মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব -০৮

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-৮
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
ঘটনার চারদিন পর পুলিশ রাফসানকে গ্রেফতার করে। রাফসান প্রথমে ব্যাপারটা অস্বীকার করলেও পরে সব স্বীকার করে নেয়।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে পৃথুলা। তার হাতে একমুঠো সবুজ কাচের চুড়ি। চুড়িগুলো কিছুদিন আগে বিভোর কিনেছিল তার জন্য। হাতে পরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
“তোমার এই সুন্দর হাত দুটোয় চুড়ি পরলে কত সুন্দর লাগে জানো? তোমার হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ আমায় মাতাল করার জন্য যথেষ্ট।”

পুরনো স্মৃতি মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠল পৃথুলা। চেনা বিভোর বড্ড অচেনা হয়ে গেছে। ওই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত বিভোর একবারও খোঁজ নেয়নি পৃথুলার। একবারও ফোন করে জানতে চায়নি পৃথুলা কেমন আছে! চুড়িগুলো জোরে চাপ দিতেই দুটো চুড়ি ভেঙে হাতে গেঁথে পড়ে পৃথুলার। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু পৃথুলার ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না। হবে কী করে? এ ব্যথার চেয়ে বড় ব্যথা যে তার ভেতরে হচ্ছে। হাতের চেয়ে বেশি রক্তক্ষরণ যে হৃদয়ে হচ্ছে। সে রক্তক্ষরণ দেখার জন্য তো বিভোর নেই। বিভোর তার জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথুলাকে। কিন্তু পৃথুলা কি করে পারবে বিভোরকে ভুলে থাকতে?

ঘরে ঢুকে প্রত্যাশা চমকে গেল। পৃথুলার রক্তে ফ্লোর অনেকখানি ভিজে গেছে। প্রত্যাশা দৌড়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে পৃথুলার সামনে বসে। পৃথুলার হাতের রক্ত মুছে হাত ব্যান্ডেজ করে দেয়।

“কী করলি তুই এটা? কতখানি রক্ত বের হলো হাত থেকে!”
“আল্লাহ আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিল বলতো প্রত্যাশা? কেন আমার সাথে এমন হলো? আমি এখন সমাজের কলঙ্কিনী হয়ে গেলাম।”

প্রত্যাশা পৃথুলাকে জড়িয়ে ধরল। তার নিজের চোখের জলও উপচে পড়ছে।

“চুপ! একদম এসব বলবি না। কিচ্ছু হয়নি। তোর কিচ্ছু হয়নি।”
“বিভোর আমার সাথে কেন এমন করল? ও আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিল?”
“খবরদার তুই ওই বদমাশ ছেলেটার কথা মুখে আনবি না। ওই অসভ্য ছেলেটা তোকে ভালই বাসেনি। ও বলেছে ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে। এটা যাস্ট তোকে একটা বুঝ দিয়েছে। ওই ছেলেটা আর তোর সাথে যোগাযোগ করবে না৷ আমার কথাটা মিলিয়ে নিস।”

বিপদের সময় আপনজনেরাও রঙ পালটে ফেলে। দেখিয়ে দেয় তাদের আসল রূপ। এ’কদিনে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে পৃথুলার পরিবার। আত্মীয়-স্বজন, কাছের মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই পৃথুলাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আনিসুল ইসলাম ভাবেন, জীবনে কি এমন জটিল পাপ তিনি করেছেন যারা শাস্তি এভাবে পাচ্ছেন? উত্তর মিলে না, মিলছে না।

জানালার কাচে ঢিল ছোঁড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল প্রত্যাশার। পৃথুলা জেগেই ছিল। ওই ঘটনার পর ও ঠিকমত ঘুমাতে পারে না। চোখ বুঁজলেই ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় রাফসান এই বুঝি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

ঢিল ছোঁড়ার শব্দে পড়িমরি করে উঠে বসে দুইবোন। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। প্রত্যাশা বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে যায়। পৃথুলাও যায় প্রত্যাশার পেছনে।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখল তিনটে বখাটে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পৃৃথুলাকে দেখেই একজন বলল,
“হেই পৃথুলা রাণী, আজ রাতে হবে নাকি?”
সাথে সাথেই আরেকজন বলে উঠল,
“তিন ঘণ্টার জন্য রেট কত?”
বলে তিনজন হাসতে হাসতে একে অন্যের উপর ঢলে পড়ছে।

পৃথুলা ঘরে চলে এলো। প্রচণ্ড ঘেন্না হচ্ছে নিজের উপর। নোংরা মনে হচ্ছে নিজেকে। ধপ করে বসে পড়ল ফ্লোরে। প্রত্যাশা এসে হাঁটুগেড়ে বসল পৃথুলার সামনে। পৃথুলার মাথাটা টেনে বুকে রাখল৷ পৃথুলা দুহাতে জাপটে ধরল প্রত্যাশা।
“রাফসান আমায় রেপ করেই ছেড়ে দিয়েছে কেন? আমায় মেরে ফেলল না কেন? ধর্ষণের পর মেরে ফেলার ঘটনা তো এ দেশে অহরহ ঘটছে। তাহলে ও আমায় মেরে ফেলল না কেন? কেন আমায় বাঁচিয়ে রাখল?”

পৃথুলাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আপাতত কোনো শব্দ প্রত্যাশার ভাণ্ডারে নেই। সে নিরবে ঠোঁট চেপে কাঁদতে লাগল।
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে আছেন আনিসুল ইসলাম। এই রাশভারী মানুষটারও চোখ ছাপিয়ে নামছে জলের ঢল।
..
“দোষ আপনারও আছে স্যার। কি দরকার ছিল মাইয়াডারে এত পড়ালেখা করানের। ইন্টার পর্যন্তই তো যথেষ্ট ছিল। আমার মাইয়ারে দেখেন, মেট্রিক পাশ করনের পরই বিয়া দিছি। কি সুন্দর গুছায়া সংসার করতেছে। আপনি তো বিয়ে দিলেন না। মাইয়া ডাক্তার হইতে চায়। আপনিও তারে ডাক্তারি পড়াইবেন। এহন হইলো তো ডাক্তার! আপনার মেয়ে অনেক সুন্দরী। এমন সুন্দরী মেয়ে ঘরে বসায়া রাখলে মাইনষের নজর তো পড়বেই।”

আয়েশী ভঙ্গিতে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বললেন আনিসুল ইসলামের প্রতিবেশি একজন ভদ্রলোক। পাশ থেকে আরেকজন বললেন,
“কাল রাইতে এলাকায় বাইরের ছেলেপেলে আসছে। আপনাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়া কিসব কথা বলছে। এমন হইলে আমাদের এই এলাকায় টিকা তো মুশকিল হইব। যাই হোক, আমরা এখন যাই। মাইয়াডার খেয়াল রাইখেন। আহারে কি ঘইটা গেল মাইয়াডার সাথে!”

দু তিনটে আফসোসের বাণী শুনিয়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক দুজন। আনিসুল ইসলাম বুঝলেন এখানে আর থাকা সম্ভব না। খুব শীঘ্রই অন্যত্র চলে যেতে হবে তাদের।
পরদিন থেকেই দূরের এলাকায় বাসা খুঁজতে লাগলেন। পেয়েও গেলেন দুদিনের মধ্যে। পরিবার সমেত এ বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় শিফট হলেন তিনি।

বাবার অফিসে জয়েন করেছে বিভোর। এখন পুরোপুরি কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। পৃৃথুলার চিন্তা এখন অনেকটাই বেরিয়ে গেছে মাথা থেকে। অফিসে কাজ শেষ করে আসাদ হক সহ বাসায় ফিরল বিভোর। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বুঝতেই ভেসে উঠল পৃথুলার হাসিমাখা মুখটা।

“এটা কী?”
পৃথুলা বিভোরের পাশে বসতে বসতে বলল,
“খুলে দেখো।”
বিভোর টিফিন বক্সটা খুলে দেখল ওর প্রিয় রেড ভেলভেট কেক! বিভোরের চোখ চকচক করে উঠল। সহাস্যে বলল,
“ওয়াও! রেড ভেলভেট কেক! থ্যাংক ইউ পৃথা।”
“খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে।”
“তোমার হাতে বিষও অমৃত সম।”
পৃথুলা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হইছে, ঢপ দিওনা। খেয়ে বলো।”
বিভোর হেসে একটুখানি কেক মুখে দিয়ে বলল,
“দারুণ দারুণ! ইচ্ছে করছে তোমার হাতটাই চেটেপুটে খাই।”
পৃথুলা লাজুক হেসে বলল,
“যাহ।”

তখন পৃৃথুলার লাজুক চেহারা দেখতে কি যে অপরূপ দেখাচ্ছিল! এই মেয়েটা লজ্জা পেলে ওকে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী মনে হয়। বিভোর শোয়া থেকে উঠে বসল। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। না চাইতেও মনটা পৃথুলার স্মৃতি আওড়াচ্ছে। এতদিনে একবারও খোঁজ নেয়নি সে পৃথুলার। এক মন চাইছে পৃথুলার কাছে ছুটে যেতে। আর অন্য মন প্রেস্টিজের কথা ভেবে পৃথুলার কথাও ভাবতে চাইছে না।

বালিশের কাছে থাকা ফোনটা হাতে নিল বিভোর। ঢুকল গ্যালারিতে। পৃথুলার সব কটা ছবি ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়েছে, কেবল একটা ছাড়া। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পৃথুলা। বিকেলের মাতাল হাওয়ায় দুলছে তার খোলা চুলগুলো, দুলছে ওড়না। পৃথুলার এই ছবিটা বিভোরের সবচেয়ে প্রিয় ছবি। পৃৃথুলার সব ছবি ডিলিট করলেও এই ছবিটা ডিলিট করতে পারেনি বিভোর। ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বিভোর। হাসলে পৃথুলার গালে অদ্ভুত সুন্দর এক টোল পড়ে। এই ছবিটাতে সেই টোলটা স্পষ্ট প্রতীয়মান।

বিভোর জুম করে টোলটা দেখছে। তৎক্ষণাৎ দরজায় খটখট আওয়াজ হলো। বিভোর মোবাইলের স্ক্রিণ থেকে চোখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। আসাদ হক দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“বিভোর আসব?”
বিভোর মোবাইল পাশে রেখে বলল,
“এসো আব্বু।”
অনুমতি পেয়ে আসাদ হক ভেতরে গেলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে বিভোরের পাশে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“কী করছিলে?”
“কিছু না।”
আসাদ হক একটু থেমে বললেন,
“তোমার প্রবাল আঙ্কেল আছেন না? ওনার ছেলে প্রিয়মের হলুদ আজ সন্ধ্যায়। হলুদে আমাদের ইনভাইট করেছেন।”
“তুমি যাও।”
“তোমাকেও নিয়ে বলেছে।”
“আ’ম টায়ার্ড আব্বু। তুমি যাও।”
“বিভোর। উনি বারবার করে আমাকে বলে দিয়েছেন তোমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। তুমি না গেলে খারাপ দেখাবে। প্লিজ বিভোর, না করো না।”
বিভোর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে, যাব।”
আসাদ হক হেসে বললেন,
“থ্যাংক ইউ। তুমি রেডী হয়ে নাও।”
বলে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন আসাদ হক।
.
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here