#ভ্রান্তির_অগোচরে
লেখা আশিকা জামান
পার্ট ০৯
” এই নাও তোমার কফি।”
শিউলি অনেকটা শব্দ করেই টি টেবিলের উপর কফিটা রেখেই কালবিলম্ব না করে ধপাশ করে বিছানায় বসে পড়লো।
সোফার উপর হেলান দিয়ে এতোক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়েই ফাইলটা ঘাঁটছিলেন সোহেল চৌধুরী। স্ত্রী আচরণে বিস্মিত না হয়ে পারছেন না।
আরেকদফা চমকিয়ে দিয়ে শিউলি গমগম করে বলে উঠলো,
” তোমার সমস্যা কি? বাড়ীটাকেও কি অফিস বানিয়ে ফেলবে নাকি? সারাদিন পর বাড়ী এসে সেই ফাইলই ঘাটাঘাটি করছো। বাড়ীতে কি হয় কোন খুজ খবর রাখো?”
” শিউলি, এই তোমার হয়েছাটা কি?
এইরকম অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন?
কখন থেকে দেখছি এই একি অবস্থা। হয়েছেটা কি?”
কপালের ভাজে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে স্ত্রীর দিকে ভ্রুকুচকে তাকালেন সোহেল চৌধুরী।
অভিমানী সুরে শিউলি বলে উঠলো,
” আমার দিকে তাকানোর সময় আছে তোমার? সারাদিন রাততো ওই বিজনেস আর বিজনেস?”
সোহেল চৌধুরী কফিতে চুমুক দিতে দিতে স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন।
” কি হয়েছে একটু খোলাশা করে বলবে?”
তুমিতো জানোই আমি একটু ব্যাস্ত মানুষ। ঠিকমতো তোমাদের খোজ খবর নিতে পারিনা। তারজন্যে বরাবরের মতোই ক্ষমা চাচ্ছি। মুখটা গুমড়া না করে একটু খুলে বলো, নাহলে বুজবো কিভাবে।”
শিউলি স্বামীর দিকে ঘুরে বসলো,
” মিম এর উপর আমি চরম বিরক্ত। মেয়েটা দিনদিন কেমন অবাধ্য হয়ে যাচ্ছে। এই মিম আর আগের মিমের মাঝে কোন তফাৎ খুঁজে পাচ্ছিনা। ”
স্ত্রীকে থামিয়ে সোহেল চৌধুরী বলে উঠলেন,
” সবুজের মা, আমার মনে হয় তুমি অহেতুক চিন্তা করছো। ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। তুমি ওকে একটু সময় দাও দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।”
সোহেল চৌধুরী বিছানা উঠতে যাবে, এমনিতেও অনেক কাজ পড়ে আছে। কিন্তু স্ত্রীর হ্যাচকা টান উপেক্ষা করে উঠে যাবার মতো মানুষ সে নয়।
” তুমি কি কথাগুলো না শুনেই উঠে যাবা। এত তাড়া কিসের?”
রাগে কটমট করে স্বামীর দিকে তাকালেন শিউলি চৌধুরী।
” আচ্ছা বলো আমি শুনছি।”
স্ত্রীর এই কটমট করে তাকানোর ভাষা সোহেল চৌধুরী বেশ ভালোভাবেই বুঝেন। সমস্ত কিছু উলটপালট করে দেয়ার জন্য,
কোন একটা নাম না জানা ঘূর্নিঝড় যে ধেয়ে আসছে তা সোহেল চৌধুরীর চোখ এড়ায় নি। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন।
” তুমি জানো, মিম দিনদিন কতোটা ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছে? আমিতো মা, আমার নাহয় টেনশন হয়। তাই না হয় ওই সময় বলেছিলাম সবুজের থেকে একটু দূরে দূরে থাকতে। তাতেই মেয়ে এতো খেপে যাবে কে জানতো?
আমিতো পরে আমার ভুল বুঝতে পেরে ওদের আবার এক করে দিয়াসছিলাম। বল দিয়াসছিলাম না।”
” হু দিয়েছো। তাতে হয়েছা কি?”
” কি আবার হয়নি? আমার ভাইয়ের জেদি মেয়ে পুরা তার মায়ের মতো হয়েছে। সে মেয়ে আমার সামনে কি সুন্দর নাটকটাই না করলো। কিন্তু আমি খোজ নিয়ে দেখলাম মেয়ে আমার ছেলের সাথে এক ঘরে শোয় না। বুঝতে পারছো কত জেদ!”
