ভ্রান্তির অগোচরে পর্ব ৬

#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০৬

” মিম, গাড়ী থেকে নামো?
তোমার ভার্সিটিতে এসে গেছি।
গলাটা খাদেঁ নামিয়ে কথাটা বলেই সবুজ মিমের চোখের দিকে তাঁকায়।
” সিরিয়াসলি এতদূর আসার পর আপনার আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো?”
মুহুর্তেই,
ফুঁসে উঠলো মিম।
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখায় ওর ফুঁসে উঠা মুখটা সবুজের চোখে ধরা পড়েনি।
” তুমি যা প্রছন্দ করোনা খামোখা সেটা আমি করতে যাবো কেন?
তাছাড়া আমার মিনিংলেস কথাবার্তার জন্য তোমাকে বোর ফিল করানোর কোন ইচ্ছেই আমার নেই।”
মুখটা কাচুমাচু করে মিমের দিকে তাকিয়েই কথাটা বললো সবুজ।
” আপনি কি করে জানলেন আমি বোর হচ্ছি?”

” সেটা আমি যদি নাই বুঝি তবে কে বুঝবে বলো।
এমনিতেও তোমাকে বিয়ে করে যে ভুল আমি করেছি। সারাজীবনেও হয়তোবা এর মাশুল দিতে পারবোনা। তুমি না সত্যিই বলো, আসলেই আমি আনস্মার্ট, ক্ষ্যাত কারো ভালোবাসার পাওয়ার কোন যোগ্যতাই আমার নেই। মাঝখান থেকে তোমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো । এই অপরাধবোধ থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই। নিজের কাছে নিজে অপরাধী হওয়াটা ঠিক কতোটা কষ্টকর তোমাকে আমি বুঝাতে পারছিনা মিম। আমি আর পারছিনা।”
সবুজ বেশ উচ্চস্বরেই কথাটা বলে পরক্ষণেই আবার থেমে গেলো।
সবুজের এইসব অসংলগ্ন কথাবার্তার উত্তর দেবার ইচ্ছেটাই মিমের মরে গেছে। দুম করে দরজা খুলে গটগট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো মিম।
সবুজ ও বিলক্ষণ নেমে পড়লো। মিমের এই রণচণ্ডী মূর্তি ওর বেশ সুবিধের লাগছেনা।
মিম সরাসরি রাস্তার মাঝখানে চলে আসে সামনে পিছের সমস্ত যানবাহনের তোয়াক্কা না করেই।
সবুজ দৌড়িয়ে এসে মিমের হাতধরে টান দেয়।
” আর ইউ ম্যাড! হুয়াট দ্যা হেল আর ইউ?
এইভাবে রাস্তার মাঝখানে কেউ আসে?
যেকোন মুহুর্তে এক্সিডেন্ট হতে পারে।”
মিমকে বেশ জোড়েসোড়েই টানতে লাগলো সবুজ।

” আমাকে টাচ করার সাহস আপনি পান কোথায় হ্যা। আপনাকে আর অপরাধবোধে ভুগতে হবেনা। আমিই আপনাকে চিরতরে মুক্তি দিব। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।”

সবুজের হাত কাঁপতে লাগলো। মুহুর্তের মাঝেই হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। মিমের হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাখার মতো শক্তি বা মনের জোড় কোনটাই ওর আর অবশিষ্ট রইলোনা।

” মিম তুমি এই কথা বলতে পারলে
?”
অস্ফুট স্বরে গলা থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো।

” হ্যা ঠিকি বলেছি। আপনি আমার সামনে থেকে যান বলছি। আপনার মুখও আমি দেখতে চাইনা।”

