#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪৮
ইভান ভাইয়ের বিয়ের পর ভাবীকে নিয়ে এই প্রথম ওরা বাইরে খেতে এসেছে। দিনগুলো আবার আগের মতো হয়ে গেছে। ঘোরাঘুরি, আড্ডার মাঝেও মীরা তার প্রিয় মানুষটাকে মিস করে। আবার তার ফেরার অপেক্ষাও করছে। কইতরি সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিব্যি প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে। মুবিন ভাইয়ের একটা সিক্রেট ওরা জেনেছে। মুবিন ভাই একটা মিউজিক দলের সাথে যুক্ত আছে। শীগ্রই ওদের প্রথম গানের অ্যালবাম বের হবে। এই খবরটা এখনও কেউ জানে না। ইভান ভাইয়ের বিয়ের ছয় মাস উপলক্ষে আবির জোর করে ট্রিট নিচ্ছে। মীরা আজ সাদা রঙের সেলোয়ার-কামিজ পরেছে। তাকে শুভ্র পরীর মতো লাগছে। রেস্টুরেন্টে এসে ওয়াশরুম খুঁজতে গিয়ে মীরা পেছন থেকে একটা ছেলেকে দেখে জায়িন মনে করে ছুটে গেল।
“জায়িন ভাই এখানে! উনি কি বাড়ি এসেছেন?”
মীরা যতটা খুশি হয়ে ছুটে গিয়েছিল, ওখানে গিয়ে অন্য একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে তার থেকেও বেশি হতাশ হলো। ছেলেটা ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবেন আপু?”
মীরা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল,
“সরি ভাইয়া। আপনাকে পেছন থেকে দেখে আমার একজন পরিচিত মানুষের মতো মনে হয়েছিল।”
“ইট’স ওকে। মানুষটা নিশ্চয় আপনার স্পেশাল কেউ?”
মীরা লজ্জায় রাঙা হলো। মানুষটা শুধুই স্পেশাল না। ভীষণ ভীষণ ভীষণ স্পেশাল। সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। ছেলেটা হেসে বলল,
“আই উইশ, খুব শীঘ্রই আপনার স্পেশাল পার্সনটা যেন আপনার সাথে থাকে।”
মীরাকে না পেয়ে মাহিমা পেছন পেছন খুঁজতে চলে এসেছে। ওকে একটা ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে ক্ষেপানোর জন্য মাহিমা বলল,
“ও বাবা, এটুকু সময়ের মাঝে হ্যান্ডসাম একটা ছেলেও পেয়ে গেছিস! কী কপাল রে তোর।”
“একটা লা’ত্থি দিব হারামি। সেই মানুষটাকে ভালো লাগার পর থেকে পৃথিবীর সব ছেলে এখন আমার চোখে অসুন্দর হয়ে গেছে।”
“ও মা, কী প্রেম! মরে যাই, মরে যাই।”
“একটা মন আর কয়জনকে দিব বল? আমার মন তো কবেই তাকে দিয়ে দিয়েছি।”
“দুইটা মাস ধরে শুধু মানুষটা মানুষটাই করে যাচ্ছিস। না তার নাম বলছিস। আর না পিক-টিক কোনকিছু দেখাচ্ছিস। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তুই পাগল হয়ে গেছিস। নইলে তোর এই ‘মানুষটা’ শুধুমাত্র তোর কল্পনা। বাস্তবে এমন কেউ নেই।”
“তোর যা ইচ্ছে হয় ভাব। কিন্তু আমি জানি মানুষটা আছে।”
“তাহলে দেখা আমাকে।”
“উঁহু।”
“কেন?”
“দেখে ফেললেই তো তোর আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে। যতদিন না দেখাব ততদিন তোর পেটের ভেতর ভুটভুট করবে।”
“ম’র তুই। সাথে তোর মানুষটাকেও নিয়ে মর। আমার জীবন বাঁচুক।”
মাহিমা রেগেমেগে মীরাকে ফেলেই চলে গেল। এই মেয়ে সবসময় এমন করে। কতভাবে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে পেটের ভেতর থেকে কথা বের করতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই মাহিমা ব্যর্থ হয়েছে। মীরা কিছুতেই তার ওই মানুষটার নাম ঠিকানা কিছুই বলেনি। তবে মাহিমাও হার মেনে নেয়নি।
….
