#ভালোবাসি_বলেই_তো ♥️
লেখিকা – #আদ্রিয়া_রাওনাফ
পর্ব – ৫০ ( অন্তিম পর্ব )
৬ বছর পর ,
কাল পূর্ণতার এম.বি.এস এর রেজাল্ট হবে । পূর্ণতা ভয়ে ভয়ে আছে । আবরন ও সাথে নেই । আবরন লন্ডন গিয়েছে এফ.সি.পি.এস. ডিগ্ৰি আনতে প্রায় ২ বছর হয়ে গেল । এই মাসেই ব্যাক করার কথা । কিছু কাজ আছে হাতে তা সেড়েই চলে আসবে জানিয়েছে ।
পূর্ণতা আধিরা আনজুম আর শাদমান চৌধুরীর সাথে আবরনদের বাসায় ই থাকে বেশিরভাগ সময় । তবে গতকাল নিজের বাসায় এসেছে । এখন ওরা ধানমন্ডিতে কেনা নতুন ফ্ল্যাট বাসায় থাকে ৩ বছর যাবত । ২ বছর আগেই আফতাব উজ্জামান একবারের জন্য দেশে চলে এসেছেন । এখন জিব্রান ফ্রান্সের ব্যবসায়ের সকল দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়েছে । তবে ৬ মাস পরপর এসে কিছুদিন থেকে যায় দেশে ।
সন্ধ্যা বেলা ,
পূর্ণতা নিজের রুমে বসে আছে । ওর রেজাল্টের চিন্তায় মাথা ব্যথা করছে । তাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । এরই মধ্যে একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলের কন্ঠ শোনা গেল ,
– পূর্ণ মা , পূর্ণ মা ! তোমাল শলিল তা কি খালাপ ??
পূর্ণতা বুঝলো ওর রুমে ছোট্ট যাইফ সোনা এসেছে । পূর্ণতা চোখ খুলে দেখল যাইফ গুটি গুটি পায়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে ।
পূর্ণতা হেসে যাইফকে বলল ,
– না সোনা … আমার একটু মাথা ব্যথা করছে । তুমি এসো , এখানে বসো আমার সাথে ।
যাইফ বিছানায় উঠে ওর পাশে বসে ওর শরীরের সাথে হেলান দিয়ে বলল ,
– দানো , আম্মু আমাকে ধপক দিয়েছে !
পূর্ণতা বলল ,
– আমার ছোট্ট মিষ্টি যাইফকে ধমক দিয়েছে ! আমি ভাবিকে বকে দেব , ওকে ?
যাইফ মাথা নেড়ে “ওকে” জানালো ।
– তা কেন যাইফ সোনাকে তার আম্মু ধমক দিয়েছে ?
যাইফ বলল ,
– পাথের বাছায় চবাই বন্দুরা একসাতে খেলে । আমি দেতে তেয়েছি , আমাকে দেতে দেয় নি । বয়ো তো পূর্ণ মা , আমি কার সাতে খেলবো ?
পূর্ণতা বলল ,
– হুম , তাহলে এই ঘটনা । আমার যাইফ সোনা খেলার সাথী পাচ্ছে না !
– হুম ।
– আচ্ছা , আমি দেখছি কি করা যায় !
এরই মধ্যে পূর্ণতার ফোনে ম্যাসেজ এলো । পূর্ণতা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল আবরন ম্যাসেজ করেছে । ম্যাসেজে লেখা , ল্যাপটপ সামনে নাও , ভিডিও কল দিচ্ছি ।
পূর্ণতা ফোনটা সাইড টেবিলে রেখে ল্যাপটপ টা সাইড টেবিল থেকে নিয়ে ওপেন করে অন করতে করতে যাইফকে বলল ,
– এখন তোমার পাপ্পা কল দিবে ? তুমি কথা বলবে ?
যাইফ মাথা নেড়ে ‘হু’ জানালো ।
এরই মধ্যে আবরন কল দিল । পূর্ণতা ল্যাপটপ টা সুন্দর করে সেট করল যেন ওকে আর যাইফকে দেখা যায় । তারপর কলটা রিসিভ করতেই আবরনকে দেখা গেল । আবরন পূর্ণতা আর যাইফকে একসাথে দেখে বলল ,
– কি খবর ছটু ?