মিমের প্রতিটি কথা ওর হৃদয়পটে শুলের মতো বিধতে লাগলো। নিজেকে সামলে নিয়ে পিছনের দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠলো সবুজের। মিম কোনকিছু বোঝার আগেই সবুজ ওকে ধাক্কা দিয়ে নিজে গাড়ীর সামনে পড়ে যায়।
মুহুর্তের মাঝেই গাড়ি ব্রেক কষে। সবুজ মাথায় আঘাত পেয়ে পড়ে যেতে লাগলে পথচারী এসে ওকে ধরে ফেলে।
এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক মিম তা ভুলেও চায়নি। বরাবরের মতোই নিজেকে অন্যের কাছে প্রকাশ করার মতো যোগ্যতা ওর নেই। এই এক যায়গায় ও ব্যার্থ। বাবা-মা মারা যাবার পর থেকেই মুড সুইং এর ব্যাপারটা বেশ ঘনঘনই ওর মাঝে দেখা যায়। হুট করেই ইমোশনাল হয়ে পড়া। কারণ ছাড়াই হুট হাট রেগে যাওয়া। মুখ ফসকে আবুল তাবুল কিছু বলে ফেলা। সত্যি বলতে এগুলো ও মন থেকে বলতে চায়না। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
কিন্তু সবুজ ওতো এইসবের উর্ধে।
ওকে বাঁচাতে গিয়েই ইচ্ছে করেই সবুজ গাড়ীর সামনে পড়ে যায়। সব ওর জন্য। ও এইসবের জন্য রেসপন্সিবল। মিম আর কিছু ভাবতে পারছেনা। গায়ের ওড়নাটা সবুজের মাথায় চেপে ধরে হো হো করে কেঁদেই চলেছে।
সবুজের রক্তে ওর জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে। আর ও চিৎকার করে কেঁদেই চলেছে।
” মিম আর কখনো তোমাকে আমার এই অবাঞ্ছিত মুখটা দেখতে হবেনা। আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে।”
মিমের ফর্সা মুখটা মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে উঠলো।
দাত মুখ খিঁচে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে উঠলো,
” দয়া করে চুপ করেন। আর একটাও কথা বলবেন না। এই অলুক্ষনে কথা আর বলবেন না। কিচ্ছু হবে না। আমি কিছু হতে দিবোনা।”

” মিম, আজকেইতো শেষ। আর কখনো কিছু বলার সুযোগ হয়তোবা পাবোনা। একটু ধৈর্য্য ধরে শুনোনা। প্লিজ চোখের জল মুছো। তোমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারিনা।
আম তোমাকে খুব খুব খুব ভালোবাসি। সব সময় চাই তুমি ভালো থাকো। সুখে থাকো। তাই…”
সবুজ হয়তোবা আরো অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু সেই সুযোগটা পাওয়ার আগেই ও সেন্সলেস হয়ে যায়।
হসপিটালে আসার পর মিমের মাথায় আসে, ইমিডিয়েট বাসায় জানানো দরকার। এতোক্ষণ সবুজের চিন্তায় ওর মাথা থেকে বিষয়টা উড়েই গিয়েছিলো। মাত্রাতিরিক্ত টেনশন আর উত্তেজনায় ওর শরীর ঘামতে লাগলো। মাথায় শুধু সবুজকে হারানোর ভয় ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছেনা। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে, ওর পুরো পৃথিবী ধূসর মেঘে ঢেকে গেছে। সবুজের রঙে ওর সমস্ত হৃদয় রঙ্গিন করে সাজানোর ব্যার্থ চেষ্টায় মিম কুঁকড়াতে লাগলো। ও বড্ড অসহায় হয়ে যাচ্ছে। সবুজকে ও কিছুতেই হারাতে পারবেনা, কোন কিছুর বিনিময়েও না। সবুজকে ওর থেকে ছিনিয়ে ডাক্তার আর নার্সরা ওটিতে নিয়ে যাচ্ছে। শেষবারের মতো সবুজের গোলগাল ফোলাফোলা চেহারার দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা। আবার ডুকরে উঠলো। আই লাভ ইউ সবুজ! বড্ড ভালোবাসি তোমায়!
প্লিজ আমাকে এভাবে অসহায় করে দিয়ে চলে যেও না।