আজ বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না হয়েছিল। প্রাইভেটে আসার সময় বড়মা ইভা আপুর মা আর মুবিন ভাইদের জন্যও টিফিনে করে দিয়ে দিয়েছে। মীরা প্রথমে ইভাদের ফ্ল্যাট হয়ে তারপর মুবিনদের এখানে এসেছে। এখন মুবিন ভাইয়ের বাবা বাড়ি আছে। তাই মীরা ভদ্র মেয়ের মতো কলিংবেল চাপে। আগের মতো একটানা কলিংবেল চেপে ধরে রাখে না।
মীরা যা কল্পনাও করেনি। এখানে আসার আগেও ভাবেনি। আজ সেটাই হলো। মীরাকে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে জায়িন দরজা খুলে দিল। হাতে গুনে গুনে দুইটা মাস পর মীরা জায়িনকে সামনে থেকে দেখছে। মেয়েটা খুশির মাত্রা সামলাতে না পেরে স্ট্যাচু হয়ে জায়িনের দিকে তাকিয়ে আছে। জায়িন নিজেও দীর্ঘদিন পর প্রেয়সীকে দেখছে। অনেকটা সময় কেটে গেলেও তাদের দু’জনের একে অপরকে দেখা শেষ হচ্ছে না। কতদিন মীরা ভেবে এসেছে আজ গিয়েই দেখবে জায়িন ভাই চলে এসেছে। কিন্তু তার ভাবা মতো একবারও জায়িন ভাই আসেনি। আজ মীরা কোনকিছুই ভেবে আসেনি। আজই সে এই সারপ্রাইজটা পেলো। জায়িনের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটে উঠেছে। সে মীরার দিকে তাকিয়েই দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। মীরা তখনও ঘোর কাটিয়ে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না। মীরাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়িনের ঠোঁটের হাসি প্রসারিত হলো।
“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”
জায়িনের কন্ঠস্বর পেয়ে মীরার ঘোর কাটলো। এতক্ষণ সে অসভ্যের মতো জায়িন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল ভেবেই বেচারি লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। কী ভাবছেন হয়তো উনি!
মীরা জায়িনকে পাশ কাটিয়ে ভেতর ঢুকতে ঢুকতে মনে মনে ভাবল,
“কী লজ্জা, কী লজ্জা! তোর হয়েছে কী মীরা? উনাকে চোখের সামনে দেখে খুশিতে পাগল হয়ে গেছিস?”
জায়িন মীরার প্রতিটা কর্মকাণ্ড মনযোগ সহকারে দেখছে। সেদিন ফেরার পর থেকে কোনকিছুই ভালো লাগছিল না তার। বারবার শুধু মীরাকেই দেখতে ইচ্ছে করছিল। পরেরদিনই হয়তো জায়িন ফিরে আসতো। কিন্তু সে মনকে বুঝিয়েছে। মীরাকে পেতে হলেও নিজেকে আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর তাই ওইদিন মীরার মেসেজ পেয়েও ছুটে আসেনি জায়িন। জায়িন খুব ভালো করেই জানে মীরা ওই ইমোজি গুলো পাঠায়নি। অন্তত সজ্ঞানে মীরা এমন কাজ করবে না। কিন্তু তারপরই মীরার আইডি ডিএক্টিভেট দেখে কনফার্ম হলো ভুলবশত মীরা বা অন্য কেউ ইমোজি কয়টা সেন্ড করে দিয়েছে। জায়িন এসব ভাবতে ভাবতে মীরা উঁকিঝুঁকি পেরে আন্টিকে খুঁজে নিয়েছে।
“আন্টি বাড়িতে নেই জায়িন ভাই?”
“না।”
“কোথায় গেছে?”
“বাবার ফ্রেন্ডের মেয়ের বিয়ে।”
“ওহ। মুবিন ভাইও কি…
” হুম। তোমার স্যারও গেছে।”
মীরা জায়িনের সাথে কথা বললেও জায়িনের দিকে তাকাতে পারছে না। তবে সে বেশ বুঝতে পারছে মানুষটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এতে তার লজ্জা পাওয়ার মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। জায়িন মীরার হাতে টিফিনবক্স দেখে জিজ্ঞেস করল,
“ওটাতে কী এনেছো?”
মীরার খেয়াল হলো সে তো বিরিয়ানি নিয়ে এসেছিল। মৃদু গলায় মীরা জবাব দিল,
“বিরিয়ানি।”
“তুমি রান্না করেছ?”
“না। বড়মা রেঁধেছে।”
“তুমি রাঁধতে পারো না?”
এবার মীরার হাসফাস লাগছে। এটা ঠিক জায়িন ভাই-ই তো! নাকি তার কল্পনা। এই দুই মাসে মানুষটাকে নিয়ে কম স্বপ্ন আর কল্পনাই তো সাজায়নি! এটাও হয়তো তার কল্পনাই। নইলে জায়িন ভাই তার সাথে এত সহজভাবে কথা বলবে কেন?
জায়িন এক সেকেন্ডের জন্যও মীরার উপর থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না। সে মীরার ভাবনাও বেশ বুঝতে পারছে।
“বিরিয়ানি কি শুধু তোমার স্যারের জন্যেই এনেছ?”
মীরা ঝট করে জবাব দিল,
“না। সবার জন্যই এনেছি।”
“তাহলে একটা কাজ করো। রান্নাঘর থেকে প্লেট নিয়ে এসো।”
এতক্ষণে মীরা সরাসরি জায়িনের দিকে তাকাল। এই লোক সত্যিই জায়িন ভাই তো! মীরার সন্দেহ হচ্ছে। তবুও সে রান্নাঘর থেকে প্লেট এনে দিল। জায়িন হাত ধুতে চলে গিয়ে মীরাকে বলে গেল।
“তুমি প্লেটে বিরিয়ানি বাড়ো। আমি হাত ধুয়ে আসি।”
জায়িন চলে যেতেই মীরা ডান হাতে জোরে বাম হাতের উপরে চিমটি কাটল।
“ওরে বাবা! আহ, ব্যথা লাগছে। তার মানে এটা তো স্বপ্ন না। কল্পনাও না। জায়িন ভাই সত্যি সত্যিই আমার সামনে আছেন! কিন্তু উনি কি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন? নাকি আমি কে তা ভুলে গেছেন? আমাকে কি মীরা না ভেবে অন্য কেউ ভাবছেন?”
