#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০৫
চৈত্র্যের খাঁ খাঁ করা রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে মিমের মনেও দহন চলতে লাগলো। জোড়া শালিক কোথা থেকে যেন উড়ে এসে, ছাদের দোলনার কর্ণারে বসে কি যেন ঠুকরাতে লাগলো।
মিম কল্পনায় একেঁ নিলো, কোন এক গোধুলী মাখা বিকেলে কফি হাতে সবুজের পাশাপাশি ছাদে বসে থাকলে খুব একটা মন্দ হয়না।
কিন্তু আফসোস এখন ভরদুপুর আর ইদানীং সবুজও ওর নাগালের বাইরে।
“মিম, ভরদুপুরে ছাদে কি করছিস তুই?
মেঘের গলার আওয়াজে মিম পিছন ফিরে তাকায়।
” কিছু না। কাপড় মেলতে এসে একটু দাড়িয়েছিলাম।”
মিম যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
” দাড়া যাসনে, কথা আছে?”
” কি কথা।”
মিম ঘুরেই আবার জিজ্ঞাস করে।
” তোর আর সবুজ ভাইয়ার সম্পর্কটা আসলে কি?”
” মানে কি?”
মিম চমকে উঠে মেঘের দিকে তাকায়।
” মানেটাতো আমিও জানতে চাচ্ছি?
তুই আর সবুজ ভাইয়া একরুমে না থেকে আলাদা রুমে কেন থাকিস।”
” তোমাকে কে বললো?”
মিম অনেকটা থতমত খেয়ে গেলো কথাটা শুনে।
” কালকে রাতে, পানি খাওয়ার জন্য বের হতেই আমি, তোকে তোর রুমে যেতে দেখেছি। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই খটকা লেগেছে। বিষয়টা আরো ভালোকরে বুঝার জন্য আমি না ঘুমিয়ে তোদের ফলো করেছি। তোরা দুইজন দুইরুমে ঘুমিয়ে গেলি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে তুই সকালের দিকে আবার সবুজ ভাইয়ার রুমে গিয়েছিলি। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি, তোরা বাইরে যা দেখাস তা সত্যি নয়..
কি ঠিক বললামতো।”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই
উৎসুক দৃষ্টিতে মিমের দিকে তাকায় মেঘ।
মিমের এই প্রশ্নের উত্তর দেবার কোনই ইচ্ছে নেই। চোরের মতো চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
হঠাৎ করেই মেঘ, মিমের পথ আটকে দাঁড়ায়।
মিম চোখদুটো অবনত করে নিচে তাকায়।
ওর সত্যিটা স্বীকার করার সাহস নেই।
হাতদুটো আচমকাই মেঘ তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।
” পালিয়ে বেড়ালেই কি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাব?তুই যে সবুজকে ভালোবাসিস না স্বীকার করতে দোষ কোথায়?”
মিম ঈষৎ চমকে উঠে মেঘের দিকে তাকায়। মিমের চোখে মুখে কৌতুহল ছাপ স্পষ্ট।
পরক্ষনেই মিম সামনের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে। সিঁড়িঘরের ঠিক কাছটায় সবুজ
ওদের দিকেই একদৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে। সবুজের চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা এতোদিনে মিম বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছে।
মুহূর্তেই মিম হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাকুল হয়ে সবুজের দিকে এগিয়ে যায়।
ওর আগমনে সবুজ মোটেও খুশি না হয়ে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেলো। ওর প্রশস্ত ললাটে অগ্নিসম রাগ দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো।
নিজের বাড়ী, নিজের ঘর সব ওর কাছে অসহ্য লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র যেন ওকে মুহূর্তের মাঝেই গিলে খেয়ে নিবে। বেডসাইডে কর্নারে রাখা
ফ্লাওয়ার ভাসটার প্রতি চোখ যেতেই, নিমিষের মাঝেই ওটা ছুড়ে মারলো। মিমের পায়ের ঠিক কাছটায় পড়তেই মিম কিছুটা ভয় পেয়ে সবুজের দিকে তাকায়।
সামনে দৃষ্টিনিক্ষেপ হতেই মিমের সাথে একদফা চোখাচোখি হতেই হাতটা মুঠ পাকিয়ে বিছানায় বসে পড়ে।
” এতসুন্দর জীনিসটা ছুড়ে মারলেন কেন?
আমার খুব প্রছন্দের ছিলো।”
মিম এমন ভঙিতে কথাটা বললো যেন কিছুই ঘটেনি সব স্বাভাবিক।
” ইচ্ছে হয়েছে করেছি। তোমাকে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।”
এমন উত্তরটা বোধ হয় মিম আশা করেনি।
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আবার বলে উঠে,
” আমি আপনার স্ত্রী তাই সব কিছু জানার অধিকার নিশ্চয় আমার আছে।”
সবুজ হো হো করে হেসে উঠলো।
” আচ্ছা মিম, এখন পর্যন্ত তোমার কোন আচরণে আমি তোমাকে স্ত্রী বলতে পারি?
সে যাই হোক, আমিতো তোমার কোন ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করিনা। যা খুশি তাই করে বেড়ায়। আমাকে স্বামী হিসেবে মানার বিন্দুমাত্র প্রয়োজনতো তোমার নেই। তাহলে,
এখন এতো অধিকারের কথা আসছে কোত্থেকে ?”