যাইফ বলল ,
– বালো না পাপ্পা !
আবরন মন খারাপ করে বলল,
– কেন ? কি হয়েছে আমার পাপ্পার ?
যাইফ মন খারাপ করে বলল ,
– আমাল কোনো খেলার মানুত নেই । চবাই খেলে পাতের বাতায় বন্দুরা মিলে , আমাকে আম্মু দেতে দেয় না ।
আবরন বলল ,
– আচ্ছা , তুমি কষ্ট পেও না । তোমাকে শুধু আর একটা বছর কষ্ট করতে হবে । তারপর যখন তোমার পূর্ণ মার একটা বেবি হবে তখন তুমি সেই বেবিটার সাথে খেলা করবে কেমন ??
পূর্ণতা আবরন এর কথা শুনে হাসল ।
যাইফ বলল ,
– থেলে বিবি নাকি মেয়ে বিবি ?
আবরন বলল ,
– তোমার কোনটা লাগবে বলো ?
যাইফ একটু ভাবনার একটিং করে বলল ,
– এত্তা মেয়ে বিবি নাগবে ।
পূর্ণতা আর আবরন হেসে উঠল ওর কথা শুনে । আবরন বলল ,
– ওকে , তোমার জন্য তোমার পূর্ণ মা আর আমি মিলে হসপিটালে গিয়ে একটা মেয়ে বেবি কিনে আনবো । ওকে ?
– ওকে পাপ্পা ।
তারপর খুশি হয়ে হাত দিয়ে ফ্লাইং কিস দিতে দিতে বলল ,
– লাব উ পাপ্পা !
আবরন হেসে বলল ,
– লাভ ইউ ঠু সোনা ।
যাইফ বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল ,
– আমি আম্মুকে বয়ে আতি যে আমাল দন্য বন্দু কিনে আনবে আমাল পূর্ণ মা আর পাপ্পা মিলে !
এই বলে খুশি হয়ে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ।
পূর্ণতা বলল ,
– পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে যাইফ , আস্তে যাও সোনা ।
আবরন বলল ,
– এটা পুরোই ভাইয়ার ডুপ্লিকেট হয়েছে ।
– হু , আর গায়ের রং পেয়েছে তার দাদীজানের মতো ।
আবরন হেসে বলল ,
– আমি আসলে তারপর ওর জন্য একটা মেয়ে বেবির ব্যবস্থা করবো তুমি আর আমি মিলে , কেমন ?
পূর্ণতা লজ্জা পেয়ে বলল ,
– ধুর , সেটা আপনি আসলে দেখা যাবে । এখন শুনুন !
– হুম । শুনছি ।
– আমার খুব ভয় লাগছে । এই মূহুর্তে আপনার উচিত ছিল আমার সাথে থাকা ।
আবরন বলল ,
– ভয়ের কি আছে ? অন্যান্য সব এক্সামে যখন ভালো করেছো , এটাতেও ভালো করবে , ইনশাআল্লাহ ।
পূর্ণতা মন খারাপ করে বলল ,
– তবুও , আপনি সাথে থাকলে আমার একটু ভয় টা কম লাগে ! আপনি কবে আসবেন ?
– আমার কিছু কাজ এখনো বাকি ! মেইবি আরো ১-২ সপ্তাহ লাগবে সময় !
– প্রতিদিন কথা বলেন তবুও কেন যেন মনে হয় আপনি ছাড়া আপনার রুমটা পরিপূর্ণ হয় না । আপনার রুমটাতে একা থাকতে ভীষন কষ্ট হয় জানেন !