জায়িন ফিরে এসেও দেখল মীরা এখনও আগের মতোই বসে আছে। সে মীরার মুখ দেখেই বুঝতে পারছে মীরা একদিনে এতকিছু হজম করতে পারছে না। বিরিয়ানি খেতে খেতে জায়িন প্রশংসা করে বলল,
“তোমার বড়মা ভীষণ ভালো রাঁধে মীরা। তুমিও উনার থেকে শিখে রাখতে পারো।”
নিজের অজান্তেই মীরার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
“কেন?”
“বিয়ের পর বরকে রেঁধে খাওয়াতে পারবে।”
খাচ্ছে জায়িন কিন্তু বিষম খেলো মীরা। সে অনবরত কেশেই যাচ্ছে। জায়িন পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,
“পানি খাও।”
মীরা পানি খেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেওয়ার আগেই জায়িন আবার বলল,
“রোজ না রাঁধো। কিন্তু মাঝে মধ্যে সব বরেরই বউয়ের হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করবে।”
এটা কোনভাবেই জায়িন ভাই হতে পারে না। খালি বাড়িতে নাকি ভূত থাকে। মীরার সাপ, তেলাপোকা, কুকুরের ভয় থাকলেও ভূতের ভয় কোনদিন ছিল না। কিন্তু আজ জায়িন ভাইয়ের এই ভূতটাকে ভয় পেয়ে মীরা যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় বেরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বুকে হাত রেখে পরীক্ষা করতে লাগল বুক ধুকপুক করছে কি-না।
“না, এখনও বেঁচে আছি। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে।”
কিন্তু মীরা এটাই বুঝতে পারল না জায়িন ভাই তার সাথে আজ ওরকমভাবে কথা বলল কেন? এ যেন কচ্ছপ তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।
“জায়িন ভাই, আপনার পেটে পেটে এত কথা লুকিয়ে আছে! কতকিছু বলার ছিল আপনাকে। কিন্তু আপনার সামনে এসে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। ভালোবাসি কথাটা বলতেই পারলাম না। তার উপর আপনি আবার আমাকে কনফিউজড করে দিয়েছেন।”
চলবে #মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৪৯
মীরা রুশমির চিপসের প্যাকেট থেকে একটা একটা করে চিপস খেতে খেতে প্রায় সবটাই খেয়ে নিয়েছে। তার মনোযোগ ফোনে ছিল। কখন চিপস শেষ হয়ে গেছে খেয়ালই করল না। এদিকে চিপস শেষ হয়ে যাওয়ায় রুশমি কান্না শুরু করে দিয়েছে। বেচারি মীরা ফেঁসে গেল। সে কোনভাবেই রুশমির কান্না থামাতে পারছে না।
“সোনা ময়না লক্ষী বোন আমার। কাঁদিস না। আমি তোকে অনেকগুলো চিপস এনে দেব। প্রমিজ। কাঁদে না টিয়া পাখির ছাও।”
“তুমি পঁচা। আমাল তিপস খেয়ে ফেলেছ। মিশি না।”
“মিশতে হবে না। তবুও তুই কাঁদিস না। কার্টুন দেখবি? এই নে, আমার ফোন তোকে দিয়ে দিলাম। তবুও কাঁদে না শালিকের ছাও।”
যেমন তেমন করে রুমশিকে শান্ত করতে পেরে মীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আজকালকার পোলাপান গুলাও! ভদ্রতা বুঝে না। বড়ো বোন একটু চিপসই তো খেয়ে নিয়েছে। তার জন্য এভাবে কাঁদতে হবে? মীরা রুশমিকে কোলে বসিয়ে ফেসবুকে ভিডিও দেখছে। বন্ধুরা তাকে গ্রুপে ডাকছে।
“রুশমি পেঁচার ছাও। গিয়ে দেখ তো মাহা বাবু কী করে। মাহা বাবুকে একটা আদর নিয়ে এসো। দৌড়ে যাও।”
রুশমি চলে গেলে মীরা গ্রুপে ঢুকলো। সবাই কিসের যেন একটা লিংক দিচ্ছে। মীরা লিংকে ঢুকে পুরা থ! মুবিন ভাইদের গানের দলটার একটা ভিডিও প্রচুর ভাইরাল হচ্ছে। সেখানে মুবিন ভাইকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সবাই কত প্রশংসা করছে। মীরাকে দেখেই কয়েকজন ম্যানশন করে বলতে লাগল,
“তোর স্যার তো রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেছে রে মীরা। এখন কি আর তুই আমাদের পাত্তা দিবি? হায়, মুবিন ভাই যে এত সুন্দর গান গাইতে পারে আমরা জানতামই না। মানুষ কত কত শেয়ার করছে!”
