#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬১
তনি পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে। ছেলের বাবার তনিকে আগে থেকেই পছন্দ ছিল। ছেলে আজ প্রথম তনিকে দেখছে। তনি কী সুন্দর করে হেসে হেসে ওদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে! এটা দেখে রাগে মীরার গা জ্বলে গেল। মনে মনে বলল,
“আবির ভাই, তুমি এমন একটা মেয়েকে ভালোবাসলে! ছি ছি তনি আপু। তুমি আমার ভাইটার সাথে এরকম করতে পারলে? আর্মি ছেলে পেয়ে তুমি এভাবে পল্টি খেয়ে গেলে! ছি।”
তনির মনের ভেতর কী চলছে তা সে সবার থেকে লুকিয়ে একপ্রকার জেদ থেকেই ছেলের সামনে এসেছে। ছেলের বাবার কোনকিছু জানার নেই। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোর কিছু জানার থাকলে বিয়ের আগেই জেনে নে। পরে বলিস না বাপের জন্য সুযোগ পাইনি৷”
কথাটা বলে তিনি এমনভাবে হাসলেন যেন ভীষণ মজার কোন কৌতুক বলেছেন। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন,
“আজকালের যুগ পাল্টে গেছে। ছেলেমেয়ে নিজেদের না জেনে বিয়ে করতে চায় না। আমরা তো ভাই মেয়ে না দেখেই বাবা মা’র কথায় বিয়ে করে নিয়েছি। ইচ্ছা থাকলেও লজ্জায় বলতে পারিনি মেয়ের সাথে একবার কথা বলবো। তোদের সুযোগ আছে। আলাদা কথা বলতে চাইলে আমাদের কোন আপত্তি নেই।”
মাহিমার ইচ্ছে করছে হাতের কাছের কোনকিছু দিয়ে বুড়োটার মাথায় মেরে বসতে। বুড়ো বক তার গাধা ছেলেকে নিয়ে এসে তার ভাইয়ের না হওয়া সংসার ভাঙতে চাচ্ছে। তনি আপুটাও ন্যাকার একশো। মাহিমা দাঁত পিষে বলল,
“খাটাশ বুড়ো মর তুই। তোর ছেলেটারও মাথার চুল সব পড়ে যাক। টাক হয়ে সারাজীবন অবিয়াইত্তা থেকে যাক। আমার ভাইয়ের সুখ কেড়ে নিতে এসেছে। কত বড়ো সাহস।”
তনি আর ছেলেটাকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। তনি উনাকে নিয়ে ছাঁদে গেছে। মীরা মাহিমাও পেছন পেছন যেতে চাইলে ছোট চাচী চোখ পাকিয়ে বারণ করলো। ওরা একা কী কথা বলবে জানতে না পারলে পেটের ভেতর মোচড়ামুচড়ি শেষ হবে না। তবুও উপায় নেই। ওরা ফিরে আসার আগেই আবিরের আগমন ঘটেছে। আবিরকে দেখে মীরা মাহিমা খুশি হয়ে গেল। আবির ভাই চলে এসেছে। এবার আর কোন চিন্তা নেই। তনির বাবা আবিরকে দেখিয়ে বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দিল।
“আমার ছোট বোনের ছেলে। আবির। কখন ফিরলি? এদিকে আয়।”
আবির মামার পাশে গিয়ে বসল। মামা কী বলছে ওদিকে তার ধ্যান নেই। সে সবার মাঝে তনিকে খুঁজছে। পেত্নীটা কি সত্যি সত্যিই এদের সামনে আসেনি? যাক, আবির মনে মনে খুশি হলো। পেত্নীটা শুধু মুখে বলে না। সত্যিই তাকে ভালোবাসে। আবির মনে মনে এসব ভেবে খুশি হতে থাকলেও তার খুশি দীর্ঘ স্থায়ী হলো না। কারণ তনিকে একটা ছেলের সাথে আসতে দেখা গেল। আবির এটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল তনির মুখে হাসি লেগে আছে। ছেলেটার কোন কথায় সে লজ্জা পেয়ে হাসছে! ওদের আসতে দেখে ছেলের বাবা বলল,
“ওইতো ওরা এসে গেছে। তোরা তো গেলি আর ফিরে এলি। এত অল্প সময়ে কথা শেষ!”
তনি ফিরে এসে আগের জায়গায় বসল। আবিরকে দেখেও সে কোনরকম প্রতিক্রিয়া জানাল না। আবির কিছু সময়ের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেলেও তনি স্বাভাবিকই আছে। আবির অবিশ্বাস্য চোখে তনিকে দেখছে। অথচ তনি ওর দিকে তাকাচ্ছেই না। আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে মীরার কান্না পাচ্ছে। তনি আপু এত খারাপ! ছি!
উনারা এবার চলে যাবেন। যাবার আগে ছেলের বাবা বন্ধুকে বললেন,
“আজ তাহলে উঠি। বাকি কথা নাহয় আমার ছেলে লম্বা ছুটি নিয়ে ফিরে এলেই সারব। এখান থেকে গিয়েই ও চলে যাবে। তাই তো এত তাড়াহুড়ো করে আসা।”
তনির বাবা, চাচা, ভাই উনাদের বিদায় জানাতে গেল। ছেলের যে তনিকে পছন্দ হয়েছে তা বলার বাকি রাখে না। এই বিষয়টা নিয়েই সবাই খুশি। মা চাচীরা নিজেদের কাজে চলে গেল। মীরা মাহিমা এখনও যাচ্ছে না। আবির নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। তনি এবার আবিরের দিকে নজর দিল। তার একটুও খারাপ লাগছে না। আবির শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কেন এমন করলি?”
তনি না জানার ভান করে বলল,
“কী করলাম?”
আবির আজ মীরা মাহিমার সামনে নিজের সম্পর্কের কথা লুকাতে চাইলো না। ওদের উপস্থিতিতেই বলল,
“এই ছেলেটাকে বিয়ে করবি?”
“বাবা চাচা দিতে চাইলে না করতে পারব না।”
“আমাদের মাঝে যে একটা সম্পর্ক ছিল সেটা ভুলে যাবি?”
“তুমি কিছু করতে না পারলে ভুলতে তো হবেই।”
“তুই বলেছিলি আজ ওদের সামনে আসবি না।”
“তুমিও বলেছিলে সামনে এলেই নাকি ওরা আমাকে পছন্দ করে নিবে না। ছেলেই আমাকে রিজেক্ট করে দিবে। তোমার ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে।”
আবির এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এবার ক্ষেপে গেল। বসা থেকে উঠে এসে তনির দু’বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বসা থেকে তুলে ফেলল।
“ওই ছেলেকে বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছিস, না! আর্মি ছেলে ছাড়া তোর বাপ বিয়ে দিবে না। ঠিক আছে। আমিও দেখব। আমাকে ভুলে যাবি? এত সহজ! মেয়ে না থাকলে তোর বাপ কাকে বিয়ে দেয় দেখব। তুই আমার না হলে আমি তোকে অন্য কারো হতে দিব ভেবেছিস। ছোট থেকে একসাথে থেকেও এটুকু চিনলি না! আমার জিনিস শুধু আমার। ছোটবেলা আমার কোন খেলনা তোর পছন্দ হলে আমি সেটা ভেঙে ফেলতাম যেন তুই নিতে না পারিস। তুই কীভাবে ভাবলি তোকে আমি এত সহজে অন্য কাউকে দিয়ে দেব।”
….
মীরা জায়িন পাশাপাশি বসে আছে। অনেকটা সময় ধরে মীরা চুপ করে আছে। কিছুই বলছে না। তার উদাসী দৃষ্টি লেকের ওই পাড়ে। জায়িন মুগ্ধ চোখে প্রেয়সীকে দেখলেও তার উদাসী ভাবটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। মাহিমা মুবিনের সাথে ঘুরতে গেলে মীরা জায়িনকে কল করেছে৷ জায়িন তখন হাসপাতালে থাকলেও কোনরকমে বেরিয়ে এসেছে। জায়িন যে পাশে বসে আছে এটা কি মীরা ভুলে গেছে? জায়িন নিজেই গলায় শব্দ করল। মানুষের চিন্তা নিয়ে এই মেয়ের ঘুম হারাম হয়। একে নিয়ে সারাটা জীবন কীভাবে চলবে সে?