– আচ্ছা , আমি যত দ্রুত পারি চলে আসবো । তুমি প্লিজ এভাবে বলো না । আমিও তো তোমাকে কতদিন জড়িয়ে ধরি না , আমারও বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তোমাকে ছাড়া ।
পূর্ণতার চোখ ছলছল করে উঠল আবরনের কথা শুনে । তারপর আর নিজের বুকের চাপা কষ্ট গুলো আটকাতে না পেরে চোখের কোটরে জমা পানি গুলো ফেলে বলল ,
– আমাকেও যখন এফ.সি.পি.এস. করতে ওখানে যেতে হবে তখন আমি কিছু জানি না , আপনিও আমার সাথে যাবেন ।
আবরন বলল ,
– আচ্ছা , আই প্রমিজ সবসময় তোমার সাথেই থাকবো , তুমি যেখানেই যাও না কেন ! ওকে ? নাউ প্লিজ , ডোন্ট ক্রাই । নাহলে কিন্তু আমার কাজ ফেলে এখনই তোমার কাছে ছুটে যেতে মন চাইবে ।
পূর্ণতা চোখ মুছে বলল ,
– হু । আমি যখন রেজাল্ট আনতে যাবো তখন কি আপনি আমার সাথে লাইনে থেকে কথা বলতে পারবেন ? তাহলে অন্তত মনে হবে যে আপনি সাথে আছেন !
– সরি ! তখন তো আমাকে ইউনিভার্সিটি তে যেতে হবে । আই ডোন্ট থিংক সো , আই উড জয়েন ।
পূর্ণতা মন খারাপ করল ।
আবরন বলল ,
– তুমি এমন করলে তো আমার পড়ায় মন বসবে না ।
পূর্ণতা জোরপূর্বক একটু হাসি দিয়ে বলল ,
– হুম , ঠিক আছে । রাখছি তাহলে । ভাবির সাথে গিয়ে একটু কথা বলি , তাহলে যদি একটু ডিপ্রেশন থেকে বের হতে পারি ।
– আচ্ছা , যাও তাহলে । রাখছি । নিজের খেয়াল রেখো , আর বেশি চিন্তা করো না । সব ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ । আল্লাহ হাফেজ ।
– আল্লাহ হাফেজ ।
পূর্ণতা আবরনের সাথে কথা শেষ করে জিব্রানের রুমে গেল । ঐ রুমে নাদিরা আর যাইফ থাকে ।
রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ণতা দরজায় নক করে বলল ,
– ভাবি , আসবো ?
নাদিরা রুম গোছাচ্ছিল । পূর্ণতাকে দেখে বলল ,
– একটা মাইর দেব । কতবার নিষেধ করেছি যে আমার রুমে আসার আগে পার্মিশন চাইবি না , সোজা ঢুকে বিছানায় বসে পড়বি । তা না , এসে সে পার্মিশন চায় ।
পূর্ণতা হেসে ভেতরে ঢুকে নাদিরা কে জড়িয়ে ধরে বলল ,
– আমার লক্ষী ভাবি । ভাইয়া শিখিয়েছে কারো রুমে হুট করে না ঢুকে তার কাছে পার্মিশন চেয়ে তার রুমে প্রবেশ করতে ।
নাদিরা পূর্ণতার গাল চেপে দিয়ে বলল ,
– পুচকি , সেটা পরের রুমে ঢুকতে গেলে , আপনজনের রুমে না ।
পূর্ণতা বলল ,
– আচ্ছা , চেষ্টা করবো ।
নাদিরা পূর্ণতা কে বিছানায় টেনে বসিয়ে বলল ,
– হাসির কথা শোনো ।
– হুম , বলো ।
– যাইফ এসে আমাকে বলছে যে পাপ্পা বলেছে , পাপ্পা আর পূর্ণ মা মিলে আমার জন্য মেয়ে বেবি বন্ধু এনে দেবে । ও এতো খুশি হয়ে বলছিল যে তোমাদের মেয়েকে ওর ভবিষ্যত বউ বানাবে ।
পূর্ণতা হাসল । হেসে ঘুমন্ত যাইফের দিকে তাকালো ।
নাদিরা বলল ,
– তা আবরন কবে আসছে ?
– আরো নাকি ১-২ সপ্তাহ সময় লাগবে ।
– মন খারাপ করছো কেন ?
– কাল এত বড় একটা ইমপরটেন্ট দিন আমার লাইফের আর সাথে উনি ই নেই । একটু কষ্ট তো হচ্ছে । আর ভয় ও লাগছে ।
নাদিরা পূর্ণতার কাধে হাত রেখে বলল ,
– সাহস রাখো মনে । আমি যাবো তোমার সাথে । ভয় পেয়ো না ।
পূর্ণতা খুশি হয়ে বলল ,
– সত্যি বলছো ??
