ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ২৭

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ২৭

বারান্দার রেলিঙ বরাবর জোড়া শালিক দেখে সবুজ বেশ খুশিমনে মিমের দিকে তাকায়। জোড়া শালিক দেখলে নাকি দিনটা ভালো যায়, অবশ্য এটা ওর মায়ের ধারণা।
” এই শোননা।”
মিম আহ্লাদি সুরে কফিতে চুমুক দিতে দিতে সবুজের দিকে তাকায়।
” হুম বলো।”
সবুজ মুচকি হাসি দিয়ে মিমের দিকে তাকায়।
” দেখো আমার মনে হয় আমাদের কোথাও ঘুরে আসা উচিৎ। আসলে সেভাবে বলতে গেলেতো হানিমুনটা হলোই না। একটা রিফ্রেশমেন্ট এরতো দরকার আছে নাকি?”
মিম কথাটা বলেই উৎসুক দৃষ্টিতে সবুজের দিকে তাকায়।
সবুজ ভ্রুকুচকে মিমের দিকে তাকায়।
” আমি আছি জ্বালায়, আর ম্যাডাম আছে হানিমুন নিয়া।” সবুজ বিড়বিড় করে বলে উঠলো।
আগেরবার হানিমুনে যাওয়ার কথা মনে হতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় যা কাহিনী করেছিলোরে বাবাহ্। সোজাতো হয় তবে সব একদম দেয়ালে পিঠ ঠেকার পরে। এই মেয়েটা ওকে যে জীবনেও আর শান্তি দিবেনা এ বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।

” কি হলো এত কি ভাবছো?
আচ্ছা বাই এনি চান্স তুমি কি যায়গা সিলেক্ট করতে বসে গেছো। ”

” আজ্ঞে না ম্যাম। আমাকে কি পাগলা কুত্তায় কামড়েছে যে আপনার সাথে হানিমুনে যাওয়া লাগবে।”

” কি বললে তুমি?”
মিম রেগেমেগে বিছানায় বসে পড়ে।
ধুর মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল। ওর আর কি এমন দোষ এত মানসিক প্যারায় থাকলে কি! আর মাথা ঠিক থাকে।
সবুজ বিছানায় গিয়ে পেছনথেকে মিমকে জাপটে ধরে।
” কিগো রাগ হয়েছে খুব।”