প্রশ্নবোধক চিন্হ নিয়ে সবুজ মিমের দিকে তাকায়।
এতোদিন সবুজের মুখচোরা, ভীতু, ন্যাকা ন্যাকা স্বভাবের সাথে ও বেশ পরিচিত। সাত চড়েও যে সবুজ রা কাটে না, দৈবাৎ তার আচরণের এমন উত্তর উত্তর পরিবর্তনে মিম চঞ্চলতার সীমানা অচিরেই পার করে ফেললো। বুকের ভেতর ধীরিম ধীরিম শব্দে ডঙ্কা সহসাই বেজে উঠলো। নাকের ডগায় রাগ যেন অবিরত ঝড়েই পড়তে লাগতো। সাহসী, স্পষ্টভাষী, কথায় কথায় গাল ফুলানো, নাকের ডগায় রাগ চুনচুন করা, বাচ্চাদের মতো ফুঁসে উঠা, ঝগড়া শেষে দুম করে জড়িয়ে ধরা উফ্ এমন ছেলেইতো ও কল্পনায় এঁকেছে বারবার রঙতুলি মিশিয়ে হৃদয়ের ক্যানভাসে। আচ্ছা সবুজ যদি এখন দুম করে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে তাহলে কি ও খুব লজ্জা পাবে? ব্যাপারটা মাথায় আনতেই লজ্জায় একবার লাল, আরেকবার নীল হতে লাগলো। একটুপরে নিজেই আবার হেসেই উঠলো।
কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটলোনা। ওপাশ থেকে বেশ উচ্চ্বস্বরে মায়ের গলা শোনা গেল।
মুহূর্তের মাঝে আবার রুমেও ঢুকে পড়লো।
” কি যেন, একটা শব্দ হলো?”
কথাটা বলেই সবুজের মা এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার সবুজের দিকে তাকায়।
” এতো সুন্দর ফুলদানিটা এভাবে ভাঙলো কি করে?”
” হাটতে গিয়ে পায়ে লেগে পড়ে গেছে।”
সবুজের অগ্নিবরণ চোখ আর মিমের চোখে মুখে উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। এখানে কিছুক্ষণ আগেও যে কালবৈশাখির ঝড় বয়ে গেছে তা উনার চোখ এড়ায়নি। সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভাণ ধরেই পরিস্থিতিটা সামলে নেয়ার চেষ্টায় ব্যাতিব্যাস্থ হয়ে পড়িলেন।
” মিম, তুই এখনও ফাইলটা ওকে দিসনি?
” নাহ, মা উনিতো একবারও ফাইলটা চাননি।
তার মানে, উনি ফাইলটা নেয়ার জন্যই এসেছেন।”
মিম আলমারি থেকে ফাইলটা বের করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে সবুজের মা ওখান থেকে কেটে পড়ে।
” নিন ফাইলটা ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।”
” হ্যা ফাইলটার জন্যই অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত জীনিস সামনে এসে পড়লো। দুঃখিত ভরদুপুর বেলা তোমার পারসোনাল লাইফে এইভাবে ঢুঁ মারার জন্য।”
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই হনহন করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো সবুজ।
পিছন থেকে অনেকবার ডাকলেও সবুজের দিক থেকে কোন সাড়া শব্দ আর মিম পায়না।
————————————
” সবুজ তুই কি, মিমকে ইউনিভার্সিটিতে দিয়াসতে পারছিস না। ওদিক হয়েইতো যাবি। ওকে একা একা আমি কোথাও যেতে দিবোনা এই বলে দিলাম।
সবুজের মা অনেকটা বাচ্চা মানুষের মতো করেই কথাটা বললেন।
” উফ্, একা কেন যাবে মেঘকে বলো দিয়াসতে। আমি ব্যাস্ত।”
গমগম করে উঠলো সবুজ।
মেঘ নিজের নাম শুনে পানি খেতে গিয়ে বিষম খেয়ে ফ্যললো। মিম উঠে গিয়ে মেঘের মাথায় হাত রাখতে যায়।
মুহূর্তের মাঝেই সবুজ অগ্নিচোখে ফুঁসতে ফুঁসতে ওখান থেকে উঠে চলে যায়।
মিম বুঝে উঠতে পারেনা সবুজ কি চায়? কেন এমন করছে?
মিম কিছুক্ষণ পর নিজের রুমে এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য অনেক হাবিজাবী কিছু ভাবতে থাকে।
কোন কিছু ভেবেই কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলোনা।
” মিম, তুই কি এখনো বসে থাকবি?”
শাশুড়ির প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মিম। সত্যিইতো ওর এখন কি করার কথা যেন ছিলো। ধুর কিছুই মনে পড়ছেনা। সব ঘেটে ঘ হয়ে গেছে।
” তাহলে কি করবো? ”
” কি করবি মানে?
রেডি হ। ছেলেটা তোর জন্য বাহিরে ওয়েট করছে। যা ঘুরেফিরে দুজন মিলে মনটা ফুরফুরে করে আয়তো মা।
এইসব মুখ কালাকালি আমি দেখতে পারিনা। ”
মিম শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে। খুশিখুশি মনে রেডি হতে চলে যায়। মনে মনে ভাবে শাশুড়ি তার বেশ রোমান্টিক। শ্বশুর আব্বা হুদাই আনরোমান্টিক বলে।
চলবে..