“মন খারাপ?”
মীরা জায়িনের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল,
“হুম।”
“খুব বেশি খারাপ?”
“হু।”
জায়িন আর কিছু না বলে সাথে সাথে উঠে গেল। মীরা ভেবেছে জায়িন হয়তো চলে যাচ্ছে। সে মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেলো। কিন্তু জায়িনকে আটকালো না। কিন্তু একটু পরই জায়িন এসে তার পাশে বসলে মীরা এদিকে তাকালো। জায়িনের হাতে দুইটা আইসক্রিম। সে দুইটাই মীরার দিকে এগিয়ে ধরে মিষ্টি হেসে বলল,
“মন ভালো হওয়ার জন্য এটুকু যথেষ্ট?”
মীরা তখনও মুখ গোমড়া করে রেখেছে। তবুও সে আইসক্রিম দুইটা নিলো। মীরা এখনও স্বাভাবিক হচ্ছে না দেখে জায়িন নিরাশ হলো। তখনই মীরা বলল,
“মেয়েদের মন কি এত অল্পতে ভালো হয়? এটাও জানেন না।”
“আরও আইসক্রিম লাগবে তোমার?”
“আমি কি রাক্ষস? আইসক্রিমের কথা কে বলছে? মেয়েদের মন তাজা একটা বেলি ফুলের মালা পেলেই ভালো হয়ে যায়। খুব দামী কিছু লাগে না।”
জায়িন হাসলো। এ মেয়ে পাগল! নইলে মন খারাপের মাঝেও কেউ আবদার করে? জায়িন আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল। এখানে কোন ফুলের দোকান নেই। কাপলদের সময় কাটানোর জন্য জায়গাটা মোটামুটি ফেমাস। কিন্তু এমন একটা জায়গায় ফুল বিক্রি হয়না এটা মোটেও ঠিক না। অন্তত হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রেমিক প্রেমিকার কাছে ফুল বেচা উচিত ছিল।
“আবির, তনির বিষয়টা নিয়ে তুমি এখনও মন খারাপ করে থাকবে?”
“থাকব না? তনি আপু তো আবির ভাইকে ভালোই বাসেনি। আবির ভাই বেচারা কাল কত কষ্ট পেয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় ওর চোখ লাল টকটকে ছিল। আবির ভাইকে আমি কোনদিন ওরকম দেখিনি। আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল।”
“তনিকে তুমি ভুল বুঝছ মীরা। ওদের সম্পর্কে আবির যতটা না সিরিয়াস তার থেকেও কিন্তু তনি অনেক বেশি সিরিয়াস।”
“কেমন সিরিয়াস তার নমুনা দেখেছি তো। বাপের কথাতে নেচে নেচে বিয়ে করে ফেলতে চাচ্ছে।”
“আচ্ছা আমরা কি ওদেরকে নিয়ে টেনশন করার জন্য দেখা করেছি?”
“হু, আমার মন খারাপ। আপনি তো আমার মন ভালো করার জন্য কিছুই করছেন না।”
“একটু আগেই না করলাম?”
“দুইটা আইসক্রিম দিয়ে! আমি কি খেতে পাই না বলে মন খারাপ করে আছি? আমি তো আবির ভাইয়ার সাথে সাথে আমাদের নিয়েও টেনশন করছি। কই আপনি তো একবারও বললেন না, আপনি তনি আপুর মতো এমন করবেন না। আপনি শুধু আমাকেই ভালোবাসেন। বিয়েও আমাকেই করবেন। আপনি এমন কেন? কিচ্ছু বুঝেন না। সবকিছু আমাকে বলে দিতে হবে কেন?”
….
আজ বাড়ি ফিরতে অন্যান্য দিনের থেকে দেরি হলে মীরাকে তনির জেরার সামনে পড়তে হলো। কিন্তু মীরা এবার তনিকে পাত্তাই দিল না। সে নিজে আবির ভাইয়ের সাথে যা করেছে তার জবাব কি মীরা চেয়েছে?
“কী হলো? কথা বলছিস না কেন? আজ এত দেরি হলো কেন?”
“এমনি হয়েছে।”
“এমনি!”
“হ্যাঁ। তোমাকে সবকিছু বলতে হবে! তুমি কি আমাকে সবকিছু বলো?”
“কী বলবো তোকে আমি?”
“কিছু না। আমি তোমার সাথে কথা বলবো না।”
একথা বলে মীরা যাওয়া ধরলে তনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।
“কী আজব! এর আবার কী হলো?”
তনি ইচ্ছে করেই আবিরের কল তুলছে না। শয়তানটাকে একটু শিক্ষা দিতে চায় সে। তাকে দেখতে আসবে এই কথাটা শুনেও মজা করেছে। এবার তনিও একটু মজা করবে। শয়তানটা বুঝুক কেমন লাগে। সেদিন ছেলের সাথে তাকে একা কথা বলতে দেওয়ার সময়ই তনি উনাকে বলে দিয়েছে,
“আপনি হয়তো জানেন না, আমি একজনকে ভালোবাসি। সম্পর্কে সে আমার ফুপুর ছেলে। একটু পরেই দেখবেন পাগল হয়ে চলে আসবে। বাবা জোর করলে হয়তো আমি আপনাকে বিয়ে করে নেব। কিন্তু কোনদিনও ভালোবাসতে পারব কি’না বলতে পারছি না। একজন মানুষকে যতটা ভালোবাসলে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবা যায় না, আমি আবিরকে ঠিক ততটাই ভালোবাসি।”
তনির কথা শুনে ছেলেটা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে,
“একটা কথা বলি? আপনার আগেও বাবা আমাকে চৌদ্দ জন মেয়ে দেখিয়েছে। দুঃখের বিষয় আমার কাউকেই পছন্দ হয়নি।”
লোকটা কথা শেষ করার আগেই তনি হাসি চেপে বলে উঠল,
“আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে!”
লোকটা দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। তনি শব্দ করে হেসে বলে উঠল,
“কিন্তু গাধাটা বলেছিল আমাকে আপনার পছন্দ হবে না। আপনিই নাকি আমাকে রিজেক্ট করে দিবেন। আমাকে টেনশন করতে হবে না।”
“আপনি যাকে ভালোবাসেন সেই ভাগ্যবান মানুষটার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে।”
“আরেকটু থাকুন। আপনার ইচ্ছে পূরণ হবে। আপনি আমার একটা কথা রাখবেন?”
“আপনাকে পাওয়ার ইচ্ছে তো পূরণ হবার নয়। আপনার ইচ্ছাই রাখা যাক। বলুন।”
তনি তখনই প্ল্যান করেছে। গাধাটাকে জন্মের শিক্ষা দেবে। যেন পাগল হয়ে তার পেছনে আসে। ডরভয় ঝেড়ে চৌদ্দ গোষ্ঠীর সামনে ভালোবাসার কথা বলতে পারে। হারানোর আগে কেউই বুঝে না মানুষটা তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই গাধাও হারিয়েই মূল্য দেওয়া শিখবে।
চলবে..#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬২
এনায়েত হোসেন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে বাপ, হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেলি কেন? নতুন কোন কৌতুক শিখস নাই?”
মাহিমা প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বাবার দিকে তাকাল। নিজের ভাইয়ের কষ্ট সে দেখতে পারছে না। বাবাও হয়তো কিছু আন্দাজ করেছে। মাহিমা ভাইকে দেখল। সে নিজেই কি বাবাকে বলে দিবে? কারণ তার ভাই তো বলতে পারবে না।
“বাবা ভাইয়ার যেন কী হয়েছে। তুমি জিজ্ঞেস করো তো ভাইয়ার কী হয়েছে।”
“জিজ্ঞেসই তো করলাম। কিরে বাপধন, কী হইছে তোমার?”