মিম মুহূর্তকাল পরেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে যেতে লাগলে মেঘ দৌড়ে এসে ওকে ধরে ফেলে। সবুজের মা ও ওদিকে কাঁদতে কাঁদতে কাহিল হয়ে পড়তে লাগলো। মাঝখানে মেঘ হিমশিম খেতে লাগলো দুইজনকে সামলাতে গিয়ে। কি করে শান্ত্বনা দিবে তা ওর জানা নেই। ভাষা শুন্য হয়ে গেছে মেঘ। মুখ দিয়ে কোন রা কাটতে পারছেনা ও। ততক্ষাণে সবুজের বাবা এসে পড়ায় ও একটু হাফ ছেড়ে বাচলো।
কিছুক্ষণ পরেই মিমের জ্ঞান ফেরায় সবাই প্রশ্নবাণে ওকে জর্জরিত করতে লাগলো।
ভাবলেশহীন ভাবে মিম সবার মুখপানে তাকানো ছাড়া আর সব যেন ভুলে গেছে।
জীবন যেখানে অর্থহীন, ভাষা সেখানে মুল্যহীন।
ডাক্তার সবুজকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ায় কেউ শেষবারের মতো আর ওকে দেখতে পায়নি। আক্ষেপের পরিমাণটা তাই আরো বাড়তে থাকলো। মিমের দিকে তাকিয়ে কোন উত্তর না পেয়ে সবুজের মা অস্থির হয়ে গেল।

মুহূর্তের মাঝে পরিস্থিতি সামলে নেয়ার জন্য সবুজের বাবা বলে উঠলেন,
” আহা! তুমি থামবে? মেয়েটার অবস্থা দেখোছো তুমি? ওকে এইভাবে এত প্রশ্ন করছো কেন? ডাক্তাররা আছেন দেখছেনতো। আল্লাহকে ডাকো। তারপর না হয় কি থেকে কি হলো তা নিয়ে ভাবা যাবে।
সামনে যা আছে তা নিয়েতো আগে ভাববে । ”
স্বামীর কথায় সবুজের মা চুপ থাকার বদলে আরো ফুস করে উঠলেন,
” সব আমার কপালের দোষ। কেন যে জোর করে এই অলক্ষীটাকে ছেলের সাথে পাঠিয়েছিলাম আল্লাহ মালুম।
ছেলে আমার যেতে চায়নি। আমিই জোড় করেছিলাম। আল্লাহ কি কপাল আমার!
রাক্ষসী নিজের বাবা মারে খাইয়া শখ মিটেনি এখন আবার আমার ছেলেরে খাওয়ার লোভ হইছে নাহ্।
আমার সবুজের কিছু হলে তোরে আমি ছেড়ে দিবোনা।”
মেঘ আর সবুজের বাবা স্তব্ধ হয়ে যায় এই ধরণের কথা শুনে। সবুজের বাবা ভেবে পায়না তার ভুলাভালা সহজ সরল স্ত্রী এসব কি কথা বলছে। হয়তো পুত্র শোকে ওর মাথা ঠিক নেই। কিন্তু মিম! ওতো ওর নিজের ভাইয়ের মেয়ে। বাকী আত্নীয় স্বজন যখন ওকে অলক্ষী বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো তখন ওইতো মেয়েটাকে বুকে তুলে নিয়েছিলো। তাহলে আজ এতো বছর পর এইসব পুরোনো মিনিংলেস কথাবার্তার আবির্ভাব কেন হচ্ছে? সবুজের বাবা ভেবে পায়না।
এতোক্ষণে মিমের ভাবলেশহীন অবস্থার উন্নতি হয়। সত্যিইতো মা যা বলছে একদম সত্যি বলছে। সেদিনতো ওই জেদ করেছিলো ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। তারপর এক্সিডেন্ট টা হলো। বাবা মা মারা গেলেও ও কেন মারা গেলো না? আর আজকে ওর জন্যই সবুজের এই অবস্থা। তারমানে ও সত্যিই অলক্ষী, অপয়া, সবাই ঠিকি বলে।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here