” ভালোতো তোমার আর মিমের শরীরেতো একি রক্ত বইছে। দুইজনের জেদতো সমান হবেই এটাই স্বাভাবিক। ”
” মানে কি? আমি জেদি!”
মুহূর্তেই শিউলি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।
” হ্যা, তোমার ওই মিডিলক্লাস সেন্টিমেন্ট দিয়েই তো সেদিন ছেলে মেয়ে দুটোর মাঝে দুরত্ব তৈরি করেছিলে। এখনতো এইরকম সিচুয়েশন তৈরি হবেই। এটাই কি স্বাভাবিক নয়।”
” সব বিষয়ে আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো যে তোমার জন্মগত স্বভাব এ আমার অজানা নয়। হ্যা, সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু ক্ষমাতো চেয়েছিলাম নাকি। আচ্ছা সবুজ যে কানাডা চলে যাচ্ছে এটার জন্যেও কি আমি দায়ী। তোমার মনে হচ্ছে না এর পিছনে মিমের হাত আছে?”
“আশ্চর্য সবুজ পি. এইচ. ডি করতে কানাডা যাচ্ছে এতে মিমের কি দোষ? না এইবার আমি তোমাকে সত্যিই বুঝতে পারছিনা।”
” বোঝতে পারছোনা না চাইছোনা। বিয়ের এখনো ২ মাস গড়ালো না। আর সবুজ সব ছেড়ে ছুড়ে কানাডা কেন যাচ্ছে বিষয়টা তোমার মাথায় ঢুকছেনা? এত গবেট হয়ে এতো বড় বিজনেস সামলাও কি করে?
তোমার ছেলে আর ছেলের বউ এর মাঝে সেইরকম কোন ফিজিক্যালি বা মেন্টালি এটাচমেন্ট নেই বুঝেছো। যতদুর বুঝতে পারছি মিমই নিজেকে সবুজের থেকে দূরে দূরে রেখেছে। আর তোমার অভিমানী ছেলে তাই কানাডা চলে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। দেখো তোমার মনে আছে, এই কানাডা যাওয়ার অফারটাতো সবুজ নাকচ করেই দিয়েছিলো। আবার যেচে কেন যেতে চাইছে একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো।”
সোহেল চৌধুরী স্ত্রী কথায় রীতিমত ঘামতে লাগলেন। স্ত্রীর প্রত্যেকটি কথাই যে সত্যি তা তিনি বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন। ব্যাপারটা যে তার চোখ এড়ায়নি তা শিউলকে বুঝতে দিলে চলবেনা। কোন কোন সময় স্ত্রীর কথায় এত সায় দিলে চলে না।
” আচ্ছা এই এতকিছু তোমাকে কে বলেছে সবুজ?”
” মাথা খারাপ নাকি? এইসমস্ত কথা কেউ কাউকে বলে নাকি?
দেখ চোখ কান খোলা রাখলেই সব বুঝা যায়। মুখে বলে দিতে হয়না।”
” তুমি এমনভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করছো যেন সবুজ সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছে। পড়তে যাচ্ছে ভালো কথা। শেষ হলেই এসে পড়বে। এ নিয়ে এতো জল্পনা কল্পনার কিছু নেই। তাছাড়া এইসব মেয়েলি প্যাচগোচ তোমার কাছেই রাখো। আমাকে বুঝাতে এসোনা।”
কোনরকম বিষয়টা ধাপাচাপা দিয়ে সোহেল চৌধুরী বিছানা থেকে দুম করে উঠে এলেন।
শিউলি নির্বিকারভাবে স্বামীর পথের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
————————————
” মেঘ ভাইয়া, আসতে পারি?”
মিমের কন্ঠস্বরে মেঘ হকচকিয়ে উঠে। সামনে রাখা ওয়াইন এর বোতল আর গ্লাস সরানোর ব্যার্থ চেষ্টায় লিপ্ত হতে থাকে। মিমের আকস্মিক আগমনে ও এই সুযোগটাই আর পেলনা। মেঘ ভেবেছিলো মিম হয়তো রিএক্ট করবে। কিন্তু না স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মিম বলে উঠলো,
” আচ্ছা আমি বোধ হয় তোমাকে বিরক্ত করলাম। আচ্ছা আসি তাহলে।”
” আরে না। বোস। আচ্ছা তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস?”