“কিছু হয়নি আব্বা।”
“কিছু হয়নি বললেই হলো? আমার বাপটার মুখ এমন চুপসে গেছে কেন? কোন কারণ ছাড়াই? উহু, বাপের থেকে কী লুকচ্ছিস বল।”
“কিছু না আব্বা।”
এনায়েত হোসেন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ছেলের মনমরা অবস্থা মায়ের চোখেও পড়েছে। হঠাৎ করে কী হলো ছেলেটার? এই ছেলে দুষ্টামি, ইতরামি না করলে তিনবেলা ভাত খেতে পারত না৷ দুই দিন ধরে ছেলেটা কেমন চুপ হয়ে গেছে।
“আবির, আব্বা। কী হইছে তোর?”
“কিছু না মা। তোমরা খাও। আমার ভালো লাগছে না।”
আবির খাবার রেখে উঠে গেল। মাহিমার বাবা মা’কে বলে দিতে ইচ্ছে করল। তনি আপুর জন্য আবির ভাই এমন করছে বাবা। তনি আপুর বিয়ে হয়ে গেলে তোমার ছেলে আর কোনদিন আগের মতো হাসতে পারবে না। তুমি কিছু করো মা। তোমার ভাইয়ের কাছের নজর দূর্বল। তাইতো আমার ভাইটাকে রেখে অন্য ছেলে খুঁজছে। বলার আগে মাহিমা ভাবল। একবার মীরার সাথে কথা বলে নিই। মীরা বললে সবাইকে জানিয়ে দেব।
“আমারও খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”
মাহিমাও উঠে গেল। ছেলে মেয়ের একসাথে কী হলো? কারোরই খেতে ইচ্ছে করছে না।
“আমার ছেলেমেয়ে দুইটার কী হলো বলো তো?”
“জানি না। আমার ছেলেটার জন্য বেশি চিন্তা হচ্ছে। ওর নিশ্চয় কিছু হয়েছে।”
…
জায়িন বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছে। বন্ধুর দুর্দিনে একটু সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। আধঘন্টা ধরে বসে আছে সে। আবির আরও বিশ মিনিট আগে বলেছে সে চলে এসেছে। এইতো পৌঁছে গেছে। আর পাঁচ মিনিট। আবিরের পাঁচ মিনিট কখন শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। জায়িন বিরক্ত হয়ে আবিরকে কল করল। রিং হচ্ছে কিন্তু আবির তুলছে না।
“গাধাটার জীবনেও কাণ্ডজ্ঞান হবে না। যা খুশি করুক গিয়ে। আর অপেক্ষা করতে পারব না।”
জায়িন উঠতেই নিচ্ছিল তখনই আবির জায়িনের সামনে বসতে বসতে বলল,
“এতবার কল করতে হয়? বলেছি তো পৌঁছে গেছি।”
“তোর ঘড়িতে পাঁচ মিনিট বিশ মিনিটে হয়?”
“তোর মতো ঘড়ির কাটার সাথে চলতে পারব না। একটু এদিকওদিক হবেই।”
জায়িন তর্ক করল না। এর সাথে যুক্তিতর্ক করে লাভ নেই। আবিরকে বেশ হাসিখুশি লাগছে। মীরার মুখে যতটা শুনেছিল এর মাঝে তো তেমন কোন কষ্টই দেখা যাচ্ছে না।
“কী খাবি বলে ফেল। চিন্তা করিস না। আজ আমি খাওয়াবো। যা খুশি অর্ডার কর।”
“হঠাৎ তোর মন এত উদার হয়ে গেল কীভাবে? ঘটনা কি?”
“ঘটনা তোর বন্ধুর বিয়ে। পাত্রীর আগেও তোকে দাওয়াত দিলাম।”
“মানে?”
“সহজ কথাটার মানে বুঝছিস না গাধা!”
“তোর বিয়ে কার সাথে?”
“আমার বউয়ের সাথে।”
“বউটা কে? আর পাত্রীর আগে আমাকে দাওয়াত দিলি মানে কী?”
আবির আরাম করে বসলো। ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিল। জায়িন কিছুই বুঝতে পারছে না। তনি বিয়ে করছে দেখে কী জেদ করে আবিরও বিয়ে করছে!
“আবির হেয়ালি না করে ঝেড়ে কাশ। কাকে বিয়ে করছিস? কবে বিয়ে?”
“কবে সেটা বলতে পারছি না। আমার বাপ বলতে পারবে। আর বিয়ে তো আমি মামুর মেয়েকেই করব।”
“কীভাবে? তনির শুনেছি বিয়ে ঠিক।”
“বিয়ে ঠিক আর বিয়ে হয়ে গেছে। কথাটার মাঝেই তো কত দূরত্ব।”
“তুই কি তনির বিয়ে ভেঙে দিয়েছিস?”
“আমি কিছু করিনি। যা করার আমার পিতা মহাশয় করবে।”
জায়িন এখনও কিছু বুঝতে পারছে না দেখে আবির বিরক্ত হলো।
“কোন কথাই বুঝিস না তুই। এই ব্রেইন নিয়ে ডাক্তার হয়েছিস কীভাবে? শোন, আব্বা আজ মামার সাথে কথা বলতে গেছে। আব্বাকে নামিয়ে দিয়েই আমি এখানে এলাম।”
“আঙ্কেল তোদের কথা জানত?”
“জানিয়েছি। পুত্রের বিরহ দেখে বাপ ঠিক থাকতে পারেনি। গত দু’দিন আব্বা আমাকে লক্ষ করছিল। আমার কী হয়েছে জানার জন্য আজ কান্নাকাটি করে চেপে ধরল। বাপের কান্না দেখে আমিও মরা কান্না জুড়ে দিয়ে বললাম,
‘আমার তনিকেই লাগবে আব্বা। তুমি তনিকে আমার করে দাও। ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। ছোট থেকে ওকে জ্বালিয়েছি। ভবিষ্যতেও জ্বালানোর জন্য আমার ওকেই চাই। তনিকে ছাড়া আমি কীভাবে ভালো থাকব আব্বা?’
ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট ছিল। এখন যা করার আমার বাপই করবে।”
আবিরের বাবার সাথে জায়িনের আলাপ আছে। উনার মতো মানুষ জায়িন আর একটা দেখেনি। ছেলের সাথে উনার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বাবা ছেলের সম্পর্ক এমনও হতে পারে ওদের না দেখলে জায়িন জানত না। মানুষটাকে দেখে জায়িনের আফসোস হতো। বাবার সাথে তার সম্পর্ক কেন এমন হলো না। আবির ফুরফুরে মনে বলে যাচ্ছে।
“আমার সরল প্রকৃতির ঘাড়ত্যাড়া বাপ নিজের শ্বশুরবাড়িকে ছেলেরও শ্বশুরবাড়ি বানিয়ে তবেই ফিরবে। নানার ব্যাটা রাজি না হয়ে যাবে কোথায়? মেয়ে তো রাজি হবেই সাথে ওর বাপও।”
…
মুবিন ও তার বন্ধুরা গতকালের কনসার্ট শেষ করে রাতে ফেলার সময় পেছন থেকে এক ট্রাক তাদের গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে দেয়। মুবিন খুব বেশি আঘাত না পেলেও বাকিদের অবস্থা গুরুতর। ঘটনাস্থলে যারা উপস্থিত ছিল ধরাধরি করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যায়। মুবিন শরীরে তেমন আঘাত না পেলেও বেচারার ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। খবর পেয়ে জায়িন ও তার বাবা ছেলের কাছে ছুটে গিয়েছে। জামান হোসেন হাসপাতালে অসুস্থ ছেলের উপর চোটপাট করতে ভুললেন না।
“আমার কথা কে শুনে? সবাই নিজেদের মন মর্জি মতন চলবে। আজকের দিনটার জন্য কে দায়ী? আমার কথা শুনলে আজ…
মুবিন ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ইশারায় ভাইকে কাছে ডাকল। জায়িন ঝুঁকে মুবিনের কাছে গেলে ফিসফিস করে বলল,
” তুমি একা আসতে পারলে না ভাইয়া? তোমার হিটলার বাপটাকে কেন সাথে নিয়ে এসেছ? আমি মরে গেলেও উনি আমার লাশকে শাসন করবেন। উনার ইচ্ছে মতো কেন মরলাম না সে জন্য গালমন্দ করবে।”
জায়িন চোখ পাকিয়ে নিচু স্বরে ভাইকে শাসন করে বলল,
“বাজে কথা বললে মার খাবি। বাবা তোর জন্য চিন্তা করে।”
“চিন্তা করার নমুনা দেখছি তো। কোথায় জানতে চাইবে আমি কেমন আছি। তা না, উনি ভাঙাচোরা শরীরের উপর চোটপাট করছেন।”
“প্রতিটা মানুষের ভালোবাসা, উদ্বেগ, স্নেহ প্রকাশ করার ধরন আলাদা থাকে। বাবা হয়তো শাসনের মাধ্যমেই ভালোবাসা প্রকাশ করে।”
“এমন ভালোবাসা দিয়ে কী করব ভাই?”