মীরা খুশিতে চিল্লিয়ে দু’মিনিটে সবাইকে একসাথে করে ফেলল। এই মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না। এর গলায় সৃষ্টিকর্তা মাইক ফিট করে দিয়েছে। চিল্লাচিল্লি থামেই না।
“তোমরা কই গো। সবাই তাড়াতাড়ি আসো। এসে দেখে যাও।”
আবিরের সাথে তনির ঝগড়া চলছে তাই তার মেজাজ ভালো না। তনি এসেই ধমক লাগালো।
“কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?”
“কী হয়নি সেটা বলো! আমার স্যার এখন সেলিব্রিটি। তোমরা তার অটোগ্রাফের জন্য আমাকে ধরবে। কিন্তু কোন লাভ হবে না।”
” আবোলতাবোল বলার জন্য ডেকেছিস? লা’থি খাবি বলে রাখলাম।”
সবাই চলে এলে মীরা মুবিন ভাইয়ের ভিডিওটা সবাইকে দেখাল। মা, চাচীরা কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না মুবিন এত সুন্দর গান গায়। ছোট চাচী বলল,
“ছেলেটার গুণের শেষ নেই। পড়াশোনাতে যেমন ভালো। অন্যান্য দিক দিয়েও ফেলে দেওয়া যায় না। কী ভালো গলা!”
বড়মাও বলল,
“সত্যিই। আমরা তো মুবিনের এই গুণের কথা জানতামই না।”
ভিডিওটা দেখে, সবার এতো প্রশংসা শুনে গর্বে ইভার বুকটা ভরে যাচ্ছে। মুবিনটা এতদূর এগিয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি। তনি এতক্ষণে ভিডিওটা চার পাঁচ বার দেখে ফেলেছে।
“তোর মনে আছে মীরা, ভাবীর বিয়ের আগে একদিন আমরা সবাই ছাঁদে আড্ডা দিয়েছিলাম। মুবিন সেদিন গান করেছিল। প্রথমে তো রাজিই হচ্ছিল না। সবাই চেপে ধরায় শোনালো। এই ছেলে যে ছোপা রুস্তম বের হবে ভাবতেই পারিনি।”
মীরা গর্বে মাটি থেকে দু-হাত উপরে উড়ে ভাব নিয়ে বলল,
“তোমরা না জানো। আমি সব জানতাম। মুবিন ভাই তো আমাকে সবই জানাতো। পাঁচ জন সদস্যের এদের একটা গানের দল আছে। ওদের প্রথম গানও এই মাসেই বেরুবে।”
“তুই আগে থেকেই জানতি!”
“অবশ্যই। তোমরা আমাকে কী ভেবেছ বলো তো? ফিউচারে আমি মুবিন ভাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট হবো। তখন তো ওর সাথে দেখা করার জন্য আমার থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে।”
হঠাৎ মীরার মনে পড়ল, কইতরি কি এই খবরটা শুনেছে? এই ভিডিও দেখে থাকলে এতক্ষণে হয়তো খুশিতে পাগল হয়ে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মাহিমাকে জানানোর জন্য মীরা ফোন হাতে দৌড়ে রুমে চলে গেল। ইভা মা’র কাছে কল করলো।
….
জায়িন সোস্যাল মিডিয়ায় তেমন এক্টিভ থাকে না বিধায় মুবিনের ভিডিওটা তার দেখা হয়নি। এমনকি এই ব্যাপারে সে কিছুই জানে না। পুরোটা দুপুর ঘুমিয়ে কাটলো। মুবিন বাড়ি নেই। বিকেলে জায়িন ঘুমিয়েছিল। তার ঘুম ভাঙলো বাবার গলা শুনে। বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই জায়িন ঘুম ঘুম চোখ মেলে কান পেতে শুনতে চাইল বাবা কার সাথে এত রেগে কথা বলছে। মা’র সাথে নিশ্চয় বলবে না। কারণ এতগুলো বছরেও জায়িন কোনদিন বাবা মা’র ঝগড়া হতে দেখেনি। মা যত বড়ো অন্যায়, অপরাধই করে ফেলুক বাবা কোনদিন কঠিন কন্ঠে মা’র সাথে কথা বলেনি। জায়িন হালকা হালকা শুনতে পেলো।
“এত এত টাকা খরচ করে তোকে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি করিয়েছিলাম। তুই পড়াশোনা না করে এসব করে বেড়াচ্ছিস!”
বাবার কথার প্রতিত্তোরে মুবিনও জোরে জোরে বলছে,
“তোমার ইচ্ছে ছিল আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। আমি একবারও বলিনি ইঞ্জিনিয়ারিং করব। তুমি নিজের ইচ্ছে আমার উপর চাপিয়েছিলে।
“আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার কথা মতোই চলতে হবে। নইলে নিজের রাস্তা দেখে নিতে পারো। লায়েক হয়ে গেছ এখন। নিজেরটাও করে খেতে পারবে।”
“থাকব না তোমার বাড়িতে। তাছাড়াও এটা বাড়ি কম জেলখানাই বেশি। এখানের জেলার তুমি। আর আমরা তোমার কয়েদি। তুমি চাও তোমার কথাই যেন শেষ কথা হয়। হোক সেটা ভুল।”
“তুই আমাকে ঠিক ভুল শেখাচ্ছিস!”