নাদিরা বলল ,
– হুম , সত্যি ।
পূর্ণতা খুশি হয়ে নাদিরা কে জড়িয়ে ধরে বলল ,
– থ্যাংক ইউ ভাবি ।
নাদিরাও ওকে হেসে জড়িয়ে ধরে বলল ,
– ওয়েলকাম ।
…………………………………………………
পূর্ণতার কোনো ভাবেই এ বাসায় মন টিকছে না । কারন ঐ বাসায় থাকলে অন্তত আবরনের বিছানায় ঘুমালেও একটু তৃপ্তি লাগে । আর এ বাসায় আবরনের কোনো কিছুই নেই । তাই ৮ টার দিকে সবাইকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে আবারও বেরিয়ে গেল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল এরিয়ার উদ্দেশ্যে অর্থাৎ আবরনদের বাসার উদ্দেশ্যে ।
রাত সাড়ে ৮ টায় পূর্ণতা বাসায় এসে পা রাখল । রাস্তায় জ্যাম থাকায় আসতে দেড়ি হলো । আধিরা আনজুম বললেন ,
– আম্মু , চলে এলি যে ?
পূর্ণতা আধিরা আনজুম কে বলল ,
– তোমাদের ছাড়া ভালো লাগে না ।
আধিরা আনজুম হেসে বলল ,
– আমার লক্ষী মা , যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে । আমি ডিনার সাজাচ্ছি ।
– না আম্মু , তুমি রেষ্ট করো । আমি ফ্রেশ হয়ে এসে সব সাজাচ্ছি । আব্বু তো বাসায় নেই তাই না ।
– হুম । রাত হবে আরো আসতে ।
– ওও । আব্বু কি এসে ডিনার করবে ?
– না , ডিনার করেই আসবে ।
– তারমানে শুধু তুমি আর আমি ।
– হু । তুই যা তো, ফ্রেশ হয়ে নে । তারপর দুজন একসাথে ডিনার করে নিব ।
– আমার খাবার আছে তো ?
আধিরা আনজুম বললেন ,
– আছে । তুই যা ।
পূর্ণতা হেসে চলে গেল নিজের রুমের দিকে । নিজের রুম অর্থাৎ আবরনের রুম । রুমটাতে থাকলেই ওর আবরনের অপূর্ণতা একটু হলেও কম মনে হয় ।
ডিনার সেড়ে পূর্ণতা আধিরা আনজুম কে বলল ,
– আম্মু , আমার তো কাল রেজাল্ট । তুমি কিন্তু ভালো মতো দোয়া করো ।
আধিরা আনজুম পূর্ণতার মাথায় হাত রেখে বলল ,
– দোয়া চাইতে হবে না পাগলি । বাচ্চাদের ভালোর জন্য মা সবসময় ই দোয়া করে । আমি ও দোয়া করি যেন তোরা অনেক খুশি থাকতে পারিস ।
পূর্ণতা আধিরা আনজুম কে জড়িয়ে ধরে বলল ,
– এই যে এত এত ভালোবাসো তুমি , এই জন্যই তো তোমাদের ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না ।
আধিরা আনজুমও হেসে পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল ,
– তোকে তো ভালোবাসবোই , তুই ই তো আমার মেয়ে । আমার তো আর কোনো মেয়ে নেই ।
– হুম ।
…………………………………………………
পূর্ণতা আবরনের স্মৃতি গুলো সাথে নিয়ে বিছানায় ঘুমাতে চেষ্টা করছে ,কিন্তু ওর কোন ভাবে ঘুম আসছে না । শুধু শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে এপাশ ওপাশ করছে ।
রাত ১ টা বেজে গিয়েছে ,