মেঘ কিছুটা ভয়ে ভয়ে মিমের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।
” কেন বলোতো?”
মিম পরক্ষণেই প্রশ্নটা করে বসে।
” এই যে, আমি ড্রিংকস করছিলাম। তাই!”
” আশ্চর্য! আমি কেন রাগ করবো।।ইটস ন্যাচারাল। তুমি বিদেশী কালচারে বড় হয়েছে এটাতো নরমাল ব্যাপার। হেজিটেট করোনা চাইলে আমার সামনেই পান করতে পারো। আমি কিছুই মনে করবোনা।”
” বাচালি আমায়।”
” আচ্ছা আমার একটা উপকার করবে?”
” হুম, শিউর। তোর উপকার করতে পারলে যে, এ নরাধম নিজেরে ধন্য মনে করে। একি তুই আজোঁ বুঝিস নি?
মিম বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। মাঝেমাঝে মেঘকে তার আকাশের লাল নীল
মেঘের মতোই মনে হয়।
তবে আপাতত এই মেঘকে নিয়ে ভাববার ফুরসৎ ওর নেই। সবুজ এমনিতেই ওকে যে হারে নাকানি চুবানি খাওয়াচ্ছে তাতে হিতাহিত বোধ শুন্য হওয়ার উপক্রম।
মিম হাতের কাগজটা হুট করে মেঘের হাতে গুঁজে দেয়। মেঘ তাজ্জব হওয়ার মত করে মিমের দিকে তাকায়। এখননি মিমকে কাগজটার ব্যাপারে জিজ্ঞাস করতো, ঠিক সেই মুহুর্তে কোনরম
ভণিতা ছাড়াই স্বাভাবিক গলায় মিম বলতে থাকে,
” তুমিতো জানো সবুজ আমাকে দেখলে কেমন অস্বাভাবিক ভাবে রিএক্ট করে। ওর রুমে গিয়ে যে দুদন্ড কথা বলবো তার ও জো নেই। এর মধ্যে ও যদি সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমি কি নিয়ে বাচাবো বলতে পারো?
বিশ্বাস করো আমি ওকে না দেখে থাকতে পারবোনা।
আমি জানি ও আমার উপর অভিমান করেই চলে যাচ্ছে।
এই চিঠিটা সবুজকে প্লিজ একটু দিয়ে দিবা। আমার বিশ্বাস এই চিঠি পড়লে ওর আর আমার সমস্ত ভুল বোঝাবোঝির অবসান ঘটবে। দয়া করে এই উপকারটুকু করবে মেঘ ভাইয়া।”
কাতর চোখে মিম মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মেঘ নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো,
” দেখ মিম আমি এটা দিতেই পারি? আমার দিক থেকে কোন সমস্যা নাই।
একটা কথা না বলে পারছিনা, জানি তুই হার্ট হবি তবুও বলছি।
নিজেকে এতোটা মুল্যহীন করে তুলিস না। তুইতো জানিস, আমি সবুজকে যতবার তোর ব্যাপারে কিছু বলতে গেছি ততোবার আমার উপর উল্টো রিএক্ট করেছে। যা নই তাই শুনিয়েছে। চরম অপমান করে বলেছে, তোদের পারসোনাল ব্যাপারে যেন আর নাক না গলাই। এরপরে ও আমার সমস্যা নেই আমি দিয়ে দিব। কিন্তু সবুজ ওতো তোর প্রতি মারাত্মক উদাসীন। কোন খোজ খবর কিচ্ছু নেয় না। আমার কি মনে হয় জানিস ও বোধ হয় এই রিলেশনশিপ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। তাই চলে যাওয়ার বাহানা খুঁজছে। একটা কথা মান, ও যদি তোকে সত্যিই ভালোবাসতো অন্তত্ত এইভাবে ফেলে যেতে পারতোনা। ”
” প্লিজ চুপ করো। আমি এতকিছু শুনতে চাইনি। কাজটা করলে বলো। না করলে নিজের ভালোটা আমি নিজেই বুঝে নিবো। ”
মিম বেশ কর্কশভাবেই কথাগুলো বললো।
মেঘ কিছু একটা ভেবে নিয়ে মিমের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকায়।
” তোকে কিছু করতে হবেনা। আমি আছি কি জন্যে। টেনশন করিস না সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
মিম আর একমুহুর্তও না দাঁড়িয়ে চলে আসে।
চলবে.