“সন্তান ভুল করলে বাবা মা-ই তো সঠিকটা শেখায়। বাবা মা’র ক্ষেত্রেও যদি সন্তান এই কাজটা করতে পারত!”
জায়িন উঠে বসল। তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে গেল। বাবা মুবিনের উপর চোটপাট করছে এটা আর পাঁচটা দিনের মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আজ মুবিনও বাবার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। তার মানে অবস্থা গুরুতর। কিছু তো হয়েছে।
জায়িন বেরিয়ে আসতে আসতেই মায়ের গলাও শোনা গেল।
“কী করছো তোমরা? বাবা ছেলে মিলে অবুঝের মতো ঝগড়া করে যাচ্ছ।”
“ঝগড়া আমি করছি! তোমার ছেলের আচরণ চোখে পড়ছে না তোমার? বাবার সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় মিনিমাম শিক্ষাটুকু জানা নেই। ওকে বলে দাও সুমনা, নিজের মন মর্জি করতে হলে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় যেন।”
“দূর! থাকলাম না তোমার বাড়িতে। তোমার বাড়ি এমনও কোন রাজপ্রাসাদ না।”
“হ্যাঁ যাও যাও। মাথার উপর ছাঁদ না থাকলেই বুঝতে পারবে তুমি যতটা ভাবছো জীবন ততটা সহজ নয়।”
“দরকার পড়লে আমি গাছ তলায় থাকব। তবুও তোমার বাড়িতে থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় চব্বিশ বার তোমার খোঁটা শুনতে পারব না।”
মুবিন একথা বলে ঘরে চলে গেল। জায়িনকে দেখে সুমনা যেন ভরসা খুঁজে পেল। বড়ো ছেলেই বাবা ছেলের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব মেটাতে পারবে। জায়িন কিছুই বুঝতে পারছে না। কয় ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে? ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে কী এমন হয়ে গেল!
“মা কী হচ্ছে এসব?”
“দেখ না বাবা। তোর বাবা আর ভাই মিলে কী শুরু করেছে। আমার কোন কথাই শুনছে না। তুই একটু বোঝা বাবা।”
“হ্যাঁ, কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো বলবে?”
মুবিন ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সুমনা ছেলের হাতে ব্যাগ দেখেই হাহুতাশ করতে লাগলেন। জায়িন ঘটনা পুরোটা না জানলেও বড়ো ভাই হিসেবে মুবিনকে শাসন করে বলল,
“কী হচ্ছে কী মুবিন? অনেক বড়ো হয়ে গেছিস না? ব্যাগ ঘরে রেখে আয়।”
মুবিন আজ কারো কথাই শুনবে না। যে বাড়িতে তার নিজের ইচ্ছের কোন দাম নেই সেই বাড়িতে থাকার চেয়ে ফুটপাতে রাত কাটানো ভালো। জামান হোসেন মুবিনের রাগের আগুনে ঘি ঢাকার কাজ করে বলে উঠলেন,
“আহা যেতে দাও। যাক, বাইরের জগতটা দেখে আসুক। দুদিনেই স্বপ্নের পেছনে ছোটার নেশা কেটে যাবে। তখন সুরসুর করে নিজে থেকেই বাড়ি ফিরে আসবে।”
জায়িন কাউকেই থামাতে পারছে না। বাবা থামার নামই নিচ্ছে না। আজ মুবিনও ছেলে মানুষী করা থেকে পিছু হাঁটবে না। তার স্বপ্ন নিয়ে বাবার এরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য শুনে মুবিন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল, এই বাড়িতে আর না। মুবিন চলে যেতে নিলে জামান হোসেন আবার বললেন,
“অহো তুমি যে ব্যাগটা নিয়ে যাচ্ছ সেটাও আমার টাকায় কেনা। ব্যাগের ভেতর যে জামাকাপড় গুলো নিয়েছ সেগুলোও আমি কিনে দিয়েছি।”
মুবিন বাবার মুখের উপর কিছু বলার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। জামান হোসেন তাচ্ছিল্য করে হেসে বললেন,
“তোমার নিকর্মা বন্ধুরা যে ফোনে কল করছে সে ফোটাও আমারই টাকায় কেনা।”
বাবার এসব কথা মুবিনের আত্মসম্মানে আঘাত করছে। সে হাতের ব্যাগ, ফোন সব টেবিলের উপর রেখে দিল। জায়িন হতাশ হয়ে বাবার ছেলেমানুষী দেখছে। বাবা ইচ্ছে করে মুবিনকে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে বেশ বুঝতে পারছে। মুবিন দুপা হেঁটে বাবার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার ওর কন্ঠে রাগ নেই। বরং চ্যালেঞ্জ দেওয়া গলায় বলল,
“তুমি ভাইয়াকে কন্ট্রোল করতে পারো। কিন্তু আমাকে পারবে না। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নিজে নিব। ভবিষ্যতে গিয়ে ওই সিদ্ধান্ত ভুল হলেও আমি পস্তাব না। কারণ সিদ্ধান্তটা আমার ছিল। কিন্তু তোমার চাওয়া মতো জীবনে যদি আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েও যাই তবুও আমার আফসোস থাকবে। কারণ আমি নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা, শখকে গুরুত্ব দিইনি। বরং তোমাকে খুশি করতে গিয়ে নিজের খুশিকে গলা টিপে হত্যা করে সেই অবস্থানে পৌঁছব। আমি না তোমার বড়ো ছেলের মতো অত মহান নই আব্বু। আমি ভীষণ স্বার্থপর। কারণ আমি তোমাকে খুশি করতে গিয়ে এমন কোন কাজই করতে পারব না যেটাতে আমার মন সায় দিবে না।”