পূর্ণতার তবুও ঘুম আসছে না । তাই ঘুম থেকে উঠে ডিপ্রেশন থেকে রেহাই পেতে তাহাজ্জুদ নামাজ টা আদায় করে নিল । তারপর আবারও বিছানায় শুতেই দেখল ঘুমে চোখটা লেগে আসছে । মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে ঘুমে তলিয়ে গেল আবরনের ছবি , ওর দেওয়া কিছু উপহার সাথে নিয়েই ।
মাঝ রাত ,
ঘুমের মাঝেই পূর্ণতার মনে হচ্ছে আবরন চলে এসেছে । চোখ খুললেই হয়তো ওকে নিজের পাশে দেখতে পারবে । ওর ফিল হচ্ছে আবরন ওর গালে স্লাইড করছে । পূর্ণতার মনে হচ্ছে ও ঘুমের মাঝেই স্বপ্ন দেখছে তাই চোখ খুলতে চাইছে না । কখনো কখনো হয়তো বাস্তবতার চাইতে স্বপ্নই ভালো । তাই পূর্ণতা চোখ বন্ধ করেই ঘুমাচ্ছে । ঘুমের মাঝেই আবারো মনে হচ্ছে আবরন ওকে বলছে ,
– আমি চলে এসেছি পূর্ণ ! তুমি দেখবে না আমায় ! এত ঘুউউউম ? একবার তাকিয়েই দেখো , আমি সত্যি চলে এসছি ।
পূর্ণতার মন চাইছে ঘুম থেকে জেগে যেতে কিন্তু জেগে গেলেই তো স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে আর আবরন ও চলে যাবে । তাই না তাকিয়ে ঘুমিয়েই রইল ।
আবরন এবার পূর্ণতা কে নিজের বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে ওর কপালে চুমু একে দিয়ে বলল ,
– সারপ্রাইজ দিব ভাবলাম , আর তুমি ঘুমিয়ে আছো ।
পূর্ণতা কপালে এবার হয়তো সত্যিই আবরনের চুমু ফিল করলো আর সারপ্রাইজের কথা শুনে আরো এক্সাইটেড লাগছে । পূর্ণতা সম্পূর্ণ জাগনা কিন্তু চোখ খুলছে না । ওর মনে একটাই ভয় , চোখ খুললেই যদি আবরন হারিয়ে যায় ।
পূর্ণতা চোখ না খুলেই ওর পাশে আবরন আছে কিনা শিওর হতে পাশে হাত রাখল । হাত রাখতেই চমকে গিয়ে চোখ না খুলে বলল ,
– আপনি সত্যি এসেছেন ? নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি ?
আবরন বলল ,
– সত্যি ই এসেছি । চোখ খুলছো না কেন ?
– না , এটা আমার স্বপ্ন । আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি তাই তো অবাস্তব ঘটনা ঘটছে । আপনার তো আরো ১-২ সপ্তাহ পর আসার কথা ছিল । আপনি আসেন নি । আমি স্বপ্ন দেখছি । আমি তাকাবো না । চোখ খুললেই ঘুমের সাথে স্বপ্ন ভেঙে যাবে ।
আবরন পূর্ণতার গালে স্লাইড করতে করতে বলল ,
– এখন কি করলে তুমি বুঝবে যে আমি সত্যিই এসেছি ?
– জানি না ।
আবরন বলল ,
– ওকে , আমি জানি কি করলে তুমি বিশ্বাস করবে !
– তাহলে অপেক্ষা করছেন কেন ? জলদি করুন , তাহলে হয়তো আমি শিউর হবো আপনি আমার স্বপ্নে না বাস্তবেই এসেছেন ।
আবরন হেসে বলল ,
– তুমি রেডি পূর্ণতা ?
– হুম ।
আবরন পূর্ণতার একদম কাছে গিয়ে ওর ঠোঁট জোড়া নিজের দখলে নিয়ে নিল । পূর্ণতা আবরনকে শক্ত করে চেপে ধরল । ওর বুঝতে বাকি নেই আবরন সত্যিই এসেছে ।
আবরন পূর্ণতা কে ছেড়ে দিয়ে বলল ,
– কি এবার বিশ্বাস হলো ?
পূর্ণতা আবরনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল ,
– আমি তাকালে আপনি চলে যাবেন না তো ??