জামান হোসেন ডাক্তারের সাথে কথা বলে ফিরে এসেছেন। চাইলে আজই মুবিনকে বাড়ি নেওয়া যাবে। জামান হোসেন জায়িনের মাধ্যমে মুবিনকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো। আমার বাড়িতে যাওয়ায় এখনও কি তার আপত্তি আছে? আপত্তি থাকলে সে যেখানে যেতে চায় দিয়ে এসো।”
জায়িন বাবাকে বলল,
“এই অবস্থায় ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে।”
“সেটা তুমি বুঝলে তো কাজ হবে না। তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো। কী চায় ও।”
“জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। বাড়ি ফিরবে ও।”
মুবিন নিজেও বাড়ি ফিরতে চায়। একা থাকা তার পক্ষে সম্ভব না এটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছে। মা’র হাতের রান্না ছাড়া বাইরের খাবারও তার গলার নিয়ে নামে না। ফিরতে চেয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু কেউ একটু জোর করেনি। নিজে থেকে ফিরে যেতেও লজ্জা লাগছিল। তাই এবার বাবা যতই খোঁচা দেক। মুবিন আর বেঁকে বসবে না। তবুও মুবিন ভাইকে বলল,
“দেখেছ, তোমার হিটলার বাপ চায় না আমি বাড়ি ফিরি। তাইতো এতবার জিজ্ঞেস করছে। যেন আমি রাগ করে বেঁকে বসি।”
“এবার বেঁকে বোস তো দেখি। তোকে কীভাবে সোজা করতে হয় আমার জানা আছে।”
“তুমি আমাকেই বকবে। তোমার বাপকে কিছু বলবে না।”
“কারণ দোষ তোর। বাবা মায়ের শাসন করার অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের রাগ করে তাদের ছেড়ে যাওয়ার অধিকার নেই।”
“তোমার কাছে মন মহান হওয়ার জন্য কোন ঔষধ বড়ি আছে? থাকলে একসাথে কয়েক ডজন খেয়ে নিতাম।”
….
মুবিনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শুনেই মাহিমা চোখ দিয়ে গঙ্গা যমুনা ভাসাতে লাগলো। ভাগ্য ভালো এবার মীরা গাধীটার সাথে ছিল। নয়তো গতবারের মতো এবারও বাহানা দিত তার সাথে ঝগড়া হয়েছে। মীরা মাহিমাকে শান্ত করার সব চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বসে আছে।
“মুবিন ভাই বেঁচে আছে। তুই এমনভাবে কাঁদছিস যেন…
মীরা কথা শেষ করতে পারল না। মাঝপথে মাহিমার রাগান্বিত দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে চুপ করে গেল।
” ছোট্ট একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। পায়ের হাড়টা একটু ভেঙেছে। ভবিষ্যতে হাঁটতে পারবে। কোন সমস্যা নেই। তোকে কোলেও নিতে পারবে। তবুও কেন কাঁদছিস?”
মাহিমা কাঁদতে কাঁদতে নাক টেনে বলল,
“যেদিন তুই কাউকে ভালোবাসবি সেদিন তার কষ্ট হলে বুঝবি কেমন লাগে।”
“যেমনই লাগুক। আমি তোর মতো ন্যাকা কান্না কাঁদব না।”
এই কথা শুনে মাহিমার কান্না আরও বেড়ে গেল। মীরা অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
“আবার কী হলো?”
“আমি ন্যাকা কান্না কাঁদছি! বোন হয়ে তুই এই কথা বলতে পারলি?”
“আরে বাবা ভুল করে বলে ফেলেছি। মুখ ফসকে নাহয় বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তুই কান্না থামা প্লিজ। বাড়ির মানুষ খোঁজ পেয়ে গেল কী বলবো ওদের? তার উপর তোর বাপও এখনও যায়নি। নিচে কী হচ্ছে জানতেও পারছি না। তোর জন্য ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। ছোট ফুপা কীজন্যে এসেছে রে? তুই তো নিশ্চয় জানিস।”
…
মুবিনের অ্যাক্সিডেন্টের বাহানা দিয়ে মীরা মাহিমাকে নিয়ে জায়িনদের বাড়িতে এসেছে। যাক অ্যাক্সিডেন্টে একটা কাজের কাজ হয়েছে। মুবিন ভাই বাড়ি ফিরে এসেছে। এবার মীরার এবাড়িতে আসতে নতুন কোন বাহানা খুঁজতে হবে না।
প্রাইভেটে আসার আজুহাতে প্রতিদিন জায়িনকে দেখতে পারবে। মীরা বুদ্ধি করে কলেজে যাওয়ার পথে মুবিনকে দেখতে এসেছে। কারণ সকালে না এলে আবার জায়িনকে বাড়ি পাওয়া যাবে না। মীরা মাহিমাকে দেখেই সুমনা খুশি হয়ে গেল। কিছুটা অভিমান করেও বলল,
“এতদিন পর আন্টির কথা মনে পড়েছে! এই তুই আমাকে ভালোবাসিস!”
মীরা আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল,
“তোমাদের কথা ভুলিই কখন যে মনে পড়তে হবে। তোমাকে তো আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
“থাক। আর ঢঙ করতে হবে না। মীরার নাহয় আমাকে মনে পড়ে না। তুমিও কি আসতে পারো না মাহিমা?”
মাহিমা লজ্জিত হেসে বলল,
“আসতে চাই তো আন্টি। কিন্তু সময় হয়ে উঠে না। এখন থেকে মাঝে মাঝেই আসব।”
“এসো। আমি একা থাকি। আমার ছেলের কথা আর কী বলবো? দুই জনই মহা ব্যস্ত।”
মীরা ভেতরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলল,
“মুবিন ভাইয়ের নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আন্টি।”
“হুম। মুবিন ঘরে আছে। দেখা করে আয়।”
“ঠিক আছে। ”
মুবিনের ঘরের দিকে যেতে যেতে মাহিমা বলল,
“আমার শাশুড়ি তো মনে হচ্ছে মাটির মানুষ। এমন শাশুড়ী পেলে সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলা হাতপা টিপে দেব। সেবাযত্নের কোন কমতি রাখব না।”
মীরা জায়িনের ঘরের দিকে উঁকি দিচ্ছে। মানুষটা কি বাড়ি নেই? এত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে গেছে? আসার আগে জানিয়ে আসেনি সারপ্রাইজ দিবে বলে। কিন্তু এখন তো সারপ্রাইজের দফারফা হয়ে গেল।
#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬৩
মুবিন ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তাকে দেখে মাহিমা আবার কাঁদতে শুরু করবে এই ভয়ে মীরা ঘরে ঢুকেই বলে উঠল,
“মুবিন ভাই আপনি একদম ঠিক আছেন। তাই না? শুধু একটু ব্যথা পেয়েছেন। এই কথাটা আপনার ন্যাকু গার্লফ্রেন্ডকে বোঝান তো। মানুষ মারা গেলে কান্না করতে হয়। আপনি তো মা-শা-আল্লাহ ঠিকঠাক আছেন।”
মুবিন মাহিমাকে দেখে বেশি খুশি হয়ে উঠতে গেছিল। পা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত সে-ও মাহিমার সাথে দেখা করতে যেতে পারত না৷ কিন্তু বেচারা ব্যথায় মুখ বাঁকিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। মাহিমা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল,
“ব্যথা পেয়েছ? উঠতে গেলে কেন?”