বাবাকে কথাগুলো বলে জায়িনের সামনে দিয়ে যাবার সময় একটু থেমে মুবিন ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেল।
“আর ভাইয়া, ছোট ভাই হয়েও আজ তোমাকে আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই। যতদিন তুমি আব্বুর হাতের কাঠ পুতলি হয়ে থাকবে ততদিনই আব্বু তোমাকে নিয়ে গর্ব করবে। একবার আব্বুর বিরুদ্ধে গিয়েই দেখো না। তখন তুমিও আমার মতোই অপদার্থ হয়ে যাবে। আজ তুমি উনার সব কথা শুনছো বলেই তুমি উনার যোগ্য সন্তান। গুড বয়। আমার মতো একটিবার নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দাও। নিজের মন কী চায় সেটা শোনো। নিজের খুশির জন্য কোন কাজ করো। তখন আব্বু তোমাকেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। ভেবো না তোমাকে হিংসে করে কথাগুলো বলছি। আমি এই একটা কাজই পারি না। নয়তো আর সব পারি।”
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৫০
মীরা মাহিমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না, আমার ফোনও ধরছে না।”
“আমারটাও না। করছে কী বল তো?”
মীরা মাহিমার পাশে বসে পিঠের উপর দিয়ে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বোন রে, এখন থেকেই এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যা। আরও কতকিছু যে তোকে সহ্য করতে হবে। কল তুলবে না। আগের মতো সময় দিতে পারবে না। এমনকি এখন আর লুকিয়ে চুকিয়ে ঘুরতেও যেতে পারবি না। তোকে তো কেউ চিনবে না। কিন্তু তোর সেলিব্রিটি বয়ফ্রেন্ডকে সবাই চিনবে। বিশেষ করে মেয়েরা তো মুবিন ভাইয়ের পেছনে দৌড়বে। মুবিন ভাইয়ের ভালোবাসা যদি একশো ভাগ খাঁটি হয় তাহলে সে তোকে ছাড়বে না। নইলে তোমার কপাল পুড়ল বলে।”
মাহিমা নাক ফুলিয়ে মীরার দিকে তাকাল। ওর হাতপা চলার আগেই মীরা লাফিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল। সেখানে থেকেও বলে চলল,
“খুব তো বলছিলি, বয়ফ্রেন্ডকে তুই জামাই ভাবিস না। মুবিন ভাই তোকে ছেড়ে দিলে তুই এক্সকে ভুলে নেক্সট খুঁজবি। এখন তো তোর কথা কাজের কোন মিল পাচ্ছি না। বেচারা এক দুপুর তোর কল তুলেনি বলেই তুই কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিস!”
“কই কাঁদছি আমি? চোখে বেশি দেখিস তুই।”
“অবশ্যই কাঁদছিস। সব কান্নাই যে প্রকাশিত হবে এমন তো আইন নেই। মনে মনে কাঁদছিস। আমার চোখ ভালো বলেই তোর মনের কান্নাও দেখতে পারছি।”
“আল্লাহর দোহাই লাগে তুই আমার সামনে থেকে যা মীরা। নইলে এক্ষুনি কোন একটা অঘটন ঘটে গেলে আমি দায়ী থাকব না।”
“এত চেততেছিস ক্যান? আমি কি তোর শত্রু? বোন আমরা। তোর দুঃখের দিনে আমি কীভাবে তোকে একা ফেলে চলে যাই বল। আয় তোকে সান্ত্বনা দিই। না, না কাঁদে না বাবু। ”
….
পাঁচ মিনিটের থেকেও কম সময়। এই সময়টুকুর মাঝেই কতকিছু হয়ে গেল জায়িন কিছুই বুঝতে পারল না। মুবিনের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কারণ এখনও তার অজানা। বাবাই বা হঠাৎ মুনিনের উপর এত চেতলো কেন? মুবিন চলে গেলে সুমনা স্বামীর উপর রাগে, কষ্টে কাঁদতে লাগলো। মুবিনের বলা কথাগুলো এখনও জামান হোসেনের কানে বাজছে। সারাজীবন ছেলেদের ভালো চেয়ে এসে শেষ বয়সে এই প্রতিদান পেলেন তিনি! জায়িন মা’র কান্না থামাতে পারছে না। আবার বাবাকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। মুবিনটা কেন এভাবে বাবাকে কষ্ট দিয়ে কথা বললো? বাবা কি ওর খারাপ চায়? জামান হোসেন ঘরে চলে গেলে জায়িন মা’কে ধরে সোফায় বসিয়ে দিল।
“মা প্লিজ, কাঁদছো কেন তুমি? মুবিন তো ওরকমই পাগল। এখন রাগ করে চলে গেছে একটু পরে ফিরে আসবে।”
সুমনা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল,
“আসবে না। দেখলি না তোর বাবা কীভাবে ছেলেটাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল।”
“আসবে। মুবিন না এলে আমি ওকে জোর করে নিয়ে আসব। বাবা তো ওর ভালোটাই চায় মা। কিন্তু পাগলটা তো সেই কথা বুঝে না।”
“মাঝে মাঝে বেশি ভালো চাওয়াটাও খারাপ হয়ে যায়। সন্তান বড় হলে তাদের স্বাধীনতা দিতে হয়। সারাজীবন কি আমরা তোদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারব? বাবা, মা হয়েছি বলে কী হয়েছে? আমাদের সিদ্ধান্ত কেন তোদের উপর চাপিয়ে দিব? তোদের নিজেও কিছু শখ আহ্লাদ থাকতে পারে বাবা মা হয়ে এই কথা কেন বুঝতে চাইব না?”