” সরো আর কপট ভালোবাসা দেখাতে হবেনা।”
মিম সবুজের হাত যত ছাড়িয়ে দিতে লাগলো, সবুজ তত শক্ত করে জাপ্টে ধরে থাকলো।
একসময় মিম হাল ছেড়ে দিয়ে নিশ্চুপ বসে থাকলো।
“আচ্ছা তুমি কি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছো? ”
মিম সবুজের দিকে পেছন ঘুরে তাকায়।
” কিসের অবস্থা? ”
” দেখো আমার একটা ফ্যামিলি আছে তাদের সবারো আমার প্রতি ডিমান্ড রয়েছে। ছেলে হিসেবে সেগুলো ফুলফিল করাটা আমার দায়িত্ব। আমি চাইলেই সব এড়িয়ে যেতে পারিনা।”
মিম সবুজের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মুখ ফসকে বলে উঠে,
“হ্যা আমিতো তোমাকে আটকে রাখিনি? তোমার কোন কাজে বাধা দেইনি। আমিতো তোমাকে বলেছিই তুমি ফিরে যাও।”
সবুজ মিমকে ধমকিয়ে উঠে,
” জাস্ট সেট আপ। কথার মাঝখানে একদম কথা বলবোনা। অবুঝের মত কথা বলো কি করে। ননসেন্স! ”
মিম চুপসে যায়।
” বুঝতে পারছো আমি বাসায় তোমার কথা বলতে পাচ্ছিনা। এইভাবে একবার বাসায় আবার তোমার বাসায় এই করতে করতে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি। দুই দিক সামলানো আমার পক্ষে কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মা বাবা আমাকে কি ভাবছে বুঝ তুমি? আমি রাতে কোথায় থাকছি? এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তারা কি ভাবছে তোমার কোন আইডিয়া আছে। আমি কতোটা নিচে নেমে গেছি বুঝতে পারছো? কোন সেন্স আছে তোমার?
রিসেন্ট তারা আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছে! বুঝতে পারছো দিনদিন সিচুয়েশনটা কতোটা কঠিন হচ্ছে।
তুমিই বলো আমার কি করা উচিৎ। আ’ম হেল্পলেস!”
সবুজ কপাল ভাজ করে বসে থাকলো।
” তুমি বিয়ে করে নাও। আর এখান থেকে চলে যাও।”
মিম কথাটা বলেই উঠে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সবুজ ওর হাত খপ করে ধরে ফেলে।
চক্ষু বিস্ফোরিত করে মিমের চোখের দিকে তাকায়। মনে হচ্ছে দুচোখের অগ্নি দিয়ে চারপাশটা এক্ষুনি ভষ্ম করে দিবে।
” তোমার কোন আইডিয়া আছে এক্ষুনি তুমি যে কথাটা বললে?”
” হ্যা যা বলেছি ঠিকি বলেছি।”
সবুজ মিমের হাত শক্ত করে মোচড়াতে থাকে।
মিম ব্যাথায় কেকিয়ে উঠলো।
” উঁহু লাগছে ছাড়ো। ”
” লাগবে বলেইতো ধরেছি। এমনি এমনিতো কিছু করিনি। আমি কি করব না করব তুমি বলার কে? আমাকে কষ্ট দেয়ার রাইট তোমাকে কে দিয়েছে। অ্যান্সার মি?”
” আমি কাউকে কোন কষ্ট দেইনি এবার ছাড়ো প্লিজ।”
” ব্যাগ গুছাও এক্ষুনি তুমি আমার সাথে যাবে। এই বিষয়ে আর একটা কথাও আমি বলবোনা।”
” তোমার সাহস হয় কি করে আমার সাথে জোড় খাটানোর?আমি যাচ্ছি না এটাই ফাইনাল। তোমার যা খুশি করতে পারো।”
” তুমি কি সারাজীবন ঘাড় ত্যাড়ামি করেই চলবে। জীবনে বুঝবে না কিছু। এত ইগো কেন তোমার?”
” আমার ইগো নাহ্। আচ্ছা বলোতো আমাকে বিশ্বাস না করে মেঘের কথা সবাই কেন বিশ্বাস করলো বলতে পারো? আমি খুব খারাপ তাই আমি একাই থাকব। আমি কারো সাথে অ্যাডজাস্ট করে থাকতে পারব না।”
” সাট আপ, তোমাকে কেউ খারাপ বলেনি আর চলেও যেতে বলেনি। আচ্ছা তোমার সাহস কি করে হলো কাউকে না বলে বাড়ী থেকে এইভাবে চলে আসতে। আমিতো তোমাকে বিয়ে করেছিলাম নাকি, তাহলে তোমার মনে হয়নি আমাকে সবটা জানানোর দরকার।”
সবুজ মিমের হাত ছেড়ে দেয়।
মিম লাল হওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে ব্যাথায় কুকড়াতে কুকড়াতে সবুজের দিকে তাকায়।
” ফোন পিক আপ না করলে আমি কি করে জানাতে পারি বলতে পারো।”
” কেন ফোন করিনি সেই কারণটাও কি তোমাকে নতুন করে জানাতে হবে। এই এত এত ঝামেলা ঘটার পিছনে কি তোমার কোন হাত নেই? তোমার কোন দোষ ছিলোনা। সমস্ত ঝামেলার সুত্রপাততো তুমিই করেছিলে। সেই বিয়ের দিন থেকে মনে পড়ছেনা এখন। তাছাড়া তোমার মনে হয়না মেঘের সাথে তোমার ঢলাঢলিটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো।”
মিম চমকে উঠে সবুজের শার্টের কলার ধরে ঝুকাতে থাকে।
” ছিঃ তুমি আমাকে এইসব বলতে পারলে? আমি মেঘের সাথে ঢলাঢলি করেছি। ছিঃ আমার ঘেন্না হচ্ছে।”
” কলার ছাড়ো। বিরক্ত লাগছে। যা বলেছি একবিন্দুও ভুল বলিনি। সত্যি বললে সবারই গায়ে লাগে।
ভুল সবারই হয়েছে সেই ভুলগুলোকে আঁকড়ে ধরে নয় শোধরাতে জানতে হয়।”
” আমি তোমার সাথে আর একটা কথাও বলতে চাইনা। তুমি আজকে আমার সাথে যা করলে বাকী জীবন মনে থাকবে।”
মিম বিছানায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
কাদুক মন খুলে কাঁদুক সবুজের আজকে আর কোন দায় নেই ওর কান্না থামানোর।
একটাসময় পর দুজনেই বেশ শান্ত হয়ে গেলো।
কিন্তু অভিমানে কেউ কারো সাথে কোন কথাই বললোনা। সবুজের একদমই ভালো লাগছেনা এত ঝগড়ার পর এখানে একমুহুর্ত ও থাকতে। তাছাড়া ও ভেবে পাচ্ছেনা এতগুলো কথা কি করে গড়্গড় করে শুনিয়ে দিলো।
হয়তোবা এতোদিনের চাপা অভিমান সুক্ষ্ম আঘাত পেয়ে লাগামহীন ভাবে বেড়িয়ে এসেছে। সবুজ আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে হনহনিয়ে অন্যমনষ্কভাবে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়।
দোতলার সিড়িতে এলোমেলোভাবে হাটতে হাটতে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই রেলিং ধরে নিজেকে ব্যালেন্স করে নেয়।
” সবুজ, তুমি এখানে? আমি কি ভুল দেখছি।”
নায়রা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়।
চেনা কন্ঠস্বর শুনে সবুজ পেছনে তাকায়,
” তুমি?”
” হ্যা এটাই আমাদের বাসা। কিন্তু তোমার এখানে আসার কারণ? আর যাই হোক আমাকে খুঁজতেতো আসোনি? কুইক কারণটা বলো।”