মাহিমার মুখে তুমি ডাক শুনে মীরা আকাশ থেকে পড়ার মতো তাকালো। ওরে বাবাহ! ভালোবাসা এত গভীরে চলে গেছে! আপনি থেকে তুমিতে নামলো কবে? কই এত বড় একটা কথা কইতরি তো তাকে জানাল না।
“কীভাবে এসব হলো? তুমি নিজের খেয়াল রাখো না কেন? তোমার যদি কিছু হয়ে যেত।”
মাহিমার কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে মুবিন হাসলো। বলল,
“কিছু হয়নি তো। দেখো আমি তোমার সামনে আছি সহিসালামত।”
“হুম দেখছি তো। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজের অভাব নেই।”
মীরাও যে এখানে আছে এটা দু’জন ভুলেই গেছে মনে হয়। মীরা খুকখুক করে গলায় শব্দ করলো।
“কাবাবে হাড্ডির কথা এতদিন শুধু শুনে এসেছি। আজ নিজেকে দেখে বুঝলাম সেই হাড্ডি কেমন হয়। যাই হোক, আমি কারো রোমান্টিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে চাই না। তাই রুমের বাইরে অপেক্ষা করছি।”
মীরা ভালোবাসায় দিন দুনিয়া ভুলা দুই কইতর কইতরিকে একা কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে এলো। সে আসলে জায়িনের দেখা পেতে মুবিনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাইরে এসে মীরার মনের আশা পূর্ণ হয়ে গেল। জায়িন পেছন দিক ফিরে ডাইনিং টেবিল থেকে পানি নিয়ে খাচ্ছিল। মীরা জায়িনকে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। তার পরই কাজটা করে ফেলল।
“এই শোন!”
জায়িন চমকে মীরার দিকে ফিরে তাকাল। বেচারার অবস্থা ভূত দেখার মতো। হাত থেকে গ্লাসটা পড়তে পড়তেও রক্ষা পেলো। প্রথমত মীরাকে সে এখানে আশা করেনি। দ্বিতীয়, মীরা তাকে তুমি করে ডেকেছে! মীরা মুখ গম্ভীর রেখে সহজ ভাবেই বলল,
“এত চমকানোর কী আছে? তোমাকে ‘তুমি’ ডেকে দেখলাম কেমন লাগে। তুমি ডাকটাও খুব একটা খারাপ না। এখন থেকে মাঝে মাঝেই তুমি ডাকব। আকাশ থেকে না পড়ে অভ্যস্ত হয়ে যান মশাই।”
….
কলেজ থেকে ফিরে খবরটা শুনে মীরা কতক্ষণ উতালপাতাল নেচে নিলো। তার খুশি বাঁধ মানছে না। তনি আপুর বিয়েটা ভেঙে গেছে। কাল রাতে তাহলে ফুপা এজন্যেই এসেছিল! আবির ভাইটার বুদ্ধি আছে।
“তনি আপু তাহলে বিয়ের পরেও আমাদের সাথেই থাকবে। কোথাও যাবে না। ইশ আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। ছোট ফুপা আর কী কী বলেছে ভাবী? বিয়ে কবে?”
“তুমি আছো বিয়ের ডেট নিয়ে। ফুপা শুধু বলেছে তনিকে নিজের বাড়িতে নিতে না পারলে ফুপাও আর কোনদিন এবাড়িতে পা রাখবেন না। বাবা কী বলেছেন এখনও জানি না।”
মীরা স্থির হয়ে দাঁড়াল। পা ব্যথা করছে। সে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বড়ো আব্বু না করবে কেন? আবির ভাইকে কি আমরা চিনি না? ওর মতো ছেলে খুঁজে পাবে? তনি আপুর জন্য আবির ভাই-ই বেস্ট।”
“হয়তো। কিন্তু তোমার বাবা, চাচা, ভাই যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই তো হবে।”
“আবির ভাই হীরের টুকরো ছেলে। বড়ো আব্বু, বাবা, চাচা কোনদিন আপত্তি করবে না। আর খোঁজ নিয়ে দেখো ইভান ভাই এতক্ষণে আবির ভাইকে দুলাভাই হিসেবে মেনে নিয়েছে। বয়সে কয়েক বছরের ছোট হলেও ওরা ছোট থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড।”
মীরা রুমে এসেই এই খুশির খবরটা জায়িনকে জানানোর জন্য কল করলো। কিন্তু জায়িন তার কথা না শুনে বলল,
“মীরা একটু পরে কথা বলি? এখন ব্যস্ত আছি।”
মীরা ছোট্ট করে কথাটা বলেই রেখে দিত। কিন্তু জায়িন তার আগেই কল কেটে দিয়েছে। মীরা রাগ করে বলল,
“আপনার শুধু কাজ আর কাজ! এত ব্যস্ত থাকেন যে গার্লফ্রেন্ডকেও ভুলে যান। কথা বলারই সময় থাকে না।”
আবির ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে মীরার সব খুশি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে আজ প্রথম বার জায়িনকে তুমি বলেছে। কই এটা নিয়েও তো জায়িন কোন কথা বলেনি।
“আপনি ব্যস্তই থাকুন। আপনার সাথে আমি আর কথাই বলবো না।”
….
দুই পরিবার বসে এটা ঠিক করেছে এখন শুধু ওদের আকদ হয়ে থাকবে। আবির প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত তনিকে তুলে নিবে না। কিন্তু তনির বাবা এই কথাতে বলেছে,
“এখন বিয়ে দিতেও আমার কোন আপত্তি নেই। আবির সারাজীবন কিছু না করলেও আমার আপত্তি থাকবে না।”
এনায়েত হোসেন বলেছেন,
“না ভাইজান। আমি জানি আমার ছেলেকে আপনি কতটা ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসার যোগ্য হতে হবে ওকে। অধিকার দেখিয়ে আমি আপনার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমার ছেলের আগে প্রমাণ করতে হবে ও তনি মা’কে খুশি রাখতে পারবে।”
আবিরকে সবাই এতটাই পছন্দ করে যে এনায়েত হোসেন প্রস্তাব নিয়ে আসার পর কারোরই আপত্তি ছিল না। মেয়ে ঘরেই থাকবে এর থেকে বড়ো কথা আর কী হতে পারে? তাছাড়া আবিরকেও উনারা ছোট থেকে চেনেন। না, এই বিয়েতে কারো আপত্তি থাকতেই পারে না।
মীরা ভাই বোনের বিয়ের মিষ্টি তিনটা খেয়ে ফেলেছে। এটা নিয়ে চার নাম্বারটা মুখে দিল। তার ফোন যে সে ঘরে ফেলে এসেছে এটা মনেই নেই। দিব্যি সে আনন্দ করছে। কিন্তু ওদিকে জায়িনের অবস্থা খারাপ। মীরা দু’দিন ধরে রাগ করে কথা বলা বন্ধ রেখেছে। দেখা করার সুযোগও দিচ্ছে না।
রাতে সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া, গল্প সেরে রুমে যেতে যেতে সাড়ে বারোটা বেজে গেল। মীরা ঘুমকাতুরে হলেও আজ কীভাবে এতক্ষণ জেগে থাকল কে জানে। ঘরে এসেই মীরা হাতপা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ঘুমঘুম ভাব এসে চোখ জোড়া লেগেই এসেছিল। এমন সময় ফোনের রিংটোনে জাগতে হলো।
“দূর! মাঝরাতে কার ম’রা লেগেছে। কল দিচ্ছে কেন?”
মীরা ঘুমঘুম চোখেই স্ক্রিনে নাম না দেখে কল রিসিভ করে বলল,
“হ্যাল..
” তুমি এক্ষুনি বাইরে আসবে। নইলে আমি তোমার বাড়ি চলে আসব। আমি কিন্তু হুমকি দিচ্ছি না। সত্যি সত্যিই এখন তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তুই চাও আমি মাঝরাতে সবাইকে জাগিয়ে ভেতরে আসি?”
মীরার ঘুম ছুটে গেল। লাফিয়ে উঠে বসল সে। ফোনে জায়িন আছে কি-না শিওর হওয়ার জন্য বলল,
“হ্যালো কে? জায়িন ভাই, আপনি এটা?”
