাদে আসতে এত সময় লাগে? সেই কখন থেকে ছাদে এসে বসে আছি।
আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললাম,
” এত রাতে আমাকে ছাদে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন?
মিহির ভাই ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে বললেন,
” এখনো এত রাত হয়নি মাত্র এগারোটা বাজে।
” রাতের এগারোটা আপনার কাছে মাত্র হতে পারে কিন্তু আমাদের কাছে অনেক রাত।
এই কথায় মিহির ভাই চোখের ভ্রু জোড়া কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” আমাদের মানে? এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?
শিলা ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে বসে ঘুমে ঝিমুচ্ছে। আমি আঙুলের ইশারায় ওকে দেখিয়ে বললাম,
” মেয়েটা সারাদিন খাটে। তারপর এই রাতের বেলা যে একটু শান্তিতে ঘুমাবে আপনার জন্য সেটাও পারছে না।
শিলাকে দেখে মিহির ভাই চমকে উঠে বলেন,
” ওই বোকাটাকে এখানে কে আসতে বলেছে?
” আপনি নিজেই বলেছেন।
” ওকে আমি তোমার সাথে আসতে বলিনি। শুধু তোমাকে ছাদে পাঠিয়ে দিতে বলেছি।
তার কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
” আপনি ওকে এত রাতে আমাকে একা ছাদে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন?
” বার বার এত রাত বলছো কেন? এখন মাত্র এগারোটা বাজে। আর তাছাড়া তুমি এমন কোনো রূপসী নও যে তোমাকে একা ছাদে ডেকে এনে আমার কোনো বাজে উদ্দেশ্য পূরণ করবো। এখানে ডেকে এনেছি তোমার বিচার করবো বলে।
আমাকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে থাকতে দেখে মিহির ভাই পুনরায় বলেন,
” তোমাকে বলেছিলাম কালো শাড়িটা পালটে অন্য কোনো কাপড় পরতে। কিন্তু তুমি সেটা না করে উলটো বেয়াদবি করে আমার কথার বরখেলাপ করেছো। আর তাই সেটার বিচার করতেই তোমাকে ছাদে ডেকে এনেছি।
আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকে দেখছি! রাগে ফুসে উঠে বললাম,
” আপনি একজন অভদ্র লোক সেটা জানতাম, কিন্তু আপনি যে একজন অসভ্য লোকও সেটা এখনি জানলাম!
আমার কথা শেষ হতেই আচমকা মিহির ভাই আমার একেবারে কাছে চলে এসে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
” অসভ্যের বদনাম যখন পেয়েই গেছি তখন অসভ্যের মতন কাজটাও করে ফেলি।
এই বলেই তিনি আমার মাথা থেকে খপ করে ওড়না ফেলে দিয়ে এক ঝটকায় চুলের খোঁপা খুলে ফেললেন। তার কাজে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। তিনি ধীরে ধীরে আমার আরও কাছে এগিয়ে আসলেন। আমি ভীরু চোখে তাকে দেখছি! কী করতে চাইছেন তিনি?
.
#চলবে …..
.