আবরন পূর্ণতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল ,
– উহু , আমি তোমাকে প্রমিজ করছি , আর কখনো তোমাকে একলা ফেলে রেখে কোথাও যাবো না । এখন একটু তাকিয়ে দেখো । আই প্রমিজ এটা স্বপ্ন না , সত্যি ।
পূর্ণতা আবরনের কথা শুনে এবার চোখ খুলে তাকাতেই দেখল সত্যিই আবরন এসেছে ।
আবরন পূর্ণতা কে তাকাতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল ,
– কি বিশ্বাস হলো ?
পূর্ণতা হেসে আবরনকে বলল ,
– আপনি তারমানে সত্যিই এসেছেন ।
– হুম ।
পূর্ণতা আবরনের বুকে কিল ঘুষি মেরে বলল ,
– আপনি একটা বাজে লোক ! আমাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে সবসময় আগে কষ্ট দেন ।
– এটা কোনো কষ্ট হলো । আর কষ্টের ফল মিষ্টি হয় জানো না !
– হুম । আপনি তারমানে ইচ্ছে করেই বলেছেন যে আপনি আরো পরে আসবেন ।
আবরন হেসে বলল ,
– হুম । আমার বউ এর এত বড় একটা দিন কাল , আর আমি না এসে পারি ?
– আপনি কখন রওনা করেছেন ?
– লাস্ট তোমার সাথে কথা বলেই । আমি সব ব্যবস্থা করেই রেখেছিলাম ।
পূর্ণতা বলল ,
– ওকে । এখন ঘুমাই । আমার ঘুমটা নষ্ট করে দিয়েছেন । কাল আবার সকালে বের হতে হবে । এখন আর কথা বলবেন না । ঘুমান ।
আবরন বলল ,
– এখন ঘুমালে যাইফের জন্য মেয়ে বেবির ব্যবস্থা করবো কি করে ?
পূর্ণতা বলল ,
– চুপ , একদম এখন এসব বলবেন না । এত বছর পর এসেছেন । আমাকে আপনার বুকে মাথা রেখে শান্তির ঘুম ঘুমাতে দিন । আর কথা ঘুরাবেন না ।
আবরন হেসে বলল ,
– ওকে , কাল ভালো রেজাল্টের খুশিতে রাতে তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি উপহার টা দিব । এক ঢিলে দুই পাখি হবে । তোমার গিফট আর যাইফের মেয়ে বেবি ।
পূর্ণতা হেসে আবরনের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল ।
আবরনও পূর্ণতা কে জড়িয়ে ধরেই ঘুম দিল ।
………………………………………………..
সকাল ১০:৩০ টা ,
পূর্ণতার রেজাল্ট বের হবে তাই ওর সাথে আজ সবাই এসেছে । সবাই মিলে দোয়া দুরুদ পড়ছে আর এদিকে পূর্ণতা ভয় পেয়ে আবরনের হাত শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে । আবরন ওকে বার বার বোঝাচ্ছে , সব ঠিক ভাবে হবে । তুমি চিন্তা করো না । কিন্তু কে শোনে কার কথা ।
মাইকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বার্তা শেষ করে অবশেষে রেজাল্টের পালা । পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে আল্লাহ কে ডাকছে ।
প্রথম ২০ জনের নাম মাইকে এনাউন্স করা হবে । ২০ তম স্থান অধিকারীর নাম থেকে এনাউন্স করতে করতে ১ম স্থান অধিকারী নাম এর দিকে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে । আর তিন জনের নাম বলা বাকি । পূর্ণতা বলল ,
– আমার নাম তো এখনো এলো না ।
আবরন বলল ,
– এই তিনের মধ্যে আছো , দেখে নিও ।
– জানি না আমি । ভয় হচ্ছে ।
অবশেষে আরো দুইজনের নাম এনাউন্স করতেই পূর্ণতা বলল ,
– আমি কখনোই ১ম হবো না । আমি ২০ এর মধ্যে নেই ।
এই বলে ছল ছল চোখ নিয়ে আবরনের দিকে তাকাতেই মাইকে শোনা গেল ,
– পূর্ণতা জামান ! আমাদের পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকারী স্টুডেন্ট এর নাম পূর্ণতা জামান । পূর্ণতা কে স্টেজে আসার জন্য অনুরোধ করা হলো ।
সবাই জোরে হাত তালি দিচ্ছে । আর এদিকে পূর্ণতার যেন বিশ্বাস ই হচ্ছে না ।
আবরন বলল ,
– congratulations ! মিস পূর্ণতা জামান । আপনি আর সময় নষ্ট না করে জলদি স্টেজে চলুন ।
পূর্ণতা খুশিতে কান্না করে আবরনকে বলল ,
– আমি কি স্বপ্ন দেখছি আবরন ?