“আমি জায়িন। কিন্তু তোমার ভাই না। তার থেকেও বেশি কিছু হওয়ার ইচ্ছা আছে।”
“আপনি সত্যি সত্যি আমাদের বাড়ির সামনে এসেছেন?”
“বাইরে এসে চেক করে দেখতে পারো আমি মিথ্যা বলছি কি-না।”
“আপনিও কি মুবিন ভাইয়ের মতো পাগল হয়ে গেছেন? সবসময় আপনাকে মুবিন ভাইয়ের সাথে তুলনা দেই বলে আপনি মুবিন ভাইকে টেক্কা দিতে চাইছেন?”
“তুমি আসবে? তুমি না এলে আমি আসব।”
“পাগল রে.. না না না। আপনার আসতে হবে না। আমি আসছি। আল্লাহ মাবুদ, আপনি আমাকে মারানোর প্ল্যান করছেন নাকি? কী সাঙ্ঘাতিক! আপনাকে তো আমি ভালো মনে করেছিলাম।”
ফোনে কথা বলতে বলতেই মীরা ওড়না নিয়ে খুব সাবধানে দরজায় শব্দ না করে বাইরে বেরিয়ে এলো। পুরো বাড়ি এখন ঘুমে কাঁদা। কেউ তাকে দেখতে পাবে না। তবুও সাবধানের মার নেই। বেড়ালের মতো পা টিপেটিপে আলগোছে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এসেই জায়িনকে দেখল। মীরা ঘাড় ফিরিয়ে বাড়ির দিকে দেখে ভয়ে ভয়ে দৌড় লাগাল।।জায়িনের সামনে এসে থেমেই বলতে লাগল।
“পাগল হয়ে গেছেন? মাথাটা কি পুরো গেছে? হঠাৎ এত সাহস কোত্থেকে পেলেন? সাহসের বড়ি খেয়েছেন? আল্লাহ, আল্লাহ! মুবিন ভাই তো দিনে আসে। আপনি চোর ডাকাতকে হার মানিয়ে মাঝরাতে এসে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন! আমি না এলে বাড়িতে ঢুকে যেতেন! আপনাকে তো আমি ভদ্রলোক ভাবতাম। না না, আপনি আমাকে হতাশ করলেন।”
মীরা এক দমে হড়বড় করে কথাগুলো বলে গেল। কিন্তু জায়িন একটা কথারও জবাব দিল না। সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে মীরাকে দেখছে। মীরা যে সত্যি সত্যিই ভয় পেয়েছে এটা ওর চেহারায় স্পষ্ট। জায়িনকে হাসতে দেখে মীরা আরও চেতে গেল।
“হাসছেন যে! কী আজব লোক! আমি কি হাসি পাওয়ার মতো কোন কথা বলেছি? সিরিয়াস কথা বলছি। হাসবেন না তো।”
“এর পর থেকে তুমি যতবার রাগ করে কথা বন্ধ রাখবে আমি প্রতিবারই তোমার বাড়ি চলে আসব।”
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
“না। সাবধান করে দিচ্ছি।”
“আমি আপনার সাথে কেন কথা বলবো? আপনি কত ব্যস্ত মানুষ। আমি বেকার, অকর্মা মানুষ আপনাকে কল করে জ্বালাই। জোর করে কথা বলতে চাই। আপনি বিরক্ত হোন। এজন্যই তো কথা বলা বন্ধ রেখেছি।”
“আমি সেদিন সত্যি সত্যিই ব্যস্ত ছিলাম মীরা। তার একটু পরেই কিন্তু আমি তোমাকে কল করেছিলাম। কিন্তু তুমি ততক্ষণে রাগ করে বসে ছিলে।”
“তো রাগ করব না? আপনি মুখের উপর কল কেটে দিলেন আমার কষ্ট হয়নি?”
“সরি তো মীরা। তুমিও তো কথা না বলে আমাকে দু’দিন শাস্তি দিলে। এবার ক্ষমা করে দাও।”
“না।”
জায়িন করুণ স্বরে অনুনয় করল,
“প্লিজ।”
“উঁহু।”
“মীরা প্লিজ।”
“আচ্ছা ক্ষমা করব। কিন্তু একটা শর্ত।”
“যেকোনো শর্ত মেনে নিতে রাজি। তবুও আর রাগ না।”
মীরা একবার ঘাড় বাঁকিয়ে বাড়ির দিকে দেখল। এখনও কেউ হয়তো জাগেনি। জাগলে এতক্ষণে তার খোঁজ পড়ে যেত। আজ এমনিতেই সবাই দেরি করে ঘুমোতে গেছে। এখন আর কারো ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না। মীরা ডান হাতে ধরা ফোনে সময় দেখে মুখে দুষ্টুমির হাসি নিয়ে জায়িনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখন আমাকে নিয়ে হাঁটতে যেতে হবে।”
“এখন? এই মাঝরাতে! ”
“হাঁটার মজাই গভীর রাতে। তাছাড়া আপনি কিন্তু কথা দিয়েছেন।”
“ঠিক আছে। কিন্তু তুমি রুমে নেই জেনে বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেলে?”
“এখন কেউ জাগবে না। কারো জাগার আগেই রুমে ফিরে যাব। কেউ জানতেই পারবে না আমি বেরিয়েছিলাম।”
“হুম, চলো।”
নিস্তব্ধ রাতে চাঁদের আলোয় দু’জন প্রেমিক প্রেমিকার পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। আকাশে এত্ত বড় একটা চাঁদ থাকায় মনেই হচ্ছে না এখন গভীর রাত। দিনের মতোই ফর্সা লাগছে। পথে একটা কুকুরও নেই। সকলেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কাছে কোন ঝোপঝাড়ে ঝিঝি পোকা ডাকছে। ডাকটা মিষ্টি লাগছে। শীতল বাতাস বইছে। দু’জন পাশাপাশি হাঁটলেও কেউ কোন কথা বলছে না। মীরা রাতের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত। সে ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখছে। আর জায়িন মীরাকে দেখছে। হঠাৎ অদ্ভুত রকমের একটা শব্দ শুনে মীরা ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেয়ে সে অজান্তেই জায়িন হাত চেপে ধরল। শব্দটা কোত্থেকে আসছে খুঁজতে খুঁজতে ভয়ে ভয়ে বলল,
“এটা কিসের শব্দ ছিল? কী ভয়ঙ্কর! হিংস্র প্রাণীদের ডাকই এমন ভয়ঙ্কর হয়। আমি বইয়ে পড়েছি। ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে হিংস্র কোন প্রাণী আমাদের উপর নজর রাখছে না তো। আমার ভীষণ ভয় করছে।”
মীরার ভয় দেখে জায়িন হাসল। সবসময় আমি ভয় পাই না বলা মেয়েটা সামান্য একটা আওয়াজে এতটা ভয় পেয়ে গেল দেখে মজা লাগছে। জায়িন হাসি লুকিয়ে সে-ও মীরার ভয়ার্ত কন্ঠ নকল করে বলল,
“বুঝতে পারছি না। বাঘ, না। বাঘের গর্জন এমন হয় না। তবে এটা কি ভাল্লুক টাল্লুক হবে?”
ভাল্লুক শুনে মীরা আরও ভয় পেয়ে গেল। জায়িনের পাশে আরেকটু ঘেঁষে এসে বলল,
“এখন কী হবে?”
“ভাল্লুকের সামনে পড়লে যা হয়। হয়তো একজন বেঁচে ফিরব। বা দু’জনই ভাল্লুকের পেটে যাব।”
ভয়ে মীরার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। জায়িন যে তাকে ইচ্ছে করে ভয় দেখাচ্ছে বেচারি ভয়ে বোধবুদ্ধি হারিয়ে এটাও বুঝতে পারছে না। শব্দটা আবার কানে এলে মীরা বুঝতে পারল উহু, এটা তো ভাল্লুকের ডাক না। আর তাছাড়া এখানে ভাল্লুক আসবে কোত্থাকে? ভাল্লুক কবে থেকে মানুষের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করেছে? মীরা এবার বুঝতে পারল জায়িন ইচ্ছে করে তাকে ভয় দেখিয়েছে। মীরা জোরে জায়িনের হাতে চিমটি কাটল। জায়িন ব্যাথা পেয়ে ‘আহ’ বলে উঠলে মীরা বলল,
“কী হলো? ভাল্লুক কামড় দিয়েছে? ইশ, ব্যথা পেয়েছেন?”