” নায়রা আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। অন্যদিন কথা বলি।”

” থাক কিছু বলা লাগবেনা তুমি আসতে পারো। ইনফ্যাক্ট তুমিতো আমাকে বন্ধু হিসেবে গণ্যই করোনা। ”
” দেখো নায়রা ব্যাপারটা তা না! তুমি এরকমটা ভেবে কষ্ট পেয়ো না।
আমি মিমকে খুঁজে পেয়েছি। তোমাদের বাসার তিনতলার হাতের ডানদিকের ফ্ল্যাটের মেয়েটাই।”
নায়রার কয়েকসেকেন্ড সময় লাগলো ব্যাপারখানা বুঝতে।
নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে একগাল হাসি টেনে বলে উঠল,
” কনগ্রাচুলেশন। তবে এই বিষয়টা বোধ হয় আমার আরো আগে জানার কথা ছিলো।”

” হয়তোবা। তবে ওকে পেয়ে খুশিতে সব ভুলে গেছিলাম তাই আরকি। নায়রা আমার প্রচণ্ড শরীর খারাপ লাগছে তোমার সাথে অন্যদিন কথা বলি।”
নায়রা হাসিমুখে বিদায় দিলেও অন্তরটা অতিদুঃখে ফেটে যেতে লাগলো।
ইশ আগে কেন এই ইবতিহাজের মাকে ও দেখলোনা। একবার দেখলেইতো চিনে যেত। কোনরকমে বাড়ি থেকে বিদেয় করতে পারলেইতো আজকে এই দিন দেখতে হতো না। ইশ কি ভুলটাই না হলো। সবুজ ওর হাতছাড়া হয়ে গেলো এটা ভাবতেই নায়রা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।
অন্তহীন দুঃখে হাত পা ছাড়িয়ে কাঁদতে বসে গেলো।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here