মা’কে কোনরকমে শান্ত করে জায়িন রুমে এসে দেখল তার ফোনে আবিরের নয়টা মিসড কল। আবির এতবার কেন কল করছে? জায়িন ফোন হাতে নিয়ে কল ব্যাক করল। আবির শুরুতেই গড়গড়িয়ে বলতে লাগল,
“ওরে শালা ফোন তুলিস না কেন? আমাদের ছোট হিরো তো ছোপা রুস্তম নিকলা। কী কাণ্ডটাই না বাঁধিয়েছে। আমি ইমপ্রেসড।”
আবির কীসব বলে যাচ্ছে তার কোন কথাই জায়িনের বোধগম্য হচ্ছে না। সে আবিরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এক সেকেন্ড থাম। শ্বাস নে। কী বলছিস এসব? বুঝিয়ে বল।”
“এহ লে, তুমি এখনও কিছুই জানো না?”
জায়িন কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কী জানব?”
আবির গাধাটাকে গালি দিতে গিয়েও দিল না। শুধু শুধু মুখ নষ্ট করার দরকার কী? গাধা কি কোনদিন মানুষ হয়? জায়িনটাও হবে না।
“কল রাখ গাধা। অনলাইনে আয়। দেখাচ্ছি কী হয়েছে।”
জায়িন ভিডিওটা দেখে এবার বুঝলো বাবা কেন এতটা চটেছে। মুবিনের জন্য গানবাজনা বাবার পক্ষ থেকে একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। মুবিন এই কাজটাই করছে দেখেই বাবা রাগ সামলাতে পারেনি। জায়িন ভিডিওটা পরপর কয়েকবার দেখল। তার ভাইয়ের এই গুণের উপর সে মুগ্ধ হলো। জায়িনের পক্ষ থেকে মুবিনের জন্য কোনো কিছুতেই কখনও বাধা ছিল না। ও যা করতে চায় করতে দিয়েছে। ছোট ভাইকে সে এবারও নীরবে সাপোর্ট করে যাবে।
….
মুবিন মীরা মাহিমার কারোর কলই তুলছে না। এতে অবশ্য মীরার কোন চিন্তা হচ্ছে না। কিন্তু মাহিমা এতেই চিন্তা করে করে হার্টের রোগী হয়ে গেছে। আরে বাবা এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। ছেলেটাকে সবকিছু সামলে নিতে দে। তা না, নিব্বি গার্লফ্রেন্ডের মতো বয়ফ্রেন্ডের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কই, সে-ও তো জায়িন ভাইকে ভালোবাসে। এইযে জায়িন ভাই দুই মাস/চার মাস পরপর বাড়ি আসে মীরা তো তখন এরকম করে না। এতগুলো দিন তো সে মানুষটাকে না দেখে, কথা না বলেই থাকে। মানুষটা দূরে থাকলে মীরা তাকে আরও বেশি করে অনুভব করতে পারে। কাছে এলেই তো কেমন যেন কনফিউজড হয়ে যায়।
“মীরা তুই একবার দেখ না। ওবাড়িতে যা না। তুই তো মুবিন ভাইয়ের কাছে পড়তে যাস।”
“তা সপ্তাহের বাকি ছয় দিন তো যাই-ই। কিন্তু শুক্রবারে তো যাওয়ার কথা না। আজ পড়তে যাওয়ার নাম নিলেও তোর মামীরা আমাকে প্রশ্নের তীরে খুলে খাবে।”
“আমি এখন কী করব তুই বল। কাল রাতের পর থেকে একটা বারও কথা হয়নি। এইযে কল করছি কিন্তু সে তো কলই তুলছে না।”
“আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়। তুই শান্ত হ তো। কী নিব্বি গিরি করছিস! তোর কি সেই বয়স আছে? কলেজে পড়িস একটু তো ম্যাচিউরিটি দেখা।”
কে কাকে ম্যাচিউরিটি দেখানোর কথা বলছে! অন্য দিন মাহিমা তর্ক করলেও আজ তার সেই মুড নেই। মাহিমার কল রেখেই মীরা মুবিনকে কল করে যাচ্ছে।
“আহা প্রেম! এমন কঠিন প্রেম আমার কেন হলো না? আমি তো উনাকে না দেখে, কথা না বলেও দিব্যি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেই দিন কাটিয়ে দিতে পারি। কইতরি একদিনেই বিরহে মরে যাচ্ছে।”
রিং হচ্ছে। কিন্তু মুবিন কল তুলছে না। তুলবে কিকরে? ফোনটা মুবিনের কাছে থাকলে তো! সে তো রাগ করে বাড়ি থেকে বের হবার সময় ফোন রেখে গেছে। কিন্তু মীরা তো এই কথাটা জানে না। তাই সে ধৈর্যের সাথে কল করেই যাচ্ছে।