চলবে#মন_নিয়ে_কাছাকাছি
#জেরিন_আক্তার_নিপা
৬৪
মীরা কলেজ জীবন পার করে ভার্সিটিতে এডমিশনের প্রিপ্রারেশন নিচ্ছে। মাঝে কিছুটা সময় কেটে গেছে। মীরা কলেজ থেকে ভার্সিটিতে যাবে এটাই যা পার্থক্য। কিন্তু তার চরিত্রে এতটুকুও পরিবর্তন আসেনি। পরিবারের কাছে মীরা আগে মতোই বাচ্চা মেয়ে। জায়িনের কাছে সে আগের মতোই অভিমানী। ওদিকে জায়িনও ইন্টার্নি শেষ করে ডক্টর হয়ে গেছে। মুবিন এখন জানা মানা সেলিব্রিটি। হাজারো মেয়েদের ক্রাশ। মুবিনের মেয়ে ভক্তদের নিয়ে মাহিমার হিংসার শেষ নেই। তার এখন আফসোস হয়, কেন মুবিন সেলিব্রিটি হলো। সেলিব্রিটি না হলে এত মেয়েরা তার বয়ফ্রেন্ডের উপর নজর দিত না। মাহিমার হিংসা ও জেলাসি দেখে মুবিনের মজাই লাগে। সে মাহিমাকে রাগানোর এতটুকু সুযোগও ছাড়ে না। মাহিমা বেচারি ঝগড়া করতে করতে একপর্যায়ে কেঁদে ফেলে। মুবিন তখন ভালোবেসে প্রিয়তমাকে বুকে টেনে নেয়।
জায়িনের আজ ঘুম ভাঙতে প্রতিদিনের থেকেও একটু বেশি দেরি হয়ে গেল। আজ ছুটির দিন থাকায় কাল পুরোটা রাতই মীরার সাথে কথা বলতে হয়েছে। ফজরের আজান কানে আসতে মীরা মাথায় হাত দিয়ে বলেছে,
“হায় আল্লাহ! সকাল হয়ে গেছে! আমি আজ সারাদিন কাটাব কীভাবে? একটুও তো ঘুমাইনি।”
“এখন তো কলেজ নেই। পড়াশোনার প্যারাও নেই। দিনে ঘুমোবে।”
“কীভাবে? বলেছিলাম না আজ বড় ফুপুরা আসবে। আমাকে সারাদিন ঘুমাতে দেখলে লাথি দিয়ে জাগাবে।”
হাই তুলতে তুলতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো জায়িন। কয়টা বাজে এখন? দেয়াল ঘড়ির দিয়ে তাকিয়ে আঁতকে উঠতে হলো। বারোটা বাজে? এতবেলা পর্যন্ত সে জীবনেও ঘুমায়নি।
আজ মা-ও ডাকেনি। জায়িন মা’র খোঁজ করতে লাগল।
“মা। মা।”
জায়িন ডেকে যাচ্ছে কিন্তু মা কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। বাড়িতে কি কেউ নেই? জায়িন মা’র ঘরে এসে কাউকে পেল না। মুবিনের ঘরও খালি। মা হয়তো খালামনির ওখানে গেছে। জায়িন দরজা খুলতে গিয়ে বুঝল তাকে বাইরে থেকে আটকিয়ে মা চলে গেছে।
“যা! মা আমাকে ডাকলো না। উল্টো বাইরে থেকে আটকিয়ে চলে গেল!
….
চাচী কী পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। এভাবে এত বড় মেয়েকে কেউ বাড়ি থেকে বের করে দেয়! রাগের মাথায় যা খুশি করে বসলেই হলো! শেষে মানুষের অপবাদ, কটুকথা কাকে শুনতে হবে? সমস্যা যা-ই হোক। ঠান্ডা মাথায় বসে সমাধান বের করতে হবে। রিমু তো এখন আর ছোট নেই। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার বয়স হয়েছে ওর।
সকালে মা রিমুদের বাড়িতেই গিয়েছিল। রিমুর সম্পর্কের কথা বাড়িতে জানলে চাচী রাগারাগি করে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। মা রিমুকে সাথে করে নিয়ে আসে। এখন জায়িন রিমুদের বাড়ি যাচ্ছে। জায়িন বুঝিয়ে বললে হয়তো চাচী বুঝবে। ছেলে নেই বলে জায়িনকেই ছোট থেকে ছেলের মতো আদর স্নেহ করেছে। আর যা-ই হোক জায়িনের কথা তিনি ফেলতে পারবেন না। জায়িন শার্ট চেঞ্জ করে নিয়ে রিমুদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। হলরুমে বেরিয়ে শুনতে পেলো মা’র ঘরে মীরার গলা শোনা যাচ্ছে। সে যেতে যেতেই শুনলো। মীরা বলছে,
“এলাকার ছেলেছোকরা যাদের ভাই ডাকি তাদেরই প্রেমিক হিসেবে কল্পনা করতে গেলে গা গুলায়। আর তুই আপন মামাতো ভাইয়ের সাথে চক্কর চালিয়েছিস! কেন রে? দুনিয়ায় কি ছেলের অভাব পড়েছিল? জীবনে অনেক পাপ করেছি। কিন্তু চাচাতো মামাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করার কথা ভাববার মতো পাপও করিনি। এতে ভাই ডাকটার পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়।”
জায়িনের পা থেমে গেল। কপালের মাঝ বরাবর সূক্ষ্ম তিনটা ভাঁজ পড়েছে। না চাইতেও মীরার কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। এভাবে লুকিয়ে কারো শোনা অন্যায়। তবে মীরা কী ভাবে তা জানতে হলে এই অন্যায়টা করতেই হবে। মীরার পরে মাহিমার গলা শোনা যাচ্ছে।
“আমার তো কোন চাচা, ফুপুও নেই। বাপের চাচাতো ভাই চার চাচার সব মেয়ে। মামাতো ভাই একটা আছে। ইভান ভাই। ওকে তো আমি আমার মায়ের পেটের আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসি। সম্মান করি।”
“তোর মামাতো ভাই হারামিটাই বা কেমন বজ্জাত রে! বোনকে আবার প্রপোজ করে কীভাবে? সব দোষ ওই খবিশটার। আমাদের ভাই গুলা দুনিয়া উল্টে গেলেও এমন করতো না। করতো রে মাহি?
“নাহ। মরে গেলেও না। সবাই কি আর ইভান, আবির ভাইয়ার মতো। আজকাল মুভি, ড্রামাতে কাজিন লাভ স্টোরি গুলো দেখে দেখেই এদের মাথা খারাপ হয়েছে। মনে পাপ ঢুকে ছ্যাড়াব্যাড়া কারবার।”
জায়িনের ঠোঁটের কোণে কৌতুকের মিহি হাসির রেখা দেখা দিল। ডান ভ্রু উঁচিয়ে ভাবল, তাই নাকি? নিজের ভাইকে নিয়ে এত বড়াই! রিমুকে এখন তো বড়ো বড়ো ভাষণ দিচ্ছে। অথচ ভাই চোখের সামনে তনির সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। জায়িন আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল।
ওরা রিমুকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। এখন রিমু ওদের কথা শুনে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল। নাক টানতে টানতে বলল,
“তোরা কি আমাকে অপমান করছিস? তোরা না আমার বান্ধবী! আমি কি ইচ্ছে করে ভালোবেসেছি। কীভাবে কীভাবে যেন ভালোবাসা হয়ে গেছে। বিশ্বাস কর আমি জানি না কীভাবে হয়েছে। কিন্তু হয়ে গেছে।”
মীরা রিমুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আফসোসের স্বরে বলল,
“না বুঝে হয়েছে? তাহলে তো আর কিছু করার নাই। থাক তুই কাঁদিস না।”
মাহিমা টেবিলের উপর থেকে টিস্যু বক্স টেনে নিয়ে রিমুকে টিস্যু দিতে দিতে বলল,
“আচ্ছা তুই কাঁদিস না। আমরা তোকে কাঁদানোর জন্য এসব বলিনি। আমরা তোর সাথেই আছি। আন্টিকে আমরা বুঝাবো।”
“মা মানবে না রে। মা’কে কেউ বোঝাতে পারবে না।”
“কেন? ভাইয়ের সাথে আন্টির সম্পর্ক ভালো না?”