আবরন পূর্ণতার চোখ মুছে দিয়ে বলল ,
– উহু । এটা স্বপ্ন না পূর্ণতা ! এটা তোমার স্বপ্ন পূরন হয়ে বাস্তবতায় পূর্ণ হয়েছে । দেড়ি করো না । যাও পূর্ণতা , যাও । আজ তোমার সবচেয়ে বড় খুশির দিন । তুমি উড়ো পূর্ণতা ! তুমি উড়ো ।
পূর্ণতা খুশি হয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেল । স্টেজে উঠতেই ম্যাডেল পড়িয়ে ওর হাতে ক্রেস্ট আর সার্টিফিকেট তুলে দেওয়া হলো । তারপর ওর ছবি তুলতেই সবাই জোরে হাত তালি দিয়ে উঠল ।
পূর্ণতার দিকে মাইক এগিয়ে দিয়ে বলল ,
– আজকের দিনে বলার মতো কিছু আছে কি ? তাহলে বলুন ।
পূর্ণতা বিনয়ের সাথে মাইকটা হাতে নিয়ে প্রথম সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিল । তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে শুরু করলো ,
– আমার এই দিনটা একসময় স্বপ্নের মতো ছিল আমার কাছে । কিন্তু এই স্বপ্নটা বাস্তবতায় রূপ দিতে সবার প্রথম আমাকে সাহায্য করেছে আমার মা এবং বাবা । তাদের প্রতি আমার সম্মান ও শ্রদ্ধা আজ আরো ১০ গুণ বেড়ে গেল । তবে আমার জীবনে বড় হওয়ার সাথে সাথে সকল অন্যান্য শিক্ষা গুলো আমি পেয়েছি আমার ভাইয়ার কাছে । আজ ভাইয়া এখানে নেই , ও ফ্রান্সে আছে । তাই খুব মিস করছি ভাইয়াকে । খুব মিস করছি । কিন্তু মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর আমার জীবনটাকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে আমার হাজবেন্ড জনাব ডাঃ শাহরিদ আহনাফ আবরন । উনিও বর্তমানে একজন সনামধন্য ডাক্তার , নিউরোলজিক্যাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট । আমার স্বপ্নটা বাস্তবতায় রূপ দিতে আমাকে যত দিক থেকে সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন সব আমি পেয়েছি আমার হাজবেন্ড ও আমার শশুর বাড়ির দিক থেকে । আমার শশুর আমার আরেকজন বাবা । আর আমার শাশুড়ি সে আমার আরেকজন মা । সবার ভালোবাসা, দোয়া আর সাপোর্ট পেয়েই আজ আমি এই স্থানে । আমি চাই আমার ফুল ফ্যামিলির জন্য একটা জোরে হাত তালি দেয়া হোক ।
সবাই স্বজোরে হাত তালি দিয়ে উঠল । পূর্ণতা চোখের পানি ফেলে বলল ,
– আর বেশি কিছু বলবো না । সবার কাছ থেকে দোয়া চাইছি যেন আমিও একজন সৎ ডাক্তার হয়ে দেশের জন্য সেবা করতে পারি । আর আমি যেন আমার ফ্যামিলি নিয়ে হ্যাপী থাকতে পারি সেই জন্যও দোয়া চাইছি । সবার সুস্থতা কামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি । ধন্যবাদ ।
পূর্ণতা স্টেজ থেকে নেমেই খুশি হয়ে সবাইকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ।
আবরন বলল ,
– আমি বলেছিলাম না , তুমি ভালো করবে ।
পূর্ণতা আবরনকে জড়িয়ে ধরেই কান্না করে দিল । এটা খুশির কান্না ।
সবাইকে জড়িয়ে ধরে ধরে পূর্ণতা কাদল ।
আবরন অবশেষে বলল ,
– অনেক হয়েছে কান্নাকাটি । এখন চোখ মুছো । আজ আমি সবাইকে নিয়ে গিয়ে ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করাবো । এটা আমার পক্ষ থেকে সবার জন্য ট্রিট ।