“মুবিন ভাই, করছিলেনটা কী আপনি? কল ধরছিলেন না কেন? কম হলেও একশোটা কল দিয়েছি। আপনি তো অনেক খারাপ। নতুন নতুন সেলিব্রিটি হয়েই দাম দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন! পুরোপুরি সেলিব্রিটি হয়ে গেলে তো আপনার দেখাই পাব না। আপনার সাথে কথা বলার জন্য লাইন ধরতে হবে। আপনি যত বড় সেলিব্রিটিই হোন না কেন, আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু ভুলে যাবেন না। তাহলে আপনার কপালে খারাবি আছে ”
মীরার শেষের কথাটা শুনে জায়িনের কপালে ভাঁজ পড়ল। মীরা মুবিনের মাঝে সেরকম কোন সম্পর্ক আছে নাকি? মুবিন ও মীরার মাঝে স্যার স্টুডেন্ট ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক হতে পারে জায়িন এটা কোনদিন কল্পনাতেও আনেনি। জায়িন শক্ত পুরুষালী গলায় বলল,
“মুবিন ভাই না। জায়িন ভাইয়ের সাথে কথা বলছো তুমি।”
মীরা ভড়কে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যিই তো জায়িন ভাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু নাম্বার তো মুবিন ভাইয়ের নামেই সেভ করা। ইশ, ভাগ্য ভালো আজ দুলাভাই ডাকেনি। মুখ ফসকেও একবার এই শব্দটা বেরিয়ে গেলেই সেরেছিল।
“মুবিন ভাইয়ের ফোনে আপনি কেন? আপনি জানেন না এভাবে অন্যের ফোন তুলতে নেই।”
মুবিনের ফোন তুলেছে বলে মীরা রাগ করছে! আশ্চর্য, জায়িনের তার নিজের ভাইয়ের উপরই হিংসে হচ্ছে। সে মনে মনে বলল,
” মুবিনের বাচ্চা, ভাবীকে পড়াতে পড়াতে ভাইয়ের সম্পত্তির উপরই হাত দিয়েছিস! ভুলেও এই কাজ করে থাকলে আমি তোর হাতই ভেঙে দিব। তখন তুই গিটার বাজাস!”
মনে মনে মুবিনের কাজের শাস্তি ঠিক করে ফেললেও গলা স্বাভাবিক রেখেই ফোনে বলল,
“না জানলেও এখন তো তুমি জানিয়ে দিলে।”
মীরা মনে মনে বলল, কথা জানে! মানুষের সামনে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না এমন ভাব ধরে থাকে। এই লোকটাকেই কি-না আমি মন দিয়ে বসে আছি! ব্যাটা মিনমিনা তো আমার মনের কথা বুঝতেই পারে না। ওপাশ থেকে কোন কথা আসছে না দেখে জায়িন বলল,
“কী বলার আমাকে বলো।”
“আপনাকে কেন বলব? আপনি কি মুবিন ভাই? আমার কথা মুবিন ভাইয়ের সাথে।”
জায়িনের সত্যি সত্যিই তার ভাইয়ের উপর অসম্ভব রাগ হচ্ছে। তুই ব্যাটা স্টুডেন্ট পড়িয়ে পরীক্ষায় পাস করাবি। স্টুডেন্টের সাথে তোর এত খাতির থাকবে কেন? এই স্টুডেন্ট তোর ভবিষ্যত ভাবী কেন জানলি না হ্যাঁ?
“মুবিন ভাইয়ের সাথে এত কিসের কথা তোমার? যার সাথে কথা থাকার কথা, তার সাথেই তো বলো না।”
“কার সাথে কথা বলি না আমি? আমি সবার সাথেই কথা বলি। আর আপনি কবে থেকে এত কথা বলতে শুরু করেছেন? এটা কিন্তু আপনার নতুন রুপ।”
মীরা যদি ঘূনাক্ষরেও টের পেত জায়িন নিজের ভাইকে নিয়েই জেলাস হচ্ছে তাহলে জায়িনকে আরও জেলাস ফিল করাতে কী কী করত তা আল্লাহই ভালো জানেন।
জায়িন নিঃশব্দে হেসে গলাটা সামান্য খাটো করে বলল,
“এখনও তো আরও অনেক রুপ দেখার বাকি। সব রুপ তুমিই তো দেখবে। আমি তো জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। এই কথাটা যেভাবেই হোক তোমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেব।”
“চিউচিউ করে কী বলছেন? মুবিন ভাই কোথায়?”
“নেই।”
“নেই মানে? কোথায় গেছে?”
“তোমার সেলিব্রিটি মুবিন ভাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।”
চলবে_
চলবে