“সম্পর্ক ভালো বলেই তো নষ্ট হওয়ার ভয় পাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে নতুন সম্পর্ক গড়লে পুরোনো সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
মীরা বিরক্ত হয়ে বলল,
“দূর! এসব কোন যুক্তির কথা না।”
…
সিঁড়ির নিচের অন্ধকার জায়গাটায় জায়িন মীরার কনুই ধরে টেনে আড়ালে নিয়ে এলো। আকস্মিক এই কাণ্ডে মীরা ভয় পেয়ে গেছে। মানুষটা কে তা না দেখেই সে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ওই মানুষটা তার মুখ চেপে ধরলো। চিৎকার গলার ভেতরেই আটকা পড়লো। শক্ত-সামর্থ্য হাত। ধস্তাধস্তি করেও ছুটানো যাচ্ছে না। জায়িন মীরাকে ঠেলে আলোতে নিয়ে এলে মীরা ওকে দেখে যেন একটু স্বস্তি পেল। ছটফটানি কমিয়ে দিল। জায়িন তীক্ষ্ণ চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এলাকার যাদের ভাই ডাকো তাদের প্রেমিক হিসেবে ভাবতে গা গুলায়? তার মানে কথাটা ইনডিরেক্টলি কাকে বললে? আমাকে প্রেমিক ভাবতে তোমার গা গুলায়! গা গুলানোর মতো তেমন কোন কাজ তো আজ পর্যন্ত করলামই না। তার আগেই গা গুলাগে বাকি দিনগুলো কীভাবে যাবে?”
এই লোক এসব কথা কখন শুনেছে? এত বড় চাপাটা তো মীরা রিমুর সামনে মেরেছিল। হায় কপাল! কেন যে যমের বাড়িতে বসে এসব কথা বলতে গিয়েছিল!
“আমার বোনটাকে অসহায় পেয়ে তখন দুই বোন মিলে যা যা বলেছ সব শুনেছি আমি। আমার সামনেও বলো। আর কী কী বলার বাকি আছে?”
মীরা কথা কীভাবে বলবে? মুখ চেপে ধরে রেখে বলছে, কথা বলো। সীমার একটা ফাজলামি থাকে। দূর গা গরম না তবুও জ্বরের মুখে উল্টাপাল্টা বলছে। কথাটা ফাজলামির একটা সীমা থাকে।
“কী হলো বলো। আমি তো তোমার প্রেমিক। তবুও তো আমাকে দিনেদুপুরে ভাই ডেকে যাচ্ছ। আমাকে ভাই ডেকেও আমার সাথে প্রেম করতে তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ভাই ডাকছো আবার চুমুও খাচ্ছো। যখন তখন জড়িয়েও ধরছো। এই এক বছরে ঠিক কতটা চুমু খেয়েছ হিসেব দিতে পারবে?”
এসব বলে মীরাকে অপমান করছে! কত বড় সাহস। মীরা মুখ খুলতে গিয়েও বাধা পেলো। শেষে জায়িনের হাত কামড়ে দিয়ে নিজেকে ছাড়ালো।
“আপনি কি চুমু খাওয়া নিয়ে আমাকে খোঁটা দিচ্ছেন? আপনি নিজেও কি আমাকে জড়িয়ে ধরেননি? চুমু খাননি? আমি কি কোনোদিনও খোঁটা দিয়েছি?”
“তুমি খোঁটা দিতে পারবে না। কারণ আমি তোমাকে মোটেও বোনের চোখে দেখি না। তোমাকে প্রেমিকা ভাবতে আমার গা গুলায় না।”
একটা কথা নিয়ে লোকটা কীভাবে তাকে টিটকারি দিচ্ছে। মুখ ফসকে নাহয় বলেই ফেলেছে। তাই বলে এই কথাকে এত বড় করে দেখার কী আছে?
“চাপা মারতে গিয়ে ওই কথাটা নাহয় বলেই ফেলেছি। তাই বলে আপনি এই কথাটা নিয়ে আমার সাথে এমন করবেন?”
মীরার অভিমানী বাচ্চা বাচ্চা মুখটা দেখে জায়িন রাগ করে থাকার ভাণটাও করতে পারলো না। মীরার মুখের কাছে এগিয়ে এসে আদুরে গলায় বলল,
“তুমি তোমার কোন বান্ধবীকেই এখন পর্যন্ত আমাদের কথা জানাও নি। আমার সব বন্ধুরা কিন্তু তোমার কথা জানে।”
মীরা আঁতকে উঠলো। বলে কী এই লোক! তার মানে আবির ভাইও জানে! আল্লাহ আল্লাহ। আবির ভাইয়া বাড়িতে বলে দিলে তার কপালে শনি আছে। জায়িন মীরার মুখ দেখেই বুঝে গেল। মীরা মুখ খোলার আগেই বলল,
“ভয় নেই। আবির জানে আমি প্রেম করছি। কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ডটা যে তার আদরের বোন সেটা জানে না। তুমি চাও না বলেই বলিনি।”
“ভালো করেছেন। আবির ভাইয়ের পেটে কথা থাকে না। আর তার থেকে বড় কথা আবির ভাই জেনে গেলে আমি লজ্জা পাবো। ওর বন্ধুর সাথে প্রেম করছি জেনে গেলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবো না।”
“কিন্তু একসময় না একসময় এমন একটা দিন তো অবশ্যই আসবে যখন সবাইকে জানাতে হবে। তখনও কি তুমি লজ্জা পেয়ে না জানিয়েই থাকবে?”
“সেই দিনটা আসুক তখন দেখা যাবে। এখন কয়েক বছর চুরিচুপিই প্রেম চালিয়ে যেতে চাই।”
“আমার অবশ্য চুরিচুপি প্রেম করতেও কোন আপত্তি নেই। এবং এভাবে দেখা করা, কথা বলার মাঝেও একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে।”
“আপনি তো রিমুর আম্মুর সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কী হলো? আন্টিকে মানাতে পেরেছেন?”
“আন্টি না চাচী শ্বাশুড়ি বলো।”
“দূর মজা না। রিমু কিন্তু ওর মা’কে নিয়েই সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে।”
জায়িন মীরার কপালে চলে আসা চুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলল,
“প্রেম করার সময় মায়ের ভয় ছিল না? মেয়ে গুলো এত ভীতু হয় কেন বলো তো?”
মীরা চোখ পাকিয়ে তাকালো। মেয়েগুলো ভীতু হয় বলতে সে-ও তো ভীতু।
“মেয়েরা মোটেও ভীতু না। মেয়েরা পরিবারের সম্মানের কথা ভাবে। যা ছেলেরা ভাবে না।”
“তাই নাকি?”
“জি তাই।”
“তাহলে বলতে চাচ্ছ তুমি ভীতু না?”
“জি না মশাই।”
“ওকে প্রমাণ দাও। চট করে এক্ষুনি আমাকে চুমু খেতে পারলে মেনে নিব তুমি অনেক সাহসী। আর হ্যাঁ, চুমুটা কিন্তু কপালে গালে খাওয়া যাবে না।”
অসভ্য লোক। সারাক্ষণ চুমু খাওয়ার ধান্দা। মীরা জায়িনের পা মাড়িয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। বজ্জাত বেটা তোমার কপালে এটাই লিখা আছে। এই এক বছরে মীরা এক নতুন জায়িনকে আবিষ্কার করেছে। প্রথম দিকে আন রোমান্টিক বললেও এই ব্যাটার রোমান্টিকতা দেখে শেষে মীরার জ্ঞান হারানোর দশা। মানুষের সামনে কম কথা বলা ছেলেটা যে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কত কথা বলে তা যদি মানুষ জানতো।
চলবে
চলবে
(