সবাই খুশি হলো ।
সবাই মিলে দুপুরে লাঞ্চ সেরে আজ আবরনদের বাসায় যাচ্ছে । আজ সবাই ঐ বাসায় থাকবে । ঘরেও রাতের জন্য রান্না বান্না হবে । দুই মা তাদের ছেলে ফিরে আসায় এবং মেয়ের জীবনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আজ একসাথে সব মজার মজার খাবার রান্না করবে ।
এদিকে বাসায় আয়মান-প্রেনা , ফাহিম – রুহি , তাসিন – নীরা সবাই এসেছে । সবাই এখন বিবাহিত । তাই সব কাপলরা আজ একসাথে আবরনদের বাসায় ডিনার করবে খুশিতে এবং আনন্দে ।
সবাই মিলে গল্প স্বল্প সেড়ে অবশেষে ডিনার শেষ করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে পূর্ণতা রুমে রেস্ট করছিল । আবরন সবার সাথে কথা বার্তা শেষ করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখল পূর্ণতা হেলান দিয়ে বসে আছে খাটে । আবরন দরজা লাগিয়ে ওর পাশে বসে বলল ,
– শরীর খারাপ ?
পূর্ণতা হেসে আবরনের কাধে মাথা রেখে বলল ,
– উহু । আজকের দিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে খুশি ও আনন্দের দিন ছিল । এই খুশি যেন চিরস্থায়ী হয় । এখন সেই কামনা ই করি ।
– হুম ।
এরই মধ্যে দরজায় টোকা পড়ল ।
পূর্ণতা বলল ,
– কে ?
দরজার ওপাশ থেকে ছোট্ট যাইফের কথা শোনা গেল ।
– পূর্ণ মা , আমি । এত্তা কতা বলতে এসেচি ।
পূর্ণতা আবরনের দিকে হেসে তাকিয়ে দরজা খুলতেই যাইফ গুটি গুটি পায়ে রুমের ভেতরে ঢুকে বিছানায় আবরনের কোলে গিয়ে বসে বলল ,
– তোমলা আমাল জন্য মেয়ে বিবি এনেচো ?
পূর্ণতা হেসে আবরনের পাশে বসলো । আবরন যাইফের গাল টিপে বলল ,
– তোমার এখনো মনে আছে যে তোমার একটা মেয়ে বেবি লাগবে ?
– আচে তো । একন বয়ো , ককন দেবে আমাকে ?
আবরন হেসে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলল ,
– এই তো আজ ই ব্যবস্থা করছি । খুব শীঘ্রই তোমাকে এনে দেব মেয়ে বেবি ।
– ওকে । তালাতালি কলো ।
আবরন বলল ,
– ওকে , তুমি তাহলে যাও । আমরা ব্যবস্থা করছি । নাহলে আবার দেড়ি হয়ে যাবে ।
যাইফ আবরনের কোল থেকে উঠে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ।
পূর্ণতা দরজা লাগিয়ে বলল ,
– কি বলেন পিচ্চিটাকে ?
আবরন শুতে শুতে বলল ,
– যেটা সত্য সেটাই তো বললাম । তুমি এখন লাইট অফ করে শুতে এসো ।
পূর্ণতা লাইট অফ করে বিছানায় আবরনের পাশে শুতেই আবরন ওকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল ,
– আর ইউ রেডি ফর দ্য মোস্ট এক্সপেনসিভ গিফট ??
পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসল । আবরন হেসে বলল ,
– ওকে । আ’ম প্রিটি শিউর ইউ আর রেডি ।
এই বলে পূর্ণতা কে আজ সবচেয়ে দামি গিফটটা দিতে ওকে সম্পূর্ণ ভালোবাসার ছোঁয়া দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল । আর পূর্ণতা ও আবরনের কাছ থেকে সেই উপহার আর ভালোবাসা নিতে সম্মতি জানিয়ে ভালোবাসার সাগরে ডুব দিল ।
#সমাপ্ত ♥️